যদিও মেয়ে দেখার দিনটাতে আমার শ্বাশুড়ি আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিলেন। আমার হাতের আঙ্গুল, পায়ের পাতা, নাকের ডগা কানের লতি প্রায় সবই। না, তিনি সেই আগের আমলের মত একটু হাঁটো তো মা, চুল খুলে দেখাও তো এসব বলেননি বটে তবে সুকৌশলে যে এসব কার্য সিদ্ধি করে নিয়েছিলেন, সে আমিসহ বাড়ির সকলেই বেশ ভালোই বুঝেছিলো। যেমন মুখ দেখে আংটি পরানোর আগে তিনি আমার হাতের আঙ্গুলগুলি মেলে মেলে দেখছিলেন। আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম উনি নিশ্চয় জ্যোতিষ শাস্ত্র জানেন। নয়তো এভাবে তো দেখার কথা না। সর্বনাশ! ভয়ে কাটা হয়ে উঠেছিলাম, আমার হাতের রেখায় আবার কি দেখে ফেলছেন তিনি।
এরপর আমার ছোট এক ননদিনী আমার এক পায়ে সোনার সরু নুপুর পরিয়ে দিলো। আর সে মুহুর্তেই সে আবার এই এক পায়ে নুপুর পরাবার রহস্যটুকুও ফাস করে দিলো যে বাকী নুপুরটা নাকি শ্বশুরবাড়িতে গৃহ প্রবেশের দিনে পরানো হবে। ঠিক একইভাবে আরও কিছু কার্য্যকলাপে আমি পরিষ্কার বুঝে গেলাম সেটেল ম্যারেজ আসলেও নানা ঝক্কির কাজ। এর চাইতে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করা চাচাতো বোন মৌয়ের বিয়েটাই বরং বেশি নির্ঝঞ্জাট ছিলো। বলা নেই, কওয়া নেই, বিয়ে বাড়ির সাজ সাজ রব, নানা রকম তর্ক-বিতর্ক, ঝামেলা নেই। নেই হাজারও মনোমলিন্য বা এর ওর মন রক্ষা করে চলার শতেক কৌশল। হঠাৎ একদিন গায়েব হয়ে যাওয়া আর তারপর ফিরে আসা দুজনে মিলে। কি আর করার আছে? মারো, কাটো বা খুনই করো, যা হবার তা তো হয়েই গেলো।
বিয়ের আগে থেকেই আমি আমার শ্বাশুড়ি ঠাকুরণকে যতই দেখেছি আমার আত্মা ভয়ে ততই হিম হয়ে গেছে। কি গুরু গম্ভীর রাশভারী চেহারা। কথা খুব কমই বলেন। হাসতে প্রায় দেখিই না তাকে। মায়ের এই স্বভাবের সাথে আমার লাজুক স্বামীর যদিও কিছুটা মিল আছে তবে তাকে কেনো যেন আমার একেবারেই ভয় লাগেনা বরং বিপদে আপদে লজ্জায় দুঃখে সে কোথা থেকে তার অদৃশ্য হাতে সব মুসকিল আসান করে ফেলে, আগলে ফেলে পরম মমতায়। এই দুজনের ঠিক বিপরীত দুটি চরিত্র আমার শ্বশুর আর ছোট দেবর। তারা বাড়িতে থাকলে বাড়ি সর্বদা সরগরম, রমরমা। শ্বশরমশায়ের হাঁক ডাক বন্ধু বান্ধব, তাসখেলা, সকাল সন্ধাকালীন মর্নিং এন্ড ইভনিং ওয়াকিং পার্টিদের পার্টি আর সঙ্গীদের নিয়ে এই বয়সেও হৈ হুল্লোড়ে মত্ত তিনি। আর ছোট মানে ছোট দেবরের তো তুলনাই নেই । মেয়ে বন্ধু, ছেলে বন্ধু, বাচ্চা বন্ধু, বুড়া বন্ধু থেকে শুরু করে পুরো বিশ্ব জোড়া বন্ধু তাহার।
তো বিয়ের পর পরই এই বাড়ির এক পুরোনো বুয়া একদিন দুপুরে আমাকে বললেন, এই বাড়িতে তুমি ভালোই থাকবা বউ, বড়দাদা তো মাটির মানুষ, পুরাই দেবতা, কারো সাতে নেই পাঁচে নেই, এমন সোয়ামী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এমন ভালো ছৈল আজকালকর দিনে দেখাই যায়না, তুমি ভাগ্যবতী গো। আর তোমার শ্বশুর উনার মত মানুষই হয়না। দিলডা এত্ত বড়। এই যে দেখো এত্ত বড়। দু হাত দিয়ে দুই দিকে যত দূর দেখানো যায় দেখিয়ে দিলো সে। আরও বললো, আর ছোটটা তো পাগলা। বলেই সে পান খাওয়া দাঁতে হা হা করে হাসতে লাগলো এবং বললো, এইডা পাগলা পাগলা হইলেও বাপের দিল পাইসে। আমি আর না পেরে জিগসা করলাম আর মায়ের দিল ? কে পাইসে?
