somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হংস- মিথুন

০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১১:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শ্রাবণ মাস। ভেজা পথ, কাল রাতে অঝোরে বৃষ্টি হয়েছিল। রাস্তায় মানুষের আনাগোনা অন্য দিনের চাইতে কম মনে হচ্ছে ।মূল রাস্তা থেকে ষাট কদম দূরে ডান দিকের এক দুই তলা বিশিষ্ট ঘিয়ে রং এর দালান। তার দ্বিতীয় তলায় এক মাঝারি মানের রেস্তোঁরা। রেস্তোঁরার নামটা চাইনীজ হলেও চাইনীজ এর সাথে ইন্ডিয়ান,বাংলাদেশী সব খাবারই পাওয়া যায়। ভর্তা বিলাসিরা এখানে এসে নিরাশ হন না ।বেগুন ভর্তা,আলুর ভর্তা,শুটকি ভর্তা সবই পাওয়া যায় এখানে ।আমি যেদিন স্ট্রাইক করে বসি, মানে রান্না না করি সেদিন আমার স্বামী আমাকে এখানে খাওয়াতে নিয়ে আসে। রেস্তোঁরার প্রধান কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকতেই যে বার খানা আসনের টেবিলটা আছে,সেখানে চোখ পড়ল। মাঝে মাঝে মনে হয় জায়গাটা রেস্তোঁরার মালিকের প্রাণভ্রোমড়া। আমার বিশ্বাস পুরো রেস্তোঁরার মধ্যে এই বার খানা আসনই মালিকের ব্যবসার পুঁজির আধখান এরও বেশি জোগান দেয়। পাত্র-পাত্রী দেখা,বিয়ের ফর্দ,নতুন বেয়াই বাড়ীর মানুষকে খাওয়ানো মূলত এই তিন বিষয়ের খদ্দের হারহামেশাই দেখা যায় এখানে। আজকে ও ঢুকেই আন্দাজ করলাম পাত্র-পাত্রী দেখার পর্ব চলছে। আর এই দেখা-দেখির ফাঁকে একটা অদ্ভুত সুন্দর ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। ছোট্র একটি প্রেমের গল্প,অতি সাধারণ ছিমছাম যার সংজ্ঞা বোধকরি রবি ঠাকুরের ছোট গল্পের সংজ্ঞা-

“ ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা,ছোট ছোট দু:খ কথা
নিতান্ত সহজ সরল,
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারটি অশ্রু জল
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।“

এর সাথে অনেকটা মিলে যায় ।

স্বমক্ষে এত সুন্দর একটা ছোট নাটিকা হাতছাড়া করতে মন সাঁই দিল না।তাই তাদের কাছাকাছি বাঁ দিকের কোণার টেবিলটায় তড়িঘড়ি বসে পড়লাম। যথারীতি ওয়েটার আসল। বেচারার সাদা শার্টে নীল না দিতে দিতে মলিন হয়ে গেছে, টাইটার কথা আর নাই -বা বললাম ।আমার স্বামী ওনথন্, স্যুপ আর পেঁপের জুস অর্ডার দিল। আমিও তাই দিলাম। আমার মেন্যু দেখে বাছাই করার সময় নেই। আমার মন পড়ে আছে ওই বারখানা আসনে। আমাদের চট্রগ্রামের স্থানীয় লোকজনদের নিয়ে একটা সুবিধা হচ্ছে, কোন কথা শুনতে অযথা কষ্ট করে আড়িপাততে হয় না,
কথা আপনা-আপনিই কানে চলে আসে।
ওয়েটার যেতেই আমি আমার নাটীকা দর্শন পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণে মন দিলাম। প্রথমে ওই টেবিলে পাশাপাশি বসা দু'জন মহিলার ওপর নজর পড়ল। একজন অল্প বয়স্কা বেশ রুপবতী,আরেকজন বোধকরি চল্লিশোর্ধ বিবর্ণ ।অল্পবয়স্কা মেয়েটার গায়ের রং হলদে সাদা,চুল হালকা সিল্কের গোলাপী রং এর ওড়না দিয়ে ঢাকা,মুখে হালকা মেকআপ,চোখজোড়া খুব মায়াবী,তার চঞ্চল চোখগুলি কখনো একনজরে দ্রুত চারিদিকে বুলিয়ে নিচ্ছিল। আবার কখনো ভয়ে ভয়ে অনেকটা কেউ টের না পায় মত করে তার সরাসরি সামনে বসা অপর প্রান্তের ছেলেটাকে লাজুক দৃষ্টিতে দেখে আবার তড়িঘড়ি করে চোখ নিচে নামিয়ে নিচ্ছিল। সেই সুবাদে আমিও একবার ছেলেটার উপর চোখ বুলিয়ে নিলাম।

