অনলাইন বা টিভি রেডিও শুনছিলাম না দুদিন ধরে। এই খবরটাও আমি শুনেছিলাম আমার মেয়ের কাছে। সে অনেকদিন পর আমার কাছে সেদিনই এসেছিল। এসেই প্রথম জর্জ ফ্লয়েডের ঘটনাটা শোনায়। আমাদের অনেকদিন পর দেখা হওয়ার আনন্দটা বিস্বাদ হয়ে যায় এই ঘটনার খবরে। পৃথিবী ব্যাপী নির্যাতনের নানা বিষয় আমদের এক সাথে থাকার সময়ের অনেকটা দখল করে নেয়।
এসব ঘটনা এদেশের বাচ্চাদের মনে, কি রকম প্রতিক্রিয়া তৈরি করে আমার খুব জানা। উত্তর আমেরিকার বেশির ভাগ বাচ্চাদের মানবতাবাদী এই মনোভাব আমার খুব চেনা।
এমন ঘটনা তো নতুন নয়। যখন তখনই কালোদের অত্যাচার করে আমেরিকান পুলিশ। এই তো মাত্র কদিন আগে পুলিশ ছাড়া পেয়ে গেল, তেইশ বছরের ছেলেটিকে ঘরে ঢুকে যে গুলি করে মেরে ছিল তারপরও। অথচ ছেলেটি ঘরে বসে আইসক্রিম খাচ্ছিল। আবার বাচ্চা মেয়ে এবং বউয়ের সামনে গুলি করে মেরে ফেলে গাড়িতে কালো লোকটিকে । কালোদের উপর নির্যাতন সব সময় চলছে। কিছুদিন আগে একজন কালো লোক ভ্যানে কিছু জিনিস তুলছিল। তাকেও পুলিশ এরেস্ট করতে গেল। অবৈধ মাল নিয়ে যাচ্ছে বলে। অথচ লোকটা ডাক্তার এবং হোমলেসদের জন্য এই করোনা মহামারীর সময়ে, মাস্ক হ্যান্ড সেনেটাইজার ইত্যাদি নিয়ে যাচ্ছিল। আইডি দেখাতে বললে, আইডি সাথে নাই বলার সাথে সাথে ঝামেলা শুরু করে পুলিশ। বাড়ির সামনে কে আইডি নিয়ে ঘুরে। ওর বউ বাচ্চা বাসা থেকে বেরিয়ে এলে, আইডি দেখে পুলিশ চলে যায়।এসব বিষয়নিয়ে কথা বলতে না চাইলেও ঘুরে ফিরে ওর কষ্ট প্রকাশ পেয়ে যায় মানুষের অবমাননায়।
বিদেশে আসার পর, মেয়ের সামনে খুব সাবধানে কথা বলতে হতো ওর খুব ছোটবেলা থেকেই। কাউকে নিয়ে হাসলে, কাউকে নিয়ে মজা করে কথা বললেও, রেসিস্ট বলে রেগে যেত। ওর সংবেদনশীল মনের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজেকে উন্নত করেছি। আমাদের দেশীয় অভ্যাসে মানুষকে নিয়ে হাসাহাসি করার মনোভাব একদম বাদ। কালো মানুষদের প্রতি বিশাল এক সফ্ট মনোভাব ওর মনে। শুধু কালো মানুষ নয়, সব মানুষের জন্য ওর প্রাণ কাঁদে। খুব ছোটবেলায় স্কুলে যাওয়া আসার পথে ট্রাফিক লাইটে যতবার থামা হতো যতবার কোন শীর্ণ হাত এগিয়ে আসত, প্রতিবার সাহায্য না করলে ওর কষ্ট হতো। বাড়িতে একজন ফকির এসে ওর তথ্যাবদানে খেয়ে যেত। প্রথম যেদিন শুনতে পেলো কেউ একজন রাস্তায় চিৎকার করে যাচ্ছে এক মুঠো ভাত দেন গো, দুই দিন খাই নাই।
নিজেই কাজের লোককে নিচে পাঠিয়ে ডেকে নিয়ে আসালো ক্ষুদার্ত মানুষটাকে। তারপর গরম ভাত বাড়িয়ে খেতে দিল। ভিক্ষুকের খাবার মনোযোগ দিয়ে দেখলো দাঁড়িয়ে থেকে। ওর সমস্ত ব্যস্ততা রেখে। বয়স তখন চার হবে। এবং প্রতি দিন যেন এসে খেয়ে যায় সেটা ঠিক করে দিল।
আজকাল মেয়ে এসব খবর এড়িয়ে চলতে চাইলেও ঠিক এই খবরগুলোতে সে আক্রান্ত হয়ে যায়। ওর মনে গভীর রেখাপাত করে।
মনে আছে মেয়ে বসে আছে টিভির সামনে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে খবর। তখন ইরাক আক্রমণের খবরে সরগরম প্রতিদিন। যে কোন মূহুর্তে আক্রমণ হতে পারে। প্রথম গুলি রকেট লঞ্চ হলো তাও সরাসরি টিভিতে দেখাচ্ছে। আর বাচ্চা মেয়েটা দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করছে, দে ডিড ইট দে এ্যাটাক মা । হাউ ম্যানি পিপুল উইল ডাই। ভয়ংকর একটা আতংক ওর মনে ছড়িয়ে পরেছে। কত আর বয়স তখন গ্রেড ট্যু তে পরে। অস্থির হয়ে বলতে থাকে আই ডু নট লাইক ওয়ার, আই ডু নট লাইক ওয়ার।
