আমাদের দেশে করোনা ভাইরাস নিয়ে ফেসবুকে সবার মন্তব্য পড়ে একটা ঘটনা মনে পড়ছে। আমি তখন দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করি। দৈনিক মানবজমিন তখন নূতন রিপোর্টারদের জন্য ভালো একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। আমিও শিক্ষানবিশ রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করেছিলাম। কিছুদিন কাজ করার পর কাজকর্ম বুঝতে শুরু করি। অসংখ্য ঘটনার মধ্যে কোনটা রিপোর্ট, সেটাও বোধগম্য হতে শুরু করে। প্রথম দিকে সিনিয়ররাও বুঝতে সহায়তা করতেন। ইতোমধ্যে আমাদের পরে আরেকটি ব্যাচ যোগদান করলে আমিও সিনিয়র হয়ে যাই। একদিন চীফ রিপোর্টার নূতন এক রিপোর্টারকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, তাকে অ্যাসাইনমেন্ট দেবেন। তখন রূপপুরে পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে সারাদেশে বিতর্ক চলছে। খেয়াল করে দেখলাম, সবাই বিশেষজ্ঞ মতামত দিচ্ছেন। তখন আজকের মতো ফেসবুক ছিলনা। তবে আলোচনা শুনার কিছু স্থান ছিল। চায়ের দোকান, লোকাল বাস, ক্লাব আর রাস্তার পাশে জটলা। ওই সব আলোচনা দেখেই বুঝতে হতো- দেশে জনমত কোন দিকে। যাই হোক, রিপোর্টারকে বললাম, আপনি তো জানেন, এখন পারমানিবক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে আলোচনা সমালোচনা চলছে। আপনাকে এর ওপর কাজ করতে হবে। কমপক্ষে বিশজন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোকজনের সাথে কথা বলতে হবে। তাদের বক্তব্যগুলো নোট করে নিয়ে আসতে হবে। তবে যিনি কথা বলবেন, অবশ্যই তাদের ডিটেল জেনে নেবেন। তারা কী করেন, বয়স কত, ঠিকানা কোথায় এসব প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নিতে হবে।
সকালে ওই অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলাম। বিকালে দেখলাম রিপোর্টার আমার মতোই যথারীতি অফিসে ফিরেছেন। আমি নিজের রিপোর্ট জমা দিয়ে দেখলাম ওই রিপোর্টারও তার রিপোর্ট আমার কাছে দিলেন। চমৎকার লিখেছেন। রিপোর্ট দেখেই বুঝা যায়, রিপোর্টার অনেক কষ্ট করেছেন। লিখেছেনও চমৎকার। বিশজন প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকারীর নাম ঠিকানা পেশা এবং তাদের মতামতসহ রিপোর্ট। পড়ে দেখলাম, পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, রিকশাওয়ালা, চায়ের দোকানদার, কলেজ ছাত্র, গৃহবধু, সরকারি বেসরকারি চাকরিজীবী! কে নেই। পক্ষে বিপক্ষে সব ধরণের মতামতই আছে। যুক্তিও আছে।
রিপোর্টারের কাছে জানতে চাইলাম, এখানে যারা বক্তব্য দিয়েছেন, তাদের কারোরই তো পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিষয়ে টেকনিক্যাল জ্ঞান নেই। একথা স্বীকার করে কেউ কী প্রতিক্রীয়া না দেয়ার কথা জানিয়েছিলেন? রিপোর্টার বললেন, না। উল্টা তারাই আগ্রহ সহকারে কথা বলেছেন। এবার রিপোর্টারকে বললাম, আসলে একটা বিষয় বাস্তবে ধারণা লাভের জন্য আপনাকে এই অ্যাসাইনমেন্টটা দিয়েছিলাম। পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো হাইলি একটি টেকিনিক্যাল বিষয়ে যে দেশের সাধারণ মানুষও বিশেষজ্ঞের মতো বক্তব্য দেয়, সেদেশে সাংবাদিকতা করতে কতটুকু সতর্ক থাকতে হবে- তা বুঝার জন্যই আপনাকে পাঠিয়েছিলাম। এদেশে সবাই বিশেষজ্ঞ। সবাই সব বিষয়ে জ্ঞানী। শুধু জ্ঞানী বললেও ভুল হবে- সেই জ্ঞানের উপর নির্ভর করে অন্যকে কী করতে হবে বা হবেনা তাও বাতলে দেন। এক্ষেত্রে তাদের আত্মবিশ্বাসটাও দেখার মতো। পৃথিবীর কোন দেশের মানুষ এরকম পাবেন কী না জানিনা। তবে এদেশে পাবেন। এজন্য এদেশে সাংবাদিকতা করতে হলে অনেক সতর্ক হতে হবে। যে কেউ আত্মবিশ্বাসের সাথে ভুল ইনফরমেশন দিয়ে আপনাকে বিভ্রান্ত করবে। এটা আমাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য।
