#
আমার নাম মৃদুল। এই নামটা নিয়ে আমি বেশ বিরক্ত। নামটার মধ্যে ক্যামন দুল দুল ভাব আছে। হাজার হোক বাপ মায়ের আদর করে রাখা বলে বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হচ্ছে। তবুও আমার মামার জন্য বেশ মজার। আমি তার সামনে উপস্থিত হলেই সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বেশ জোরে জোরে বলতে থাকেন,পৃথিবীতে দুল কয় প্রকার জানিস?? আমি উত্তর না দিয়ে চুপ থাকি। মামা নিজেই উত্তর দেন, পৃথিবীতে দুল দুই প্রকার ;এক হইলো কানের দুল,আরেকটা হইলো মৃদুল। হা হা হা।
কলেজ থেকে ফিরছি। উদ্দেশ্য শান্তিনীড়। যে ভদ্রলোক এই বাড়ির নাম এটা রেখেছেন, আমার কাছে একদম যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়েছে,সারাদিন নিস্তব্ধ থাকে বাড়িটা, কোন হই-হুল্লোড় নেই। আমাদের স্থানীয় বাড়ি এক অঁজপাড়া গাঁয়ে বলে শহরে এসে বাসা ভাড়া নিয়েছি। আমি,আমার মা আর বোনের ছোট্ট একটা সংসার পেতেছি। আমার বাবা ব্যবসা সুত্রে ঢাকায় থাকেন।
বিকেলবেলা ছাদে উঠেছি, নেহায়েত কোন কাজ নেই বলে ছাদে উঠা। ছাদে উঠে দেখি নিশাত আপু ছাদের কার্নিশে বসে আছেন অনেকটা বৈরাগীর ভঙ্গীতে। ও হ্যা ভালো কথা আমরা যে ফ্লাটে থাকি ঠিক তার পাশের ফ্লাটে নিশাত আপুরা থাকেন,তার একমাত্র দুলাভাইয়ের আশ্রয়ে এখান থেকে পড়াশুনা করছেন। উনি আমার চেয়ে বয়সে পাক্কা তিন বছরের বড়, কিন্তু কি এক বিচিত্র কারনে আমি ইন্টার সেকন্ড ইয়ারে পড়লেও নিশাত আপু অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়েন। নিশাত আপুর আব্বু অনেক আগেই গত হয়েছেন, আম্মু বছর দুয়েক হতে যাচ্ছে গত হয়েছেন। এক কথায় নিশাত আপু পুর্ণ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এতীম তরুনী।
গত কয়েক দিন হইলো, নিশাত আপুর সাথে আমার 'অহি-নকূল' সম্পর্ক চলতেছে। আমি তাকে দেখে বেশ উল্লসিত ভঙ্গীতে বললাম,আপনাকে একদম পারফেক্ট বৈরাগী লাগতেছে,হাতে একটা সিরাগেট থাকলে পুরা দশে দশ হইতো।
তাতে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই,নির্বিকার ভঙ্গীতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি আবার বললাম, আমার কাছে ঘাসের একটা রেসিপি আছে, শুনতে চাইলে বলতে পারি।রোজ বানায়ে খেতে পারেন, তাহলে ছাগলের মত স্বাস্থ্যবান হতে পারবেন। দেখেনই তো আজকালকার ছাগলগুলা অনেক স্বাস্থ্যবান।
নিশাত আপু রাগ হয়ে যাবার বদলে বেশ সহজ ভঙ্গীতে বলল,দেখ মৃদুল ফাজলামুর মুডে নাই,মাথা ভীষণ ব্যথা করতেছে।
আমি বেশ সিরিয়াস ভঙ্গীতে বললাম, আচ্ছা মাথায় কিসব টেস্ট আর এক্স-রে করালেন তার কি খবর???