তারা ওয়ার না লাইক করলে ও কত ধরনের ওয়ার চলছে পৃথিবী জুড়ে। দরিদ্রর উপর ধনীর, দূর্বলের উপর সবলের। ধর্মের নামে একে অপরের উপর। ভিন্ন জাতিয়তা। বর্ণ এবং উচু নিচু, গোত্র, লিঙ্গ, সমকামী, আস্তিক নাস্তিক, মোটা চিকন, পাগল, সুন্দর অসন্দুর কত কিছুর জন্যই যে মানুষের সাথে মানুষের বিভেধ। নিজেকে উচ্চ শ্রেণীর ভেবে অন্যদের হেয় করে দেখার মধ্যে একধরনের সুখ মানুষ অনুভব করে। অথচ এসবই মানুষের অবস্থানগত চিন্তার ফসল।
সতের বছরের মেয়েটার ভিডিও করার সময় কেমন লেগেছিল আমি প্রাণ দিয়ে অনুভব করি। যে সব বাচ্চারা রাস্তায় নেমেছে যারা প্রতিদিন দেখে তাদের পরিবারের, কাছের বন্ধু, প্রতিবেশীর উপর অত্যাচার তাদের মনের উপর কি পরিমান কষ্ট হয়। এক ধরনের চাপা যন্ত্রনা সইতে না পারা কিন্তু তার মধ্যে থাকার অবস্থাটা, আমাদের দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতনই এক করুণ অবস্থা বিরাজ করছে সুন্দরের ভিতরে। এ সময়ের বেশির ভাগ বাচ্চা যে কোন রেইসেরই হোক তাদের মধ্যে মানবতার একটা সুন্দর মন আছে। এই মনটিকে নষ্ট করা হয় পরিবার, ধর্ম, জাতী বর্ণ, গোষ্টি ইত্যাদির বিভিন্ন নিয়মের মাধ্যমে।
মাত্র বারো বছরের ছেলেটি গান লিখেছে, আই এ্যাম এ ইয়াং ব্ল্যাক ম্যান, I’m a young black man / doing all that I can / to stand/ I just want to live / I just want to live.'
যে গানের কথা মানুষের হৃদয় ভেঙ্গে দিচ্ছে।
ভিতরের কান্না, কষ্ট প্রতিবাদের ঢেউ হয়ে ভেঙ্গে পরেছে। আগুনের চিতায় পুড়ে শুদ্ধ হোক মানুষের প্রতি মানুষের অসম ভাবনা।
অর্ধেক কালো মানুষ জেল হাজতে থাকে ক্রাইম অভিযোগে অভিযুক্ত থাকে। ভালো সুযোগ পাওয়ার অবস্থানগুলো তাদের জন্য কঠিন করে রাখা হয়। মাত্র কয়েকদিন আগে মিশেল ওবামার সাক্ষাাতকার অনুষ্ঠানটি দেখছিলাম রাত জেগে।
যখন পারিবারিক সাপোর্টে মেয়েটা পড়ালেখা করে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিল, তখন স্কুল গাইডেন্স তার স্বপ্ন ভেঙ্গে চুড়মার করে দিয়ে বলে, প্রিন্সটন ইউনির্ভাসিটিতে যাওয়ার চিন্তা, তোমার জন্য একটু বেশি আশা করা হয়ে যাবে। এ ভাবে অনেক শিক্ষার্থির স্বপ্ন শুরুতেই শেষ করে দেওয়া হয়। ভুল তথ্য বা গাইটেন্সের নিজের ইচ্ছার প্রতিফলনে। মূল কথা তারা সরাসরি বলে না কিন্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে, তোমার যাওয়া লাগবে না ।ঐ বড় জায়গাগুলো তোমাদের জন্য নয়।
অনেক অভিভাবক বা শিক্ষার্থি আর ভাবতে পারে না এগিয়ে যাওয়ার। কিন্তু মিশেল নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। এবং শেষ পর্যন্ত প্রিন্সটনের শিক্ষা শেষ করে। সবাই এমন মনের জোড় পায় না।
"আই ক্যানট ব্রিদ" নতুন এই স্লোগান উই ক্যানট ব্রিদে পরিবর্তন হয়ে যে প্রতিবাদ চলছে ,তার হাত ধরে আসুক নতুন মানবতা। অনেক হয়েছে অবমাননা। মানুষ না ভাবা। মানবতাবাদী সবাই নিজের জানের পরোয়া না করে করোনার ভয় না করে কারফিউ অমান্য করে যারা মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে সবাইকে অন্তর থেকে ভালোবাসা জানাই। সতের বছরের যে মেয়েটি পুলিশি নির্যাতনের ভিডিওটি করেছে তার প্রতি শুভকামনা।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০২০ বিকাল ৩:৪৭