somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোলিশ কবি বিস্বোয়াভা সিম্বর্স্কার নোবেল বক্তৃতা

২৭ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১২:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



জীবন

১৯২৩ সালের ২রা জুলাই কবি বিস্বোয়াভা সিম্বর্স্কা পোল্যাণ্ডের পোজনান শহরের কাছে বিয়েনেন-এ (বর্তমানে কর্নিকের অংশ) জন্মগ্রহন করেন। দুই কন্যার মধ্যে তিনি ছিলেন পরিবারের ছোট মেয়ে। প্রথম দিকে ছোট গল্প আর গান লিখলেও পরবর্তীতে ১৯৪৫ সাল থেকে কবিতা লিখা শুরু করেন। তিনি অ্যাডাম ওয়্লোডেককে বিয়ে করেছিলেন এবং এই জুটি ক্রাকোতে রাইটার্স কালেক্টিভ-এ বাস করতেন। কিন্তু ১৯৫৪ সালে তালাকের মাধ্যমে আলাদা হয়ে যান তারা। তবে, পরস্পর বন্ধু হয়ে থাকেন এরপর। লেখালেখির কর্মজীবনের পাশাপাশি বিস্বোয়াভা সিম্বর্স্কা জ্যাকি লিট্রেসি এবং পিসমোর মতো সাহিত্য জার্নালে এবং পুরানো ফরাসি কবিতার অনুবাদক হিসাবেও বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন। মৃত্যুবরণ করেন পোল্যাণ্ডে, ২০১২ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি।

কাজ

বিস্বোয়াভা সিম্বর্স্কার কবিতা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্নগুলিকে সামনে নিয়ে আসে। তাঁর কবিতা নিজস্ব ধরনের মধ্যে অনন্য এবং সহজে শ্রেণীবদ্ধকরণ করা যায়। বিস্বোয়াভা সিম্বর্স্কার কাজ মানব অস্তিত্বের গভীরতম সমস্যাগুলি আলোকিত করার জন্য সচেষ্ট, বর্তমান এবং দৈনন্দিন জীবনের অনিত্যয়তা দ্বারা বেষ্টিত। তিনি স্থান ও কালের মুহূর্তময় অভিজ্ঞতাকে শাশ্বতের যন্ত্রে বুনন করেন। তাঁর কবিতাকে একটি সরল, “ব্যক্তিগত” ভাষা দ্বারা চিহ্নিত করা হয় যা সমসাময়িক ভাষার চেয়ে পৃথক, প্রায়শই শেষে কিছুটা মোচড় দিয়ে আধ্যাত্মিকতা, চতুরতা এবং সহানুভূতির চমৎকার সমন্বয় যেন।

তিনি ১৯৯৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর ভাষা ছিল পোলিশ। আর নোবেল পুরস্কারের প্রেরণা ছিল: তাঁর কবিতা, যা বিদ্রুপাত্মক স্পষ্টতায় জৈবিক আর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে মানবিক বাস্তবতার আলোয় উদ্ভাসিত করে তোলে।



নোবেল বক্তৃতা, ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৯৬

কবি এবং বিশ্ব

সবাই বলেন আমার কোনো বক্তৃতার প্রথম বাক্যটি হলো সবচে’ কঠিন। অবশ্য, ওটা আমার পেছনে বলে থাকেন ওরা, সে যাই হোক। তবে আমার মনে হয় কি, যে বাক্যগুলি—তৃত্বীয়, চতুর্থ, দশম কিংবা এভাবে একেবারে শেষে আসবে, সবই সমপরিমাণে কঠিন হবে, যেহেতু কবিতা বিষয়ে কথা বলবো আমি। আমি আসলে এই বিষয়ে খুব সামান্যই বলেছি, বলতে গেলে কিছুই বলিনি তেমন। আর যখনই কিছু বলেছি, সব সময় একটা সন্দেহজনক ধারণা হয়েছে যে তেমন ভালো কিছু বলতে পারিনি। এজন্য হয়তো আমার বক্তৃতাটি বরং সংক্ষিপ্ত হবে আজ। কেননা, অল্প মাত্রায় পরিবেশন করা হলে সমস্ত অপূর্ণতা সহ্য করা সহজ হয়।

