দুপুরবেলাটা বড্ড চুপচাপ। কান পাতলে বসন্ত হাওয়ার হাঁটাচলার শব্দ মেলে, আলতো পায়ে ঘাসের গালিচায়। রোদের লুকোচুরি পাতাদের আনাচে কানাচে। পাতায় পাতায় ঝামরের শব্দ। আর পাখিদের কলকলানি। কে জানে কেন, কি কারণে অনবরত বাড়ির ছাদে পায়রাদের বাকবাকুম।
মন খারাপ হয়ে যায় আমার। চোখ বন্ধ করলে টের পাই, গন্ধ পাই ফেলে আসা শহরের। হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলার শব্দরা জ্যান্ত হয়ে ওঠে। দুপুরের রোদ মাখা হাওয়ায় হঠাত ভেসে আসে নানাবাড়ির সামনে ফেলে আসা তেজপাতা গাছের আদরের শব্দ, দারুচিনি গাছের বাকলের ঝাঁঝালো গন্ধ, পাঁচিলের ওপরে ঝুঁকে পড়া কাঁঠালি চাঁপার ডাল, ইগলু আইসক্রিমওয়ালার ঘন্টার টিং টিং, রান্নাঘরে নষ্ট হওয়া কলের অনবরত টুপটাপ জল পড়ার আওয়াজ, ফেরীওয়ালার সুরেলা ডাক, দুরের কোন ছাদে ডানপিটে ঘুড়ি। ঝিমুতে থাকা রৌদ্রক্লান্ত শহর, আমার স্মৃতির শহর টুকরো টুকরো মনখারাপ হয়ে এখানে ওখানে ছিটকে আসে। দুম করে একা লাগে, ভয় করে।
রুদ্র...তোর ঠোঁট, তোর স্পর্শ এখনও কেন জানি না লেগে আছে, আমার চোখে মুখে। বারবার পালাচ্ছি। আমি পালাচ্ছি, আর পালাচ্ছি। তবু আমার ঠোঁট ভিজে, মনখারাপের চুমুতে।
কোন এক দুপুরের আচমকা, অস্থির, লুকোনো চুরোনো চুমু। ঠোঁটে ঠোঁট রেখেই ভয়ে সরিয়ে ফেলা। মনে আছে তোর? একবার শান্তভাবে তোর ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে দিবি রুদ্র? লুকোনো চুরোনো, অস্বস্তিকর, তাড়াহুড়ো নয়...শান্ত ভাবে, অনেকক্ষণ!! হতে পারে এমন কোন নির্জন দুপুর, কোনও সন্ধ্যা কিংবা কোন নিয়ন আলোর রাতে।
নরমেরা ছোঁবে নিজেদের মতো করে যতক্ষণ ইচ্ছে। ঠোঁটের আঁচে পুড়তে থাকব। মোমের মতো গলতে থাকব। ভালোবাসায় ভিজতে থাকব। চোখের জল ছোঁবে তোর রুক্ষ নীলচে গাল, তোর নিকোটিনের গন্ধমাখা ঠোঁট। আমাকে ভিজতে দিবি রুদ্র?
শেষ চুমু তোর জন্য রুদ্র!! তোর সামনে নতজানু আমি। ইচ্ছে করলেই নিয়ে যেতে পারিস প্রাচীন কোন অন্ধকার মাখা পাহাড়ি জঙ্গলে। নিয়ে যেতে পারিস সেই উদ্ধত পাহাড় চূড়োয়, হাত বাড়ালেই যেখানে চাঁদ ছোঁয়া যায়। সেই পাহাড়চুড়ো থেকে ভাসিয়ে দিস আমাকে, আমার শরীরকে। কথা দিচ্ছি পতনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তোকে ভালোবাসবো। আমাকে তুই মুক্তি দিস রুদ্র!!পাহাড়ের পাশে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে যাবো, অনন্ত অসাড় ঘুম। তোর চোখে চোখ রেখে নির্বিবাদে শূণ্যে হারাবো। নিয়তির মতো অমোঘ হারিয়ে যাবো।
আর তুই? তুই ফিরে যাস তোর নিজের ঘরে, নিজের জীবনে। হঠাত এমন কোন একলা হয়ে যাওয়া দুপুরে, রোদমাখা হাওয়ায় ভেসে আসা শব্দে, হয়তোবা মনে পড়বে আমাকে। পাতাদের ফিসফিসানি, বাতাসের বয়ে চলা, পাখিদের অকারণ ডাকাডাকি মনে করিয়ে দেবে আমায়। অথবা মস্ত থালার মতো চাঁদ আকাশে...জোছনার আড়ালে লুকিয়ে থাকা নীলচে অন্ধকারে আচমকা মনে পড়বে এমন কোন এক রাতে আমাকে ফেলে এসেছিলি তুই।
অযাচিত একটুকরো পাখির পালকের ওম মাখা বিষণ্ণতা ছোঁবে তোর মন। তুই জানিসও না, অথচ তোর আশেপাশেই আমি রয়ে গেছি। রুদ্র...একটু হলেও মনখারাপ করিস আমার জন্য।
শোন রুদ্র!! সেই রাতটা আসার আগে, পাহাড়চূড়োয় ওঠার আগেই ঠোঁট ছুঁতে দিবি আমায়? মনখারাপেরা বাড়ি ফেরার আগেই, হারিয়ে যাওয়ার আগেই একটু কি ভালোবাসবি আমায়?
তুই চাইলেই হারিয়ে যাব। যেদিন বলবি, সাথে সাথে হারিয়ে যাবো। কিন্তু ততোদিন, ঠোঁট ছুঁতে দিবি আমায়, আরেকবার? শান্ত ভাবে? দুপুরবেলার দিব্যি, রুপকথার চুপকথার দিব্যি, আরেকবার ভালোবাসবি রুদ্র?
© শিখা রহমান
Painting by Arya Chandra Chowdhury (IN ANTICIPATION)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১১:১১