সে খানিক থতমত খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে প্রায় কানে কানে বললো, সত্য কই, কেউ না । এই বাড়ির সবার দিলই ভালা শুধু তোমার শ্বাশুড়িই একটু .....মানে মেজাজটা এট্টু কড়া, এই যা। ঠিক এট্টু না, ভালো রকমই কড়া। কারণে বেরনে খেইপা উডে। এই বাড়িতে মেলাদিন আমি। তা পরায় ২০ বছর হইবো। এই ২০ বছরেই দেখছি তো কম না! তার মেজাজ সেই ২০ বছরে ধরে একই রকম। আমার তো তখন হার্টফেল হবার দশা। বুয়ার কথার সাথে আসলেও মিলে যাচ্ছে। উনি চিল্লাচিল্লি করেন না কিন্তু উনার চোখের দিকে তাকালেই বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়।
এরপর একদিন আসলেন এক মামী শ্বাশুড়ি। তিনিও কথায় কথায় শুনালেন আমার শ্বাশুড়ি নাকি মহা বদরাগী একজন মানুষ। তাকেই নাকি একটু ম্যানেজ করে চলতে হবে।
এমনকি একদিন একটি তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে আমার শ্বাশুড়ির তপ্ত মেজাজ দেখে আমার শ্বশুর মশাইও আমাকে ডেকে বললেন, তুমি কিছু মনে করো না মা, বয়স্ক মা বাবারা ভুল করলেও ছেলেমেয়েদের মেনে নিতে হয়। আমরা সবাই জানি এতে তোমার কোনো দোষ নেই আরও কি কি যেন সব বলছিলেন উনি। আমার চোখে ততখনে পানি এসে গিয়েছিলো। অনেক কষ্টে বললাম, না আমি কিছু মনে করিনি।
উনি আরও বললেন, দেখো কতটা বছর হলো উনি হুইল চেয়ার বন্দী। এই অসুস্থতাও তাকে বিরক্ত করে তুলেছে নয়তো আগে তোমার শ্বাশুড়ির লাগানো গোলাপ বাগান দেখে ,হাতের রান্না খেয়ে প্রশংসা করেননি এমন মানুষ কম আছে। আমি ততখনে নিজেকে সামলে নিয়েছি।
সেদিনই সন্ধাবেলা ছোট দেবরটা আমাকে বললো, ভাবী চলো তোমাকে নিয়ে ফুচকা খেতে যাবো। আমি বললাম কেনো? সে অবাক হয়ে বললো, কেনো আবার? তুমি আমার একমাত্র ভাবী না? চলো চলো...... আমি ওর আবদার মেনে নিয়ে রেডি হয়ে যখন এলাম সে বলে তার মটর সাইকেলে উঠতে। আমার তো ভীমরি খাবার দশা! বলে কি ? সে বলে কোনো ভয় নাই ইহা উনার পঙ্খীরাজ, হেন তেন শত কথা। কিন্তু আমাকে এভারেস্ট পর্বত সরাতে বললেও হয়তো আমি চেষ্টা করবো কিন্তু মটর সাইকেলে চড়ে পড়ে মরার কোনোই শখ নেই আমার। দেখা যাবে আমি ধরাশায়ী আর মটরসাইকেল চলে গেছে দুইশো হাত দূরে। শেষে অনেক কষ্টে তাকে রিকশা করে যেতে রাজী করানো গেলো।
সেদিনও সে বললো, ভাবী তুমি কি জানো তুমি একজন চমৎকার মেয়ে! আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি দেখে সে বললো, কেনো বলছি শোনো, এই বাড়িতে এত সুন্দর মনের একটা মানুষ ছাড়া এত সুন্দরভাবে কেউই এ্যাডজাস্ট করে নিতে পারতো না। আমি বললাম, কি করেছি আমি? সে বললো, এই যে কত কিছুতে দেখি, কি সুন্দর করে সামলে নিচ্ছো। আমি তক্ষনাৎ বুঝে গেলাম, আজ সকালের শাশুড়ি ঠাকুরণের তপ্ত মেজাজ নিয়েই সে ইঙ্গিত করছে আর সে কারণেই আমাকে খুশী করতেই তার এই ফুচকা ভ্রমনের আয়োজন।
আমার শ্বশুর আর দেবরের আমার দিকে লক্ষ্য রাখবার এই সজাগ দৃষ্টিটুকু দেখে এবং আমি যেন একদম কষ্ট না পাই সে ব্যাপারে এই সচেতনতা দেখে আমি যতখানি লজ্জা পেলাম তার থেকেও শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় মন ভরে গেলো। এরপর আরও অবাক হবার পালা বাকী ছিলো, যখন অনেক রাতে আমার পতিদেবতা বললেন, তোমাকে একটা রিকোয়েস্ট করবো। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম কি রিকোয়েস্ট আবার করবেন তিনি?
