বাংলাদেশে মধ্যম আয়ের দেশে উঠে এসেছে এটি আমাদের জন্য একটি গর্বের বিষয় । চারিদিকে তাকালেই এই উন্নতির চিত্র চোখে পরে । বিদেশিরা বা দাতারাও আমাদের প্রশংসা করতে বাধ্য হচ্ছে । অর্থনৈতিক উন্নয়নের জোয়ার শহর ছাড়িয়ে গ্রামে গঞ্জেও পৌঁছে গেছে । আগে পুরো গ্রামে ছিল একটি দালান বাড়ি দু চারটে টিনের ঘর । আর এখন সে চিত্র পাল্টে গিয়ে অগুনিত দালান কোঠা আর টিনের ঘরে ভরে গেছে গ্রাম । এটি মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র বলেই গণ্য করা যায় । মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের পাশাপাশি বিনোদনের জন্য ও মানুষ অর্থ কড়ি খরচ করছে ।
গ্রাম আর গ্রাম নেই । গ্রামে লেগেছে শহরের ছোঁয়া । ঘরে ঘরে শোভা পাচ্ছে টেলিভিশন । নাটক সিনেমায় মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পরেছে । দেশের গণ্ডি পেরিয়ে হলিউড,বলিউড এর ছবি চলছে গ্রাম গঞ্জে । বিড়ির চল উঠে গিয়ে জায়গা করে নিয়েছে বিভিন্ন ব্রান্ডের দেশি বিদেশি টোবাকো আর পানিয় । সবই যে হচ্ছে দেশের অথনৈতিক উন্নয়নের জন্য এ আর বলার অপেক্ষা রাখে না ।
এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে সকলের অজান্তেই একটি নীরব পরিবর্তন ঘটে চলেছে । বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবছে কিনা বলতে পারবো না । বিষয়টি নিয়ে লেখার জন্যই আমার এই দীর্ঘ ভূমিকার অবতারণা ।
অর্থনৈতিক এই উন্নয়নের ফলে মানুষ কর্ম বিমুখে হয়ে পরছে । ধীরে ধীরে ঝুঁকে পরছে কি করে অল্প পরিশ্রমে বেশি আয় করা যায় সেই দিকে। যেহেতু মানুষের আয় এবং খরচ এর পরিমাণ বেড়ে গেছে সেই সুযোগটাই সবাই ব্যবহার করছে । চলুন একটু ব্যাখ্যা করে দেখা যাক ।
লাজ্জাতুল নামের আমার এক পরিচিতা স্কুল শিক্ষিকা তার বাসায় গৃহ কর্মী নিয়োগ দিয়েছেন যার মাসিক বেতন খাওয়া দাওয়াসহ ধরা হয়েছে "দশ হাজার টাকা" । টাকার অঙ্ক শুনে অনেকে হয়তো অবাক হচ্ছেন ? আমিও অবাক হয়েছিলাম । যেখানে এখনও অফিস আদালতে চাকরী করা অনেক মানুষের মাসিক আয় এর চেয়ে কম বা কিছু বেশি । সেখানে একজন গৃহ কর্মীর জন্য দশ হাজার টাকা একটু বেশিই বৈই কি । এমন নয় যে, ঐ বাসায় অনেক লোক, অনেক কাজ । বাসায় লাজ্জাতুলের অসুস্থ শাশুড়ি,হ্যাজবেন্ড এক ছেলে, এক মেয়ে । মোটা মানুষের সংখ্যা পাঁচ জন ।
যে গৃহ কর্মী রাখা হয়েছে সে সকাল থেকে ৬ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ পর্যন্ত কাজ করবে । তার কাজের মধ্যে রয়েছে মূলত অসুস্থ শাশুড়িকে দেখাশোনা করা,কাপড় চোপর ধোওয়া,রান্না করা । লাজ্জাতুলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাজের লোক না পেয়ে একান্ত বাধ্য হয়েই এই গৃহ কর্মীকে নিয়োগ দিতে হয়েছে ।
একটু খোজ খবর নিয়ে বুঝতে পারলাম । ঢাকা শহরে আসলেই তীব্র গৃহ কর্মীর সংকট চলছে । বাসা বাড়িতে কাজ করার মতো লোক পাওয়া যাচ্ছে না বলা চলে । যারা কাজ করছে তাদের ও ডিমান্ড অনেক বেশি । বিনোদনের সকল উপকরণ দেখার সুবিধা, সেই সঙ্গে স্নো, পাউডার,লিপিষ্টিক পর্যন্ত তাদের কিনে দিতে হয় ।