বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্র পরিচালনার সময় পর্যন্ত, বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট ছিল । পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না।
বাহাত্তর সনের সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতার বিষয়ে স্পষ্ট বলা আছে।
১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন তাতেও ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার বাণী। তিনি বলেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে; মুসলমান তার ধর্ম পালন করবে; খ্রিস্টান, বৌদ্ধ- যে যার ধর্ম পালন করবে। কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, বাংলার মানুষ ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ চায় না। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মকে বাংলার বুকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। যদি কেউ ব্যবহার করে, তাহলে বাংলার মানুষ যে তাকে প্রত্যাঘাত করবে, এ আমি বিশ্বাস করি।’
১৯৭২ সালে ৪ নভেম্বর পুনরায় জাতীয় সংসদে তিনি বলেন: ‘জনাব স্পীকার সাহেব, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না। ২৫ বৎসর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানি, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যাভিচার। এই বাংলাদেশের মাটিতে এ সব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয় নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি’।
বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম' এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বিষয় দু'টি ছিল না৷ ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম সংযোজন করা হয়৷ আর ১৯৮৮ সালে সাবেক সেনাশাসক এইচ এম এরশাদের সময় সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযুক্ত হয়৷
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পর ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ফেরার কথা বলা হয়৷ ২০১১ সালের জুনে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭২-এর সংবিধানে ফেরার লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের পাশাপাশি অসংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ বিবেচনায় সর্বোচ্চ দণ্ডের বিধান করে এ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা হয়৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ কিন্তু বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থেকেই যায়৷
৭২ থেকে ৭৫ মাত্র তিন বছর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্র পরিচালনার সময়।
৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে ইসলামকে প্রধ্যান্য দেওয়ার পর থেকে পদ্মা মেঘনাা যমুনায় অনেক জল গড়িয়েছে।
পুরো রাষ্ট ব্যবস্থার কাঠামো, চিন্তা চেতনা বদলে গেছে ধীরে ধীরে। আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বোরখা আবৃত্ ছাত্রীদের আগমন ঘটে তাদের বিস্তার বাড়তেই থাকে বাড়তেই থাকে। সাথে ইসলামী চেতনার ভুল ব্যাখ্যা ক্রমাগত সাধারন মানুষের মাঝে বিস্তার লাভ করে। শহরে জনপদে দোয়া, মজলিসের ভিড় বাড়ে। ধর্ম প্রচারের নামে গর্তে লুকিয়ে থাকা রাজাকাররা, ইসলাম প্রচরারে ব্যস্ত হয় যার মূল ভিত্তি তাদের কাছে ছিল ধর্মের নামে মানুষদের বিভ্রান্ত করে তাদের মনে ঠাঁই করে নেয়া।
