somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভারতবর্ষে মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন

২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গৌতম বুদ্ধ মৃত্যুবরণ করেন খ্রিষ্ট পূর্ব ৪৮৬ সালে। আর মহাবীর মৃত্যুবরণ করেন খ্রিষ্ট পূর্ব ৪৬৮ সালে (জন্ম ৫৪০ খ্রিষ্ট পূর্ব)। নানান অনিয়ম, দূর্নীতির বেড়াজালে আটকে জৈন বিস্তার থেমে গেলেও বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার রোধ করা যায়নি। ভারতবর্ষে অনেক অনিয়ম সত্ত্বেও বৌদ্ধ ধর্ম ভালো একটা অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলো। বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তৃত হয়েছিলো দেশ থেকে দেশান্তরে। তার অন্যতম কারণ ছিলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। সম্রাট অশোক সিংহাসনে আরোহণ করেন খ্রিষ্ট পূর্ব ২৬৯ সালে। অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর ইতোমধ্যে ২০০ বছরেরও বেশি পার হয়ে গেছে। এ রকম মুহুর্তে বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরায় অশোক এক শক্তিশালী সম্রাট হিসেবে ভারতবর্ষে আবির্ভূত হন। এই অশোকই বৌদ্ধ ধর্মকে নিয়ে যান দেশে বিদেশে। অশোকের আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্ম চলেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। মূলত এই অশোকের সময়েই বৌদ্ধ ধর্ম দেশে তো বটেই বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে। সম্রাট অশোকের পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রা সম্রাট অশোকের আদেশ পেয়ে শ্রীলংকায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার করেন। এছাড়া চীন, কাশ্মীর, গান্ধার, মহারাষ্ট্র, আফগানিস্তান, নেপাল, থাইল্যান্ড, জাপান, প্রভৃতি দেশে এখনো আমরা যে সকল বৌদ্ধ ধর্মালম্বী দেখতে পাই এটা মূলত সম্রাট অশোকেরই অবদান ছিলো। এ জন্য স¤্রাট অশোককে বৌদ্ধ ধর্মের কনস্ট্যানটাইন বলা হয়। কে ছিলেন এই সম্রাট? কিভাবে ঘটে তার উদ্ভব? ভারত বর্ষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কি ছিলো তার প্রভাব? এবার সেই ঘটনা পরম্পরাগুলো আমরা জানার চেষ্টা করবো।
প্রথমে স¤্রাট অশোকের আবির্ভাবের ঘটনাটা একটু দেখে নিই।
স¤্রাট অশোক ও মৌর্য সা¤্রাজ্য সম্পর্কে আমরা জানতে পারি কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, সেলুকাসের পাঠানো দূত মেগাস্থিনিসের রচিত গ্রন্থ “ইন্ডিকা” ( যেখানে তিনি তৎকালীন ভারতবর্ষের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটগুলো সম্পর্কে লিখে গেছেন), সমকালীন সাহিত্য, সমকালীন শিলালিপি, স্তম্ভলিপি থেকে। যেগুলো বিশ্লেষনের মাধ্যমে সেই সময়কার অনেক অজানা নিগূঢ় রহস্য চোখের সামনে জ্বল জ্বল করে ভেসে উঠে। যেগুলো আমাদের সামনে পরিষ্কার করে দেয় মৌর্য সা¤্রাজ্যের তথা অশোকের কাহিনী।


খ্রিষ্ট পূর্ব ৬০০ সালে ভারতবর্ষ সর্বমোট ১৬ টি মহাজনপদে বিভক্ত ছিলো। এই মহাজনপদগুলো হলো-১. কাশী (বর্তমান বেনারস ও বারাণসী), ২. কোশল (অযোধ্যা), ৩. অঙ্গ (পূর্ব বিহার), ৪. মগধ (দক্ষিণ বিহার), ৫. বৃজি (উত্তর বিহার), ৬. মল্ল (গোরখপুর), ৭. চেদি (যমুনা ও নর্মদা নদীর মধ্যবর্তী অব্জল), ৮. বৎস (এলাহাবাদ), ৯. কুরু (থানেশ্বর, মীরাট ও দিল্লী), ১০. পাঞ্চাল (বেরিলি, ফারুখাবাদ ও বদায়ূন), ১১. মৎস (জয়পুর), ১২. সূরসেন (মথুরা), ১৩. অশ্মক (গোদাবরী উপত্যকা), ১৪. অবন্তি (মালব), ১৫. গান্ধার ( পেশোয়ার ও রাওয়ালপিন্ডি), ১৬. কম্বোজ (কাশ্মীর)
এই ষোলটি মহাজনপদের মধ্যে প্রায়ই বিরোধ লেগে থাকতো। এই বিরোধগুলোকে কেন্দ্র করেই মগধ পুরো ভারতবর্ষের মধ্যে শক্তিশালী মহাজনপদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সম্রাট অশোককে বর্ণনা করতে এই মগধ রাজ্যেকেই আমরা একটু গুরুত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করবো। বলে রাখি মগধ আর্যদেরই রাজ্য ছিল প্রথমে। অথর্ববেদেও মগধের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিহার এবং বাংলার অধিকাংশই মগধ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। এই মগধকে কেন্দ্র করেই এক পর্যায়ে মৌর্য সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে, আর সম্রাট অশোকই ছিলেন এই মৌর্য সাম্রাজ্যের শেষ রাজা। মগধের এই উত্থানে মূল ভূমিকা পালন করেন বিম্বিসার। বিম্বিসারই মগধকে উত্তর ভারতের রাজনীতির কেন্দ্রে পরিণত করেন। বিম্বিসারের পর তার পুত্র অজাতশত্রু ৪৯৪ খ্রিষ্ট পূর্বে মগধের সিংহাসনে আরোহণ করেন। খ্রিষ্ট পূর্ব ৩৬৪ অব্দের দিকে নন্দ বংশের দখলে চলে যায় মগধ। নন্দ বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মহাপদ্ম নন্দ। পুরাণ অনুযায়ী এই মহাপদ্ম নন্দই বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত্রিয়দের (পাঞ্চাল, কলিম, কাশী, অশ্মক, কুরু, সুরেন, মিথিলা ইত্যাদি) পরাজিত করে গড়ে তুলেন এক বিশাল সাম্রাজ্য। গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার পুরো পারস্য সাম্রাজ্য জয় করে যখন তার বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে ভারতবর্ষ আক্রমণের পরিকল্পনা নেন, তখন মূলত এই নন্দ সা¤্রাজ্যের সক্ষমতাই তাকে ভড়কে দিয়েছিলো। এই সময় নন্দ সা¤্রাজ্যের অধীনে ২,০০,০০০ পদাতিক, ৮০,০০০ অশ্বারোহী, ৮,০০০ রথারোহী, ৬,০০০ যুদ্ধহস্তী ছিলো। এই সামরিক শক্তির কারণেই আলেকজান্ডার তার জীবদ্দশায় আর ভারতবর্ষ আক্রমণ সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নিতে পারেননি। এ থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, সামরিক ক্ষেত্রে সেই সময় ভারতবর্ষ ছিলো পুরো বিশ্বে অদ্বিতীয়। লোহা উৎপাদনে সেই সময় মগধের ধারে কাছেও কেউ ছিলো না।
এই লোহা দিয়ে তৈরি হতো লাঙ্গল, কাস্তে, তবে সবচেয়ে বেশী যে কাজে ব্যবহৃত হতো তা হলো অস্ত্র তৈরি করা । যুদ্ধের জন্য অস্ত্র। খাদ্য শস্য উৎপাদনের চেয়ে অস্ত্র উৎপাদনই ছিলো তৎকালীন মুখ্য বিষয়। প্রত্যেক রাজাই সিংহাসনে বসার পর রাজ্য জয়ের প্রতি সবচেয়ে বেশি নজর দিতেন।
নন্দ রাজা ধননন্দের সৎ ভাই ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মা ‘মুরা’ ছিলেন নন্দ রাজার দাসী। এই দাসীর সাথেই নন্দ বংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং মগধ সম্রাট মহাপদ্ম নন্দের ঔরষে চন্দ্রগুপ্তের জন্ম হয়। এই চন্দ্রগুপ্তই এক পর্যায়ে হয়ে উঠেন ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি।
মহাপদ্মে¥র মৃত্যুর পর পর তার পুত্র ধননন্দ মগধের সম্রাট হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। চন্দ্রগুপ্তও কম গেলেন না। দুই ভাইয়ের মধ্যে চলতে থাকলো ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্র ধীরে ধীরে প্রকাশ্য রূপ ধারণ করে। ধননন্দ এক পর্যায়ে জোর পূর্বক তার দাসী মাতা মুরা এবং সৎ ভাই চন্দ্রগুপ্তকে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করেন। ধননন্দের এই দুঃসাহস চন্দ্রগুপ্তের তাজা শরীরে যেনো স্ফুলিঙ্গ তুলেছিলো। চন্দ্রগুপ্ত তার মা ও তার উপর ধননন্দের এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে মগধের সিংহাসন দখলে পাল্টা চক্রান্ত চালান। কিন্তু এতে চন্দ্রগুপ্ত সফল হতে পারেন নি। ধননন্দ তখন বুঝতে পারলেন, চন্দ্রগুপ্ত যেকোনো সময় বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। ধননন্দ তখন ভালোভাবেই চন্দ্রগুপ্তকে একেবারে শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। চন্দ্রগুপ্তেরও বিষয়টা অনুধাবন করতে সময় লাগলো না। এটা বুঝতে পেরে চন্দ্রগুপ্ত ধননন্দের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে গা ঢাকা দেন গভীর অরণ্যে। কিন্তু সিংহাসনের মোহ আর ধননন্দের এরকম অপমান চন্দ্রগুপ্তের রাতের ঘুম হারাম করে দেয়। ফলে সিংহাসনের লোভ আর প্রতিশোধের স্পৃহা চন্দ্রগুপ্তকে ধীরে ধীরে আরো বেশি ক্ষুধার্ত করে তুলছিল।