-জানি না।
-বাহ, খুব সুন্দর বলছেন। আমরা মনুষ্য জাতি কিছুই জানি না,যা জানি সব আপেক্ষিক।
-মৃদুল তুমি কি জানো তুমি কি ধরনের বর্বর প্রাণী??
-নাহ তো!! আমি বেশ উৎসুক ভঙ্গীতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম বাকি কথা শোনার জন্য।
-তুমি হচ্ছ সবচেয়ে নিচু স্তরের বর্বর প্রাণী।
-শুনে কৃতার্থ হইলাম।
নিশাত আপু আমার কথায় বিচলিত না হয়ে বলতে থাকলেন,তুমি নিজেই অই মেয়েটার পিছনে ঘুরলা,এখন মেয়েটাকে এইভাবে কষ্ট দিচ্ছ,এড়িয়ে যাচ্ছ।প্রতারক তো তুমি, বিশাল প্রতারক।আসলে তোমরা পুরুষ জাতটাই নোংরা, জিল্লুর নামের কুত্তাটা প্রত্যেকটা দিন যেভাবে জ্বালায়, নোংরামী করে,প্রতিদিন রাস্তায় চলতে আমার আতংক হয়।
-অউউউম।
-এইটা কি ধরনের উত্তর তোমার?? অউ তুমি তো আবার লজ্জ্বাহীন বেকুব ছেলে।
-আচ্ছা আপনি এরকম দয়ালু বড়ভাইটারে কিভাবে কুত্তা বললেন........মিলতেছে না। উনার তো দুইটা পা আর কুত্তার তো চারটা পা।মনে হয় কুত্তা না বলে বান্দর বললে ভাল হতো, এক্কেবারে জুতসই হতো।
নিশাত আপু কঠিন চোখে তাকালেন, সম্ভবত দাঁতও কিড়মিড় করতেছেন,তার মুখের কাছে কান পাতলে নিশ্চিৎ কিড়মিড় শব্দটা শোনা যেত।তবুও আমি এতটুকু বিচলিত হইলাম না, বেশ আয়েশি ভঙ্গি তে বললাম,আপু আপনি যেহারে দাঁত কিড়মিড়ি করতেছেন তাতে সব দাঁত পড়ে যাবে,এমনিতেই দূর্বল দাঁত। তারচেয়ে বরং এক কাজ করুন প্রতিদিন সকালবেলা উঠে এক কেজি করে মুড়ি চাবাবেন এতে দাঁত বেশ শক্ত হবে।
আপু এদিক সেদিক তাকিয়ে কিছু খুঁজছেন মনে হলো। সম্ভবত আমাকে মারার জন্য কিছু খুঁজছেন। আমি দ্রুত সটকে পড়লাম। বিপজ্জনক স্থানে বেশীক্ষণ থাকা ঠিক না।
নিশাত আপু অসম্ভব ভাল মানুষদের মধ্যে একজন, বেশ সাধাসিধে মানুষ। কাউকে ভালবাসার মত প্রচন্ড ক্ষমতা তার মধ্যে আছে। কিভাবে যেন আমি তার নিজের ভাইয়ের মত হয়ে গেলাম। তার ভালবাসার নমুনা অসংখ্য।একটা নমুনা দেই। একবার প্রচণ্ড জ্বরে পড়লাম মরি মরি অবস্থা। আমার ঠান্ডার এলার্জী আছে, প্রতি শীতে আমার এইরকম মরি মরি অবস্থা হয়। তো সেবার জ্বরে আমাকে আপু দেখতে এলেন। কপালে হাত দিয়ে বেশ চমকে গিয়ে বললেন,এ তোমার গায়ে তো অনেক জ্বর।
আমি শুকনো হাসি দিয়ে বললাম,আমার প্রতি বছর এমন হয়। আপু আমার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেললেন।
আমি হতভম্ব গলায় বললাম,আপু কান্দেন ক্যান??