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সকল কিছু ওতপ্রোত ভাবে জড়িত । মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির ফলেই বাসা বাড়িতে কাজ করার লোক কমে গেছে । গ্রামের লোকজন শহর মুখো হলেও মেয়েরা বেছে নিচ্ছে গার্মেন্টস আর পুরুষেরা বেশে নিচ্ছে রিকসা । রিকসা একটু পরিশ্রমের কাজ হলেও অল্প পরিশ্রমে বেশি আয় করা যাচ্ছে । এ কারণেই ঢাকা শহরে হঠাৎ করে বেড়ে গেছে রিকসার সংখ্যা । বিভিন্ন ভাবে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে রিকসার মালিকেরা নামে, বেনামে দশ,বারোটা,বিশটা করে রিকসা নামিয়ে দিচ্ছে শহরের রাস্তায় । চালাবার লোকের অভাব নেই । গ্রাম থেকে মানুষ আসছে । রিকসা নিয়ে নেমে যাচ্ছে । তিন মাস পর পর গ্রামে গিয়ে ঠাট ভাট করে,বাবু সেজে সেই টাকা খরচ করে আসছে ।
নগদ টাকা পাওয়া যায় বলে কৃষিকাজ বা অন্য কোন পেশা থেকে এই পেশাটাই মানুষের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছে । নগদ টাকা আর কারো অধীনে থাকতে হয় না বলে গ্রামের মানুষ শহরে এসে রিকসাই বেছে নিচ্ছে । ফলে গ্রামেও চলছে কাজ করার লোকের অভাব । ক্ষেতে খামারে কৃষি কাজ বা অন্য কোন কাজের জন্য লোক পাওয়া দুস্কর হয়ে পরেছে । কল-কারখানায় কাজ করার মানুষের সংখ্যাও কমছে দ্রুত হারে । অনেক জায়গায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কল-কারখানা শ্রমিকের অভাবে ।
রিকসার ভাড়ার ব্যাপারে কোন নিয়ম নীতি না থাকায় রিকশা চালকের যে যার মতো ভাড়া আদায় করছে । অদক্ষ এই সকল চালকদের জন্য প্রতিদিন শহরে অনেক দুর্ঘটনা ঘটছে । ঢাকা শররের বর্তমান জ্যাম এর কারণ হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত রিকশা । এই রিকশা চালকেরাই শারীরিক ভাবে রিকসা চালাতে অক্ষম হয়ে পরলে তখন পেশা হিসাবে বেছে নিচ্ছে ভিক্ষা । একটু বয়স্ক মহিলা,পুরুষ বা অলস প্রকৃতির মানুষ পেশা বেছে নিচ্ছে সেটা হচ্ছে, ভিক্ষা বৃত্তি ।
এই কারণে ঢাকাসহ অন্যান্য নগরীতে এখন ভিক্ষুকের সংখ্যা চোখে পরার মতো । দিনকে দিন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে ভিক্ষুক আর ভবঘুরে লোকের সংখ্যা । উপরের দুটি পেশার মতো এটিও বিনা পুঁজিতে করা যায় । সরকার বেশ কয়েকবার নগরীগুলোকে ভিক্ষুক মুক্ত করার চেষ্টা করলেও সে প্রচেষ্টা কাজে লাগেনি ।
এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে, বিদেশে গৃহ কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে হাজার হাজার লোকের সারা পেলেও দেশে মানুষ গৃহ কর্মী বা কল-কারখানার শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করছে । অথচ মালয়েশিয়া, সৌদি গিয়ে তারা যে অমানুষিক পরিশ্রম করছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না ।
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ধরে রাখতে হলে চাই যোগ্য কর্মী বাহিনী গড়ে তোলা । তা না হলে যোগ্য ও দক্ষ লোকের অভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন মুখ থুবরে পরতে পারে । মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি মিলবে । মানুষ এগিয়ে গেলে দেশ এগিয়ে যাবে । বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে এটাই সকলের কাম্য । আমার মনে হয়, সরকারের এখনই এ বিষয়ে ভাবে চিন্তে পরিকল্পনা করার সময় এসেছে । তা না হলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জোয়ারে মানুষের নৈতিক উন্নয়নের জোয়ার বন্ধ হয়ে যেতে পারে ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৩:০৬