ঠিক একই সময় অর্থাৎ যে সময়টিতে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নন্দ বংশকে মগধ থেকে উৎখাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন সেই সময়টিতে তৎকালীন ভারতের অন্যতম চিন্তাবিদ চাণক্যের (ছদ্মনাম কৌটিল্য) সাথে নন্দ রাজবংশের বিরোধ বাঁধে। বিরোধ বলাটা হয়তো ঠিক হবে না, এক প্রকার ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব।


চাণক্য (৩৭০- ২৮৩ খ্রিষ্ট পূর্ব) ছোট বেলা থেকেই খুব মেধাবী ছিলেন। পরবর্তীতে তক্ষশীলায় (বর্তমান ইসলামাবাদের ৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ও রাওয়ালপিন্ডির কিছু উত্তর পশ্চিমে) পড়াশুনা করেছেন। অধ্যাপনা করেছেন এই তক্ষশীলায়ই অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতি নিয়ে। তিনিই হলেন ভারতের সর্ব প্রথম অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। চাণক্যের সবচেয়ে বড় অবদান হলো ১৫ পর্বের গ্রন্থ “অর্থশাস্ত্র”।

চাণক্য জীবনের একটি পর্যায়ে নন্দ রাজবংশের প্রশাসনে চাকুরিরত ছিলেন। যেহেতু অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে তার এতদিন যাবৎ প্রচুর পড়াশুনা সেহেতু রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামো সংক্রান্ত চাণক্যের কিছু মৌলিক চিন্তা ছিলো। যে চিন্তাগুলো ইতোপূর্বে আর কারো মাথায় আসেনি। চাণক্য তার এই চিন্তাগুলো মগধ সম্রাট ধননন্দের সাথে শেয়ার করতেই ধননন্দের সাথে তার তীব্র মত বিরোধের সৃষ্টি হয়। চাণক্য ভেবেছিলেন ধননন্দ হয়তো তার প্রস্তাবগুলোকে সাদরে গ্রহণ করবেন। কিন্তু এরকম ভাবে ধননন্দ তার সাথে বিষয়গুলো নিয়ে তর্কযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বেন চানক্য তা কল্পনাও করেননি। চাণক্যের সিদ্ধান্তগুলোকে ধননন্দ কানেই তুলেন নি। কিন্তু কী কারণে ধননন্দ এরকম করলেন সে বিষয়টি এখনো অজানা থেকে গেছে (কারণ চাণক্যের চিন্তা ভাবনা জনগণের মাথায় বেশি করে কাঁঠাল ভেঙে সিংহাসন পাকাপোক্ত করার এক সুতীক্ষ্ণ কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়)। যতটুকু ধারণা করা হয়, ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বই ছিলো চাণক্যের সাথে ধননন্দের এ বিরোধের মূল কারণ। যাই হোক, এই বিরোধের পরপরই চানক্য সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন- নন্দ রাজার অধীনে আর নয়! তাকে হটাতে পারলেই তবে এ রাজ্যে ফিরবেন চাণক্য। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে চাণক্য পালিয়ে গেলেন গভীর অরণ্যে।
কিছুদিন বিমর্ষভাবে কাটার পর এই অরণ্যেই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সাক্ষাত পান চাণক্য। চাণক্য এবং চন্দ্রগুপ্ত দুজনেই নন্দ রাজবংশ কর্তৃক বিতারিত, দুজনেই নন্দ বংশের শেকল থেকে বেরিয়ে ঘুরছেন এদিক ওদিক, আরো যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির মিল দুজনেরই মধ্যে পাওয়া যায় তা হলো- ধননন্দকে উচ্ছেদ করে নন্দ রাজ বংশ দখলে দুজনেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
নন্দ সাম্রাজ্যের হাতে তখন ২,০০,০০০ পদাতিক, ৮০,০০০ অশ্বারোহী, ৮,০০০ রথারোহী, ৬,০০০ যুদ্ধ হস্তী। সামরিক দিক দিয়ে সেই সময়কার অদ্বিতীয় শক্তি। আলেকজান্ডারের মতো সম্রাটকে এই শক্তির নিকট মাথা নিচু করে চলে যেতে হয়েছিল। সেই শক্তিকে পরাজিত করার প্ল্যান করতে থাকেন চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্ত। দুজনের হাতই শূণ্য। একমাত্র মাথা ছাড়া দুজনের কাছে আর কিছুই নেই। এই মাথা খাটিয়েই দুজনেই চিন্তা করতে লাগলেন ধননন্দকে কিভাবে সিংহাসনচ্যুত করা যায়। চাণক্য তার অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞান, রাষ্ট্র সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা, নন্দ রাজবংশের পুরো রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংক্রান্ত জ্ঞান (যেহেতু তিনি নন্দ রাজার প্রশাসনে কর্মরত ছিলেন) কাজে লাগিয়ে চিন্তা করতে লাগল কিভাবে মগধের সিংহাসন দখল করা যায়। অন্যদিকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রয়েছে অপরিসীম সাহস ও উদ্যম। নন্দ রাজবংশ উৎখাতে সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
