ঘুম থেকে উঠার পর আমাকে সাবান শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করানো হতো। পাঞ্জাবী পায়জামা পড়িয়ে দাদার কাছে নিয়ে যেতো। দাদা দোয়া করে দিতেন। সকাল থেকেই সবার মধ্যে কর্ম ব্যস্ততা। আম্মা স্কুল থেকে ছুটি নিতেন। আব্বা বছরের একটা দিন স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসতেন। পেঁয়াজ রসুন ছুলতে বসে যেতো অনেকে। একবার পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে আমার আঙ্গুল কেটে গিয়েছিল ছোটবেলায়। সেই কাঁটা আঙ্গুলে তুলা আর কাপড় প্যাঁচিয়ে দাঁত বের করা ছবিও আছে।
দুপুরবেলায় ছোট খাটো মিলাদ হতো। হুজুর আমার জন্য দোয়া করতেন। মিলাদে পোলাও মাংস থাকতো। আশেপাশের বাচ্ছারাও খেতে আসতো। বেশকিছু আত্মীয়স্বজন আসতো। সন্ধ্যার পরপর কেক কাটা হতো। কেক কাটা আমি খুব উপভোগ করতাম। তখন ভেড়ামারাতে কেক পাওয়া যেত না। কেক আসতো কুষ্টিয়ার থেকে।
একেবারে ছোটবেলার জন্মদিনে আমার পাশে পাড়ার ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে যেত। দিনের বেশীরভাগ সময়ই তারা আমার সাথে কাটাতো কারণ আম্মা স্কুলে গেলে ওদের কাছেই আমি থাকতাম। আমার ছবিটাতে লিলি আপাকে দেখা যাচ্ছে।
১৮ নভেম্বর আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম দিন ছিল। ঐ দিন আমি জন্মে ছিলাম। আমার জন্মদিন।
একবার জন্মদিনের আগের দিন বাজার করে আর ঘর সাজানোর বেলুন আর রঙিন কাগজ কিনে আব্বার সাথে বাড়ি ফিরছি। ফিরতে ফিরতে আব্বা কে বললাম, আব্বা সবারই কি জন্মদিন হয়?
আব্বা বলল, না। সবার হয় না। আমার হয় না। অনেকে তো জন্ম তারিখই জানে না।
আমি বললাম, তাহলে যাদের হয় না তারা কি মন খারাপ করে?
আব্বা বললেন, তোমার কি মন হয়?
১৮ নভেম্বর আমাকে স্কুলে যেতে হতো না। জন্মদিনের পর দিন স্কুলে গেলাম। সম্ভবত ক্লাস টুতে পরি। ম্যাডাম জানতে চাইলেন, সৌরভ কাল স্কুলে আসোনি কেন?
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমি জানি, ম্যাডাম না আসার কারণটা জানেন। আমি নিচু স্বরে বললাম, কাল আমার জন্মদিন ছিল তো তাই আসিনি।
সবাই আমার দিকে তাকিয়ে। লজ্জা লাগলো খুব। ম্যাডাম আদুরে কন্ঠে বললেন, তাই? দারুণ ব্যাপার তো? শুভ জন্মদিন। তো কি করে ছিল তোমার জন্মদিনে?
আমি বললাম, কেক।
ম্যাডাম অবাক হয়ে বললেন, শুধুই কেক। পোলাও মাংস কিছু না?
আমি আবার মিথ্যা বললাম, বললাম শুধু কেক।
ম্যাডাম আর কিছু বললেন না। আমি মাথা নিচু করে বসে পড়লাম।
বাসায় এসে যখন সব শুনলো সবাই। তখন বললো, মিথ্যা বললাম কেন?
আমি কিছু বললাম না। শুধু বললাম, এমনি।
আমি সেদিন কারণটা বলিনি। ক্লাসে দাঁড়িয়ে বলিনি পোলাও মাংস রোস্টের বিড়াট আয়োজন। আমি বলিনি কারণ আমার মনে হয়েছিল ক্লাসের অনেকের হয়তো মন খারাপ হয়ে যাবে। সত্য কথা বলে অনেকের মন খারাপ করে দিতে ইচ্ছা হয়নি।
এরপর অনেকের জন্মদিন গেছে। বড় বড় আয়োজনের কথা অনেকেই বলেছে।
আব্বা আজ আমার জন্মদিন। প্রতিটা জন্মদিন আমার কাছে শিক্ষনীয় ছিল। কি দারুন এক শৈশব দিয়েছিলেন আমাকে।
আমার আব্বা হাসপাতেল ভর্তি হয়ে আছে অনেকদিন হয়ে গেল। সেদিন দেখা করতে গেলাম। ফুঁপাতে ছিল। বললেন খুব অস্থির লাগছে। সেই অস্থিরতা ঠিকই বুঝি । এই ব্লগে আমি ফাদার ফিগার খুঁজি। জানি , আব্বার সুযোগ থাকলে ব্লগিং করতেন 'হেডস্যার' নিকে।
সেদিন আমার ছেলে একটা কার্ড দিয়ে বলল, হিপি বাড ডে ইউ ইউ। লাভু বাবা।
বলেই কাঁধে মুখ ঘষে। আমি কাঁধে মুখ ঘষতাম ঠিকই কোন ঐ কথা গুলো বলতে পারি নি। 'লাভু বাবা' খুব কঠিন শব্দ না। তাও পারিনি।
একটা জোকস দিয়ে শেষ করি। খুব কমন একটা জোকস । দুইজন ছাত্রের মধ্যে সেকেন্ড হবার জোকস।
আঁকাআঁকিতে আগ্রহ থাকায় প্রাইমারীতে থাকতে প্রতিযোগিতায় নাম দিতাম। উপজেলা পরিষদে প্রতিযোগিতা হতো। আমি হতাম দ্বিতীয়। বারবার দ্বিতীয়। অনেক হাসতো। কারণ প্রতিযোগী ছিল মাত্র দুইজন।
আব্বাকে বললাম , এইবার নাম দিবোনা। সবাই হাসে। আমি সেকেন্ড হই। দুইজনের মধ্যে সেকেন্ড।
আব্বা বললেন, ভেড়ামারাতে বেশ কয়েকটা প্রাইমারী স্কুল আছে। সেখানে অনেক ছাত্র ছাত্রী আছে। তাদের মধ্যে কেউ কিন্তু আগ্রহ আর সাহস নিয়ে এগিয়ে আসেনা।
আমি সেইবার নাম দিয়েছিলাম। সেইবার অংশগ্রহণ করেছিল পাঁচজন। আমি হয়েছিলাম ফার্স্ট। জলরঙের খেলায় ক্রিমসন লেকে দূর্দান্ত এক সূর্যদয় এঁকেছিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০২২ বিকাল ৪:১৩