শুধু অন্যদের বেলায় নয়, সমসাময়িক কবিরা এমনকি নিজেদের বেলায়ও হয়তো বিশেষভাবে অবিশ্বাসী আর সন্দেহপ্রবণ। তারা প্রকাশ্যে কবি হওয়ার কথা স্বীকার করেন নিতান্ত অনিচ্ছায়, যেন তারা লজ্জা পান কিছুটা। কিন্তু আমাদেরে এই সোচ্চার সময়ে নিজেদের ভুলগুলি স্বীকার করা অনেকটাই সহজ, অন্ততপক্ষে যদি সেগুলো আকর্ষণীয়ভাবে গাঁটবাঁধা থাকে, তখন ওগুলোই তোমার নিজস্ব প্রতিভাকে চিনতে পারে, যেহেতু এগুলো গভীরভাবে লুকোনো থাকে তোমার ভেতর, আর তুমি দেখতে পাও না, সামান্যতম বিশ্বাসও করো না এর উপর... প্রশ্নাবলী পূরণ কিংবা অপরিচিত লোকের সাথে চ্যাট করার সময়, মানে হচ্ছে, যখন তারা তাদের পেশা-প্রকাশ এড়াতে পারে না, কবিরা তখন “লেখক” শব্দটি ব্যবহার করতে পছন্দ করেন অথবা লেখালেখির পাশাপাশি যে পেশায় আছেন তিনি “কবি”র বদলে সেটাকে বলতে পছন্দ করেন। আমলা এবং বাসের যাত্রীরা কেবল অবিশ্বাস্যতা এবং অ্যালার্মের ছোঁয়ায় সাড়া দেন যখন তারা জানতে পারেন যে তারা কোনও কবির সাথে কাজ করছেন। আমার মনে হয় দার্শনিকরাও অনুরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন। যদিও, তাঁরা এখনো ভালো অবস্থানে আছেন, কিন্তু প্রায়শই নিজেদেরকে পণ্ডিতসূচক নামের আহ্বানে শোভিত করতে পারেন না। অবশ্য, দর্শনের অধ্যাপক বললে অনেক বেশি সম্মানজনক মনে হয় এখন।

তবে কবিতার কোনও অধ্যাপক নেই। এ কথার অর্থ হলো, কবিতা এমন একটি পেশা যাতে বিশেষায়িত অধ্যয়নের প্রয়োজন, নিয়মিত পরীক্ষা প্রয়োজন, গ্রন্থপঞ্জি এবং পাদটীকা সংযুক্ত তাত্ত্বিক নিবন্ধ প্রয়োজন, আর পরিশেষে, আনুষ্ঠানিকভাবে ডিপ্লোমা দেওয়া। এবং এর মানে হবে, ঘুরেফিরে, সেই, কবি হওয়ার জন্য সর্বাধিক উৎসাহী কবিতা দিয়ে পৃষ্ঠাগুলি ভরে ফেলাই যথেষ্ট নয়। গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি হলো একটি সরকারী স্ট্যাম্প বহনকারী কাগজের কিছু স্লিপ। আসুন আমরা স্মরণ করি সেই রাশিয়ান কবিতার গর্বকে, ভবিষ্যতের নোবেল বিজয়ী জোসেফ ব্রডস্কি একবার স্পষ্টভাবে এই জাতীয় কারণেই অভ্যন্তরীণ নির্বাসনের সাজা পেয়েছিলেন। কবি হওয়ার অধিকার দেওয়ার জন্য সরকারী শংসাপত্রের অভাব থাকায় তারা তাঁকে ‘‘পরজীবি” বলে অভিহিত করেছিল...

