কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা (পূর্বনাম কলিকাতা পুস্তকমেলা) পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় আয়োজিত একটি বার্ষিক আন্তর্জাতিক বইমেলা। এই মেলাটি কলকাতা বইমেলা নামেই সমধিক পরিচিত। ১৯৭৬ সালে প্রবর্তিত এই বইমেলা ১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক বইমেলার স্বীকৃতি অর্জন করে। বর্তমান বছরের জানুয়ারি মাসের 30 তারিখ থেকে বারো দিনব্যাপী এই বইমেলার উদ্বোধন হয়। সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কে বসে মেলার আসর। মেলা দেখতে 4ঠা ফেব্রুয়ারি US-Bangla Airlines এর একটি বিমানে করে কলকাতার উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করি। পাঁচদিনের সফর। সাথে ছিলো আমার পাবলিশার মন্টু ভাই।
কলকাতা বইমেলা বিশ্বের বৃহত্তম অবাণিজ্যিক বইমেলা। এটি আন্তর্জাতিক বইমেলা হলেও মেলার সিংহভাগ জুড়ে বাংলা বইয়ের বিক্রিই বেশি হয়। তবে প্রচুর ইংরেজি গ্রন্থ প্রকাশক ও বিক্রেতাও এই মেলায় অংশগ্রহণ করে। এছাড়া হিন্দি, উর্দু, সংস্কৃত ইত্যাদি অন্যান্য ভারতীয় ভাষার বইও এই মেলায় পাওয়া যায়। বিদেশি দূতাবাসগুলিও স্টল বা প্যাভিলিয়ন সাজিয়ে নিজ নিজ দেশের প্রকাশিত বইপত্রের প্রদর্শনী করে থাকে। এবারের বইমেলায় যেসব বিদেশি রাষ্ট্রগুলোকে দেখেছি সেগুলো হলো ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনা, কোস্টারিকা, রাশিয়া, নেপাল, জাপান, গুয়েতমালা প্রভৃতি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও ভারত সরকারের বাংলা প্রকাশনা বিভাগগুলিও এই মেলায় অংশ নিয়ে থাকে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ও বইমেলায় অংশ গ্রহণ করে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে মেলায় দেখেছি। এছাড়াও ফ্রাঙ্কফুট বইমেলার আদলে প্রতি বছর মেলায় অংশগ্রহণকারী একটি বিদেশি রাষ্ট্র ‘ফোকাল থিম’ ও অপর একটি রাষ্ট্র ‘সম্মানিত অতিথি রাষ্ট্র’ নির্বাচিত হয়। ২০১৯ সালের ৪৩তম কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলার ফোকাল থিম ও সম্মানিত অতিথি রাষ্ট্র হল মায়া সভ্যতার হৃদয় - গুয়েতমালা।
বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নঃ বাংলাদেশ থেকে 42টি প্রকাশনা সংস্থা এবার কলকাতা বইমেলায় অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে আটটি সরকারি প্রকাশনা সংস্থা এবং অবশিষ্ট 34টি বেসরকারি প্রকাশনা সংস্থা। বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নটি ঢাকার রোজ গার্ডেনের অনুকরণে দৃষ্টিনন্দন করে তৈরি করা হয়। কলকাতা বইমেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিলো এই প্যাভিলিয়নটি। কলকাতাবাসী আগ্রহের সঙ্গে এই প্যাভিলিয়নটিতে আসে এবং প্রচুর বই ক্রয় করে। বাংলাদেশের বইয়ের প্রতি তাদের এই আগ্রহ দেখে মনটা ভরে যায়।
