somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বই পর্যালোচনাঃ অভ্যাসের শক্তিঃ পর্ব ৪

২৫ শে মে, ২০২০ রাত ৯:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অভ্যাসের শক্তি (power of habit), রচনা: চার্লস দুহিগ (Charles Duhigg): (Part One-Chapter Three: The Golden Rule of Habit Change)

অভ্যাস বদলানোর স্বর্ণালী নিয়ম
এই অধ্যায়ের মুল বিষয় হলো কিভাবে অভ্যাস বদলানো যায়। অভ্যাস হচ্ছে ইঙ্গিত-কাজ-পুরস্কার
( Cue-Routine-Reward) এই তিনের সমন্বয়ে একটি চক্র। মস্তিষ্ক যখন ইংগিত পায়, সে তখন একটা কাজ সম্পন্ন করে যেটা তাকে একটা আকাংখিত পুরষ্কার দেয়। এই চক্রে যেটাকে কাজ বলা হচ্ছে সেটাই আমরা বাহ্যিকভাবে অভ্যাস হিসাবে দেখে থাকি। ইঙ্গিত এবং পুরস্কার ঠিক রেখে যদি কাজটা বদলিয়ে দেয়া যায়, তাহলেই আমরা দেখব যে একটা অভ্যাস বদলে অন্য একটা অভ্যাস তৈরী হয়।
টনি ডাংগি (Tony Dungy) নামে এক ভদ্রলোক দীর্ঘদিন আমেরিকান ফুটবল লীগের বেশ কয়েকটি দলের সহকারী কোচ ছিলেন। এর মধ্যে বিভিন্ন সময় উনি চারটি দলের প্রধান কোচ হিসাবে সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন কিন্তু উনি উনার কোচিং দর্শন বলার পর আর সেই চাকরি হয়নি। উনার কোচিং দর্শন ছিল মাঠে খেলোয়ার যে সিদ্ধান্ত (একশন) নিবে তা যেন তার অভ্যাস থেকে আসে, তাকে যেন ঐখানে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে না হয়। তার মতে চ্যাম্পিওনরা আলাদা কিছু করেন না, তারা সাধারন কাজই করেন তবে সেটা অভ্যাস থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে করে, যার ফলে সেটা এত দ্রুত করেন যে অন্যারা সেটা অনুসরন বা কাউন্টার করতে পারেনা। উনি চান নির্দিষ্ট ইংগিত (cue) এর বিপরীতে যে কাজ (একশন/রুটিন) করবেন, তা যেন ওদের অভ্যসে পরিণত হয় যাতে মাঠে অবস্থা বিবেচনা করে মস্তিস্ককে ব্যস্ত করে সিদ্ধান্ত নিতে না হয়, প্রশিক্ষন থেকে রপ্ত করা অভ্যাস থেকে ইংগিত অনুযায়ী দ্রুত পদক্ষেপ (একশন) নিতে পারে যেটা অন্য দল বুঝে ওঠার আগেই সম্পন্ন হবে। তবে উনি কোন খেলোয়ারদের মাঝে নতুন কোন অভ্যাস তৈরি করতে চান না। একজন খেলোয়াড় মাঠের একটা অবস্থা বুঝে (এই অবস্থাকে অভ্যাস চক্রের ইঙ্গিত বলা যেতে পারে) সাধারণত সিদ্ধান্ত নেন এবং সফলতা পেলে সেটাকে মস্তিষ্ক পুরস্কার হিসাবে বিবেচনা করে। তিনি চান আগের ইংগিত (CUE) ঠিক থাকবে, পুরস্কারও একই থাবে শুধু একশন/কাজটা বদলে দিবেন। এমনকি কাজটা একই থাকলেও সেটা হবে মস্তিষ্কে সংরক্ষিত অভ্যাস চক্রের প্রোগ্রাম অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে, যাতে ওই সময়ে মস্তিষ্কের চিন্তা বা অবস্থা বিশ্লেষন করে সময় নষ্ট না করতে হয়। অবশেষে তিনি লীগের নিম্নসারির একটা