বেশ কয়েক বছর আগে, ব্রডস্কির সাথে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাত করার সম্মান এবং আনন্দ পেয়েছিলাম। আর লক্ষ্য করে দেখেছিলাম, এ পর্যন্ত যতো কবির সাথে দেখা হয়েছে আমার, তিনিই একমাত্র ব্যাক্তি যিনি নিজেকে কবি বলা উপভোগ করেছিলেন। তিনি কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই শব্দটি উচ্চারণ করছিলেন।

ঠিক বিপরীত—এক বেপরোয়া স্বাধীনতার সাথে উচ্চারণ করছিলেন। আমার কাছে মনে হয় যৌবনে যে নির্মম অপমানের ভেতর দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি সেটি স্মরণ করেই হয়তো এমন করেছিলেন।

অন্য ভালো-ভাগ্যের দেশগুলিতে, যেখানে মানুষের মর্যাদাকে এত সহজে আক্রমণ করা হয় না, কবিরা আকুল হয়ে থাকেন সেখানে, অবশ্যই, প্রকাশিত, পঠিত, আর বোধগম্য হতে, তবে তারা সাধারণের আর প্রত্যহিকতার উর্ধ্বে ওঠার জন্য তেমন কিছুই করেন না। এবং এখনও খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, এই শতাব্দীর প্রথম দশকে, কবিরা তাদের অমিতব্যয়ী পোশাক আর অভিনব আচরণের দ্বারা আমাদেরকে হতবাক করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে এই সমস্ত কিছু নিছক জনসাধারণের দোহাই দেওয়ার জন্য। যখন সময় হোতো কবিদের তখন পেছনে গিয়ে দরজা বন্ধ করতে হোতো, খুলে ফেলতে হোতো আলখাল্লা, তুচ্ছ কারুকার্য আর সমস্ত কাব্যিক পরম্পরা, আর মুখোমুখী হতে হোতো—নীরবে, ধৈর্য সহকারে অপেক্ষারত আপন সত্তার সাথে—স্থির শুভ্র এক-পাতার কাগজ যেন। এর জন্যই অবশেষে যা সত্য তা গ্রহন করা হয়।

বিখ্যাত বিজ্ঞানী আর শিল্পীদের জীবন নিয়ে একসাথে এতো এতো চলচিত্র নির্মাণ কোনো দূর্ঘটনা নয়। এমনকি আরও উচ্চাভিলাষী পরিচালকগণ প্রত্যক্ষভাবে সৃজনশীল প্রক্রিয়া পুনরুৎপাদন করার চেষ্টা করেন যেন তা গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বা একটি মাস্টারপিসের উত্থানের দিকে পরিচালিত করে। এবং কেউ কেউ কিছুটা সাফল্যের সাথে নির্দিষ্ট ধরনের বৈজ্ঞানিক শ্রমও চিত্রিত করতে পারেন। গবেষণাগার, বিভিন্ন সরঞ্জাম আর বিস্তৃত যন্ত্রপাতি আমাদের জীবনকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে: এই জাতীয় দৃশ্যগুলি দর্শকদের আগ্রহকে কিছু সময়ের জন্য ধরে রাখতে পারে। আর সেই অনিশ্চয়তার মুহুর্তগুলি—কিছু ক্ষুদ্রতর পরিবর্তন সহ হাজারবার পরিচালিত এই পরীক্ষাটি কি শেষ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ফল পাবে? —ব্যাপারটা বেশ নাটকীয় হতে পারে। চিত্রশিল্পীদের নিয়ে তৈরি চলচিত্রগুলি দর্শনীয় হতে পারে, কারণ তারা প্রথম পেনসিল রেখা থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ব্রাশ-স্ট্রোক পর্যন্ত বিখ্যাত চিত্রকর্মের বিবর্তনের প্রতিটি পর্যায় পুনরুদ্ধার করতে চায়। সুরকারদের নিয়ে নির্মিত ছায়াছবিতে সংগীত দারূণভাবে ফুটে ওঠে: সুরকারের কানে-বাজা সুরের প্রথম বারগুলি শেষ পর্যন্ত সিম্ফোনিক আকারে একটি পরিপক্ক কাজ হিসাবে আবির্ভূত হয়। অবশ্যই এটি বেশ নির্বোধ এবং অদ্ভুত মানসিক অবস্থাকে অনুপ্রেরণা হিসাবে জনপ্রিয় ব্যাখ্যা করে না, তবে অন্তত দেখার এবং শোনার মতো কিছু আছে।

