১.
জুম্মার খুতবা কানে ভেসে আসছে। একটু পড়েই একামত দেয়া হবে। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকাই । বুকের ভেতর কেমন যেন করে। রাস্তায় মানুষজনের আনাগোনা বেশ। পা মচকানো কুকুরটাও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে চলছে। বড় বড় ব্যাগ হাতে বাজার থেকে ফিরছে মানুষ । বাজারে লোক সমাগম । চলছে রোজার প্রস্তুতি (!) । কি রফিক সাহেব রোজার প্রস্তুতি কেমন নিলেন? জ্বী রহমান সাহেব , সবই কিনেছি। শুধু মাংস কেনা বাদ আছে। আজ কিনে ফেলবো।
মানুষ বাজার সদাই, ছোলা বুট , বেসন , খেজুর কিনে রমজানের প্রস্তুতি নিচ্ছে! কে জানে কারো কারো হয়তো দোয়া কুনূত টাও মনে নেই । কেউ কেউ দোয়া মাসুরা ভুলতে বসেছে । তবুও রমজানের প্রস্তুতি কিন্তু চলছে-- ছোলা, ডাল , খেজুর।
কিচ্ছু থেমে নেই । লক ডাউনের মাঝে সব চলছে। টাটকা সবজি কেনা চলছে, বাজারে চলছে লোক সমাগম, গাড়ি চলছে, অফিস চলছে, গার্মেন্টস চলছে, মেশিন চলছে।
ব্যাংক চলছে, চাল চুরি চলছে, তেল চুরি চলছে জোচ্চুরি চলছে, খুন ধর্ষন সব চলছে । মসজিদ বন্ধ । দশ জন মুসল্লী নিয়ে নিয়ত বাঁধেন ইমাম সাহেব । আমার বারান্দা থেকে শোনা যায়।
আগামীকাল কাল থেকে রোজা। আজ থেকে তারাবীহ। হঠাৎ মনে হলো গতবছর হয়তো শেষ তারাবীহ পড়ে ফেলেছি ।
" আলিফ-লাম-মিম; জালিকাল কিতাবু লা-রাইবা ফিহি হুদাল-লিল মুত্তাকিন" হয়তো আর কোনদিনই শোনা হবে না।
মনটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে উঠছে। ক্যানেলের ধারে নওদাপাড়া জামে মসজিদের আম গাছ গুলো কেমন আছে? ঐ মসজিদে আমি আজান দিয়েছি।
রোজার প্রথম দশ দিন রহমতের। প্রচন্ড গরম শেষে প্রায় প্রতি বছরই প্রশান্তির বৃষ্টি শুরু হয়। আমাদের বড়ফুফু বলতেন, "এটা হচ্ছে রহমতের বৃষ্টি । রহমতের বৃষ্টি দিয়ে আল্লাহ সব কিছু শান্ত করে দেন। "
এই অশান্ত পৃথিবীর জন্য শান্তির খুব প্রয়োজন । পুরো আকাশে কালো মেঘ জড়ো হয়ে বৃষ্টির প্রস্তুতি নিচ্ছে । হে পরম করুণাময় আমরা শুধু আপনার অপেক্ষায় আছি ।
- ২৪ শে এপ্রিল ২০২০ ।
২.
আজ মঙ্গলবার। বড়ফুফু গত মঙ্গলবার চলে গেছেন। সাতদিন হয়ে গেলো।
ছোটবেলায় যখন প্রাইমারীতে পড়তাম তখন স্কুল শেষ করে এক দৌড়ে বড়ফুফুর ঘরের সামনে দাঁড়াতাম। মঙ্গলবার ভিক্ষুক আসতো বাড়িতে বাড়িতে, আমাদের হাত দিয়ে বড়ফুফু ভিক্ষা দেয়াতেন। মঙ্গলবার ভালোই কাটতো। বড় হয়ে গেছি, কত মঙ্গলবার পার করেছি। আজকের মত এতোটা খারাপ কোনদিন লাগেনি।
বাড়ি থেকে বাইরে কোথাও যাওয়ার সময় বড়ফুফু বলতেন, "বিসমিল্লাহ বলে বের হবা। সব সময় দোয়া ইউনুস আর সূরা কাউসার পড়বা। মা ফাতেমার কথা মনে করবা।" মা ফাতেমার কথা মাঝে মাঝেই বলতেন। কেন বলতেন আজ বুঝতে পারছি!
আমাদের মায়েরা খুব দুঃখী। আমাদের বড়ফুফুর কোন ছেলেপেলে ছিলোনা কিন্তু তিনি অনেক জনার মা ছিলেন!
- ২৪ শে আগস্ট ২০১৪।
৩.
অনেকদিন ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দিখি না। দেখলেও ভাঙ্গা ভাঙ্গা কি সব হাবিজিবি মনে থাকে না!
