বুদ্ধ মূর্তির উদ্ভব ও বিকাশকে মূর্তি পূর্ববর্তী যুগ ও মূর্তিযুগ এই দুইভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করা হলঃ
মূর্তি পূর্ববর্তী যুগ (খ্রিঃপূঃ ৫ম শতক-খ্রিঃপূঃ ১ম শতক)
• ভগবান বুদ্ধের পরিনিবার্ণকাল হতে কুষান সাম্রাজ্যের পত্তন কাল পর্যন্ত সময়ে (খৃঃ পূঃ ৬ষ্ঠ শতক হতে খ্রিস্টীয় প্রথম শতক) প্রাচীন বৌদ্ধ শিল্পকলায় কোন বুদ্ধ মূর্তি আবিষ্কৃত হয়নি।
• কিংবদন্তি অনুসারে গৌতম বুদ্ধ তিনমাসের জন্য তাবতিংসে তার মা ও ঋদ্ধিমান দেবতাদের অভিধর্ম দেশনা করতে গেলে তাঁর অবর্তমানে বুদ্ধ ভক্ত রাজা প্রসেনজিৎ চন্দন কাঠের একটি বুদ্ধমূর্তি তৈরী করে বুদ্ধের উদ্দেশ্য শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন।
ব্যাখ্যাঃ এটি কতটুকু সত্য তা বিচার সাপেক্ষ। বুদ্ধের সময় অজাতশত্রু প্রমুখ বহু রাজন্যবর্গ ও শ্রেণীবর্গ বুদ্ধের একনিষ্ট ভক্ত ছিলেন। তখন যদি বুদ্ধ মূর্তির প্রচলন থাকতো নিশ্চয় তাঁরা বুদ্ধমূর্তি তৈরী করতেন।
• সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে বুদ্ধ মূর্তি প্রচলন কিংবা উদ্ভব হয়নি বলেই মৌর্য শিল্পকলায় বুদ্ধ মূর্তি দেখা যায় না।
• পরবর্তীতে শুঙ্গ-কান যুগেও বুদ্ধ মূর্তির নির্দশন দেখা যায়নি।
• এই যুগ পর্যন্ত বৌদ্ধ শিল্পকলায় বুদ্ধ মূর্তির প্রতীক হিসেবে ধর্মচক্র, উষ্ণীশ, বোধিবৃক্ষ, ভিক্ষাপাত্র, স্তুপ ইত্যাদি ব্যবহার করা হত।
মূর্তিযুগ (খ্রিস্টীয় ১মশতক-বর্তমান)
• কুষাণ যুগে (খৃষ্টীয় ৫০ হতে ৩০০বৎসর) গান্ধার শিল্পকলার সুচনা হয়। মহাযান মতের প্রকৃষ্ঠ বিকাশের ও গান্ধার ভাস্কর্যের উৎপত্তিতে সর্ব প্রথম নির্মিত হয় বুদ্ধ ও বোধিসত্বের মূর্তি গুলো। গান্ধার ভাস্কর্যের সৃষ্টি হল গ্রীক, রোমান ও পারসিক ভাস্কর্যের সঙ্গে ভারতীয় ভাস্কর্যের সংমিশ্রনে। অনেকের মতে হারকিউলিস, এ্যাপোলো, জিউজ ইত্যাদি গ্রীক দেব-দেবী মূর্তির অনুকরনে গান্ধারের শিল্পীগণ বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। ফলে এখানকার উপাদান ভারতীয় হলেও নিমার্ণ কৌশলের দিক দিয়ে এগুলো গ্রীক প্রভাবান্বিত। তাই তারা বুদ্ধ মূর্তির মধ্যে কখনো দাঁড়ি বা গোফ ও আরোপ করেছেন। এই সময়কার বুদ্ধের এই মূর্তিগুলো ছিল বিদেশী ভাস্কর্য়ের ‘লেটএন্টিক’ পদ্ধতিতে সৃষ্টি এক জঠিল পটশিল্প।
• কুষাণ যুগকে ভারত শিল্পের সুর্বণ যুগ বলা হয়। ভারতীয় শিল্পরীতিতে যে সমস্ত স্থাপত্য ও ভাস্কর্য নির্মিত হয় এগুলো হল মথুরা শিল্পের উদ্ভব। মথুরা শিল্পকলার প্রসার ঘটে তক্ষশীলা, সাঁচী, কোশাম্বী, শ্রাবস্তী, সারানাথসহ অন্যান্য স্থানে। কিংবদন্তী আছে যে, প্রথমে ভারতীয় শিল্পীরা বুদ্ধমূর্তি নির্মাণে ব্যাপারে সাহস করেনি। মূর্তিতে বুদ্ধের মহাপুরুষ লক্ষণ গুলো ফুটিয়ে তোলা ভারতীয় শিল্পদের মনপুতঃ হয়নি। মথুরা বুদ্ধমূর্তি সমগ্র উত্তর ভারতে জনপ্রিয়তা লাভ করে। মথুরা বৌদ্ধ শিল্পকলার প্রাণ কেন্দ্র হয়ে উঠে। বুদ্ধমূর্তি গুলোকে সাধারণত তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথাঃ ১) স্থানক,২) আসন,৩) শায়িত। এসব মূর্তির দ্বারা বুদ্ধে জীবন বহুমূর্তি। যেমন- অভয়মুদ্রা, ভূমিস্পর্শমুদ্রা, ধর্মচক্রমুদ্রা ইত্যাদি লক্ষ্য করা যায়।
