শৈশব ! আহ! শৈশব ! শৈশবের স্ম্বতিগুলো যেন সাদা ক্যানভাসে একটা রঙিন তুলির আঁচড়; আনুসঙ্গিক কিছুই মনে নেই শুধু মূল ঘটনা ছাড়া, যেন রবিঠাকুরের ছোটগল্প। তেমনি একদিনের ঘটনা, ক্লাস ওয়ানে পড়ি, কলোনির ভিতেরই আমাদের স্কুল। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে কি মনে হলো বাসায় না গিয়ে বাবার অফিসে চলে গেলাম। কলোনির ভিতরেই ছিলো বাবার সাইট অফিস। হঠাৎ আমাকে দেখে বাবার কি অনুভূতি হয়েছিলো তা আজ আর মনে নেই, কিছু একটা খেতে দিয়েছিলো এইটুকুই মনে আছে। শৈশব বড়ই অদ্ভুত সময়, যত সব তুচ্ছ জিনিসের প্রতি থাকে অদ্ভুত আকর্ষণ। হঠাৎ চোখে পড়লো টেবিলের উপর রঙিন একটা কাঠপেন্সিল। আমরা তখন কাঠপেন্সিলে লিখতাম, আমাদের পেন্সিলগুলো ছিলো গোল আকৃতির সাদা রঙের আর মাঝে মাঝে লাল গোলাপির রঙে আঁকা ছোট বিড়াল, ফুল আর পুতুল। খুব সম্ভবত সেগুলো চায়না থেকে আনা হতো। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম বাবার টেবিলে পড়ে থাকা পেন্সিলটা ষড়ভুজ আকারের, একটা তল কালো আর পাশের তলটা খয়েরী; আর কোনাগুলো সোনালি রঙ করা। জীবনের এত সুন্দর জিনিস দেখিনি আগে, আমি সাথে সাথে বললাম, "বাবা, এটা নেই?"
নাহ, এটা নেওয়া যাবে না; এটা অফিসের পেন্সিল।
-কাঁদোকাঁদো স্বরে বললাম," আমি এটা নিবো। বাবা, এটা আমি নিবো"
তোমাকে আজকে নতুন একটা কিনে দিবো, এখন বাসায় যাও।
-"না ! না ! আমি এটাই চাই"।
"আচ্ছা নাও; বলে বাবা পিয়নকে ডেকে পকেট থেকে একটা নোট বের করে দিয়ে বললেন, "এক্ষণি এইরকম একটা পেন্সিল কিনে নিয়ে আস"
বাবা ইচ্ছা করলেই আমাকে এমনি এমনিই পেন্সিলটা দিয়ে দিতে পারতেন, অফিসকে কোন হিসাবও দিতে হতো না; বাবার ব্যাবহারের জন্যইতো এইগুলা! তখন বুঝিনি, তবে বুঝতে শিখার পর যখনি ঐ ঘটনা মনে পড়ে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে।
২.
আমাদের এলাকায় এক ডাকে সবাই স্যারকে চিনতো, ইংরেজির জাহাজ বলতে যা বুঝায় আসলেই তাই ছিলেন উনি। স্যারের ছেলে আমাদের সাথে পড়তো, কিন্তু ছাত্র হিসাবে অতটা ভালো ছিলো না। উনি সাধানত ক্লাস নাইনের ক্লাস নিতেন। তো, আমরা ক্লাস নাইনে উঠার পর উনি ক্লাসের এসে বললেন, "আমি আসলে এই বছর তোদের ক্লাস নিতে চাইনি, কিন্তু হেডস্যার অনেক অনুরোধ করে রীতিমত জোর করে আমাকে এই ক্লাসটা ধরিয়ে দিলেন। তবে আমি একটা শর্ত দিয়েছি যে, ক্লাস আমি নিলেও প্রশ্ন আমি করবো না খাতাও আমি দেখবো না। এই বছর তোদের প্রশ্ন অন্য একজন টিচার করবে"।
-স্কুল শেষে স্যারকে ধরলাম, "স্যার, আমরা কি কোন অন্যায় করেছি? না হলে আপনি ক্লাসে এমন কথা কেন বললেন?"
পাগল। তোদের কোন কিছু না। সমস্যা হচ্ছে আমার পুলা তোদের সাথে পড়ে, আর আমি বাবা হয়ে কিভাবে তার পরীক্ষা নিবো! আমিই প্রশ্ব করবো, আমিই খাতা দেখবো ! ব্যাপারটা কেমন হয়ে যায় না ? তোরা চিন্তা করিস না, তোদের কোন সমস্যা না।
আবার শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসলো। পরে অনেক ভেবেছি; যে স্যার এত নীতিবান সেই উনি নিশ্চয় ছেলেকে কোন রকম অবৈধ সুবিধা দিবেন না, উনি নিশ্চয় ছেলেকে প্রশ্ন আগে থেকে বলে দিবেন না বা খাতায় অতিরিক্ত নাম্বার দিবেন না। তাহলে নিজেকে কেন প্রত্যাহার করে নেয়া ? এটাকেই কি বলে বিবেকের তাড়না ? না কি অতিরিক্ত দ্বায়িত্ববোধ?
৩.