তবে কবিরা হলেন সবচেয়ে খারাপ। তাদের কাজ হতাশাজনকভাবে অবিচ্ছুরিত। কেউ যদি কোনো চেয়ারে বসেন অথবা সোফায় গা এলিয়ে দেন, তো তিনি অদ্ভুতভাবে দেয়াল বা সিলিংয়ের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন। বহুক্ষণ পর হয়তো একবার সাতটি লাইন লিখলেন যার প্রতিটিতে পনেরো মিনিট করে চলে গেছে, তারপর হয়তো আরো চলে গেছে এক ঘন্টা, এর মধ্যে আর কিছুই লেখেননি...এই ধরনের জিনিস দেখার জন্য কে অপেক্ষা করতে পারে বলুন?

আমি অনুপ্রেরণার কথা বলছি। যদি জিজ্ঞেস করা হয় এটি কী, সমসাময়িক কবিরা প্রকৃতপক্ষে সেটা উপস্থিত থাকলেই তবে সুস্পষ্টভাবে উত্তর দেন। এমন নয় যে তারা কখনও এই অভ্যন্তরীণ প্ররোচনার আশীর্বাদ জানতে পারেন নি। নিজে না-বুঝলে অন্যকে বোঝানো এতো সহজ না।

বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যখন আমাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, আমিও প্রশ্ন করি নিজেকে। তবে আমার উত্তরটি হলো: অনুপ্রেরণা সাধারণত কবি বা শিল্পীদের একচেটিয়া সুযোগ নয়। পৃথিবীতে একদল মানুষ আছেন, থাকেন আর থাকবেন সবসময় যাদের ভেতরে অনুপ্রেরণা দেখা দেয়। এঁরা হচ্ছেন তাঁরাই যাঁরা তাদের অন্তরাত্মার আহ্বানে সারা দিয়েছেন আর হৃদয়ের প্রেম আর কল্পনা শক্তি দিয়ে তাদের কাজ করে যান। এঁরা হতে পারেন চিকিৎসক, শিক্ষক, বাগানকারী—এমনকি আমি আরো হাজারো পেশার মানুষকে যোগ করতে পারি এই কাতারে। যতক্ষণ না তারা নতুন চ্যালেঞ্জগুলি আবিষ্কার করতে পারে তাদের কাজের ভেতর ততক্ষণ তা ক্রমাগত দু: সাহসিক কাজ হয়ে ওঠে। অসুবিধা এবং কোনো বিপত্তিই তাদের কৌতূহলকে কখনো কমিয়ে দেয় না। তাদের সমাধান করা প্রতিটি সমস্যা থেকেই নতুন প্রশ্নের ঝাঁকুনি উঠে আসে। অনুপ্রেরণা সে যাই হোক না কেন, এটি একটি অবিচ্ছিন্ন ‘‘আমি জানি না” থেকে জন্মগ্রহণ করে।