ধননন্দ এমনিতেই খুব অত্যাচারী রাজা ছিলেন। তার অত্যাচারের জ্বালায় পুরো মগধের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিলো। প্রজাদের উপর কারণে অকারণে অবর্ণনীয় নির্যাতন চালাতেন ধননন্দ। কর আদায়ের সময় প্রজাদের শারিরীক নির্যাতন করে কর আদায় শুরু করেন। যার কারণে সাধারণ প্রজাদের মধ্যে ধননন্দকে পছন্দ করে না এরকম প্রজার সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছিলো। ধস নামে ধননন্দের জনপ্রিয়তায়। প্রজাদের এই ধননন্দ বিরোধীতাকে শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা শুরু করেন চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। তারপর চাণক্যের সহযোগিতায় চন্দ্রগুপ্ত অতি দ্রুত একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। এজন্য তারা দুজনেই যথেষ্ট গোপনীয়তার আশ্রয় নেন। এই সেনাবাহিনী আর তার সাথে চাণক্যের কৌশল নিয়ে চন্দ্রগুপ্ত মগধ রাজ্য আক্রমণ করেন। সত্যি সত্যিই ধননন্দের সুবিশাল বাহিনীকে পরাস্ত করে চন্দ্রগুপ্ত মগধ দখল করে নিতে সক্ষম হন। তবে এসময় হিমালয়ের এক রাজার সামরিক সহায়তা পেয়েছিলেন বলে বিভিন্ন প্রাচীন সাহিত্য সূত্রে জানা যায়।
মগধ রাজ্যে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটলো। ধননন্দের জায়গায় এলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। খ্রিষ্ট পূর্ব ৩২২ হতে ২৯৮ খ্রিষ্ট পূর্ব পর্যন্ত মোট ২৪ বছর রাজত্ব করেন চন্দ্রগুপ্ত। তার রাজত্বকালে তিনি কলিঙ্গ ও তামিল ছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পূর্বে বাংলা থেকে পশ্চিমে আফগানিস্থান ও বেলুচিস্থান, উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে দক্ষিণাত্য মালভূমি পর্যন্ত তার শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিলো। চন্দ্রগুপ্তের শাসনামলেই প্রথমবারের মতো পুরো ভারতবর্ষ এক শাসনের অধীনে আসে অর্থাৎ রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের হুকুমই ছিলো সব কথার শেষ কথা। সর্বোপরি একটি একক রাষ্ট্রের অধীনে আসে ভারতবর্ষ। চাণক্য মূলত নন্দ বংশের উচ্ছেদ চেয়েছিলেন প্রধানত যে কারণে তা হল তার মতামতের অপমান। তাহলে এমন কি মত ছিলো যা রাজা ধননন্দ মানেননি বলে পুরো রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে গভীর অরনেণ্য চলে আসেন? এই বিষয়গুলো আমরা বুঝতে পারবো যদি চন্দ্রগুপ্তের শাসনকাল একটু ভালোভাবে দেখি। কারণ রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য রাজা হলেও রাজ্য পরিচালনা ও অর্থনীতি সংক্রান্ত সকল সিদ্ধান্ত আসতে চাণক্যের মাথা থেকে।


চন্দ্রগুপ্তের পুরো শাসন ব্যবস্থাটি ছিলো একনায়কতান্ত্রিক। রাজা যা বলতেন তাই হতো। এই একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই আরো হৃষ্টপুষ্ট করার জন্য চাণক্যের পরামর্শে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য পুরো মৌর্য সম্রাজ্যের একটি প্রশাসনিক কাঠামো দেন। প্রথমে পুরো সাম্রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করেন। প্রদেশগুলোকে আবার অহর ও বিষয়ে (জেলা) ভাগ করেন। বিষয়গুলো আবার কিছু গ্রামে বিভক্ত ছিলো। ৪-৫টি গ্রামের দায়িত্বে থাকতেন একজন করে গোপ। এভাবে পুরো সাম্রাজ্যকে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক কাঠামোয় নিয়ে আসেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, যা এর আগে আর কেউ পারেনি। এই প্রথমই ভারতবর্ষ লাভ করে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক কাঠামো। এই প্রশাসনিক কাঠামোর মাধ্যমেই মৌর্য সাম্রাজ্য লাভ করে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।
এ সময় সাধারণ প্রজাদের উৎপাদিত পণ্যের এক চতুর্থাংশ অংশ বাধ্যতামূলক কর হিসেবে দিতে হত। কর ফাঁকির কোনো সুযোগ ছিল না এবং কর আদায়ে আদায়কারীরা প্রচুর নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিতেন। এই কর দিয়েই ফুলতে থাকে মৌর্য সাম্রাজ্য। করের টাকা মূলত ব্যয় হতো পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দৃঢ় ও মজবুত রাখার জন্য। কারণ এই প্রশাসনই মৌর্য সাম্রাজ্যের মূল ভিত্তি। সে কারণে মন্ত্রী, পুরোহিত, সেনাপতি, অন্যান্য কর্মচারীদের মন ভরানো বেতন দেয়া হতো। বেতন পেতে চন্দ্রগুপ্তের কোনো কর্মচারিকে খিস্তি করতে হয়নি। সবাই ঠিক ঠাক তাদের বেতন পেয়ে যেতেন।


এ সময় ঋণের ব্যবহার ব্যাপক হারে প্রচলিত হতে শুরু করে। কারণ কৃষির প্রতি সরকারের অনেক উদ্যোগী ভূমিকা ছিলো। সরকারি উদ্যোগে জলসেচ করে প্রজাদেরও আকৃষ্ট করা হত কৃষি জমি চাষের প্রতি। কৃষির এই রমরমা অবস্থা দেখে অনেক কৃষকই সরকারের কৃষি ঋণ নামক ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। যার পরিণামও খুব একটা সুখকর ছিলো না। ঋণের বোঝা বইতে বইতে অনেক পরিবারকে পথে বসতে হয়েছে, অনেককে সহ্য করতে হয়েছে অত্যাচার নির্যাতন। কিন্তু মৌর্য রাজস্বের গতি প্রবাহ থেমে নেই। এত অত্যাচার নির্যাতনের মধ্যেই ফুলে উঠছিলো মৌর্য অর্থনীতি।
চাণক্যের এসব কূটবুদ্ধিই মূলত চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজ্য-জয় থেকে শুরু করে রাজা শাসন সবকিছুর মূল চাবিকাঠি।