আপু বেশ লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, কই না তো। অথচ তার চোখ পানিতে টইটম্বুর। এই হলো নিশাত আপু। এইরকম অনেক উদাহরণ আছে,বলতে গেলে ইতিহাস হয়ে যাবে।
#
আমি সন্ধ্যের দিকে বাইরে বের হলাম। জিল্লুর ভাইয়ের সাথে দেখা হওয়া দরকার, মাই ডিয়ার টাইপের মানুষ। দেখলেই নিজের ভাইয়ের মত খাতির জমায়।
লুৎফর মামার চায়ের স্টলে জিল্লুর ভাইয়ের দেখা পেলাম। বেশ আয়েশ করে সিগারেট খাচ্ছেন।ধূমপান করাও যে একটা শিল্প জিল্লুর ভাই কে না দেখলে তা বোঝার উপায় নেই। জিল্লুর ভাই আমাকে দেখে বেশ আহ্লাদিত ভঙ্গিতে বললেন, আরে মৃদুল, কি অবস্থা ভাই???
আমি বেশ বিগলিত কন্ঠে বললাম, এইতো ভাই।আমি চোখ সরু করে হাস্যমুখে বললাম,আপনার কি অবস্থা ভাই?? এমন ভাবে বললাম যেন অতীব কোন গোপণ কথা জানতে চেয়েছি
জিল্লুর ভাই বেশ লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, বলতে গেলে বিরাট কাহিনী। জিল্লুর ভাইয়ের অনেক তুচ্ছ ঘটনাকেও ইতিহাস বানানোর অসম্ভব দক্ষতা আছে। বলার আগে লুৎফর মামাকে চায়ের অর্ডার দেন। এসময় মামাকে জিল্লুর ভাই মামাকে 'ভাতিজ' বলে সম্বোধন করেন। সম্পর্কেরও যে উলটা বিবর্তন হয়,সেটাও সম্ভবত তার প্রতিভার একটা অংশ।
তার ইতিহাসের সারমর্ম এরকম,নিশাত আপুর সাথে তার আজকে দেখা হয়। আপু কে কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন কিন্তু কোন উত্তর দেয় না আপু। অনেক জোরাজুরির পর আপু উত্তর দেয়। জিল্লুর ভাইয়ের কাছে এটা মেয়ে মানুষের লজ্জা বলে মনে হয়। তারপর অনেক তাড়াহুড়ো করে জিল্লুর ভাইয়ের কাছ থেকে আপু বিদায় নিয়ে চলে যায়। এটাও জিল্লুর ভাইয়ের কাছে একধরনের লজ্জার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে হয়েছে। কিন্তু এর গূঢ় অর্থ যে ঠিক উল্টো টা তা সহজেই বোঝা যায়।
জিল্লুর ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নেবার আগে তার সঙ্গে হাঁটছিলাম মেইন রোডের ফুটপাত ধরে। জিল্লুর ভাই বললেন, বুঝলা মৃদুল পেইন নিতে ভাল্লাগে না
-কিসের পেইন ভাই?
-আরে মাইয়াটারে নিয়া। ভাবতেছি বিয়াটা করে নেব বুঝলা
আমি বেশ অবাক হলাম। মেয়ে তাকে পছন্দ করে কি না তা নিয়ে জিল্লুর ভাইয়ের মাথা ব্যথা নাই, বিয়াটাই তার ব্যপক চিন্তার বিষয়। আমি বললাম,করে ফেলেন ভাই। কোন কাজ ফেলে রাখা ঠিক না। কখন কি হয় বলা তো যায় না।
জিল্লুর ভাই বেশ খুশি হয়ে বললেন,এইতো বুঝছ।
-কিভাবে করবেন ভাবছেন কিছু?
-আরে অত ভাবাভাবির কি আছে কও? কালকে দেখা হইলে ডাইরেক্ট তুলি নিব, তারপর কাজি অফিস। কাহিনী শ্যাষ।
-যদি রাজি না হয়?