ফেসবুক থাকায় এখন বিষয়টা পরিস্কার। বিশ্বাস না হয় আপনার ফেসবুকের ফ্রেন্ডলিস্টের বন্ধুদের স্টাটাস চেক করতে পারেন। দেখবে করোনা ভাইরাস নিয়ে তারা বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়ে যাচ্ছেন। কেউ বলছেন, এটা বাতাসে উড়ে। কেউ বলছেন, গরমে মরে। কেউ বলছেন, বাতাস দুষিত, একারণে বাংলাদেশে ভাইরাস মরে যাচ্ছে। ফেসবুকে হাজার হাজার ভিডিও। আমার প্রশ্ন হলো- আপনারা কী ভাইরোলজি নিয়ে কাজ করেন? না কী এ বিষয়ে আপনার পড়ালেখা বা প্রাকটিস আছে? এই যে বিশেষজ্ঞ মতামত- এটা একটা উদাহরণ মাত্র।
শুধু কী করোনা ভাইরাস নিয়ে সাধারণ মানুষ বিশেষজ্ঞ মতামত দিচ্ছেন! বিষয়টি তা নয়। এখন দেশে সবচেয়ে যে বিষয়টা নিয়ে সরগরম আলোচনা চলে সেটা হলো ধর্ম। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতরাও এখন আলেমদের সমালোচনা করেন। তার ভুল ধরতে যান। গালাগালি করেন। অন্য ধর্মের ভুল ধরতে যান। কথায় কথায় কোরআন হাদিসের এমন কিছু উল্লেখ করেন যা কোরআন হাদীসে নেই। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো- অনেক উচ্চ শিক্ষিত মানুষকেও কনফিডেন্সের সাথে বলতে দেখেছি যে, আল্লাহর নবী বলেছেন, জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজন হলে সুদূর চীন দেশে যাও। আমি হাদীস শাস্ত্রে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেছি। কোথাও এরকম কিছু পাইনি। ধর্ওমবেত্তাদেরও বলতে শুনেছি, এটা ভুয়া। অথচ আমাদের শিক্ষিত সমাজ অহরহ এটা বলে যাচ্ছেন। তার মানে তারা নবী যা বলেননি তা তার নামে বলে দিচ্ছেন। মানে রাসুলের নামে মিথ্যা কথা বলছেন। এজন্য না জেনে শুনে বিশেষজ্ঞ মতামত দেয়ার আরেক নাম হলো মিথ্যা বলা। আপনি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত। বাংলায় বা আরবীতেই হোক কোরআন শরীফ পড়েছেন। একটা আয়াত পড়েছেন। আপনি জানেন না এটা নাছেখ না মানসুখ আয়াত। এর শানে নুযুল কী। হুট করে বলে দিলেন। আবার তার উপর অটল থাকলেন। অথচ এমনও তো হতে পারে, এটা ইসলামের প্রাথমিক যুগের একটা আয়াত। পরে আরেকটা আয়াত নাযিল হয়ে রহিত হয়েছে। মদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে ধাপে ধাপে। এগুলো না জেনে কথা বললে শুধু নিজেই বিভ্রান্তই হবেন না অন্যকেও বিভ্রান্ত করবেন। ইসলামে এর সুযোগও নেই।
যা বললাম, এগুলো আসলে উদাহরণ মাত্র। আমাদের চারপাশে দেখলে এমন বহু বিষয় দেখতে পাওয়া যাবে। অশিক্ষিত মানুষগুলো এরকম করলে না হয় মানা যায়, শিক্ষিত মানুষগুলোর এমন আচরণ মানা যায়না। আসুন, বিষয়টা সম্পর্কে না জেনে কোনরূপ মন্তব্য না করি। কোন টেকনিক্যাল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান না থাকলে বিশেষজ্ঞ মতামত না দেই। নিজেকে আহাম্মক প্রতিপন্ন না করি। বরং বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে জেনে নেই।
দক্ষিণ কোরিয়া
৬ মার্চ ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৫:০৭