• আনুমানিক খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে ইক্ষাকুবংশের রাজা শ্রী ধীর পুরুষদত্তের রাজত্বকালে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় অমরাবতীর বেীদ্ধ শিল্পকলা গড়ে ওঠে। এই শিল্পকলায়ও গান্ধার ও মথুরা শিল্পকলার সমন্বয় ঘটে। এখানকার শিল্প (বুদ্ধমূর্তি) সজীব ও প্রাণবন্ত। এখানে বহু বুদ্ধমূর্তি, বোধিসত্বমূর্তি নির্মিত হয়।
• গুপ্তযুগেও (খৃষ্টীয় চতুর্থ হতে ষষ্ঠ শতকে) বৌদ্ধ শিল্পকলার ব্যাপক সমৃদ্ধি ঘটে। এ সময় বুদ্ধমূর্তিগুলো অধিকতর সুন্দর,প্রাণবন্ত ও অনুপম। বুদ্ধমূর্তি গুলোতে মুখমন্ডলের সমানুপাত গঠন, করুণা বিলাসিত চক্ষুদ্বয়, ওষ্ঠের হাস্য লাবন্য-স্বর্গীয় পবিত্রতায় পূর্নবিকাশ দেখা যায়।
• পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার থেকে আবিষ্কৃত এক সারি পোড়ামাটির প্যানেল থেকে বাংলার ভাস্করদের প্রচলিত ও কলাবিদ্যায় তাদের পছন্দের একটি সূক্ষ্ম আভাস পাওয়া যায়। এই বিহারের ভিত্তি-প্রাচীর থেকে আট শতকের শেষার্ধে নির্মিত মোট ৬৩টি প্রস্তর ভাস্কর্য পাওয়া গেছে। এই ভাস্কর্যগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত নালন্দা বৌদ্ধ বিহারের ভিত্তিমুখে নির্মিত ভাস্কর্যগুলির মতোই পাথরের স্লাবের উপর গভীর রিলিফসহ খোদাইকৃত।
• কুমিল্লা জেলার ময়নামতী দেবপর্বতের রূপবান মুরার প্রধান পূর্ব-মন্দির থেকে প্রায় অক্ষত অবস্থায় প্রাপ্ত আরেকটি দন্ডায়মান বুদ্ধমূর্তি অত্যন্ত গুরুত্ববহ । অত্যন্ত ভাল অবস্থায় সংরক্ষিত প্রায় ২.৬ মিটার উচ্চতার বুদ্ধের এই অতিকায় মূর্তিটির শৈল্পিক সৌন্দর্য বাংলায় এযাবৎ প্রাপ্ত মূর্তিগুলির মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট। অভয় মুদ্রা বা আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে আসীন উত্থিত ডান হস্তসহ ঈষৎ ফেরানো শারীরিক ভঙ্গিতে দন্ডায়মান মূর্তিটির প্লাস্টিক মডেলিং-এ সামান্য বৈচিত্র্যই পরিস্ফুটিত হয়েছে। তবে ঈষৎ উন্মুক্ত নেত্র ও মুখের মলিন হাসির সাহায্যে বাইরের জগতের প্রতি মুখায়ববের প্রাণবন্ততা সাত শতকের গুপ্ত পরবর্তী শৈলীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
• দশ শতকের বাংলা পাথর ও ব্রোঞ্জের বৌদ্ধ ভাস্কর্যের জন্যও সমৃদ্ধ। কলকাতা প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরে সংরক্ষিত নদীয়া জেলার বড়িয়ার ভূমিস্পর্শী বুদ্ধের প্রস্তর মূর্তিটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় (৬৯ সেমি)। এখানে বুদ্ধ উপস্থাপিত হয়েছেন গুপ্তোত্তর যুগের আনুমানিক আদলে, উপরের দিকে পাঁচটি ধ্যানী বুদ্ধ ও দুপাশে দুটি বোধিসত্ত্বসহ যথোপযুক্ত জ্যোতিশ্চক্র মন্ডিত হয়ে। তবে যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, স্তূপের ন্যায় বস্ত্ত শীর্ষায়িত মোচাসদৃশ উষ্ণীষ। বুদ্ধ মস্তকের এই অস্বাভাবিক গঠন পাল শিল্পরীতির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যা পরবর্তীকালে বাংলা থেকে মায়ানমার ও থাইল্যান্ডে বিস্তার লাভ করেছে।