-শোন পুরুষ মানুষ হইলো চাক্কুর চরম ভক্ত,ভুড়ির মধ্যে হান্দায়া দিবা, সব ঠিক। আর মাইয়া মানুষ হইলো ধামকির ভক্ত। ধামকি দিবা, তার কাছে সব ঠিক, বেঠিক কিচ্ছু নাই।
আমি তার বুদ্ধির তারিফ করলাম। বেশ হাসি মুখেই বললাম,ঠিকি বলছেন ভাই।
-তুমি আবার তারে কিছু কইতে যাইয়ো না আবার।
-মাথা খারাপ, তাই বলি নাকি।
আমার কথায় জিল্লুর ভাই বেশ নিশ্চিন্ত হলেন। আমি বললাম,আমি যাই তাইলে যাই ভাই।
-ঠিক আছে যাও ভাই। কোন সমস্যা হইলে আমারে বলবা।
আমি জিল্লুর ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তার এপারের ফুটপাতে হাঁটা ধরেছি। ফুটপাতে যখন একা হাঁটি তখন আকাশ থেকে পাতাল পর্যন্ত বিভিন্ন রকমের ভাবনা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়, যাকে বলে আকাশ পাতাল ভাবনা। ভাবছি আমরা দুনিয়ার সবাই কম বেশি ক্রিমিনাল, যেমনটা আমি। আজকে একটা মেয়ের জন্মদিন,নাম মিথী।আমি তাকে একটা ধাক্কা দিয়েছি,যে ধাক্কার নাম প্রতারণা,রবার্ট ফ্রুস্টের মত অনেক সাধনা করে মেয়েটাকে এক ধরনের আবেগের জালে ফেলেছিলাম। অত্যন্ত কার্যকর জাল,সময়মত গুটিয়ে এনেছি । আজকে তাকে কোন কারণ ছাড়াই কঠিন সুরে বলেছিলাম, আমার সাথে আর যেন তোমার দেখা না হয়।মেয়েটা হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিলো, আমি তাকে অই অবস্থায় রেখে সটকে পড়েছিলাম।
সামের সাথে দেখা হওয়া দরকার, অনেক দিন ধরে দেখা হয় না। অসম্ভব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছেলে।ছেলেটা একটা মেয়ে কে অসম্ভব ভালবাসে,গদগদ হয়ে প্রেম নিবেদন করাটা তার চরিত্রে নেই বলেই মেয়েটাকে কিছু বলতে পারছে না। ছেলেটা প্রতিদিন মেয়েটার চলার পথে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে,কখন মেয়েটার সাথে দেখা হবে এই আশায়। দেখাও হয়, কিন্তু কেউ কার সাথে কথা বলে না। দেখে তবে সামের কেনো যেন এখন মনে হচ্ছে সে আর মেয়েটাকে ভালবাসার অধিকার পাবে না, কেউ একজন ছিনিয়ে নিবে,এবং সেটা খুব সম্ভব আমি।ইদানীং কালের তার শুকনো মুখ সেই চিন্তার আভাস দিচ্ছে। সামের এই শোকের দিনে তাকে মিথীর কাছে পাঠাবো সাথে থাকবে সদ্য কলি থেকে বের হওয়া গোলাপ, ফুলের দোকানে গেলে হয়তো পাওয়া যাবে। সাম আর মিথী দুজনে মিলে শোক করুক।রোজ তো রাস্তায় দুজনের দেখা হত, কথা হত না। এবার হবে নিশ্চয়।