কলকাতা বইমেলায় বই ক্রয়বিক্রয়ের সঙ্গে সঙ্গে আয়োজিত হয় বিভিন্ন অণুষ্ঠান, সেমিনার, পদযাত্রা, প্রতিযোগিতা ও গ্রন্থ প্রকাশ অনুষ্ঠান। আমি যে কদিন গিয়েছি, প্রতিদিনই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হতে দেখেছি। মূলত দেশাত্মবোধক ও বাউল টাইপের গান গাইতে বেশি দেখেছি। পশ্চিমবঙ্গ মন্ডপের সামনে এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের মতো কলকাতাতেও বইমেলার সময়ই প্রকাশকেরা তাঁদের নতুন বই প্রকাশ করে থাকেন। বইগুলো অত্যন্ত মানসম্মত ও উচুঁদরের। ছাপা, বাধাইসহ সবকিছুই চমৎকার। মূল্যও সহনীয়। তবে কমিশন বেশ কম। মাত্র 10%। গ্রন্থসম্ভারের পাশাপাশি চিত্রশিল্পী, শিশু, তথ্যপ্রযুক্তি ও লিটল ম্যাগাজিনের জন্য বিশেষ চত্বর নির্ধারিত ছিলো এ মেলায়। বিশেষ করে লিটল ম্যাগাজিন অংশটি ছিলো সুবিশাল। আমাদের দেশে লিটল ম্যাগাজিনকে একরকম অবহেলা করা হলেও কলকাতায় এর বেশ সমাদর আছে দেখলাম। আমাদের দেশের বইমেলার সাথে আরেকটা বড় পার্থক্য হলো, আমাদের বাংলাদেশে একুশে বইমেলাসহ যে কোনো বইমেলায় পাঠ্য পুস্তকের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ থাকে। কিন্তু কলকাতা বইমেলায় এরূপ কোনো নিষেধাজ্ঞা দেখলাম না। সেখানে বিভিন্ন স্টলে প্রচুর টেক্সট বই আমার চোখে পড়েছে। এমনটি স্কুল কলেজের পরীক্ষার সাজেশনও সেখানে বিক্রি হয়। আমি পরিসংখ্যান, গণিত, অর্থনীতি এবং পরিবেশের উপরে বেশ কয়েকটা বই ক্রয় করি মেলা থেকে।
কলকাতা বইমেলায় সবচেয়ে বেশি মানুষের ভিড় ছিলো আনন্দ পাবলিশার্স এবং দে’জ পাবলিশিং এর স্টল দুটোয়। আনন্দ পাবলিশার্সে তো ঢুকতে হলে রীতিমতো লাইন দিয়ে ঢুকতে হয়। এ দুটো স্টলসহ অন্যান্য স্টলগুলোতে মানুষের আনাগোনা উল্লেখযোগ্য পরিমাণেই ছিলো। প্রচুর মানুষকে বই ক্রয় করতে দেখেছি। মমতা বন্দোপাধ্যায়ের লিখিত বইগুলোও প্রচুর বিক্রি হয়েছে। কলকাতায় স্কুল কলেজে পড়ার মাধ্যম ইংরেজি হলেও বাংলা বই পড়ার প্রতি তাদের আগ্রহ লক্ষ্য করার মতো।
মেলার স্থানটি ছিলো সুবিশাল এবং পরিবেশ ছিলো সুশৃঙ্খল। মেলা প্রাঙ্গনে কোনো প্রকার ধুলোবালু ছিলো না। প্রতিটি স্টলে ভিতরে ঢুকে বই দেখার সুযোগ ছিলো। প্রতিটি স্টলেই ফ্লোরে কার্পেট বিছানো ছিলো। অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি এড়াতে প্রচুর পুলিশ উপস্থিত ছিলো। টয়লেটের সুব্যবস্থা ছিলো। খাবারের দোকান ছিলো। আর খাবারের দাম ছিলো নাগালের মধ্যেই। আমাদের দেশের মতো গলাকাটা মানসিকতা তাদের নেই দেখলাম। মেলায় সরকারি ভাবে বিনামূল্যে খাবার পানি সরবরাহ করা হয়। ছোটো ছোটো প্লাস্টিকের প্যাকেটে ড্রাম ভর্তি করে এই পানি রাখা হয়। যার প্রয়োজন হয় নিয়ে ব্যবহার করে। মেলার সময়কাল দুপুর বারোটা থেকে রাত আটটা। 10ই ফেব্রুয়ারি মেলা শেষ হয়।
যাতায়াত ও খরচঃ আমি বিমানে করে যাতায়াত করি। রাউন্ড ট্রিপে খরচ হয়েছে 10,500 টাকা। নিউ মার্কেটের সেন্টার পয়েন্ট লজে উঠি। প্রতিরাতের থাকার ব্যয় 900 রুপি। খাবার খরচ নাগালের মধ্যেই। আমি ইসলামিয়া হোটেল নামে একটাতে নিয়মিত যাই। সেখানে গরুর মাংসের দাম অত্যন্ত কম। এক প্লেট গরুর মাংস আর ভাত খেলে খরচ হয় পঞ্চান্ন রুপির মতো। কলকাতায় যাতায়াতের জন্য ট্যাক্সি, বাস, হাতটানা রিকশা, উবার, ট্রাম এগুলো আছে। রাস্তায় তেমন যানযট নেই। মানুষজন ট্রাফিক আইন মেনে চলে। আপনাদের যদি সুযোগ হয় তবে আগামী বছর মেলায় অংশগ্রহণ করবেন।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১২:৪৬