এক।
শরতের বিকেলে,রিক্সা চেপে পরিবাগ থেকে মগবাজার একটি বেসরকারি হাসপাতালে যাচ্ছে রায়হান ও তৃনা । পরিবাগের রাস্তায় শীত, গ্রীষ্ম, বসন্ত সবই ওদের আপন মনে হয়। বিয়ের আগে, প্রেমের উত্তাল আগ্রাসী আবেগের সময়টা ওরা এই পরিবাগের রাস্তায় হাতে হাত রেখে এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হেঁটেছে, একটা হেডফোন দু’জন ভাগ করে কানে গুঁজে ঘন্টার পর ঘন্টা দুলাল মামার দোকানে কাটিয়ে তৃনা ও রায়হান । আজ ওদের তিন বছরের সংসারে সব চাইতে আনন্দের দিন । রায়হান তৃনাকে প্রথম চুমুটা খেয়েই জানতে চেয়েছিলো আমাদের বাবুর নাম কি হবে? তৃনা লজ্জায় কানে কানে বলেছিলো; রায়হান একটা চুমুতে বাবু হয়ানা ! এখানে বসেই রায়হান তৃনা কে পেঁজা মেঘ চিনিয়েছিলো, আকাশে তুলোর মতো আকৃতিবিশিষ্ট যে মেঘ ভেসে বেড়ায় তাকে পেঁজা মেঘ বলে একথা জানতোই না তৃনা ।
কত মধুর স্মৃতির ভীর ঠেলে ওরা সামনের দিকে যাচ্ছে, একটা নতুন অস্বিত্ব বাসা বেঁধেছে তৃনার শরীরে; বাবা হতে চলেছে রায়হান। দু’জনের মধ্যে আনন্দের যে ধারা বইছে তবুও কেউ কাউকে এখনো কিছুই বলছে না । ডাক্তারের মুখে শুনেই হয়তো হাউমাউ করে কেঁদে ফেলবে রায়হান, নয়তো তৃনার হাত ধরে হয়তো চুপ হয়ে মাথাটা নুইয়ে রাখবে, কিংবা তৃনার কাঁধেই ঘুমিয়ে পরবে, তৃনা ভাবে রায়হান আসলে কি করবে ।
অভিনন্দন রায়হান ভাই ডাক্তারের কথায় তৃনা মৃদু হাসছে; এই হাসিতে ফেঁসে গিয়েছিলো রায়হান আজ তার কোল জুড়েই আসছে রায়হানের সন্তান; রায়হান তৃনার দিকে তাকায় কেঁদে ফেলেছে রায়হান; তৃনাও মনে মনে তাই ভেবেছিলো ।
রিক্সায় একই পথে ফিরছে রায়হান ও তৃনা । রায়হান রিক্সাচালকে বিনা কারনেই বিনা কারনে ধমক দিয়ে বলে এই মিয়া আস্তে চালাও, একটা হাত দিয়ে তৃনাকে ধরে রেখেছে রায়হান, হাসপাতালে যাওয়ার পথে এতটা কেয়ারিং ছিলো না রায়হান, মুহূর্তেই জীবনের দৃশ্যপট পাল্টে গেলো; তৃনা বুঝতে পারে রায়হান এমন কেন করছে। মনে মনে সেই আনন্দ তার সবটুকু অস্বিত্ব ছড়িয়ে পরে তবুও কিছু বলছে না। দু’জের চরিত্রের প্রধান দুটি দিক হল রায়হান আনন্দে কেঁদে ফেলে আর তৃনা চুপ হয়ে যায়। রায়হানের ধারনা তৃনার মৃদু হাসি পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের যুদ্ধ থামানোর উত্তম ডিপ্লোমেটিক পলিসির অংশ হতে পারতো ।
দুই।
আনন্দের সংবাদ এসেছে আজ প্রায় একমাস হতে চলেছে। আজ তৃনাকে নিয়ে রায়হানের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা; অফিস থেকে এসেই রায়হান তৃনাকে নিয়ে বের হবে তাই তৃনা রেডি হয়ে টিভি দেখছে; একজন সুন্দরী নারী খবর পড়ছে সিলেটে পাশবিক নির্যাতনে রাজন নামে এক শিশুর মৃত্যু; আচমকা নিজের পেটে হাত বুলায় তৃনা, এরমধ্যে ফোন বেজে ওঠে, আপনি এখনই ঢাকা মেডিকেলে আসেন ভাবি রায়হান ভাইয়ের বাইকে ধাক্কা দিয়েছে বাস, রক্ত লাগবে; মুহূর্তেই পৃথিবীটা শূন্য মনে হয় তৃনার। এত হালকা লাগছে মনে হচ্ছে ভার শূন্য হয়ে গেছে তৃনা, ২/৩ মিনিট চেষ্টার পর উঠে দাড়ায় সে গন্তব্য ঢাকা মেডিকেল;
তৃনার জন্য বাকি রয়ে গেছে শুধু আনুষ্ঠানিকতা, রায়হান নেই সেটুকু তৃনা তার অফিস কলিগদের মুখ দেখেই বুঝতে পারে, তৃনা চুপ হয়ে বসে পরে তখনও একটা হাত দিয়ে আগলে রাখে তার পেট !