ও হ্যা,একরাম চাচার সাথে দেখা হওয়া খুব জরুরী। তিনি আমাদের এলাকা থেকে এসেছেন। তবে প্রায় বছর পনের হল তিনি এখানকার বাসিন্দা, এখানে তার পরিচিতিও বেশ। তার একটা বৈশিষ্ট্য আছে অবাক করার মত, তার চোখে একধরনের কাঠিন্য আর নির্বোধ প্রকৃতির ভাব আছে। তিনি তেলাপোকা বেশ দক্ষতার সাথে মারেন।তেলাপোকা মারলে 'পটাস' শব্দ হয় আর বুক চিরে বেরিয়ে আসে রক্তের বদলে আঠালো তরল পদার্থ।কিন্তু তিনি যে তেলাপোকা মারেন তা দুই হাত-পা ওয়ালা আর মারার সাথে সাথে বুক চিরে বেরিয়ে আসে রক্ত, যার রঙ গাঢ় লাল।
আমি সামকে মিথীর কাছে পাঠানোর মত অসাধ্য সাধন করে রবার্ট ফ্রুস্টের চেয়েও বেশি গর্ববোধ করছি। তবে সদ্য কলি থেকে বের হওয়া গোলাপ পাই নি, দেশী গন্ধরাজ পেয়েছি, সেটা দিয়েই সামকে পাঠিয়ে দিলাম।অতঃপর একরাম চাচা কে তেলাপোকার সন্ধান দিয়ে আসলাম। তারপর অসম্ভব মাথা ধরা নিয়ে বেশ রাতে বাসায় ফিরলাম। পরম ক্লান্তিতে রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম, কারণ মাথা ধরার একমাত্র ট্রিটমেন্ট ঘুমানো
#
সকালবেলা নিশাত আপু একরকম জোর করে ডেকে তুললেন। লেপ থেকে মাথা তুলে ঘুম ঘুম চোখে তার দিকে তাকালাম।আমার পড়ার টেবিলের লাগোয়া চেয়ারে সে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছে।
-কি ব্যপার এখনও উঠ নাই ক্যানো??
কালকে রাতে ভীষণ মাথা ব্যথায় ঘুমের ঔষধ খেয়ে শুয়ে পড়েছি।সম্ভবত ঔষধ কাজে দিয়েছে। আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম, ক'টা বাজে??
-বেলা সাড়ে এগারো টা। দুইটা গুডনিউজ আছে, বলার জন্য আসলাম।একটা ভাল গুডনিউজ, আরেকটা কুৎসিত গুডনিউজ।
-ভালোটাই বলেন
-অই মেয়েটার সাথে আই মমিন মিথীর সাথে আজকে দেখা হইছিলো তাকে খুব খুশি খুশি লাগতেছিলো,মেয়েটার সাথে তোমার সাথে যে ছেলেটা ঘোরে, সাম নাম তার সাথে রিলেশন হইছে।
-অউ।বলে একটা হাসি দেই।
-শুধু একটা ব্যপার জানতাম না.......
-কি?
-সাম মেয়েটাকে আগে থেকেই অসম্ভব পছন্দ করত।
-অউ।বলে আবার একটা হাসি দেই।
-আর কুৎসিত গুডনিউজটা বাইরে গেলেই জানতে পারবা। তবুও বলি জিল্লুর নামের ফাজিল ছেলেটার লাশ পাওয়া গেছে মঠ মাঠে, শুনলাম মার্ডার নাকি।
আমি বিরক্তমুখে বললাম,মরা মানুষ কে ফাজিল বলার কি দরকার, মৃত মানুষের সব অপরাধ ক্ষমা করা উচিৎ।
-দিছি তো, অই ছেলেটার জন্য দু'রাকাত নফল নামাজও পরছি।
আমি বেশ চমকালাম তবুও মুখে বললাম,অউ।এবার আর হাসলাম না।
-তাই বলে ভাবিও না আবার, মানুষটা মরছে জন্য ভালবাসা উথলে পড়েছে। শোন মেয়ে মানুষ এত সহজে কাউকে ভালবাসে না, বুঝলা?
