ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কথা ছিল, বাংলাদেশের সম্মতি ছাড়া এ বাঁধের কাজ শুরু করা হবে না। ভারত সে কথা রাখেনি। বাংলাদেশকে অবহিত না করে কিংবা সম্মতি না নিয়েই বাঁধের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। এ ব্যাপারে উভয় দেশের মধ্যে একটি কমিটি করা হয়েছিল। কমিটির কাজ ছিল, বাঁধের কারণে বাংলাদেশ কি ধরনের ক্ষয়ক্ষতির কবলে পড়তে পারে তা খতিয়ে দেখা। কমিটির মাত্র দুটি বৈঠক হয়েছে। তারপর আর হয়নি। বন্ধ হয়ে গেছে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণসংক্রান্ত সমীক্ষার কাজও। ভারত যে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে আমাদের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বা সরকারের কোনোউদ্বেগ আছে, সেটা বোঝার উপায় নেই। এ বিষয়ে একটা বিস্ময়কর নীরবতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধকে যেমন বাংলাদেশের জন্য মরণফাঁদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, তেমনি টিপাইমুখ বাঁধকেও অনুরূপআরেকটি মরণফাঁদ বলে মনে করা হয়। গঙ্গায় ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে একতরফা পানি প্রত্যাহার করে ভারত বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে এবং পরিবেশগত দিক দিয়ে মহাবিপর্যয়ের মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। এই বাঁধের কারণে বাংলাদেশ কি ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ও বিপর্যয় মোকাবিলা করছে তা কারো অজানা নেই। ফারাক্কা বাঁধের কারণে গঙ্গা বেসিন পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। পদ্মা ও গঙ্গার পানির ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীল নদীগুলো শুকিয়ে গেছে। এ কারণে একদিকে মরুপ্রক্রিয়া অন্যদিকে লবণাক্ততার বিস্তার শুরু হয়েছে। উৎপাদন, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, টিপাইমুখ বাঁধ হলে মেঘনা বেসিনও পানিশূন্য হয়ে পড়বে। এর ফলে সিলেটসহ দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল চরম বিপন্ন দশায় পতিত হবে। বাংলাদেশের মানুষ তাই এই ‘দ্বিতীয় মরণফাঁদের’ বিরোধিতায় বরাবরই সোচ্চার। এ ব্যাপারে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত দুঃখজনক। একদিকে ভারত বন্দনা, অন্যদিকে নীরবতা, এই বাস্তবতার প্রেক্ষিতেই টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ভারত।
সিলেট জেলার পূর্ব সীমান্ত অমলসিদ থেকে একশ’ কিলোমিটার উজানে মনিপুর রাজ্যের টিপাইমুখ গ্রামে বরাক ও টুইভাই নদীর সংগমস্থলে এই বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। শুধু টিপাইমুখ বাঁধ নয়, ভাটিতে ফুলের তলায় আরও একটি ব্যারাজ নির্মাণের কাজ করছে ভারত। বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের কথা বলা হলেও, এই সঙ্গে পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনাও তার রয়েছে। টিপাইমুখ বাঁধে ১৬ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি ধরে রাখা হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর সেই পানি ছেড়ে দেয়া হলে ফুলেরতলা ব্যারাজের মাধ্যমে সেচের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে। এতে বাংলাদেশ পানি থেকে বঞ্চিত হবে। বাংলাদেশের সুরমা ও কুশিয়ারা বরাকের পানির ওপর নির্ভরশীল। টিপাইমুখ বাঁধ ও ফুলেরতলা ব্যারাজের মাধ্যমে পানি সরিয়ে নিলে সুরমা-কুশিয়ারা পানিশূন্য হয়ে যাবে। আবার এই ধরে রাখা পানি যদি এক যোগেছেড়ে দেয়া হয় তাহলে সিলেটসহ হাওর অঞ্চল ভেসে যাবে। সবচেয়ে গুরুতরআশংকার দিক হলো, টিপাইমুখ বাঁধ এলাকা ভূমিকম্পনপ্রবণ এলাকার মধ্যে পড়ে। বলা হয়েছে, বাঁধটি তাইথু বিচ্যুতি রেখার ওপর পড়েছে। এ এলাকায় উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের নজির রয়েছে। বাঁধটি ভূমিকম্পের কবলে পড়লে সংশ্লিষ্ট এলাকা তো বটেই, বাংলাদেশও এ কারণে ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হবে।
জন, পরিবেশ ও বাংলাদেশের মহাবিপর্যয় ডেকে আনবে যে বাঁধ তা নির্মিত হতে পারে না। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য এবং পরিবেশবাদী সংগঠন এই বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে জোরালো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরও ভারত এসবের কোনো তোয়াক্কা না করে বাঁধ নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের প্রেক্ষাপটে ভারতের শীর্ষ নেতৃপর্যায় থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল, বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন উদ্যোগ ভারত টিপাইমুখে নেবে না। এটা যে কথার কথা মাত্র তা বিশদ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমান সরকার ভারতকে চাইবামাত্র সব কিছুই দিয়েছে। বিনিময়ে কিছুই পায়নি। এমনকি টিপাইমুখ নির্মাণ বন্ধ করতে পারেনি। টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ বিভিন্ন সময়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে, লংমার্চ করেছে। এই গণবিক্ষোভ ও প্রতিবাদকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। বিরোধীদলও এ ব্যাপারে এক ধরনের নীরবতা অবলম্বন করে যাচ্ছে। এমতাবস্থায়, জনগণকে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে হবে। পরিবেশবাদী ও নাগরিক সমাজের তরফেও জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ প্রতিবাদী ভূমিকা রাখতে হবে। টিপাইমুখ বাঁধের সঙ্গে বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত। প্রয়োজনে এই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সূত্রঃ Click This Link