রায়হান নেই আজ ৭ দিন, তৃনার চুপ থাকার স্বভাবটা তাকে নির্বাক করে দিয়েছে । গতকাল নিজের সংসার ছেড়ে তৃনা বাবার বাসায় এসেছে, বিয়ের পর এই প্রথম তার বাবার বাড়ি আসা । নানা ঘাতপ্রতিঘাতে প্রতিদিনের টুকরো টুকরো স্বপ্নে বোনা সংসার ছেড়ে দিয়েছে তৃনা, মা গিয়ে ট্রাকে করে নিয়ে এসেছে ফ্রিজ,টিভি আর হাঁড়িপাতিল।
তিন।
তৃনার বাবা বড় আইনজীবী। আজ আইনজীবীরা রাস্তায় মানববন্ধন করবে রাজন হত্যার বিচার চেয়ে, বাসা থেকে বের হওয়ার সময় নিজের রুম থেকে তৃনা বাবার কন্ঠ শুনতে পায়। এ অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না, এভাবে একটা শিশু কে কেউ কিভাবে হত্যা করতে পারে, তৃনার মাকে বলছে তার বাবা। এর একটা ন্যায্য বিচার হওয়া উচিত; বাবার সাথে খাবার টেবিলে যোগ দেয় ছোট বোন মোনা, বাবা আমরা বন্ধুরা ফেসবুকে একটা পেইজ খুলেছি এই হত্যার বিচার চেয়ে, বাবা মোনার কাছে যানতে চায় আচ্ছা মোনা হ্যাস ট্যাগ কি ?
তৃনার মন ব্যকুল হয়ে ওঠে সে কান ফিরিয়ে নিজের জগতে চলে যায় মমতায় হাত বুলায় নিজের পেটে; ইদানীং রায়হানের বদ অভ্যাসটা পেয়ে বসেছে তৃনাকে কখন কি ভাবে যে চোখ ভিজে উঠে বুঝতে পারে না তৃনা।
এমন সময় দরজার দাঁড়ায় মা; চল কিছু খাবি, তৃনা চোখ মুছে খাবার টেবিলের দিকে যায়, মা পাশে বসে তৃনাকে বলে দেখ মা; রায়হান নেই এই সত্য তোকে মেনে নিতে হবে; তিন দিনে আজ প্রথম কোন কথা বলছে তৃনা, মেনে নিয়েছি মা, শুধু মাত্র রায়হানের অস্বিত্বটুকু বাচিয়ে রাখতে চলে এসেছি খেতে; এই যে দেখো খাচ্ছি; মুখ খাবার তুলে নেওয়ার শক্তিটুকুও নেই তবুও তৃনা চেষ্টা করছে খেতে; (তবুও যেন তার সন্তান থাকে দুধে ভাতে)
কি বলছিস কি তুই ? এই সন্তানের কথা তোকে ভুলে যেতে হবে মা। এখনও সময় আছে আবার জীবনটা সুন্দর করে সাঁজা। রায়হান কে তোর বাবা কোন দিন মেনে নেয়নি, আজ এই অবস্থা একটা সন্তনা সহ এই সমাজের কোন ছেলেই বা তোকে বিয়ে করবে বল ? রান্না ঘর থেকে বুয়া এসে তৃনার পাশে দাঁড়িয়ে; দ্যাহেন আফা এই ডিসপুট নিয়া কে আবার আপনারে বিয়ে করবে ? বিয়ে করলেও কি সে বাবা পাবে ? মা বুয়াকে ধমক দেয়, তুমি যাও আমি কথা বলছি ।