চাণক্যের মধ্যে যে গুণটা সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় তা হলো, তিনি অনেক দূর পর্যন্ত চিন্তা করতে পারতেন। আর সেই চিন্তা অনুযায়ী সুপরিকল্পিতভাবে নিজের মাথাকেও কাজে লাগাতে পারতেন। তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই চন্দ্রগুপ্তের পুরো শাসনকাল জুড়ে। চাণক্য বুঝতে পেরেছিলেন ভারতবর্ষে গ্রীকদের অবস্থান খুব একটা সুবিধের নয়। তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে গ্রিকদের বিতারনে চন্দ্রগুপ্তকে উপদেশ দেন। চন্দ্রগুপ্তও তা পালন করেন অক্ষরে অক্ষরে।
খ্রিষ্ট পূর্ব ৩২৩ সালে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সেনাপতি সেলুকাস (এই সেলুকাসকে উদ্দেশ্য করেই আলোকজান্ডার তার ভারতবর্ষে ১৮ মাস অবস্থানকালে বলেছিলেন- সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ! আলেজান্ডারের মৃত্যুর পর সেলুকাস ব্যাক্টিয়া ও সিন্ধু নদ পর্যন্ত পূর্ব দিকের অংশের মালিক হন।) মগধ রাজ্য আক্রমণ করেন। কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের বিশাল সৈন্যবাহিনী এবং চাণক্যের কৌশলের নিকট সেলুকাসকে পরাজয় বরণ করতে হয়। এই যুদ্ধের পর চাণক্য ও সেলুকাসের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি মোতাবেক কাবুল, কান্দাহার, হিরাট ও বেলুচিস্তান এই জায়গাগুলো দখল করে নেন চন্দ্রগুপ্ত এবং সেই সাথে সেলুকাস তার কন্যা হেলেনকে চন্দ্রগুপ্তের সাথে বিবাহ দিতেও বাধ্য হন। এই চুক্তির পর সেলুকাস যখন এন্টিগোনাসের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন তখন সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তের কাছে সহায়তা চান এবং চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাসকে ৫০০ যুদ্ধ হস্তি দিয়ে সহায়তা করেন। এই হাতিগুলোই মূলত ঐ সময় সেলুকাসকে এন্টিগোনাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় লাভ করতে সহায়তা করে।
চন্দ্রগুপ্ত মারা যান খ্রিষ্ট পূর্ব ২৯৮ সালে। চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বিন্দুসার মগধের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তখন বিন্দুসারের বয়স ছিলো মাত্র ২২ বছর। কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মতো বিন্দুসার কোনো কারিশমা দেখাতে পারেননি। তারই রাজত্বকালে তক্ষশীলার অধিবাসীরা দুইবার বিদ্রোহ করে কিন্তু বিন্দুসারের পক্ষে তা দমন করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু অশোক (এই অশোক হলেন বিন্দুসারের ১০০ পুত্রের মধ্যে একজন) পেরেছিলেন। তবে বিন্দুসার দক্ষিণ ভারতে বিছিন্নভাবে কিছু জায়গায় আক্রমণ চালিয়ে জায়গাগুলো দখল করতে পারলেও চন্দ্রগুপ্তের তৈরি করা প্রশাসনিক ব্যবস্থায় কেমন যেনো ফাটল ধরে যায় এ সময়টিতে।
কিন্তু কেনো? তার একমাত্র কারণ চাণক্যের প্রতি অবহেলা। চাণক্য বিন্দুসারের সময়েও উপদেষ্টা ছিলেন। কিন্তু চাণক্যের মতামত আর আগের মতো কাজ করছিলো না। বিন্দুসার উনার পিতার মতো চাণক্যের প্রতি আস্থা রাখতে পারছিলেন না। তাছাড়া বিন্দুসারের আরেক উপদেষ্টা সুবন্ধুর সঙ্গে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বিষয় নিয়ে চাণক্যের বিরোধ বাঁধে। যতটুকু জানা যায় বিন্দুসার ক্ষমতায় আরোহণের ১৫ বছর পর চাণক্য মারা যান। কিন্তু কিভাবে মারা যান? এই প্রশ্নটি আজো একটি প্রশ্ন হিসেবে রয়ে গেছে পুরো মানব জাতির কাছে। সুবন্ধুর এই চক্রান্তেই হয়তো চাণক্যের মৃত্যু হয়েছিল কিংবা চাণক্য ঠিক আগের মতোই অর্থাৎ ধননন্দের সাথে যেভাবে জেদ করে গভীর অরণ্যে চলে গিয়েছিলেন, এবারো হয়তো সে রকম অবস্থায় নির্বাসনে গিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর প্রহর গুণতে থাকেন। কারণ এখন তার জীবনের অন্তিমকাল। তাছাড়া চন্দ্রগুপ্তের ছেলে বলে হয়তো বিন্দুসারকে বিন্দুসারকে উৎখাত করার কোনো চিন্তাও তার মাথায় আসেনি। নানা ধোঁয়াশার আড়ালে লুকিয়ে রইল ভারতের প্রথম অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর অন্তিমকালের ঘটনা। তবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, বিন্দুসার তার পিতার মতো চাণক্যকে গুরুত্ব দেন নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হেয়ও করেছেন। যার ফলাফলস্বরূপ চাণক্য মৌর্য সা¤্রাজ্যের বলয় ছিঁড়ে বেরিয়ে যান।
বিন্দুসার মারা যান খ্রিষ্ট পূর্ব ২৭২ সালে। বিন্দুসারের মৃত্যুর পরেই শুরু হয়ে যায় বিন্দুসারের পুত্রদের মধ্যে রাজ্য নিয়ে কাড়াকাড়ি। কে হবে এই মগধ রাজ্যের সম্রাট? কার কথায় উঠবে বসবে এই মগধ রাজ্য?
অশোক এই মুহুর্তে হয়ে ওঠেন একজন কারিশমেটিক নেতৃত্ব। বিন্দুসারের ১৬ জন স্ত্রী ছিলো, এই ১৬ জন স্ত্রীর ছিলো সর্বমোট ১০০টি পুত্র। অশোক ছিলেন এই একশো জনের মধ্যে একজন। অশোক বিন্দুসারের জীবিত অবস্থায়ই তক্ষশীলার বিদ্রোহ দমাতে সক্ষম হন। তাছাড়া বিন্দুসারের সেনাবাহিনীতে অশোকের ভালোই জনপ্রিয়তা ছিলো। তক্ষশীলার বিদ্রোহ দমানোর পর অশোক তক্ষশীলার দায়িত্বেই থেকে যান। কিন্তু বিন্দুসারের মৃত্যুর পর অশোকের মধ্যেও পুরো মগধের সম্রাট হওয়ার এক তীব্র লালসা জন্মাতে শুরু করে। অন্যদিকে নিয়মতান্ত্রিক উপায় কিংবা সরল পথে হাঁটলে এ উদ্দেশ্য সাধন হবে না অশোক তা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারলেন। তাহলে কী করা যায়? অনেক চিন্তা করতে করতে অশোক এক পর্যায়ে হাতে নিলেন ঝকঝকে তলোয়ার। হত্যা করতে লাগলেন একের পর এক ভাইকে। তখন অশোকের বয়স মাত্র ১৮। এই ১৮ বছরের ছেলে বীতাশোক নামক এক ভাইকে বাদ দিয়ে নির্দয়, নিষ্ঠুরের মতো বাকি সব কয়টা ভাইকে হত্যা করেন। যদিও এই হত্যা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কিন্তু এই হত্যা ছাড়া পুরো মৌর্য সাম্রাজ্যের উপর একক আধিপত্য বিস্তার করার আর কোনো পথও তখন সম্রাট অশোকের সামনে খোলা ছিলো না। সুসীম নামক ভাইকে (সিংহাসন দখলে অশোকের অন্যতম প্রতিদ্বন্ধী ও বিন্দুসারের খুব পছন্দের পাত্র) জলন্ত কয়লা ভর্তি গর্তে ফেলে দিয়ে হত্যা করেন। মগধ রাজ্য নিয়ে এরকম টানা হেঁচড়া ও রক্তারক্তি চলে টানা তিন বছর। এই তিন বছর ধরে বিন্দুসারের পরিবার জুড়ে চলতে থাকে মৃত্যুর মিছিল। এরকম রক্তারক্তির অবসান ঘটে খ্রিষ্ট পূর্ব ২৬৯ সালে। মৌর্য সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন সম্রাট অশোক। যার সিংহাসনে আরোহণের পেছনে রয়েছে নিজের ৯৮ জন ভাইয়ের লাশ। এখানে উল্লেখ্য, অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধ জয়ের আগ পর্যন্ত বৈদিক রীতিনীতির অনুসারী ছিলেন।


