বাংলা নববর্ষের ‘পহেলা বৈশাখ’ এখন শহর, বন্দর, গ্রামগঞ্জে জাতি-বর্ণনির্বিশেষে আবালবৃদ্ধবনিতার আবেগের উৎসবে পরিণত হয়েছে। এই দিবসে বৈশাখি মেলা বসে দেশের বিভিন্ন স্থানে। বয়স-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সকল মানুষের উৎসব বাংলা ‘নববর্ষ’। বৈচিত্র্যময় ষড়ঋতুর এই দেশ গ্রীষ্মকালের শুরুতে পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। এ প্রেক্ষাপটে শিক্ষিত, স্বশিক্ষিত, আধাশিক্ষিত, অশিক্ষিত, নিরক্ষর, ধনী-গরিব সব শ্রেণির এবং বিভিন্ন পেশার মানুষ আবেগময় আনন্দের আতিশয্যে আপ্লুত হয়। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষ। যা বাঙালি আবাহমান সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কিন্তু দু:খজনক বিষয় হলো দিনদিন সার্বজনীন বাঙালি সংস্কৃতির নামে এ বিশেষ উৎসবে নানাভাবে অশ্লীলতা, নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনা জায়গা করে নিয়েছে; যা একদিকে যেমন সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা তৈরি করছে। তেমনই কলঙ্কজনকভাবে প্রকাশ্যে জনতার ভিড়ে গণহারে মা-বোনেদের বস্ত্রহনন-শ্লীলতাহানির সুযোগ করে দিচ্ছে। আর এসব সম্ভব হচ্ছে নারী-পুরুষের অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত মেলামেশার কারণে। যা নারী-পুরুষের মাঝে ভালোবাসা-সুন্দর্যের পরিবেশকে যৌন আক্রমণ-বিভেদ চর্চায় রূপান্তরিত করছে।
ইংরেজি Culture-এর প্রতিশব্দ হিসেবে সংস্কৃতি শব্দটি ১৯২২ সালে বাংলায় প্রথম ব্যবহার করা শুরু হয়। কোন স্থানের মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সঙ্গীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয়, তাই সংস্কৃতি। আবার সংস্কৃতি হল টিকে থাকার কৌশল এবং পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র সংস্কৃতিবান প্রাণী। মানুষের এই কৌশলগুলো ভৌগোলিক, ধমীও , সামাজিক, জৈবিকসহ নানা বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে। পূর্বপুরুষদের যেমন এই কৌশলগুলো ছিল তা থেকে উত্তরপুরুষেরা এই কৌশলগুলো পেয়ে থাকে। অধিকন্তু সময় ও যুগের প্রেক্ষিতেও তারা কিছু কৌশল সৃষ্টি করে থাকে। তাই বলা যায় সংস্কৃতি একদিকে যেমন আরোপিত অর্থাৎ উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত তেমনি তা অর্জিতও বটে।
উপরোক্ত সংঙ্গার আলোকে বলা যায়, বাঙালি হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য ভাষাভাষি জাতির চেয়ে যেমন আমাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি রয়েছে, তেমনই আমাদের বাঙালিদের মধ্যে ধর্মীয় ও ভৌগলিক কারণে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা রয়েছে। সঙ্গত কারণেই বাঙালির সার্বজনীন সংস্কৃতিকে নির্দিষ্ট করতে হলে অবশ্যই তা সচেতনতা, গ্রহণযোগ্য ইতিহাস-ঐতিহ্যের মাধ্যমে হতে হবে। তাই আমরা যেমন বাঙালি বলে যেমন হিন্দুদের ওপর মুসলিমদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে পারি না, তেমনি মুসলিমদের ওপর হিন্দুদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার কারোর নেই। আবার ভৌগলিক অবস্থান ভেদে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলের মানুষের মধ্যে কিছুটা হলেও সাংস্কৃতিক বিভেদ রয়েছে; যা কেও অস্বীকার করতে পারবেন না। অন্যদিকে, দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বাংলাবর্ষ নিয়ে একদিনের হেরফের আছে। বাংলাদেশের নববর্ষের পালনের পরের দিন পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ পালিত হয়, যা মোটেই ভালো দেখায় না।
এবার আসি আমাদের ধর্ম, জাতি-গোষ্ঠী ও ভৌগলিক পার্থক্য সত্ত্বেও বাঙালি হিসেবে কিছু না কিছু কমন সংস্কৃতি রয়েছে, সেগুলি আসলে কী? ধম-বর্ণ নিবিশেষে আমাদের বাঙালি জীবন-যাপনের সঙ্গে বাঁশ, কাঠ, রশি, ছন, খড়, ইট, পাথরের ঘরবাড়ি; লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, শাড়ি ইত্যাদির গ্রামীণ পোশাক-পরিচ্ছেদ; স্থানভেদে রেশম শিল্প, চা শিল্প, রাবার শিল্প, তামাক শিল্প ও তাঁত শিল্প, কৃষিকাজসহ গ্রামীণ বিভিন্ন পেশা; গ্রামীণ আড্ডা, জারি সারি, মুর্শিদি, কবিগান, পালাগান, যাত্রাভিনয়ের মাধ্যমে চিত্তবিনোদন; গোল্লাছুট, হা-ডু-ডু, কানামাছি, কড়ি, ডাংগুলি, লাঠি, মোরগ ও ষাঁড়ের লড়াইয়ের খেলাধুলা; নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি চলাচলের যোগাযোগ ব্যবস্থা; ব্যবসায়ীদের হালখাতা, এবং যৌথ পরিবার ব্যবস্থা।