তৃনা রান্না ঘর থেকে দা নিয়ে এসে মায়ের হাতে দিয়ে বলে নাও আমাকে খুন করো মা ? তুমি পারলে আমিও পারবো আমার সন্তান কে খুন করতে, রুম থেকে দৌড়ে আসে মোনা; আপা বুঝতে চেষ্টা কর, তোর মাত্র ত্রিশ, সামনে কত সুন্দর দিন পরে আছে; আমরা চাইলে তো আর তোকে রায়হান ভাইকে এনে দিতে পারবো না, তবে তোর আগামীটা সুন্দর করতে পারি সবাই মিলে, তুই মেনে নে আপা, এই সন্তান আমরা কেউ চাই না। তখনই ফোন আসে তার, মোনা ফোনে বলতে থাকে টিএসসি আয় আজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদ সমাবেশ হবে রাজন হত্যাকারীর বিচার চেয়ে, ব্যানার কি প্রিন্ট হয়েছে ? মোনা আবার তৃনার কাছে ফিরে আসে আপা ভেবে দেখ, এখনও সময় আছে; তৃনা মোনার কথায় কোন উত্তর দেয় না । আবারও চুপ হয়ে যায়। ফিরে যায় নিজের ঘরে, আবার আসে মা আমার খাবার রুমে দিয়ে দিও ।
রাতে মা খাবার নিয়ে আসে তৃনার রুমে, রেখে চলে যায়। সকাল হয়। আজও গতকালের মত সকাল, তৃনার কানে বাবার কন্ঠ ভেসে আসে, কতদিন বাবার সাথে কথা হয়না তার, বাবা মাকে বলছে; রাজন হত্যার বিচার পাবে এ জাতী স্বয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখছেন শুনলাম । মোনা বাবার সাথে যোগ করে হ্যাঁ বাবা গতকাল আমাকে লাইভ দেখালো একটা টেলিভিশন, আমিও বলেছি রাজন হত্যার বিচার না পেলে ঘরে ফিরে যাব না । রুমে শুয়ে খাবার টেবিলের এসব কথা তৃনার কানে যায়।
বাবা বেরিয়ে গেলে মা হাসি মুখে তৃনার ঘরে খাবার নিয়ে আসে, মা খেয়ে নে, আমার দাদুভাই যেন কষ্ট না পায় । মোনা বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার আগে তৃনার ঘরে যায়, আপা কালকের কথায় কিছু মনে করিস না, তোর জীবন তুই যে ভাবে চিন্তা করছিস সেই ভাবেই আগাবে; আপা খেয়ে নে, আমাদের চ্যাম্পু যেন কষ্ট না পায় ।
হুট করে সবার এই পরিবর্তন তৃনা বুঝতে পারে না। দুপুর গড়াতেই পেটের মধ্যে ব্যাথা অনুভব করে তৃনা। আদিম মমতায় সেই পেটে হাত বুলায়; ঘণ্টা খানেক পরেই পেটে ব্যাথা বেড়ে যায়, কন্সেপ করার পর তার এমন হয়নি; পিরিয়ডের তারিখে মনে করে; মিলিয়ে দ্যাখে তৃনা কিছুই বুঝতে উঠতে পারে না। একটু পর পর মা আর মোনা তার কাছে আসছে; কিছু লাগবে কি না জানতে চাচ্ছে ? রক্তাক্ত তৃনার বুঝতে বাকি থাকে রক্তের সাথে সাথে সাথে তার ভিতরের অস্বিত্বটুকু বিলীন হয়ে যাচ্ছে;
পেঁজা মেঘের দেশে, যেখানে চলে গেছে রায়হান ।
রানা, ২২/১০/১৫
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১০:৩৬