সম্রাট অশোক চাণক্যের মতো অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর সহযোগিতা না পেলেও চাণক্যের চিন্তা ভাবনা তখনো পুরো শাসন জুড়ে বিরাজিত ছিলো। তৎকালীন রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে নজর দিলে চাণক্যের নিয়ম নীতিগুলোই আমরা দেখতে পাই। পুরো ভারতবর্ষকে একই শাসনের অধীনে রাখা মূলত চাণক্যের কৌশলেরই প্রতিফলন।
সম্রাট অশোক নিজেও খুবই কৌশলী ছিলেন বিধায় খুব সুশৃঙ্খলভাবে তিনি পুরো মগধ শাসন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু সিংহাসন লাভের পর এবার নতুন লোভ পেয়ে বসলো অশোককে। আর সেটা হলো সাম্রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি। বর্তমান উড়িষ্যা অর্থাৎ তৎকালীন কলিঙ্গ তখনো মৌর্য সাম্রাজ্যের বাইরে ছিলো। অশোক কলিঙ্গ জয়ে অগ্রসর হলেন। সিংহাসনে আরোহণের মাত্র কয়েক বছরের মাথায় (খ্রিষ্ট পূর্ব ২৬০/২৬১ সালে) অশোক কলিঙ্গ আক্রমণ করেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয় কলিঙ্গে। যুদ্ধটি হয় মূলত দয়া নদীর তীরে। কলিঙ্গবাসীও বেশ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলো। কিন্তু কলিঙ্গকে আর তারা রক্ষা করতে পারেনি। কলিঙ্গ চলে যায় সম্রাট অশোকের দখলে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এরকম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কথা খুবই কম শোনা যায়। এ যুদ্ধে অশোক ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তার পুরো সেনাবাহিনী নিয়ে। সেই সময় অশোকের সেনাবাহিনীতে ৪ লক্ষের বেশি সৈন্য ছিলো। যুদ্ধে এই চার লক্ষের মধ্যে এক লক্ষই মারা যায়। অন্য দিকে ঠিক প্রায় একই পরিমান কলিঙ্গ যোদ্ধাও মারা যায়। সম্রাট অশোক যুদ্ধের পরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছদ্মবেশে বেড়াতে থাকেন, কিন্তু কান্না ছাড়া আর কিছুই তার চোখে পড়ে না। বৃদ্ধা মা তার মৃত পুত্রের লাশ নিয়ে কাঁদছে, অসহায় ছেলে তার পিতার লাশ নিয়ে কাঁদছে, গৃহবধু তার স্বামীর লাশ নিয়ে কাঁদছে। সব দিকে শুধু লাশের মিছিল। তার উপর যুদ্ধে হা-হাড়ানো, পা হারানো, চোখ হারানো আহতদের কান্না তো আছেই।
প্রশ্ন জাগতেই পারে, কী কারণ ছিলো এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পেছনে? অশোকই বা এত বড়ো সা¤্রাজ্যের মালিক হয়ে কেন কলিঙ্গ জয়ে এতটা উঠে পড়ে লেগেছিলেন?