দলের প্রধান কোচের দ্বায়িত্ব পান এবং তিনি এই নীচুসারির দলটিকে চ্যাম্পিওন করেন। শুধু তাই নয় এর পরের ক্যারিয়ারে তিনি অনেক সফলতা পান, তিনিই একমাত্র কোচ যার দল পর পর দশ বছর প্লে-ওফ খেলেন , তিনি প্রথম আফ্রিকান আমেরিকান কোচ যিনি সুপার বোল (super bowl) জয় করেন। এবং এথলেটিক্স জগতে কোচিং পেশায় অত্যন্ত সম্মানের স্থান অধিকার করেন। অন্যান্য কোচরা তাকে অনুসরন করতে থাকেন।
বিল উইলসন নামে এক আমেরিকান ভদ্রলোক জীবনের প্রথকদিকেই এলকোহলে আসক্ত হয়ে পড়েন। যেটা তার জীবনকে ভীষনভাবে দুর্বিসহ করে তোলে। একটা পর্যায়ে তিনি এলকোহল ত্যাগ করে সাধারন জীবনে ফিরে আসেন। একবার ছেড়ে দেবার পর ১৯৭১ সালে মারা যাবার আগ পর্যন্ত ৩৬ বছর তিনি আর একগ্লাস মদও পান করেন নি। একটা পর্যায়ে তিনি এলকোহল এনোনিমাস (alcohol anonymous) নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন যেখানে মাদকাসক্তদের নেশার জীবন থেকে ফিরে আসতে সাহায্য করা হয়। লক্ষ লক্ষ লোক এটার সাহায্য গ্রহন করে নেশামুক্ত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। ধরা হয় অভ্যাস পরিবর্তনের সবচে বড় সাংগঠনিক প্রচেষ্টা। উইলসন কোন একাডেমিক জার্নাল অনুসরন করেননি কিম্বা ডাক্তারের পরামর্শ নেননি তার প্রোগ্রাম ডিজাইন করবার জন্য। অভ্যাস চক্রের কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধারণাও উনার ছিলনা। উনি বার (১২) ধাপের প্রোগ্রাম ডিজাইন করেন এবং সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাসকে প্রবল্ভাবে উনার পক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করেন। উনার সাফল্যের কারনে পরবর্তীতে বিভিন্ন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগন এটা নিয়ে গবেষণা করেন এবং তারা দেখতে পান যে অভ্যাস পরিবর্তনের সোনালী নিয়ম এর মধ্যে তৈরি (বিল্ট ইন) ছিলো। অর্থাৎ ইঙ্গিত আর পুরস্কার ঠিক ছিল কিন্তু রুটিনটা বদলে দেয়া হয়েছিল। যেমন একজন মানুষের মদ খাবার ইংগিত (Cue) সাধারনত শরীরের মদের চাহিদা থেকে নয় (শারিরীক চাহিদা থাকলেও সেটা খুব বড় কারণ নয়) বরং অন্য কোন দুঃখ ভুলে থাকা কিম্বা মস্তিষ্কের অন্য কোন ক্ষুধা নিবারন থাকে আসল কারন (ইংগিত)। উইলসনের নেশামুক্তির প্রোগ্রামে তারা স্পন্সর প্রোগ্রাম চালু করে। অর্থাৎ যখন তিনি দুঃখবোধ/একাকিত্ব বোধ থেকে ( CUE) মদ খাবার চিন্তা/প্রয়োজন (Routine) তার মাথায় আসে, তাকে পরামর্শ দেয়া হয় এই রকম ক্ষেত্রে সে যেন তার স্পন্সরকে ফোন করে যে তাকে সময় দিবে, বিভিন্ন আলোচনা করবেন কিম্বা কোন গ্রুপ গ্যাদারিং এ যোগ দিবেন এবং তাতে তার মস্তিষ্ক ক্ষুধা নিবারন হবে (reward) করেন । এভাবে তার মদপানের অভ্যাস বদলে যায়। তবে গবেষকরা লক্ষ্য করেন শুধু রুটিন