আমি নাক দিয়ে বললাম,হুঁউউউউ।বলে মৃদু একটা হাসি দিলাম।
আপু চুপ মেরে বসে রইলেন। তাকে দেখেবেশ আনন্দিত মনে হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, আপনার মাথার রিপোর্ট টার কি খবর?? কালকে রাতেই তো রিপোর্ট পাওয়ার কথা।
আপু বেশ বিরক্ত মুখে সহজ গলায় বললো,টিউমার ধরা পড়ছে, ক্যান্সার জাতীয়, যেকোন সময় মারা যেতে পারি।
আমি চমকালাম না, এরকম একটা আভাস অনেক ধরেই পাওয়া যাচ্ছিলো।
আপু বেশ নরম স্বরে ডাকলো, মৃদুল।
আমি চমকে গিয়ে তার দিকে তাকালাম। আপুর চোখে পানি, গাল বেয়ে পড়ছে। তাতে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আপু সহজ গলায় বললো, মাইন্ড কিউরিসিটি টাইপের একটা কোশ্চেন তোমার কাছে আছে।সেটা হল,আচ্ছা তুমি এত ভালো ক্যান বলো তো?
চোখের পানি বেশ সংক্রামক, যে কোন মুহূর্তে আমার মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। আমি প্রাণপণে চোখের পানি আটকে রেখে জবাব দিলাম, কারণ আমি যে আপনার ভাই। বলেই দ্রুত লেপের তলে মুখ লুকিয়ে নিলাম। কারন পুরুষ মানুষের চোখের পানি কাউকে দেখানো ঠিক না।
আপু কিছুক্ষন পর নিঃশব্দে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সারাদিন এলাকায় ঘোরাঘুরি করলাম, জিল্লুর ভাইয়ের জানাযা হয়ে গেলো, তারপর কবর। সমাজের উঁচু দরের মানুষ হিসেবে একরাম চাচা নিজেই এসব ব্যবস্থা করলেন। আমি বেশ অবাক হলাম জিল্লুর ভাইয়ের মারা যাওয়াতে শোক করার মত তেমন কোন মানুষ নেই। তার বাবা-মা অনেক আগেই মারা গেছে, তার একটা বোন ছিলো। সে গত দুই বছর আগে এক ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে।আর ফেরৎ আসে নি। আরও শুনলাম জিল্লুর ভাই সবসময় নেশা করে বলে তার আত্মীয়-স্বজন কেউ তার খোঁজ-খবর নিতে আসে না।
কোন কাজ নেই,কি করব ভেবে পাচ্ছি না। কলেজও বন্ধ। সেই সুত্রে কোন প্রাইভেটে যাই না। কয়েকদিন ধরে বেশ কয়েকটা ব্যপার নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম,এখন আর নেই সেই ব্যস্ততা। নিশাত আপুর সমাধান তো হয়েই গেলো, আপু এখন নিশ্চিন্তে কলেজ যেতে পারবে। ভাবতেই ক্যামন যেন মুক্ত মুক্ত ভাব আসে,সামেরও ব্যপারটা চুকে গেছে।আচ্ছা সামের সাথে দেখা করলে ক্যামন হয়, আড্ডা মেরে সময়ও কাটানো যাবে আর সুখী মানুষের সংস্পর্শে নির্মল আনন্দটাও ভোগ করা যাবে।
সামের বাসায় গেলাম। শুনলাম বাসায় নেই, কোথায় যেন গেছে। বেশ অবাক হলাম, সাম সহজে বাসা থেকে বের হয় না অথচ আজকে বাসায় নেই। পরে ফোন দিয়ে জানতে পারলাম, মিথী নামক মেয়েটাকে সাথে নিয়ে সে এই শহরের এক অনিন্দ্য সুন্দর জায়গায় গিয়েছে, যে জায়গার নাম সে কাউজে বলতে চায় না । ফোনে তার কন্ঠ শুনে তাকে অনেক খুশি মনে হচ্ছিলো।ভাবছি, এরকম সুখী মানুষে যদি পৃথিবীটা ভরপুর হত।
সন্ধ্যাবেলা বাসায় ফিরে জানতে পেলাম নিশাত আপুর অবস্থা গুরুতর। কাউকে চিনতে পারছে না। একটা ছবি আঁকড়ে ধরে চুপচাপ তার ঘরে বসে আছে। কেউ তার ঘরে এলে হতাশ ভঙ্গিতে সে জিজ্ঞেস করছে,আপনি কে?