এরকম অনেক লোক নেই। পৃথিবীর বেশিরভাগ বাসিন্দা এগুলি পাওয়ার জন্য পরিশ্রম করেন। কারণ তাদের করতে হয়। আবেগ তাড়িত হয়ে তারা এ ধরনের কাজ বেছে নেননি; জীবনের পরিস্থিতিই তাদেরকে বাধ্য করেছিল। প্রেমহীন কাজ, বিরক্তিকর কাজ, কাজের মূল্য দেয় কেবল কারণ অন্যরা এতোটা পায়নি, যতোটা প্রেমহীন এবং বিরক্তিকর—যাকে বলা যায় মানুষের দুর্দশাগুলির মধ্যে অন্যতম। এবং এমন কোনও সংকেতও নেই যে আগত শতাব্দীগুলি যদ্দূর সম্ভব এর ভালো কোনও পরিবর্তন আনতে পারবে।

আর তাই, যদিও অনুপ্রেরণা বিষয়ে কবিদের একচেটিয়া অধিকার আমি অস্বীকার করি, তবু তাদেরকে প্রিয় সেই সৌভাগ্যবানদের দলে রাখতে চাই।

যদিও, এই মুহূর্তে, আমার শ্রোতাবৃন্দের মনে নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নের উদ্ভব হতে পারে। কয়েকটি উচ্চস্বরে স্লোগান দেওয়ার মাধ্যমে ক্ষমতার জন্য লড়াই করা সকল ধরনের নির্যাতনকারী, স্বৈরশাসক, ধর্মান্ধ এবং জননেতারাও তাদের চাকরি উপভোগ করেন, এবং তারাও উদ্ভাবক উদ্দীপনা নিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করেন। ঠিক আছে, হ্যাঁ, তারা ‘‘জানেন’’। তারা জানেন এবং তারা যা জানেন তা তাদের পক্ষে একবারে যথেষ্ট। যেহেতু তাদের যুক্তিগুলির শক্তি হ্রাস করতে পারে তাই তারা অন্য কোনও কিছুর সন্ধান করতে চান না। আর যে জ্ঞান নতুন প্রশ্নের উত্থাপন করে না তা দ্রুতই নিঃশেষ হয়ে যায়: জীবন বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়। সবচে’ চরম ক্ষেত্রগুলিতে আর প্রাচীন এবং আধুনিক ইতিহাস থেকে সুপরিচিত কেসগুলিতেও প্রমাণিত, এটি এমনকি সমাজের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।

এই কারণেই ‘‘আমি জানি না” এই ছোট বাক্যাংশটি এত বেশি উচ্চারণ করি আমি। ছোট হলেও এর ডানা অনেক শক্ত। আমাদের জীবনকে প্রসারিত করে। আমাদের মধ্যবর্তী স্পেসকে আগলে নেয়। পাশাপাশি সেই বাহ্যিক বিস্তৃতিকেও যাতে আমাদের ক্ষুদ্র পৃথিবী ঝুলে থাকে স্থগিত হয়ে। যদি আইজাক নিউটন নিজেকে না বলতেন ‘‘আমি জানিনা”, আপেলগুলো হয়তো তার বাগানে শিলাবৃষ্টির মতো এসে পড়তো আর তিনি কুড়িয়ে নিয়ে বড়োজোর কামড়ে খেতেন। আমার স্বদেশী মেরী-কুরি কি নিজেকে কখনো বলেননি ‘‘আাম জানিনা”, তিনি সম্ভবত ভাল পরিবারের যুবতীদের জন্য কিছু বেসরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে রসায়ন পড়ানোয় বিক্ষত বোধ করতেন, অন্যথায় এভাবেই এই সন্মানজনক কাজে তার দিনগুলো ফুরিয়ে যেত। কিন্তু তিনি নিজেকে বারবার বলেছেন ‘‘জানিনা আমি”, আর এ জন্যই, এই কথাটাই তাকে একবার নয়, দু’বার স্টকহোমে নিয়ে আসে, যেখানে অস্থির আর সন্ধানী মহাত্মা মানুষদের মাঝে মাঝে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়।