পরিবর্তন করে অভ্যসের পরিবর্তন অনেক ভঙ্গুর হয়ে থাকে। দেখা যায় গেল একজন মদ পান ছেড়ে দিয়ে ৫-৭ বছর পার করে দিলেন তার পর জীবনের কোন একটা স্ট্রেসফুল সময়ে এসে (যেমন মায়ের ক্যান্সার বা নিজের ডিভোর্স ইত্যাদি) তিনি আবার মদপান শুরু করেন। কাজেই তারা সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে শুধু রুটিন পরিবর্তন যথেষ্ট নয়, বরং পরিবর্তিত অভ্যাসকে স্থায়ী রুপ দেবার জন্য সাথে আরেকটা কিছু দরকার। বিভিন্ন গবেষণা থেকে গবেষকরা সিদ্ধন্তে আসেন যে বাড়তি যে জিনিষটা দরকার সেটা হচ্ছে বিশ্বাস। যে তার অভ্যাস পরিবর্তন করতে চায় তাকে নিজকে বিশ্বাস করতে হবে যে এই পরিবর্তন তার পক্ষে সম্ভব। এই বিশ্বাসই তার পরিবর্তন কে স্থায়ী করতে পারে। উইলসনের এলকোহলিক আনোনিমাস প্রোগ্রামে সৃষ্টিকর্তার বিষয়টিকে যদিও গবেষকরা গুরুত্ব দিতে চাননা কারন চার্চগুলিতে প্রচুর মানুষ আসে যারা নিত্যদিন মদপান করে। তবে তাদের মতে বিশ্বাস উপাদানটা জরুরী, সেটা নিজের আত্মবিশ্বাস থেকে হতে পারে অথবা একটা কম্যুনিটির মেম্বারশিপ থেকে নিজেদের উপর এই বিশ্বাস তৈরি হতে পারে।
সুতরাং বুঝা যাচ্ছে অভ্যাস বদলানো যায়। একজন এলকোহলে আসক্ত ব্যক্তি নেশামুক্ত জীবন যাপন করতে পারে, একটা ক্রমাগত ভাবে হারতে থাকা দল চ্যাম্পিওন হতে পারে, একজন ধুমপায়ী ধুমপান ছেড়ে দিতে পারে, একজনের নখ কামড়ানোর বদ অভ্যাস অন্য অভাস দিয়ে বদলিয়ে দেয়া যায়, অফিসে কাজের ফাকে ফাকে স্ন্যাক্স খাবার অভ্যাস ফল বা স্বাস্থ্যকর ফল খাবার অভ্যাস দিয়ে বদলিয়ে দেয়া যায়।
আপনি আপনার কোন অভ্যাস বদলাতে চান? খুজে বের করুন কোন ইংগিতে আপনি এই কাজটি করেন, মস্তিষ্কের পুরস্কারটি কি? দুটোই ঠিক রেখে মাঝের রুটিনটা বদলিয়ে দেন। আর হ্যা, অবশ্যই বিশ্বাস তৈরী করতে হবে যে আপনার পক্ষে এই পরিবর্তনটা সম্ভব। দরকার হলে কম্যুনিটির সাহায্য নিন। আপনি ধুমপান ছেড়ে দিতে চান? একটা ভিন্ন রুটিন বের করুন যেটা আপনার মস্তিষ্কের যে নিকোটিনের ক্ষুধা বা পুরস্কারকে অন্য ভাবে পুরণ করবে। একটা সাপোর্ট গ্রুপ খুজে বের করুন যেখান থেকে আপনার বিশ্বাস তৈরি হবে।
তো আর ভাবনা কি? যদি ভাবেন যে আপনার একটা খারাপ অভ্যাস আছে, সুত্র প্রয়োগ করে তা বদলিয়ে ফেলুন। কিম্বা আপনার কাছে কেউ তার খারাপ অভ্যাস বদলাতে চায় তার ইংগিত এবং পুরস্কার চিহ্নিত করে তাকে একটি নতুন কাজ (রুটিন) খুজে দেন, দেখবেন আপনার প্রিয়জন তার খারাপ অভ্যাস থেকে বের হয়ে আসতে পারবে। হয়ত একজনের জীবনকে আপনি পজিটিভ্লি বদলয়ে দিতে পারবেন।

এরপর আমরা দেখবে প্রতিষ্ঠানের অভ্যাস কিভাবে কাজ করে।
(চলবে)

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০২০ রাত ৯:৪৭
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

×