শহরটিতে আগে সকাল শুরু হত কাকের কর্কশ স্বর দিয়ে।
যেমন শহরের এই ছোট বাসাটির কথাই ধরা যাক। আগে বাসাটি ছিল টিনশেড, সামনে বেশ জায়গাজুড়ে উঠোন ছিল। আর উঠোনে ছিল কয়েকটা নারকেল গাছ। গাছগুলো উচ্চতায় ছিল একতলা বাসাটির চারগুণ। সেই নারকেল গাছেই ছিল অনেক কাক পরিবারের বাস। কাকগুলো সেখানে নারকেল গাছের ডালে বসে থাকত আর পাতার ফাঁকেফাঁকে তাদের কালো ঠোঁটগুলো ঠুকে শান দিত অথবা কখনো ঠোঁটে কাঠি বা শুকনো ডাল এনে গাছে নতুন নতুন বাসা বানাত। আর তাদের পরিবারে নতুন অতিথি এলে বাড়িয়ে দিত সতর্কতার মাত্রা। এ শহরে কোকিল নেই, কাজেই কোকিলের ডিমে তা দেবার অজানা আশংকাও ছিল না কাকদের। এভাবে বেশ ভালই কাটছিল তাদের শহুরে দিনগুলো। সময় অসময়ে তারা কা-কা রবে এমনভাবে ভরে তুলত যে মানুষ তাদের একসময় শহুরে পাখি বলেই জানতে শুরু করল।
কাকগুলো তাদের দৈনন্দিন খাবার সংগ্রহ করত শহরের পড়ে থাকা আবর্জনা থেকে। নানাপ্রান্তের ডাস্টবিনে ভিড় লেগে ওদের থাকত সবসময়। যেহেতু শহরে মানুষজনের অভাব নেই, তাই ময়লা আবর্জনারও অভাব ছিল না। আর কাকদেরও তাই খাবারের উৎস ছিল অফুরান। শহরটিতে ভোর হবার আগেই পরিচ্ছন্নতাকর্মি পুরো শহর ঝাঁট দিত, আর দিনের বাকি সময় এ দায়িত্ব নিত কাকেরা। তারা যতটা না ময়লাগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করত, তার চেয়ে বেশি চেটেপুটে খেয়ে পরিষ্কার করে রাখত। এসবমিলে কাক ছিল শহরটির জাতীয় পাখি।
তারপর কয়েক বছর পরের কথা। এখনো শহরটিতে সকাল হয়, তবে তাতে কাকের ডাক মেশানো থাকে না। কারণ এখন সেই একতলা টিনশেডের মতন বাড়িগুলো আর নেই। সেখানে চারতলা সমান উঁচু নারকেলগাছগুলোর স্থান নিয়েছে ততোধিক উঁচু ইটপাথরের দালান। অন্যপ্রজাতির গাছগুলোও ক্রমশ কমে এসেছে। আজ শহরে প্রকৃত অর্থেই শহরায়ন ঘটেছে। আগে যে কাকগুলো তাদের বাচ্চাদের দিকে আক্রমণ করতে দেখলেই তাদের ধারালো ঠোঁটের একদু ঘা বসিয়ে দিত, সেই কাকগুলো তাদের বাসা হারিয়ে আজ কোথায় আশ্রিত হয়েছে কে জানে! এখন তাদের অস্তিত্ব গাছগুলোর মতনই ম্রিয়মাণ। একটি কাককে এখন ঢিল ছুঁড়লে কা-কা রব তুলে এগিয়ে আসে না বাকি কাকেরা, কারণ তাদের সমাজে এখন কাকদের সংখ্যা নেই বললেই চলে।
সেরকম শহরের অলিতেগলিতে আবর্জনার স্তুপে এখন আর পাওয়া যায় না কাকদের। সেখানে তাদের একসময়কার ভোজনোৎসব যেন এখন ইতিহাসের শীর্ণ পাতা। ডাস্টবিনগুলো বরং এখন ভরে উঠেছে কিছু টোকাই আর গরিব ছেলেপুলেদের দিয়ে। সেখানেই হয় টোকাইদের দৈনন্দিন ভোজন। শহরে শহরায়ন ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু বস্তিবাসী অভাবি লোকের সংখ্যা যেন আরো বেড়েছে।
এ শহরের আদি অধিবাসি জনৈক নাগরিক এরকমই একটা ডাস্টবিন অতিক্রমকালে আজ থেকে কয়েক বছর আগের চিত্রের সাথে কোথাও একটা মিল খুঁজে পায়। সে দেখে, পথচলতি ডাস্টবিনে খাবার কিংবা জীবনের সন্ধান করছে কিছু টোকাই। মানুষটির মনে হয়, তার শৈশবের সেই কাকগুলো আজ যেন টোকাই হয়ে শহরের আবর্জনার স্তুপে চলে এসেছে। কাকগুলোর আত্মা কি আজ তাদের জীর্ণদেহে? টোকাইদের শরীরে পরা ধুলোময়লা পোশাক দেখে তার অবিকল মনে হয় কাকরঙা শরীরের রূপ। এতসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ এক টোকাইয়ের কণ্ঠস্বর শুনে সে আবার আরেকটা মিল খুঁজে পায়। টোকাইগুলো তাকে এখান থেকে সরে যেতে বলছে, খাবার জোগাড় করে দিতে না পারলে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে মজা দেখা কেন। কিন্তু তাদের স্বর শুনে জনৈক নাগরিকটির জীবনসংগ্রামে ভারাক্রান্ত কোন স্বরের কথা মনে হয়না। বরং মনে হয়, টোকাইর মুখে উচ্চারিত হয়েছে সেইসব হারানো কাকের কর্কশ স্বর।
এবার কি তাহলে ঠোকর খাওয়ার পালা? ভয়ে মানুষটা ত্রস্তপদে একটু দূরে পিছিয়ে আসে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ১২:০২