কবিরা, যদি তারা সত্যবাদী হন তবে তাদের অবশ্যই ‘‘আমি জানি না” কথাটির বারবার পুনরাবৃত্তি করতে হবে হৃদয়ে। প্রতিটি কবিতা এই বক্তব্যটির উত্তর দেওয়ার জন্য একটি প্রচেষ্টা মাত্র। কিন্তু যখনই তা কাগজে ফুটে ওঠার উপক্রম হয়, কবিরা দ্বিধান্বিত হন, বুঝতে শুরু করেন এই নির্দিষ্ট উত্তরটি পুরোপুরি অস্থায়ী যা শুরু করার পক্ষে একেবারেই অপ্রতুল। তাই কবিরা চেষ্টা করতে থাকেন, আজ অথবা কাল তাদের আত্ম-অসন্তুষ্টির ধারাবাহিক ফলগুলো সাহিত্যের ইতিহাসবিদদের দ্বারা সংগৃহীত হবে আর বলা হবে ‘‘শিল্পকাজ”...

আমি কখনও কখনও এমন পরিস্থিতির স্বপ্ন দেখি যেগুলি সম্ভবত সত্য হতে পারে না। দু:সাহস নিয়ে যদি কল্পনা করি, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মানুষের সমস্ত প্রচেষ্টার অসারতা নিয়ে চলমান বিলাপ লেখক সেই একলিজিয়াসটেজ-এর সাথে চ্যাট করার সুযোগ পাওয়া। তার সামনে গভীর শ্রদ্ধায় নত হবো আমি, কারণ, প্রকৃতপক্ষে তিনিই হলেন মহৎ কবিদের একজন, অন্তত আমার কাছে তিরি তা-ই। আমি তার হাত স্পর্শ করবো। ““সূর্যের নিচে নতুন কিছু নেই”: এমটাই লিখেছেন আপনি, একলিজিয়াসটেজ। কিন্তু আপনি নিজেই সূর্যের নীচে নতুন হয়ে জন্মেছিলেন। আর যে কবিতাটি লিখেছিলেন তাও ছিল নতুন, আপনার আগে কেউ তা লেখেনি। এমনকি আপনার সমস্ত পাঠকই পৃথিবীতে নতুন, আপনার আগে যারা জন্মেছিল তারা কেউ আপনার কবিতা পড়েনি। আপনি যে সিপ্রেসের নীচে বসে রয়েছেন তা ভোর হওয়ার পর থেকে আর বাড়ছে না। আপনার মতোই অন্য অরেক সাইপ্রাসের মাধ্যমে অস্তিত্বে এসেছিল সে, তবে তা পুরোপুরি এক রকম ছিল না। আর একলিজিয়াসটেজ, আমি আপনার কাছে জানতে চাইব পৃথিবীতে আর কী কী কাজের পরিকল্পনা আছে আপনার? ইতিমধ্যে প্রকাশিত আপনার ভাবনাগুলির সাথে যা আরও পরিপূরক? অথবা হয়তো সেগুলোর সাথে বিরোধী কিছু নিয়ে ভাবছেন কি? আপনার আগের কাজটিতে আপনি আনন্দের কথা উল্লেখ করেছিলেন—তাই এবার যদি ক্ষণস্থায়ী হয় তা? তাহলে কি আপনার নতুন-সূর্যের কবিতাটি আনন্দময় থাকবে? কোনো নোট করেছেন, খসড়া আছে? আমার ধারণা আপনি বলবেন, সব লিখা হয়ে গেছে আমার, আর কিছু বাকী নেই। হ্যাঁ, পৃথিবীতে আর কোনো কবি নেই যিনি এভাবে বলতে পারেন, অন্তত আপনার মতো দূর্দান্ত আর নেই।”