পহেলা বৈশাখে এসব বিষয়ের ওপর সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান, মঞ্চ নাটক, প্রদর্শনীর আয়োজনের মাধ্যমে গ্রামীণ আবাহমান সংস্কৃতি তুলে ধরা যেতেই পারে। এছাড়া বৈশাখি মেলায় চেয়ার, টেবিল, চৌপায়া, ব্যালন, পিঁড়ি, রেহেল, লাঠি, ইঁদুর ধরার ফাঁদ, কুলা, নারকেল কোরানি, পুতুল, গাঁইল, চেগাইট, খড়ম, বাঁশের বাঁশি, পাউডি, ডাল ঘুটনি, ঘুড়ির নাটাই, মাটির তৈরি রকমারি জিনিস, খেলনা, মুড়ি, মণ্ডা, মিঠাই, জিলাপি, বাতাসা, তিলের খাজা, তেজপাতা ইত্যাদির বিক্রয় ও প্রদর্শনীর আয়োজন করা যেতে পারে। পাশপাশি মেলায় বিরিয়ানি, তেহারি, চিতাই, পাক্কান, তিরো, তালের ভাপা, পাটিসাপটা, পোয়াপিবাশঁশঠা বড় আকর্ষণ। এ ছাড়া শিশু-কিশোরদের দেশী-বিদেশী খেলনা, মহিলাদের সাজসজ্জার জিনিসপত্রসহ বিভিন্ন বাঙালি খাদ্যদ্রব্য যেমন— চিঁড়া, দই, মুড়ি, খই, তিলের খাজা, বাতাসা, ঝুরি, সাঁচ, ইত্যাদি লোকজ খাদ্যের বহিঃপ্রকাশ। তবে বর্তমানে বৈশাখি মেলার নামে অশ্লীল নাচ-গান, জুয়া খেলা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
আসুন এবার জেনে নেই পহেলা বৈশাখের সার্বজনীন সংস্কৃতি নামে চালিয়ে দেওয়া অপসংস্কৃত বা সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি কোনগুলি।ইসলামের দৃষ্টিতে ১) “এসো হে বৈশাখ” বলা নিষেধ৷ কারণ এর দ্বারা মাখলুকের নিকট কল্যাণ কামনা করা হয়৷ অথচ কল্যাণের মালিক একমাত্র মহান আল্লাহ্ তায়ালা। ২) বড় বড় র্যালি বের করা যাকে মঙ্গল শুভ যাত্রা বলা হয়, এটা নিরেট হিন্দুদের ধর্মীয় কাজ। যা কোন মুসলমান কখনো করতে পারেনা৷ ৩) পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়া এটা ও মূলত হিন্দুদের থেকে এসেছে কেননা তারা আশ্বিনের শেষ রাত্রে রান্না করে কার্তিকের প্রথম দিনে খায়৷ ৪) এই দিনে সাদা কাপড়/শাড়ী পরিধান করে এবং কপালে শাখা-সিঁদুর লাগায় ও উলুধ্বনি দেয়৷ যা মূলত হিন্দুদের কাজ৷ ৫) জীব জন্তূর কার্টুন ব্যবহার করা, যেমন বাঘ, শিয়াল, বানরের এটা ঠিক নয়৷ কারন হিন্দুরা হনুমান/ সাপের পূজা করে৷ ৬) গালে, কপালে, হাতে উল্কি আঁকা, শরীরের যে কোনো জায়গায় অঙ্কন করা। এতে বেপর্দা ও শারিরীক লসও রয়েছে, কেননা চিকিৎসকরা বলেন, কেমিক্যল ক্রিম,/ বস্তূ গুলো ত্বকের জন্য ব্যবহার করা মারাত্বক ক্ষতিকর৷
৭) গান বাজনা ছাড়া তা পালন হয় না৷ তার জন্য ঢোল/তবলার প্রয়োজন, আর হিন্দুরা পূজার সময় ঢোল, তবলা বাজায়৷ তা ছাড়া হাদিস শরীফে নিষেধ করা হয়েছে। ৮) নারী, পুরুষের অবাধ মেলামেশা৷ যার ফলে অনেক সময় অপ্রীতিকর ঘটনা সংঘটিত হয়, যেমন গত বৎসরের আগের বৎসর পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়েছে৷ আর গত বছর টি,এস,সি মোড়ে যা হয়েছে তা সবার জানা৷ এ ছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ও রমনা পার্ক এলাকার অবস্থা যে কত ভয়াবহ রূপ ধারন করে তা লিখে শেষ করার নয়৷
পুলিশ প্রশাসন পহেলা বৈশাখে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা প্রতিরোধে এবারও ভুভুজালা ও বাঁশি নিষিদ্ধসহ বেশ কিছু বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করেছে, যা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। একইসাথে মঙ্গল শোভা যাত্রার নামে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা এবং এর ফলে সৃষ্ট সামাজিক বিশৃঙ্খলা রোধে প্রশাসনকে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
আসুন! আমরা পহেলা বৈশাখে বিগত এক বছরের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় জীবেনর ব্যর্থতা, ভুল-ত্রুটি এবং অতৃপ্তির জায়গাগুলো রিভিউ করি। এবং আগামী এক বছরের জন্য ব্যক্তি, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা, অভিপ্রায় গ্রহণ করি। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোক। আমিন।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৮:১৫