অবস্থা বুঝতে আমি নিশাত আপুর ঘরের জানালার কাছে গেলাম। নিশাত ঘরে মোমবাতি জ্বালানো, সে বিছানায় গা এলিয়ে বসে আছে । তার চোখ দিয়ে পানি গাল বেয়ে পড়ছে। তাতে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে একদৃষ্টে একটা ছবির দিকে তাকিয়ে আছে, যে ছবিটাতে নিশাত আপুর আব্বু-আম্মু একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
আমি বেশ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, নিশাত আপুকে মোমবাতির আলোয়ে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে, পৃথিবীর বেঁচে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিস্পাপ মানবীটা বিছানায় বসে আছে আর আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।
ভোর রাতে নিশাত আপু বিনা নোটিশে মারা গেলেন। মারা যাবার সময় নিশাত আপুর হাতে ঐ ছবিটা ছিলো, বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। অই ফ্ল্যাট থেকে এখন মৃদু ক্রন্দনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আমি কান্নার শব্দ সহ্য করতে পারি না, তাই শান্তিনীড় থেকে বেরিয়ে এলাম।
শান্তিনীড়ের সামনে বেশ জটলা,সবাইকে একে অপরের সাথে বেশ দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে কথা বলছে। একরাম চাচাকেও দেখা যাচ্ছে। তিনি আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন। আমাকে বেশ নিচু স্বরে বললেন, ভাতিজা হায়াত মউত আল্লার হাতে।তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে উপরে নিয়া যাবেন। তুমি মন খারাপ কইরা থাইকো না।আমি অনেক কষ্টে মুচকি হেসে বললাম, চাচা একটা খারাপ মানুষ মরলে আরেকটা ভাল মানুষ মরবে। এইটা হচ্ছে ইকুয়ালিটি, উপরওয়ালার খেল।
চাচা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। আমি তাকে অই অবস্থায় রেখে সরে পড়লাম। গলাটা খুব যন্ত্রণা দিচ্ছে, কি যেন একটা প্রাণপণে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তাই আমাকে একা হওয়া দরকার,ভীষণ একা।
ভোরের আলো কেবল ফুটতে শুরু করছে। আমি মেইন রোডের ফুটপাত ধরে হাঁটছি খুবই মন্থর গতিতে। ভাবছি,আচ্ছা ভোরবেলায় নিশাত আপুকে দেখতে ক্যামন লাগতো, নিশ্চয় খুব নিস্পাপ।সত্যি সত্যি কি নিশাত আপু আর কথা বলবে না। আমি তো তাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলাম, এরকম ভাবে তো তাকে অনেকবার ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছি। অথচ সে নাকি আর ঘুম থেকে উঠবে না, কথাও বলবে না। গলাটা আসলেই যন্ত্রণা দিচ্ছে,জমে থাকা জিনিসগুলো প্রাণপণে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
আমি মৃদুল, ফুটপাতে বসে হাউমাউ করে কাঁদছি। মাথার উপর বৈদ্যুতিক তারে বসে দুটো কাক কা কা করছে। রাস্তার ঝাড়ুদার তার কাজ ফেলে থমকে দাঁড়িয়েছে। সে অবাক হয়ে দৃশ্যটা দেখছে,সম্ভবত এর চেয়ে অবাক করা দৃশ্য সে আগে কখনো দেখে নি।
-তাহমিদ আহবাব