• প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের ফলে কুমিল্লা জেলার ময়নামতী-দেবপর্বত এলাকা থেকে বেশ কিছু সংখ্যক বৌদ্ধ মঠ ও স্তূপ এবং সেই সাথে প্রচুর পরিমাণে পোড়ামাটির ফলক এবং প্রস্তর ও ব্রোঞ্জ নির্মিত বুদ্ধ মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। এই প্রত্নস্থলের বেশির ভাগ মূর্তি সাধারণত ছোট সাইজের এবং এগুলির স্থানিক চেহারা জনপ্রিয় শিল্পরীতির পরিচায়ক।
• চট্রগ্রাম থেকে ১৬ কিমি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত ঝেওয়ারী গ্রাম থেকে ৬১টি ব্রোঞ্জ বুদ্ধ মূর্তির বিশাল এক ভান্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে। এই মূর্তিগুলি সাত শতকের শেষ থেকে এগারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত।
• এগারো শতকের প্রথম দিকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধ মূর্তিটি ময়নামতী-দেবপর্বত থেকে পাওয়া গেছে। ব্রোঞ্জের এই বিশালাকায় মূর্তিটিতে বোধিসত্ত্ব-বজ্রসত্ত্ব উপস্থাপিত হয়েছে। বসা অবস্থাতেও এই মূর্তিটির উচ্চতা ১.৫ মিটার। এ যাবৎ পূর্ব ভারত থেকে আবিষ্কৃত ধাতব মূর্তিগুলির মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড় ও সম্ভবত সবচেয়ে ভালভাবে সংরক্ষিত।
• একাদশ শতাব্দীতে বাংলায় হিন্দু-ভাস্কর্যের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। তবে এ সময় বুদ্ধমূর্তিও নির্মিত হতো। বুদ্ধমূর্তিগুলোর অধিকাংশ ছিল নারীমূর্তি।
• একটি মূর্তি বাগেরহাটের শিববাটিতে পাওয়া যায়। আধুনিক অনেক পণ্ডিত মূর্তিটি পর্যবেক্ষণ করে এমন অভিমত প্রকাশ করে থাকেন যে এটি দুই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখা কিংবা হিন্দু দেবতার চেয়ে বৌদ্ধ দেবতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা যেকোনো একটি উদ্দেশ্যেই নির্মিত হয়েছিল।
• বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তিগুলির মধ্যে অন্যতম। বিখ্যাত চৈনিক বৌদ্ধ ভিক্ষু,পণ্ডিত,পর্যটক এবং অনুবাদক হিউয়েন সাঙ (৬০২ - ৬৬৪) তাঁর বিখ্যাত ভ্রমণকাহিনী ‘দা তাং জিউ জি ’তে বামিয়ানকে বৌদ্ধ ধর্ম,দর্শন ও সংস্কৃতি চর্চার একটি বিশাল কেন্দ্র হিসেবে বর্ণনা করেন। রাজার প্রাসাদের উত্তরপূর্ব দিকে অবস্থিত পাথরে খোদাই করা (বড়) মূর্তিটির উচ্চতা তিনি ১৪০-১৫০ ফিট বলে উল্লেখ করেছেন। এটির বর্ণ তিনি স্বর্ণোজ্বল বলে জানান। ছোট মূর্তিটির উচ্চতা তাঁর মতে ছিল ১০০ ফিটের মতো। কিন্তু তিনি এটি পিতলে তৈরি বলে উল্লেখ করেছেন। উপত্যকার ৬০ মাইল দক্ষিণপূর্বে একটি মঠে রক্ষিত তিনটি মহামূল্যবান স্মারকের উল্লেখও তাঁর বিবরণে পাওয়া যায়,যার মধ্যে একটি ফা-হিয়েন উল্লিখিত বুদ্ধদেবের দাঁত।
লেখকঃ অনিক কান্তি সরকার
তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০১৬ সকাল ৯:৩৯