কলিঙ্গ যুদ্ধের কারণটা ছিলো মূলত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। কলিঙ্গ তখন ছিলো খুবই সমৃদ্ধ একটি রাজ্য। সমৃদ্ধ অঞ্চল দখলের প্রতি সব রাজারই একটা বিশেষ নজর থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এরকম আকর্ষণ থেকেই অশোকের বাবা বিন্দুসার ও দাদা চন্দ্রগুপ্ত দুজনেই কলিঙ্গ আক্রমণ করেন, কিন্তু দুঃখজনকভাবে পরাজিত হন। তারপর অশোক বাপ দাদার ইচ্ছা পূরণ এবং নিজ রাজ্যের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা বিবেচনা করে কলিঙ্গ আক্রমণ করেন। অর্থাৎ কলিঙ্গ যে আগে থেকে একটা সমৃদ্ধ জনপদ ছিলো তা সহজেই অনুমেয়। তাছাড়া কলিঙ্গ যে সামরিক দিক দিয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠছিলো সেটা স¤্রাট অশোকের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কলিঙ্গ যুদ্ধের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখলে কলিঙ্গের সামরিক সক্ষমতা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। প্লিনির বিবরণ অনুযায়ী, এ সময়ের কলিঙ্গে ৬০,০০০ পদাতিক, ১,০০০ রথারোহী ও ৭০০ রণহস্তী বিশিষ্ট এক শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ছিলো। যুদ্ধ জয়ের পর অশোক কলিঙ্গের দেড় লক্ষ সৈন্য বন্দি করেন, এক লক্ষ যুদ্ধে নিহত হয় (মৌর্য বাহিনীরও সম পরিমাণ সৈন্য নিহত হয়েছিলো), ব্যাপক তান্ডব লীলার ফলে কলিঙ্গের বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতিও হয়। যুদ্ধের সকল হিং¯্রতাকে ভোগ করতে থাকে কলিঙ্গের সাধারণ মানুষ জন। পুরো কলিঙ্গ শুধু মৃত্যু পুরীতে পরিণত হয়েছিলো তা নয়, সাধারণ মানুষের হাহাকার কলিঙ্গের সমগ্র প্রকৃতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলো।
এই কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্রাট অশোক থেকে শুরু করে পুরো ভারতবর্ষের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে। যে অশোক নির্বিঘেœ নিজের ভাইদের একের পর এক হত্যা করে মগধের সিংহাসন লাভ করেছিলেন- কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা তার মনের বরফকে গলিয়ে দেয়। অশোক এক চরম মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে থাকেন। এ কী করলেন তিনি! আদৌ কি তিনি এরকম তান্ডবলীলা চালানোর অধিকার রাখেন? এরকম অসংখ্য চিন্তা অশোককে ভেতরে ভেতরে পিষতে থাকে। অশোকের বোধোদয় ঘটে। অশোক পাল্টে ফেলেন তার জীবনের গতি ধারা। গৌতম বুদ্ধের বাণী এ সময় অশোককে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে। অশোক দীক্ষিত হন বৌদ্ধ ধর্মে। যার প্রমাণ পাওয়া যায় ত্রয়োদশ শিলালিপিতে। সেই শিলালিপির বর্ণনা অনুযায়ী- কলিঙ্গ জয় করে দেবতাদের প্রিয় অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন। কারণ একটি স্বাধীন দেশ জয় করার সময় মানুষের হত্যা, মৃত্যু ও নির্বাসন প্রত্যক্ষ করে দেবতাদের প্রিয় অতিশয় কষ্ট পেয়েছিলেন।
সম্রাট অশোক যে সময় বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন তা ছিলো গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর ২২৪/২২৫ বছর পরের ঘটনা। বৌদ্ধ ধর্ম তার সৃষ্টির সময় উদ্দেশ্য থেকে গৌতম বুদ্ধের সময়কালেই বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিলো তা আমরা আগেই দেখেছি। পরবর্তীতে এই ধর্মের প্রধান কেন্দ্র বৌদ্ধ সংঘগুলোও ব্যাপক হারে দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু এই দুর্নীতি অধিকাংশ মানুষের কাছেই ছিলো অজানা। সব সময় ভিক্ষুরা নির্বাণ লাভ নামক এক ভাববাদী জগতে মানুষকে বেশ ভালোভাবে ডুবিয়ে রাখতে পারতেন। তাছাড়া গৌতম বুদ্ধ তখনো সাধারণ মানুষের কাছে এক মুক্তির প্রতীক হিসেবেই বিবেচ্য ছিলেন। কিন্তু সমস্যাটা বাঁধলো যে জায়গায় তা হলো ধর্মের বিস্তৃতি। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিলাসী জীবন যাপন আর সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারলো না। বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও হিন্দু ধর্মের ব্রাহ্মণদের মতো সমাজের একটি সুবিধাবাদী শ্রেণী হিসেবে আবির্ভূত হয়।
এমন সময়ে সম্রাট অশোকের বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ পুরো বৌদ্ধ ধর্মের মোড় পাল্টে দেয়। সম্রাট অশোক দূত পাঠিয়ে বিভিন্ন রাজ্যের রাজাদের নিকট যুদ্ধ নয়, শান্তির বাণী পাঠাতে লাগলেন। অশোকের পৃষ্টপোষকতায়ই এশিয়ার বিভিন্ন রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারিত হয়। অশোকই নিজ উদ্যোগে তার পুত্র মহেন্দ্র এবং কন্যা সংঘমিত্রাকে শ্রীলংকায় পাঠান বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করার জন্য। এরপর অর্থাৎ কলিঙ্গ যুদ্ধের পরবর্তী শিলালিপিগুলো ঘাঁটলে অশোককে একজন উদার স¤্রাট হিসেবেই আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখতে পাই। একটি শিলালিপিতে স¤্রাট অশোক বলার চেষ্টা করেছেন- আজ যদি কলিঙ্গ যুদ্ধে যত লোক নিহত হয়েছিলো বা নির্বাসিত হয়েছিলো তার এক শতাংশ মানুষের ভাগ্যেও অনুরূপ বিপর্যয় ঘটে , দেবতাদের প্রিয় তাহলে প্রচন্ড কষ্ট পাবেন।
মূল কথা হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার পরেও স¤্রাট অশোকের রাজত্বকালে পুরো সা¤্রাজ্য জুড়ে ভিন্ন ধরনের শোষণ বিরাজিত ছিলো। যা কয়েকটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই আমরা বুঝতে পারবো। প্রথমত, মৌর্য সা¤্রাজ্যের মতো এই সুবিশাল সা¤্রাজ্যকে কোনো ভাবেই উদার নীতি গ্রহণ করে টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিলো না। তাহলে যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো শক্তির হাতে পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। অশোক কলিঙ্গ জয়ের পর যখন অনুতপ্ত হলেন তখন কিন্তু তিনি কলিঙ্গবাসীকে তাদের রাজ্য ফিরিয়ে দেন নি। তাছাড়া যে মানুষগুলোর কান্না হাহাকার অশোকের মতো রক্তপিপাসুর মনের বরফ গলিয়েছিলো সেই মানুষগুলোকে অশোক বুদ্ধের একরাশ বাণী ছাড়া দৃশ্যমান আর কিছুই দেন নি। তিনি সাধারণ মানুষের মাথার উপর থেকে মাত্রাতিরিক্ত শোষকমূলক করের পরিমাণ বিন্দুমাত্র কমান নি। চাণক্যের অর্থনৈতিক ফর্মুলাগুলো অশোক বেশ সুচারোভাবে প্রয়োগ করে গেছেন বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার পরেও। চাণক্যের অর্থনীতি দরিদ্রকে নতুন নিয়মে বিশেষভাবে শোষণ করার নিয়ম নীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে এটা সত্য, যুদ্ধের পথ পরিহার করে শুধুমাত্র বিভিন্ন অঞ্চলের রাজাদের শান্তির আহ্বান জানালেই সবাই শান্তির ডাকে সাড়া দিবে (কোনো প্রকার ষড়যন্ত্র ছাড়াই!) সেরকম কোনো পরিস্থিতিই তখন ছিলো না। সেজন্য লিপিগুলোতে উদারতার কথা বললেও অশোক তার গুপ্তচর সংস্থা বিলোপ করেন নি। কিংবা মৌর্য সা¤্রাজ্যে তার নিরঙ্কুশ আধিপত্য বজায় রাখতে যেখানে হিং¯্র হওয়া প্রয়োজন সেখানেও অশোক পরিচয় দিয়েছেন চরম হিং¯্রতার।
অশোকাবদান (২য় শতাব্দীর দিকে রচিত অশোকের জীবন সম্বন্ধীয় গ্রন্থ। মথুরা অঞ্চলের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এই গ্রন্থটি রচনা করেন) গ্রন্থ অনুসারে সম্রাট অশোকের নির্দেশ অনুযায়ীই পুন্ড্রবর্ধন অঞ্চলে বসবাসকারী সকল আজীবীক সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যা করেন। সেই মানুষের সংখ্যা শুনলেও আঁতকে উঠতে হয়- প্রায় ১৮,০০০। তখন সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত এক খাঁটি পুরুষ। সেই খাঁটি পুরুষটি অনায়াসে ১৮,০০০ মানুষ হত্যা করতে পারেন। এটাই হলো ইতিহাস!