এই বিশ্ব—মানে এর বিশালতা আর আমাদের অসম্পূর্ণতা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে আমরা যা ভাবি, অথবা মানুষের, প্রাণীদের, এমনকি গাছেদের ব্যক্তিগত দূর্ভোগের প্রতি বিশ্বের উদাসীনতায় তিক্ত, তাহলে কেনইবা আমরা ভাবি গাছেদের বেদনা নেই; আমরা কেবল গ্রহ বেষ্টিত নক্ষত্রদের আলোয় এর প্রসার নিয়ে ভাবতে পারি, ভাবতে পারি শুরু হওয়া গ্রহের আবিস্কার নিয়ে। গ্রহগুলি মরে গেছে? নাকি মরে যাচ্ছে? জানিনা আমরা। অসীম এই থিয়েটারটি সম্পর্কে আমরা যা-ই ভাবি না কেন, এর রিজার্ভ টিকেট রয়েছে আমাদের কাছে, তবে তুলনায় আমাদের জীবনকাল হাস্যকররকম ক্ষুদ্র, দুটি যদৃচ্ছ তারিখের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এছাড়া এই বিশ্বকে নিয়ে আর যা ভাবতে পারি আমরা, তা শুধুই অবাক-করা।

তবে “অবাক-করা” একটি যৌক্তিক ফাঁদ গোপন করার একটি উপমা। আমরা কিছুটা সুপরিচিত এবং সর্বজনস্বীকৃত আদর্শ থেকে বিচ্যুত এমন জিনিস দ্বারা অবাক হয়েছি, অবাক হয়েছি এমন একটি স্পষ্টতা থেকে যাতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এখন কথা হচ্ছে, এমন সুস্পষ্ট বিশ্ব আসলে নেই। অন্য কিছুর সাথে তুলনায় নয়, জন্মগতভাবেই আমাদের অবাক হওয়াটা রয়েছে আমাদের।

মঞ্জুরিপ্রাপ্ত, প্রতিদিনের ভাষণে, যেখানে আমরা প্রতিটি শব্দকে বিবেচনা করতে থামি না, আমরা সবাই ‘‘সাধারণ পৃথিবী,” ‘‘সাধারণ জীবন”, ‘‘ঘটনাগুলির সাধারণ পথ” এর মতো বাক্যাংশ ব্যবহার করি... তবে কবিতার ভাষায়, যেখানে প্রতিটি শব্দের অর্থ হয়, সেখানে কিছুই সাধারণ বা স্বাভাবিক হয় না। একটি পাথরও নয় কিংবা এর উপরে একটি মেঘও নয়। একটি দিনও নয় এবং এর পরে একটি রাতও নয়। সর্বোপরি, একক অস্তিত্ব নয়, এই পৃথিবীতে কারও অস্তিত্বই নেই।

মানে হচ্ছে, নিজের খাতিরেই কবিরা সবসময় তাদের কাজকে অস্বীকার করবেন।


****


কবিতা

ধূসর-রঙের আকাশে
আরো ধূসর-রঙের মেঘ দেখা যাচ্ছে
যার প্রান্ত-রেখাটুকু সূর্যের আলোয় কালো হয়ে উঠেছে।
ডানপাশ থেকে বামপাশ বরাবর
অন্ধকার ফুলের সাথে যেন এক সাদা চেরির শাখা ওটা।

আর তোমার কালো চেহারা, সামান্য ছায়ায় ঢাকা।
তুমি একটা টেবিল সেট করে
তার উপর তোমার ধূসর হাতটি রেখেছ।

তোমাকে দেখে ভূতের মতো লাগছে
যে-কী-না জীবিতদের তলব করতে চেষ্টা করছে।

(কারণ এখনও আমাকে তাদের দলেই গণ্য করা হয়েছে,
আমার দেখা-দেয়া আর নক করা উচিৎ তবে:
শুভরাত্রি থেকে শুভসকাল পর্যন্ত,
বিদায় সম্ভাষণ থেকে হ্যালো পর্যন্ত।
যদি জীবন সম্পর্কিত হয় তাহলে
প্রশ্ন থেকে উত্তর পর্যন্ত বখিল না-হয়ে,
মানে হচ্ছে, শান্ত হওয়ার পূর্বের ঝড় এটা।)


বাংলা অনুবাদ: ঋতো আহমেদ
ছবি : ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১২:৩১
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×