somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অধ্যায়-১ (ত্রয়ী) । সুকুমারি, দ্য লাস্ট কিস ও ধ্রুব।

১৩ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দ্য লাস্ট কিস(১৯৩১)
The Last Kiss(1931)

নওয়াব পরিবারের উদ্যোগে বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘ইস্ট বেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানের প্রযোজনায় ১৯২৯ সালের অক্টোবর মাসে শ্যুটিং শুরু হয় ‘দ্য লাস্ট কিস’ চলচ্চিত্রটির। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন জগন্নাথ কলেজের(অধুনা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) তৎকালীন শরীরচর্চার শিক্ষক ‘অম্বুজ প্রসন্ন গুপ্ত’। ঢাকার বিক্রমপুরে জন্ম এই চলচ্চিত্র পরিচালকের। এই চলচ্চিত্রটিকে বলা হয় বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটির দৃশ্যায়ন করা হয় দিলকুশা গার্ডেন, মতিঝিল, নীলক্ষেত, পরীবাগ, শাহাবাগ এবং আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ের কাছে নবাবদের বাগানে। চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রহণের কাজ শেষ হতে সময় লেগেছে প্রায় একবছর এবং ১৯৩১ সালে সম্পন্ন হয় চলচ্চিত্রটির নির্মান কাজ।

চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রাহক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন খাজা আজাদ এবং খাজা আজমল(মতান্তরে খাজা আজমল ও খাজা জহির ছিলেন সহকারী চিত্রগ্রাহক)।

চলচ্চিত্রটির গল্প নিয়ে একটু মত পার্থক্য আছে। খাজা শাহেদ বর্ণনা করেছেন এভাবে-‘দুটি পরিবারের মাঝে সখ্যতা গড়ে ওঠে। বিভিন্ন ঘটনার এক পর্যায়ে পরিবার দুটির মাঝে বিচ্ছেদ ঘটে। এ সময় দুই পরিবারের দুই শিশু পরস্পরকে চুমু দিয়ে বিদায় জানায়। আর এ কারনেই ছবির নাম ‘দ্য লাস্ট কিস’।

আবার খাজা জহির তাঁর বর্ণনায় বলেন, ‘খাজা আজমল(নায়ক) তার স্ত্রীকে(ললিতা/নায়িকা) নিয়ে যাত্রা দেখতে যাবার পথে আরেক ভূপতি খাজা নাসরুল্লাহ(খলনায়ক) ললিতাকে অপহরণ করে। পরবর্তীতে আজমল, ললিতাকে নাসরুল্লাহর শয়নকক্ষে খুঁজে পায় এবং আজমল ও নাসরুল্লাহর মধ্যে যুদ্ধ হয়। অবশেষে আজমল ও ললিতার মৃত্যু হয়’।

কিন্তু খাজা শাহেদ ও জহির একটি বিষয়ে একমত, একটি দৃশ্যে শিশু চরিত্রে শাহেদ(আদিল ও চারুবালার সন্তান) শৈলেন(টোনাবাবু) রায়ের ডাকাত দল কর্তৃক অপহৃত হন।

বাংলাদেশি ইতিহাসবিদ হায়াৎ ও কাদির এই চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলোর বর্ণনা করেছেন এভাবে-
-নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন খাজা আজমল।
-খলনায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন খাজা নাসরুল্লাহ(সুকুমারি চলচ্চিত্রের নায়ক)।
-নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন ললিতা(খাজা আজমলের স্ত্রীর চরিত্রে)।
-অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেনঃ
শৈলেন রায়(টোনাবাবু, ডাকাতদের সর্দারের চরিত্রে)।
খাজা আকমল(ডাকাত চরিত্রে)।
খাজা জহির(ডাকাত চরিত্রে)।
খাজা আদিল(জমিদারের চরিত্রে)।
খাজা শাহেদ(জমিদার আদিলের শিশুপুত্রের চরিত্রে)।
সৈয়দ সাহেবে আলম(পুলিশ অফিসারের চরিত্রে)।
দেবীবালা বা দেবযানী।
হরিমতি।
ধীরেন মজুমদার।
ধীরেন ঘোষ।
শিশু টুনটুন।
বেনু ব্যানার্জি।

এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করা শিশু টুনটুনের বয়স ছিল তখন তিন কি চার। সে জমিদার রায় বাহাদুর সতেন্দ্রনাথ দাসের কণ্যা ছিল। সতেন্দ্রনাথ দাস ঢাকার ওয়ারির কাছাকাছি একটি জায়গায় থাকতেন, ঢাকার বেশ পরিচিত মুখ ছিলেন।

এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম নায়িকা হিসেবে আগমন ঘটে ‘ললিতা’ নামের তের(মতান্তরে চৌদ্দ) বছর বয়সী কণ্যার। ললিতার আসল নাম ছিল ‘বুড়ি’। পেশায় ললিতা ছিল পতিতা। সমাজব্যবস্থার বেড়াজালের কারণে নায়িকা চরিত্রের জন্য ললিতাকে নিয়ে আসা হয় পুরান ঢাকার ‘বাদামতলী’র এক পতিতা পল্লী থেকে। ‘দ্য লাস্ট কিস’ ছিল তাঁর প্রথম ও শেষ চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের শেষে সে তাঁর পূর্বের স্থান বাদামতলীতে ফিরে যায়।

চলচ্চিত্রটিতে নারী চরিত্রে আরও অভিনয় করেন দেবীবালা। বিশ শতকের প্রথম দিকে ঢাকার সবচেয়ে বিখ্যাত বাঈজি ছিলেন জিন্দাবাহার লেনের এই দেবী বাঈজি বা দেবীবালা। ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা মওদুদের ডায়েরী(সম্পাদনা-অনুপম হায়াৎ) থেকে জানা যায়, ১৯১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে খাজা হাবিবুল্লাহের বিয়ের অনুষ্ঠানে দেবী বাঈজি ও অন্য এক বাঈজি নাচ করেছিলেন। পরবর্তীতে এই দেবী বাঈজি ‘দ্য লাস্ট কিস’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

শিল্পী পরিতোষ সেন তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা ‘জিন্দাবাহার’এ হরিমতি বাঈ সম্পর্কে লিখেছেন,
‘হরিমতি বাঈজির ঘরটি আমাদের বারান্দা থেকে পরিষ্কারই দেখা যায়। প্রতিদিনের অভ্যাসমতো ভৈরবী রাগে গান ধরেছেন, “ রসিয়া তোরি আখিয়ারে জিয়া লালচায় ” ঠুংরি ঠাটের গানের এ কলিটির সুরের মাধুর্য্যে আমাদের জিন্দাবাহার গলিটি কানায় কানায় ভরে ওঠেছে’। এই হরিমতি বাঈজি অভিনয় করেন বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে।

ঢাকায় চলচ্চিত্রের শ্যুটিং হলেও প্রিন্ট ও প্রসেসিং হয় কোলকাতায়। ১২ রিলের ছবিটি ১৯৩১ সালে মুক্তি পায় ঢাকার মুকুল হলে(অধুনা আজাদ হল)। ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই হলে চলচ্চিত্রটির প্রদর্শনী চলে প্রায় একমাস। চলচ্চিত্রটির নির্মানব্যয় ছিল তৎকালীন ১২,০০০ টাকা। এর প্রিমিয়ার শো উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৮৮৮-১৯৮০)। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (১৯৩৬-১৯৪২) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তির সময় নির্বাক এ চলচ্চিত্র বাংলা,ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় সাবটাইটেল করে দেওয়া হয়েছিল। এই চলচ্চিত্রের বাংলা ও ইংরেজি সাবটাইটেল রচনা করেন পরিচালক নিজে। উর্দু সাবটাইটেল রচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আন্দালিব সাদানী।

ছবিটির একটি মাত্র প্রিন্ট করা হয়েছিল। আরও কিছু কপি বানানোর জন্য আহসান মঞ্জিলের সৈয়দ সাহেবে আলম কোলকাতার ‘অরোরা ফিল্ম কোম্পানি’র কাছে যান। অরোরা কোম্পানি কৌশলে মাত্র এক হাজার টাকায় সেই একমাত্র প্রিন্টটি কিনে নেয়। তারপর এই ছবির আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি।

-------------------------------------------------------------------------------------------------অনিক কান্তি সরকার


সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১:২০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×