অশোক সম্পর্কে আমরা পরিস্কারভাবে জানতে পারি জেমস প্রিন্সেপের কারণে। জেমস প্রিন্সেপ (১৭৯৯-১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির প্রধান। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি নিয়ে ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রিন্সেপ কলকাতায় আসেন। এই প্রিন্সেপই ভারতীয় প্রতœতত্ত্বকে নব জীবন দান করেন। অশোক তার ধর্ম উপদেশগুলো ইলাহাবাদ, দিল্লি ও বিহারের স্তম্ভগুলোর গায়ে লিখে রাখতেন। প্রিন্সেপের আগে কেউ এগুলো নিয়ে মাথা ঘামায় নি। প্রিন্সেপ এই লিপিগুলো দেখে বিশাল হোঁচট খান। কী লেখা থাকতে পারে এখানে? কী-ই বা এর নিগুঢ় রহস্য? প্রিন্সেপ মাঠে নেমে পড়লেন। শুরু করলেন কঠোর পরিশ্রম। সার্থকও হলেন। ১৮৩৮ সালের মধ্যে বেশ কিছু লিপির অনুবাদ করতে সক্ষম হলেন প্রিন্সেস। খুলতে থাকলো ভারতীয় ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায়ের জট। কারণ এর আগ পর্যন্ত এই ইতিহাসটা জানার জন্য আঠারোটা পুরাণের ঝাপসা ঝাপসা কিছু বর্ণনা ছাড়া আর কিছুই লোকজন জানতো না। তাছাড়া পুরাণগুলোর তথ্য নিয়েও ছিলো নানা মত, সম্রাট অশোকের নামটি কেবল পাওয়া যায় সেখানে, কিন্তু এই সম্রাট যে পুরো ভারতবর্ষ কাঁপিয়ে বেরিয়েছেন এক সময় সেটা কিংবা সেই রকম রাজা ও তার কর্মকান্ড সম্পর্কে কোনো কিছু সেখান থেকে জানা যায়নি। প্রিন্সেপ ইতিহাসের এক বিশাল অংশকে উন্মোক্ত করতে সক্ষম হন। প্রিন্সেপের পর তার শিষ্য আলেকজান্ডার কানিং হামও মৌর্য যুগের ইতিহাস উদঘাটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
এরই মাধ্যমে উঠে আসে ঐ সমাজের নিষ্ঠুর বাস্তবতার ছবি। মানুষজন কঠোর পরিশ্রম করে যে ফসল উৎপাদন করতো তার সিংহভাগ গিয়ে জমা হত মৌর্য সাম্রাজ্যের কোষাগারে। জনগণ যাতে এই শোষণের বিরুদ্ধে ফুঁসে না উঠে সেজন্য অশোক প্রত্যেক জনগোষ্ঠীকে সদুপদেশ দিতেন- রাজাকে পিতার মতো দেখতে, কারণ তিনি তাদের সন্তান জ্ঞান করেন।
প্রিন্সেপের উদ্ধার করা লিপিগুলোতে এ রকম অসংখ্য উক্তি পাওয়া যায় যা থেকে সেই সময়কার জটিল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আড়ালে লুকিয়ে থাকা শোষণ বেশ সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে।
এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছেন একান্ত নিজ উদ্যোগে। কিন্তু এই ধর্মকে ছড়িয়ে দিতে তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগারের যাচ্ছে তাই ব্যবহার করেছেন। অশোক ৮৪ হাজার বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই বিহারগুলো যে কী পরিমান জৌলুস দ্বারা আবৃত ছিলো সেগুলোর বর্তমান যে ধ্বংসাবশেষগুলো বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সেগুলোর দিকে চোখ রাখলেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাছাড়া বৌদ্ধ ভিক্ষুদের তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ ব্যয় করে খাবার দিতেন। তৎকালীন প্রায় ৬০ হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুকে অশোক নিয়মিত খাবার সরবরাহ করতেন। অর্থাৎ এই অর্থ সম্রাট অশোকের ব্যক্তিগত অর্থ ছিলো না। ছিলো সাধারণ জনগণের। এই অর্থ দিয়ে এই জনগণেরই উন্নতি সাধন করা উচিত ছিলো অশোকের। কিন্তু অশোক সেসব না করে যা করলেন তা-ই তাকে ইতিহাসে বৌদ্ধ ধর্মের কনস্ট্যানটাইন বানিয়ে দিলো। অন্যদিকে মৌর্য সা¤্রাজ্যের হতভাগা মানুষকেই বহন করতে হতো এসব কিছুর দায়ভার।
অর্থাৎ পুরো মৌর্য শাসন জুড়ে আমরা দেখতে পাই নতুন স্টাইলের এক দল শোষকের আবির্ভাব। যাদের একেক জনের প্রত্যাবর্তনের সাথে জড়িয়ে রয়েছে হাজারো চক্রান্ত- ষড়যন্ত্র, হাজার হাজার মানুষের কান্না। মৌর্য যুগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে ভারতবর্ষের অর্থনীতিতে। এ সময় পুরো ভারতবর্ষের অর্থনীতি নতুন রূপ লাভ করে। পুরো মৌর্য সাম্রাজ্যে একই ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (পড়সসড়হ বপড়হড়সরপ ংুংঃবস) চালু হয়। শুধু তাই নয় এই প্রথম পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে অভিন্ন মুদ্রা ব্যবস্থার (ংরহমষব বপড়হড়সরপ ংুংঃবস) চালু হয়। যা এত দিন ধরে চলে আসা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গতিপথকে পাল্টে দেয়।

মৌর্য যুগের ধর্মীয় প্রভাবটাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। মৌর্য যুগের পূর্বে গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীর বৌদ্ধ ও জৈন নামক যে দুটি ধর্ম মতের প্রভাব সৃষ্টি করেন মৌর্য যুগেও এই ধর্ম দুটির বেশ কিছু প্রভাব দেখা যায়। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তার জীবনের শেষ পর্যায়ে জৈন ধর্মে দীক্ষিত হন। চন্দ্রগুপ্তের ছেলে বিন্দুসার বেশ সচেতনভাবে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম দুটিকেই এড়িয়ে গেছেন। সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে সম্রাট সম্প্রতিকে জৈন ধর্ম গ্রহণ করতে দেখা যায়।

মৌর্য শাসনামলেই মূলত বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের চূড়ান্ত বিস্তৃতি ঘটে। তবে চন্দ্র গুপ্ত ও সম্প্র্রতি অশোকের মতো একেবারে রাজ কোষ ঢেলে দিয়ে ধর্ম প্রচারে মগ্ন না হওয়ায় জৈন ধর্মের বিকাশ অতটা হয় নি (তাছাড়া জৈন ধর্মের কৌশল গত কিছুু ব্যর্থতা তো ছিলোই যা ইতো মধ্যে আলোচনা করা হয়েছে)। তবে সম্রাট সম্প্র্রতি অনেকটা অশোক স্টাইলে দূত পাঠিয়ে পাঠিয়ে গ্রীস, পারস্য, মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন জায়গায় জৈন ধর্ম প্রচারের চেষ্টা করেন, যদিও তিনি তেমন একটা সফলতা লাভ করতে পারেননি।
মৌর্য শাসনামলেই রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যে বহুবিদ কর আরোহণের নিয়ম চালু হয়। ইতিহাস ঘাটলেই আমরা দেখি মৌর্য যুগে একেবারে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কৃষি জমিতে পানির সরবরাহের যাবতীয় ব্যবস্থা করা হয়ে ছিলো। কিন্তু এই সেবাটি দিয়ে তখন পানির উপর যে কর (ডধঃবৎ ঃধী) আরোপ করা হয়েছিলো সেই কর আরোপের কথা ইতিহাসে খুব সহজে পাওয়া যায় না। তাছাড়া ল্যান্ড ট্যাক্স (খধহফ ঃধী) নামক এক ধরনের ট্যাক্স আরোপ করা হয় শুধু মাত্র জমির উপর। বেশি উর্বরা জমির উপর এই ট্যাক্সের পরিমাণ ছিলো বেশি, কম উর্বরা জমির উপর এই ট্যাক্সের পরিমাণ ছিলো কম। এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জনগণের পকেট কাটা হতো। সবকিছু ছাপিয়ে এ সময় শিল্পের বিষয়টি ছিলো বেশ উল্লেখযোগ্য। প্রায় ১৮ ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ পাওয়া যায় মৌর্য যুগে।