আজকেরটা কিছুটা মনে পড়ছে।
আমাদের বাড়ির রান্নাঘরের পেছনের আম গাছটায় প্রচুর আম এসেছে। ঐ গাছটাকে আমরা 'কটা 'গাছ নামে ডাকি। কয়েকটা আম পাক ধরেছে , কিছু আমের ভেতর হলুদ হলুদ হয়েছে। এই আম গুলোতে সরিষা বাঁটা, কাঁচা মরিচ আর লবণ মাখিয়ে খেতে ভালো লাগে।
আম পারার ব্যবস্থা হয়েছে। পিকু গাছে। আমি আর রাজু নিচে আম ক্যাচ ধরছি, বিকেল আবার ক্রিকেট ম্যাচ আছে নয়নের পাড়ার সাথে। বিভা আর প্রসূন গেছে সরিষা বাঁটা কাচা মরিচ আর লবণ আনতে বড় ফুফুর কাছে। সেই সাথে ধমক ফ্রী। ওরা ছোট তাই ধমক কম খাবে তাই ওদের পাঠানো। বড় ফুফু আম খাওয়ার দ্রব্য মসলাপাতি দিতে দিতে ধমক দিয়ে বলবো, 'বড় শয়তান গুলা গেলো কোথায়?'
মূহুর্তেই পিকু আমগাছের ডালের আড়ালে লুকালো, রাজু 'বাকি চাচা'র ঘরে আর আমি তালগাছতলায়।
বড়ফুফু ইদানীং শয়তান গুলারে খুঁজে না। বড় ফুফু মারা গেছেন ২০১৪ সালের আগষ্ট মাসের ১৯ তারিখে ভোরে। আজানের পরে। তিনি মারা যাওয়ার আগে এই শয়তান গুলোকে এতিম করে রেখে গেছেন!
আজ ১ লা জানুয়ারি। নতুন বছর। পান্তা কিংবা খিচুড়ি খাওয়ার দিনগুলো আর নেই। খিচুড়ি মাখানো গামলা হাতে সাদা শাড়ি পড়া মমতাময়ী মহিলাটা তাঁর শয়তানদের খুঁজে বেড়ান না।
- ১ লা জানুয়ারি ২০১৫।
৪.
সানি লিওন এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের বাংলাদেশে আসার কথা শুনেছিলাম। নাকি এসে চলে গেলো!
দেশের অবস্থা ভালো না। আমি এখনো না পুড়ে বেঁচে আছি। দুধ চা ছেড়ে রং চা ধরেছি। পুদিনা পাতা দিয়ে রং চা। রং চায়ে লিকার কম দিতে বলি, না হলে রক্ত রক্ত লাগে!
বার্ন ইউনিটে মহড়া চলছে।পোড়া হাত, পোড়া পা। কোমড়ে মাথায় ব্যান্ডেজ। পাশে দাঁড়ানো প্রিয়জন। ছলছল চোখ। তাদের চেয়ে ব্যথিত আগত জনতা, ভি আই পি দের সাগরেদ। টিভি, ক্যামেরা...বললাম না, মহড়া চলছে। তারপর আপনার অনুভূতি কি? মুন্নী তো অনেক আগেই বদনাম হয়ে গেছে...
বার্ন ইউনিটের কাতরানি আমার কানে পৌঁছায় না। ছোটবেলায় বাসায় পিকনিক করতে ছিলাম একদিন। তুমুল আগ্রহ চুলায় জ্বাল দিতে ছিলাম। কাঠের খড়ি গুলোতে ছিলো ডাই পিপঁড়া, বড় বড় কালো কালো। পট পট করে পুড়ছে, শুনতে ভালোয় লাগছে... পট পট পট।
পেছন থেকে বড় ফুফু এসে বললেন, পোকা মাড়ক কোন কিছুই পুড়িয়ে মারতে হয় না। বড় ফুফু বকলেন না, বুঝিয়ে বললেন।
বড় ফুফু বেঁচে নেই। মারা গেছেন, সাত মাস হতে চললো। বড় ফুফু বেঁচে থাকলে জানতে পারতেন আমাদের বাংলাদেশে পট পট পট পোকা মাকড়ের মত মানুষ পুড়িয়ে মারা হয়।
বড় ফুফু হয়তো কিছু বলতেন না। মুখ অন্ধকার করে শুধু বলতেন, আল্লাহ মাফ কর!
আমি জানি বাংলাদেশে অনেক মানুষ আছেন যারা সানি গ্যাংয়ের আসা নিয়ে অনেক টেনশনে আছেন । বিএনপি অবরোধ তুলুক, সরকার সংলাপে বসুক। মানুষ পুড়ুক আর না পুড়ুক, পরীক্ষা হোক আর না হোক... সানি গ্যাংরা যেন বাংলাদেশে আসে।
এই স্ট্যাটাসটা যখন লিখছি তখন হয়তো কোথাও মানুষ পুড়ছে অথবা পুড়বে। আমি আপাতত পোড়া মাংস গিলছি নান রুটি সহযোগে। লাল সস্ টা নেয় না, রক্ত রক্ত লাগে। জমাট রক্ত, লাল লাল রক্ত।
- ৫ই মে ২০১৫ ।
৫.