আহারে! শ্যামলা রং এর কী মায়াভরা চেহারা! পুরুষ মানুষের চেহারায় এত মায়া থাকতে আছে? আমার আপুনির থিওরী অনুযায়ী যে ছেলের চেহারায় যত মায়া, সে ছেলের মনে তত শয়তানি! সে যাক্েগ, ছেলের রুচি মাসাল্লাহ ভালই বলতে হয়।
পরনে হালকা নীল রং এর শার্ট সাথে হালকা ছায় রং এর প্যান্ট,চোখে ব্র্যান্ডের কালো চশমা,হাতে কোন নামিদামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি,দৃশ্যমান খুঁতের মধ্যে মাথায় হালকা টাক। বাদবাকী আগাগোড়া সুস্বাস্হ্যের লক্ষণ।
পাত্রের পাশে বসা ভদ্রলোক পঞ্চাশোর্ধ, শ্যামলা বেঁটে ,তার পরনে বাদামী পাঞ্জাবী সাথে কালো রং এর কোটী ,ভদ্রলোক খুবই অস্থির প্রকৃতির মানুষ হবেন হয়ত,
কারণ তাকে এক মিনিটের জন্যেও স্থির থাকতে দেখলাম না। অনুমান করলাম পাত্রের মামা-টামা কেউ হবেন হয়ত, আর তার পাশে বসা ফর্সা মহিলা নিশ্চিত তার মিসেস।
মিসেসের হাতে একগোছা সোনার চুড়ী। তাঁর অনবরত অপ্রয়োজনীয় হাত নাড়ানোর সময় চুড়িগুলি ঝনঝন শব্দ করছে।
আর তার পাশের দুই সিটে পিঠাপিঠি বয়সী তাঁর দুই ছেলেমেয়ে ।ছোট্র মেয়েটা একটু পরপর নিজের মাথায় হাত দিয়ে শখের লাল রং এর ক্লিপটা ঠিক আছে কিনা দেখে নিচ্ছে।


হঠাৎ পাত্রের অস্থির মামার উচ্চস্বরের কথাবার্তা কানে আসতে আবার তার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম।
`না-না-না কাবিন এক লাখের উপর একটাকা ও বেশি হবে না`
-বললেন মামা।
তাই শুনে পাত্রীর দুই আসন পরে বসা অর্ধবয়স্ক ভদ্রলোক মৃদু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে জবাব দিলেন
`এই অংকের কাবিনে আপনার আমার সময় বিয়ে হত, এই যুগে মনে হয়না এত কমে কাবিন সম্ভব`!
সহসা পাত্রের মামী তার হাতের চুড়ী ঝনঝনিয়ে কিছু একটা বললেন এইদিকে আমার স্বামী একটু পরপর তাগাদা দিচ্ছে
`কী? খাওয়া শুরু করনি`?
ওয়েটার কখন খাবার রেখে গেছে, খেয়াল করিনি স্বামীকে বুঝ দিতে একটু খাওয়ায় মন দিলাম।ঐদিকে কাবিনের টাকা নিয়ে মাঝারি দন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে ।
পাত্র পক্ষের পাত্রীকে পছন্দ হয়েছে কিন্তু তারা একলাখের উপরে কাবিন ধরতে নারাজ।
এদিকে পাত্রীর পরিবারের আবদার, এটা এদের বড় মেয়ের বিয়ে।
পরিবারের প্রথম বিয়ে বলে কথা! ওদেরও পাত্র পছন্দ হয়েছে, কিন্তু এগার লাখের নিচে ওনারাও নামতে নারাজ ।
যাব্বাবা!কোথায় এগার আর কোথায় এক!
পাত্রের মামী দেখলাম আচমকা উঠে দাঁড়ালেন। হাতের পার্সটা সশব্দে টেবিলে রাখলেন। `এভাবে হয়না এককথা এতবার কেন বলতে হয়?`
বলে থমথমিয়ে দরজা ঠেলে বাইরে চলে গেলেন। এতে পাত্রীর পাশের চল্লিশোর্ধ বিবর্ণ মহিলা চোখ বুঁজলেন ,একটু পরেই আবার দ্রুত চোখের পাতা তুলে পাত্রের মামার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বললেন,
`ওনার আচরণটা মোটেও শোভনীয় হয়নি`
`দু:খিত ওর হয়ে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি `
বলে অস্থির মামা কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে বসলেন। সামান্য ভ্রু কুঁচকে তিনি চাপাস্বরে কাঁশলেন।