অশোক মারা যান খ্রিষ্ট পূর্ব ২৩২ সালে। অশোকের মুত্যুর পর পরই মূলত ধস নামা শুরু করে পুরো মৌর্য সাম্রাজ্যে। অশোকের মুত্যুর পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে মোট ছয়জন সম্রাট মগধের সিংহাসনে বসেছেন। অশোকের পর তার ছেলে দশরথ, দশরথের পর স¯প্রতি, শালিমুক, দেববর্মন, শতধনবান ও বৃহদ্রথ মগধের সিংহাসনে বসেন। এদের মধ্যে শালিশুকের রাজত্বকলটাই ছিলো একটু বেশি- সর্বমোট তের বছর (২১৫- ২০২ খ্রিষ্ট পূর্ব)। বাকি আর কেউই তের বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেন নি।
দশরথ ছিলেন চতুর্থ মৌর্য সম্রাট। এই সময়ই মূলত মৌর্য সাম্রাজ্যে ভাঙ্গন শুরু হয়। এত দিনে কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে পুরোপুরি ভাবে।
মৌর্য সা¤্রাজ্যের চূড়ান্ত পতন ঘটে খ্রিষ্ট পূর্ব ১৮৫ সালে। চূড়ান্ত পতনের মূল হোতা ছিলো ঘরের শত্রু বিভীষণ। মৌর্য সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট বৃহদ্রথের নিজ সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ বৃহদ্রথকে হত্যা করে মগধের সিংহাসন দখল করে। এরই মধ্যে দিয়ে মৌর্য সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক পতন ঘটে এবং শুঙ্গ রাজবংশের উত্থান ঘটে।

মৌর্য সাম্রাজ্যের এই পতনের অন্যতম কারণ ছিলো এতদিন দাপটের জায়গায় একটু আড়ালে থাকা আর্যীয় ধারার ব্রাক্ষণ সম্প্রদায়ের ষড়যন্ত্র। আমরা জানি গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীরের উত্থানে পুরো আর্র্য শাসক গোষ্ঠীর এত দিনের ভন্ডামির বিরুদ্ধে যে শুধু আঘাত হেনেছিলো তা নয় এটি আঘাত হেনেছিলো পুরো আর্য সমাজের অর্থনীতির উপরও। যে মানুুষগুলোর বিশ্বাসকে পুঁজি করে তারা ধর্ম ব্যবসার পসরা সাজিয়ে বসেছিলো সেই মানুষগুলোর এক বিরাট অংশ এক প্রকার বিদ্রোহ করেই বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। ফলে একদিকে আর্যদের এতদিনের শোষণের পরিধিও থেমে যায়, কমে যায় সেই শোষণকে কেন্দ্র করে তাদের গড়ে ওঠা অর্থনীতির চালচিত্র। তার উপর বৌদ্ধ ধর্ম স্বয়ং অশোক দ্বারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ায় আর্যীয় রীতি নীতির বিকাশের রাস্তাও সহজ ছিলো না। কারণ বৌদ্ধ ধর্মকে ডিঙিয়ে যাওয়ার মতো অর্থ, রাজনৈতিক শক্তি, কিংবা আদর্শ কোনোটাই তাদের ছিলো না।
তারপর সমাজে আর্যদের ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রভাব অনেকাংশে কমে যায়। কিন্তু ব্রাহ্মণরাও সব সময় ওঁৎ পেতে থাকতো কোন সময় আবার সেই সোনালী সময় তাদের হাতে ধরা দিবে। সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পর (সম্রাট অশোকের সময় পর্যন্ত বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সাথে সরাসরি কোনো ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের বিরোধ লাগেনি। যে বৌদ্ধ কিংবা জৈন ধর্ম গ্রহণ করেনি সে নির্দ্ধিধায় ইন্দ্রসহ অন্যান্য বৈদিক মানুষরূপী দেবতার পূজা করে গেছে ।) ব্রাহ্মণদের কূট বুদ্ধিগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। এ ক্ষেত্রে তারা বেশ ভালো অস্ত্র হিসেবে পেয়ে যান বৃহদ্রথের সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ। তাকে ব্রাক্ষণরা সর্বতো ভাবে সহায়তা করেন মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটানোর জন্য। পুষ্যমিত্র শুঙ্গ বেশ ভালো করে সফলতা অর্জনও করলেন। সুতরাং মৌর্য সা¤্রাজ্যের পতনের পেছনে আমরা একটি ব্রাহ্মন্যবাদী ষড়যন্ত্র সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাই।

এভাবেই ধসে পড়ে ভারত কাঁপানো একটি সা¤্রাজ্যর, একটি রাজবংশের। এরপর আর মৌর্যরা ভারতবর্ষের বুকে দাঁড়াতে পারে নি।
লেখক
সৌরভ দাস
শিক্ষার্থী,
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০১৬ দুপুর ১:০৩
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আব্বাসীয় কুরাইশ বেশি যোগ্য

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৫




সূরাঃ ২ বাকারা, ১২৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
১২৪। আর যখন তোমার প্রতিপালক ইব্রাহীমকে কয়েকটি বাক্য (কালিমাত) দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন, পরে সে তা পূর্ণ করেছিল; তিনি বললেন নিশ্চয়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলমানদের বিভিন্ন রকম ফতোয়া দিতেছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩


আপন খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুফাতো বোনের বা ছেলের, মেয়েকে বিবাহ করা যায়, এ সম্পর্কে আমি জানতে ইউটিউবে সার্চ দিলাম, দেখলাম শায়খ আব্দুল্লাহ, তারপর এই মামুনুল হক ( জেল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জুমার নামাজে এক অভূতপূর্ব ঘটনা

লিখেছেন সাব্বির আহমেদ সাকিল, ১০ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০



মসজিদের ভেতর জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বাহিরে বিছিয়ে দেয়া চটে বসে আছি । রোদের প্রখরতা বেশ কড়া । গা ঘেমে ভিজে ওঠার অবস্থা । মুয়াজ্জিন ইকামাত দিলেন, নামাজ শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। হরিন কিনবেন ??

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৯



শখ করে বন্য প্রাণী পুষতে পছন্দ করেন অনেকেই। সেসকল পশু-পাখি প্রেমী সৌখিন মানুষদের শখ পূরণে বিশেষ আরো এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এবার মাত্র ৫০ হাজার টাকাতেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধখানা ভ্রমন গল্প!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৩৯


২০০২ সাল বান্দারবানের রিগ্রিখ্যাং-এর এই রিসোর্ট আজ সকালেই আমরা আবিস্কার করলাম! পাহাড়ের এত উপরে এই মোড়টাতে একেবারে প্রকৃতির মাঝে এমন একটা রিসোর্ট থাকতে পারে তা আমরা সপ্নেও কল্পনা করিনি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×