ভয়ংকর একটা বছর কাটালাম। এখনো কিছুটা সময় বাঁকি আছে।
প্রথমে আমার অসুখ। আব্বার মৃত্যূর কোল থেকে ফিরে আসা আর ১৯ ই আগষ্ট বড় ফুফুর আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া।
'ভালো কিছু' কিছুই নেই কিংবা ঐগুলো ছাড়া বাকি সব কিছুই হয়তো ভালো। এই যে বেঁচে থাকাটা...বেঁচে আছি বলে।
তারপরেও ভোরের আজানের সময় ঘুম থেকে উঠছে ভালো লাগে... ঘোর অন্ধকার থেকে পরিস্কার হতে থাকে আকাশটা, চার পাশটা।
অনেকদিন পিকনিক করা হয়না নববর্ষের। আমাদের বেশীর ভাগ পিকনিকের যোগান দিতেন বড়ফুফু। আর কোনদিন পিকনিক সরন্জাম যোগারের জন্য বড়ফুফুর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাতে হবেনা।
আর ঐযে ভোরের কথা বললাম। ঘোর অন্ধকার দূর করা ভোরেই বড়ফুফু চলে গিয়েছিলেন, কথা না বলতে পারলেও শেষ মূহুর্তেও তাঁর ঠোঁট নড়েছে... ঠোঁট আল্লাহ, আল্লাহ করেছে!
বছরের শেষ ক্ষণে সবার জন্য শুভকামনা রইলে। দূরের মানুষ গুলো কিংবা দূর থেকে কাছে আসা মানুষ গুলো, কাছের মানুষ গুলো...সবাই ভালো থাকুক। ঘোর অন্ধকার কেটে ভোরের আলো ফুটুক... শুভ নববর্ষ।
- ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৪
৬.
আমাকে বাড়িতে রেখে আম্মা আব্বা দুজনায় চাকুরীতে যেতো। বোনেরা যেতো স্কুল কলেজে। আমি এবং আমরা মানুষ হয়েছি বড়ফুফু'র হাতে। বড়ফুফু আমাদের এবং পাড়ার মানুষের কাছে কি সেটা পরিচিতরাই বলতে পারবে। বড়ফুফুর বিয়ে হয়েছিল অনেক ছোটবেলায় কোলকাতায়, আমার বড় ফুফা ছিলেন নামকরা পীর পরহেজগার মানুষ। উনার নাম সৈয়দ শামসুল হুদা। উনার নামে কোলকাতায় একটা সড়ক আছে। সৈয়দ শামসুল হুদা স্টীট। বড়ফুফুর কোন ছেলেমেয়ে ছিল না। আমরা চাচাতো ভাই বোনেরা তাঁর কাছে 'হয়তো' ছেলেমেয়ের মত ছিলাম। 'হয়তো' বলছি কারণ আজ নিশ্চিত হতে পারছিনা বলেই বলছি। ছেলেমেয়ের মত হলে ৬০ বছর ধরে বহন করে চলা পেটের টিউমারের কথা আমাদের বলতেন।সেই টিউমার আজ অনেকগুলো টিউমারের জন্ম দিয়েছে! আমাদের বড়ফুফুর অবস্থা ভালো না।
বড়ফুফুর ক্যান্সার।গলায় ইনফেকশন। বড়ফুফুর পেটে বড় একটা টিউমার। শক্ত লোহার মত। খাদ্যনালীতে একটা, ওভারিতে একটা। কাউকে কোনদিন বুঝতেও দেয়নি, উহ উহ শব্দও করেনি! কি রকম সহ্য ক্ষমতা আল্লাহতায়ালা তাঁকে দিয়েছেন জানিনা।বিছানায় পরে যাওয়ার পরেও তাঁকে জিঞ্জেস করা হয়েছে আপনার কি কষ্ট হচ্ছে, "তিনি বলেছেন, না। ইনশাল্লাহ আমি ভালো আছি।" এখন স্যালাইন চলছে, মাথার কাছে দোয়া পড়া হচ্ছে, বড়ফুফু অচেতন। এই অবস্থা কতক্ষণ চলবে জানিনা!
মানুষটা হাজার মানুষের জ্বালাতন সহ্য করে কাউকে না জ্বালিয়েই চলে যাবেন।
মহান আল্লাহতায়ালা মানুষের সেবা করার সৌভাগ্য তাঁকে দান করেছিলেন, শেষ যাত্রায় তিনিই যেন তাঁর সহায় হউন!
-১৮ই আগষ্ট ২০১৪
৭.
১৯শে আগষ্ট ।
২০১৪।
সকাল ছয়টা পনেরো মিনিট । বড় ফুফু চলে গেলেন। আল্লাহ আমাদের দাদা , দাদী , চাচা এবং বড় ফুফু কে নিয়ে যাওয়ার জন্য কেন জানি জ্বিলহজ্জ মাস কেই বেছে নিয়েছেন।
বড় ফুফু নাই।অনেক বছর হয়ে গেল। ।
বাড়িটা এলোমেলো । পুকুরে মাছ নেই।আবর্জনার স্তুপ । ঈদের দিন নামাজ পড়তে যাবো আমরা , কিন্তু বড় ফুফু পাটি হাতে অপেক্ষা করে না।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২১ সকাল ১১:২৭