কয়েক সেকেন্ডের নিরবতার পর আবারও সবাই যে যার যার টা বলে যাচ্ছে, কেউ কি কারোটা আদৌ শুনছে নাকি সন্দেহ! এই চিৎকার চেঁচামেচির ভেতরেই ওই দুই পিঠাপিঠি ভাইবোন তাদের সামনে থাকা আমের জুস মন দিয়ে খাচ্ছে ।কাবিনের টাকা নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই।
ছোট্ট মেয়েটার মাথাব্যথা বোধকরি শুধু তার মাথার লাল রং এর ক্লিপটাকে নিয়ে। সে সেই আগের মত একটু পরপর মাথায় হাত দিয়ে ক্লিপটাকে ঠিক করে নিচ্ছে।
হঠাৎ আবার পাত্র পাত্রীর দিকে চোখ পড়ল। এই চেঁচামেচি আর হট্টগোলের ফাঁকে এই সদ্য সাক্ষাৎ হওয়া হংস মিথুন জুটি ঠিকই নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি আদান-প্রদান করে নিচ্ছে ! পাত্রের দুটি চোখ রেস্তোঁরার এ কোণ ও কোণ খানিকটা ঘুরে,একবার দু'বার নিজের এবং পাত্রীর মুরব্বীদের দেখে নিশ্চিত হয়ে তারপর পাত্রীকে আড়চোখে একবার করে দেখে নিচ্ছে। আর পাত্রী লাজুক ভঙ্গিতে তার সুন্দর চিকন হাত দিয়ে মাথার ঘোমটা ঠিক করে নিচ্ছে। দু'জনের মুভমেন্ট- এ একধরনের ছন্দ আছে। তাদের দু'জনের চোখে যেন ইতিমধ্যে আগামী দিনের স্বপ্ন বোনার কাজ শুরু হয়ে গেছে ।
কই? তোমার হল?
স্বামীর ডাকে টনক নড়ল। প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখি,
প্লেট সাফ ! কখন খাবার শেষ করেছি, টের ও পায়নি।
বলি,আজকে এখানেই থেকে যাবে? বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না?
স্বামীর পীড়াপীড়িতে উঠে দাঁড়ালাম। ১/১১ এর দ্বন্ধ তখন ও চলছে।
আহারে!শেষটা পর্যন্ত যদি থাকতে পারতাম!
রেস্তোঁরা থেকে বের হয়ে আমরা একটা রিকশা ধরালাম, বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।
আমার রিকশার হুড টানতে ইচ্ছে করছে না,স্বামীকেও টানতে দিলাম না। এই কর্দমাক্ত পিচ্ছিল রাস্তায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাসায় যাচ্ছি আর মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছি মুরব্বীদের ১/১১ এর দ্বন্দ্বে যেন এই সদ্য গড়া হংস মিথুনের জুটি না ভাঙ্গে………………………………………………….।





সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০২২ সকাল ৮:৪৮
১১টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×