উনি বললেন, কখনও আম্মার কথায় মন খারাপ করবেনা. আমাকে কথা দাও।আমি বললাম, আমি কিছু মনে করিনি, সত্যি মনে করিনি। তিনি আর কিছু না বললেও কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। কিন্তু বুঝলাম উনি বাড়িতে না থাকলেও বা সংসারের প্রতি সব ব্যাপারেও উদাসীনতা দেখালেও প্রতিটা সংবাদের বেশ ভালোই খবর রাখেন।
মিঠে কড়ার এই সব দিন রাত্রী নিয়ে এবং বেশ নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রপেই কেটে যাচ্ছিলো দিন। সকলের সাবধান করে দেওয়া বদরাগী শ্বাশুড়ির মেজাজ মর্জী একটু না, বেশ ভালোই সামলে চলতাম আমি। সব সময় উনি যা পছন্দ করেন না, তা না করার চেষ্টাই করেছি, উনার ছোট খাটো কাজ গুলো যথাসাধ্য যত্ন নিয়ে করে ফেলতে চেয়েছি ।তারপরও কেনো যেন তার সাথে ঠিক সহজ হতে পারতাম না। এবং সত্যি বলতে এ কারণে শ্বশুরবাড়ির অন্যান্য মানুষগুলো খুব সহজে হৃদয়ের কাছে চলে আসলেও উনাকে ভয়ের কারণেই হোক বা অন্যান্য সকল হতে তার সম্পর্কে শোনা মন্তব্যের কারণেই হোক, উনার থেকে একটু দূরেই থেকে গিয়েছিলাম আমি।
কেনো যেন সব সময় মনে হত উনি আমাকে খুব একটা পছন্দ করেন না বা আমার কোনো কাজই তার খুব একটা পছন্দ হয়না। এই পরিবারের অন্যান্য সকলের যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি তার এক বিন্দুও আমি তার থেকে পেয়েছি এটা ভাবতে পারতাম না।
কিন্তু হঠাৎ একদিন, তখন আমার বাবু হবে। একদিন সকালের দিকে ফোনে আমার এক কাজিনের সাথে কথা বলার সময় সে জানতে চাইলো। কি খেতে ইচ্ছে করে আমার? কিছদিন যাবৎ আমার ডালের হালুয়া খেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো কিন্তু তখন আমার সকাল বা বিকালের দিকে এত আলস্যি লাগতো যে নিজে বানিয়ে খাবো সেটা আর ইচ্ছে করতো না, আমি খুব একটা না ভেবেই বলে দিলাম ডালের হালুয়া খেতে ইচ্ছা করে। এরপর এটা সেটা নানা কথা।
বিকালে ঘুম থেকে উঠে কিচেন হতে আমার শ্বাশুড়ির বেশ হাক ডাকের গলা শুনতে পেলাম। উনি প্যারালাইজড বলে খুব একটা উনাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেওয়া হয়না। আমি ভয় পেয়ে তড়িঘড়ি ছুটে গেলাম। কি করছেন উনি দেখতে। ভেবেছিলাম আমি বেশিক্ষন ঘুমিয়ে পড়ায় উনি নিজেই চায়ের ব্যাবস্থা করতে গেছেন।
কিন্তু কিচেনের দরজায় দাঁড়িয়ে আমি যা দেখলাম তাতে আমার অবাক হবার পালা আরও বেশি বাকী ছিলো। দেখলাম শ্বশুর মশায় হাতে হ্যান্ড গ্লভস পরে কড়াইতে কি যেন নাড়ছেন। আর হুইল চেয়ারে বসে আমার বদরাগী শ্বাশুড়িজী তাকে নানা রকম ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছেন। দারুচিনি, এলাচ, তেজপাতা আর বুটের ডাল ঘি, চিনির সুগন্ধে কিছুই আর বুঝতে বাকী রইলোনা আমার। আমি স্তম্ভিত দাঁড়িয়ে রইলাম!
আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো ........
বদরাগী মানুষগুলোর বুকের গভীরে লুকিয়ে রাখা ভালোবাসাগুলো যে অনেক বেশি প্রখর, এরপরে তার আরও অনেক প্রমানই আমি পেয়েছি ........
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:৩৭