সংবিধানে যেখানে স্পষ্ট করে বলা আছে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং প্রত্যেক ধর্ম পালনকারীর অধিকারের কথা। সেখানে ভুলুণ্ঠিত হতে থাকল অন্য ধর্মের বিশ্বাস ধর্ম প্রচারকারীদের প্রোরচনায়। যাদের অন্তরে নিজেদের বিশ্বাস ছিল, মানুষের ধর্ম ভিরুতার ভেলায় চড়ে মসনদ জয় করা। তারা সেটা করেও ফেলে। একাত্তরের ঘাতক দালাল রাজাকার বসে যায় সংসদে। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না। সংবিধানের এই স্পষ্ট বাক্য জেনেও তারা ধর্মকে ব্যবহার করে হাতিয়ার হিসাবে। বাংলাদেশের মানুষ এমনই বেকুব তারা রাজাকারকে ভোট দিয়ে জয়ী করে ।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূলের প্রবল প্রতিবাদ করেন, রাজাকারের ক্ষমতায় এসে সংসদে আসীন হওয়ার । ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ ‘গণআদালত’ এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের নরঘাতক গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠান করেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।
পদ্মা মেঘনা যমুনার জল আরো গড়ায় মানুষের মধ্যে পাকা পোক্ত হয় ধর্মের ব্যবসা। নারীদের আবৃত করা, অবমাননা। আর সুবিধা আদায়, হাওয়া ভবনের অনুপ্রেরনায়।
হঠাৎ করে দাবার ছক বদলে যায় বদলে দেয় একঝাঁক নতুন প্রাণ। যারা খুঁজে বের করে অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য। ভুল বোঝানো নির্বোধ মানুষের মাঝে তারা জাগ্রত করে স্বাধীনতার মূল ভিত্তি। ধর্ম অবতারদের মুখোশ উন্মোচণ করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সংসদে বসার সুযোগ পান, এই সব তরুণদের আশা হিসাবে ।
রাজনীতি বড় নিকৃষ্ট এক পথ; বিশেষ করে বাংলাদেশে। সবাই থাকে চাটুকারী এবং সুযোগের সন্ধানে। আওয়ামি লীগ দলের অনেকে পদাধিকার পেয়ে দেশের কাজ না করে, নিজেদের আখের গোছাতে ব্যাস্ত হন । বিরোধী দল শেষ কামড় হিসাবে দেশে নানারকম নৈরাজ্যের অবস্থা তৈরি করে। সুযোগ সন্ধানীরা নেত্রীর চারপাশ দখল করে রাখে।
আসল কর্মিরা চলে যায় দূরে আর সুবেশধারী নব্য আওয়ামি লীগরা হয়ে যায় কাণ্ডারী। দেশে তখন অনেক দলের শক্তিমান অবস্থান।
নেত্রী কাকে রেখে কার কথা শুনেন। কিন্তু সবাইকে খুশি করা যায় না।
সবাইকে খুশি করতে গিয়ে তিনি দেশের প্রতি অবিচার করলেন অনেক। দৃঢ় ভাবে সংকল্প বদ্ধ থাকলেন না দেশের ভালোর জন্য কাজ করার প্রতি। অন্য দলের সাপোর্ট আদায় করতে যেয়ে নিজের সাথে দেশের পায়েও কুড়াল মারলেন।
তার ফল এখন আমরা দেখি মূর্তি ভাঙ্গা, অন্য ধর্মের মানুষকে যাচ্ছে তাই ভাবে নিপিড়িত করা। দেশের মধ্যে নানা রকম ভেজাল খাদ্যে পণ্যে। টাকা পাচার অনেক কিছু নৈতিকতা বিরোধী কাজ চলছে।
শুধু তাই নয় তাদের পাখা এতটাই গজিয়েছে তারা সঙ্গীত বাউল আদালতের সামনে ভাস্কর্য ইত্যাদি নানা বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে এখন বঙ্গবন্ধু জাতীর পিতার ভাস্কর্য ভাঙ্গতেও পিছপা হয় না। যার কারণে একটা স্বাধীন দেশের জন্ম হয়েছে। যে দেশে থেকে তারা গলা উঁচু করে কথা বলছে। এ অধিকার তাদের থাকত না সাধের মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্থানে থাকলে ।
অথচ একটার পর একটা রাজাকারের ফাঁসি হওয়া, বিচার হওয়ার সময় যেমন শক্ত অবস্থানে নেত্রী ছিলেন, সে ভাবে যদি ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং ধর্মের নামে রাজনীতি করা বন্ধ করার আইন কার্যকরী করতেন। যে তরুণদের কারণে, যাদের লেখালেখির জন্য মানুষের দৃষ্টি পরিবর্তন হলে । দেশের মানুষ ইতিহাস জানল। সেই ব্লগারদের হত্যা, নির্যাতনের সময় তাদের নিরাপত্তা সহায়তা না করে সুযোগ সন্ধানী ধর্ম প্রচারকারী অন্যদের সাথে আপোশ না করতেন। আরো কিছুকাল আগে হয় তো বাংলাদেশের মানুষের মন মানসিকতা বদলে যেত জাতিয় ঐতিহ্যর প্রতি অনুভুতি প্রবণ হয়ে উঠত মানুষ। রাষ্ট্র কতৃক নির্ধারিত নিয়মের বাইরে নিজস্ব মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য যারা দেশে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে তারা রাষ্ট্র দ্রোহিতার কাজ করছে।
একমাত্র শেখ হাসিনাই এখনো পারেন দেশের মধ্যেকার এই অরাজগতা নির্মূল করতে। তার শক্ত নির্দেশে দেশটা হয়ে উঠতে পারে ধর্ম নিরপেক্ষ। মৌলবাদী পরিচ্ছন্ন সুস্থ বসবাসের আবাস।
বাঙালির লৌকিক ইতিহাস মিলে মিশে থাকা। বাউল ভাটিয়ালী গাওয়া, আনন্দ হাসিতে নিজেদের সুখে দুঃখে পাশাপশি থাকা।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২০ ভোর ৬:১১