যেহেতু দেশের বাইরে বাংলাদেশি কমিউনিটি স্কুল তাই বোর্ড পরীক্ষা ও বৃত্তি পরীক্ষাগুলোর তত্বাবধানে থাকে বাংলাদেশ এম্বাসি। বাবা স্কুল কমিটির প্রধান, সেই হিসাবে ব্যবহারিক পরীক্ষার সময় ভাইবা বোর্ডে থাকেন এম্বাসি থেকে একজন প্রতিনিধি, কমিটির প্রধান হিসাবে বাবা আর দুই তিনজন শিক্ষক। প্রতিবারই বাবা খুব সূচারুভাবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেন। শুধুমাত্র যেই বার ছোট ভাই এস.এস.সি পরীক্ষা দিলো সেইবার ইচ্ছা করেই ঐ ভাইবা বোর্ড থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখলেন। অনেক অনুরোধ করেও ঐবার বাবাকে বোর্ডে রাখা যায় নি।
পরে আমি একদিন বাবাকে বললাম, "আচ্ছা, তুমিতো অন্যদের ভাইভা নিতে পারতে। যখন ছোট ভাই আসতো তখন না হয় উঠে চলে যেতে"
বাবা হেসে বললো, "আমার ছেলের ব্যাচের অন্যরাও তো আমার ছেলের মত। আর সবার সাথেই আমার ছেলের একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা আছে। এখন আমি যদি বোর্ডে থাকি তাহলে নিজের অজান্তেই হয়তো কোন ভুল হয়ে যেতে পারে। অথবা পরবর্তীতে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে যে নিজের ছেলেকে এগিয়ে রাখার জন্য ওকে কম নাম্বার দেওয়া হয়েছে"
আরও একবার শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়লাম। পরে অনেক ভেবেছি। ভেবেছি, বাবা যদি ঐ বোর্ডে থাকতো , তাহলে কি কোন রকম অবৈধ সুবিধা দিতো ছোট ভাইকে? না। অবশ্যই না। তাহলে, আসলে এটা কি ? এটা কি সততা? না কি সতর্কতা? না কি বিবেক?
অনেক ভেবে দেখেছি আসলে এটা হলো সাধুতা। সততা মানুষের অপরিহার্য বিষয়, কোন অতিভৌতিক বৈশিষ্ট নয়। একজন লোক ঘুষ খায় না এটা তার কোন কৃতিত্ব হতে পারে না, বরং এটা হওয়ায় স্বাভাবিক; রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া মানিব্যাগ ফেরত দেওয়া কোন কৃতিত্ব হতে পারে না, বরং না দেওয়াটা অস্বাভাবিক।
হ্যাঁ, এটা সাধুতাই। সাধুতা।
৪.
এইবার আসি মূল বিষয়ে, আমাদের সামরিক বাহিনী। আমাদের সামরিক বাহিনী নিঃসন্দেহে অনেক চৌকশ ও দেশপ্রেমিক একটা বাহিনী । তারা যেমন দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্তে জীবনের পরোয়া না করে মুহূর্তে মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, তেমনি দেশও তাদের অনেক দিয়েছে ও দিচ্ছে। আমরা ব্লাডি সিভিলিয়ানরা শরীরে ঘাম বাষ্প করে প্রতিনিয়ত যে টেক্স দিচ্ছি সেই টেক্সের পয়সায় সামরিক বাহিনীর ঘি জোগার হয়, গলফ খেলার মাঠের কৃত্বিম ঘাস বসানো হয়, রুটিরুজি হয়। এতে আমার কোন আপত্তি নেই।
উচ্চপদস্হ কর্মকর্তারা নানাবিদ সুজোগ সুবিধা পেয়ে থাকে। কেউ কেউ বিভিন্ন সংস্হার প্রধানের দায়িত্বে থাকে, যেমন বিরিআর, কোস্টগার্ড, ডিজিএফআই, এনএসআই ইত্যাদি। যারা এমন সুজোগ পান না তাদেকে পাঠানো হয় বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ এম্বাসিগুলোতে। আবার অনেকে যারা এগুলোতে সুজোগ পায় না তাতের পাঠানো হয় জাতিসংগের মিশনগুলোতে। মুটামুটি কাউকেই পুরাপুরি বঞ্চিত করা হয় না। এতেও আমার কোন সমস্যা নেই।
আমার খারাপ লাগে তখনই যখন দেখি উচ্চপদস্হ সামরিক কর্মকর্তারা অবসরের পরেও বিভিন্ন বড় বড় গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ পদ গুলো দখল করে বসে থাকেন। সিনহা গ্রুপ, হামীম গ্রুপ, পেপসি, কোকাকোলা, বেক্সিমকো এইসব গ্রুপগুলোতে বিগ্রেডিয়ার, এয়ার কমোডর আর কমোডরদের জয়জয়কার।
সবচেয়ে ভয়ের কথা, এইসব কর্মকর্তারা ইচ্ছা করলে প্রশাসনকে অনেক ভাবেই প্রভাবিত করতে পারেন। এইসব প্রাইভেট কম্পানিগুলোর কি এই কারনেই এরকম অবসর প্রাপ্ত উচ্চপদস্হ কর্মকর্তাদেরকে পছন্দ করে? উনারা অবসর নিলেও ইনসার্ভিস অনেক অফিসার থাকে যারা উনাদের জুনিয়র এবং উনাদের নিজ হাতে গড়া।
তারপর, রাষ্ট্রিয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ, স্পর্ষকাতর ও গোপনীয় ব্যাপার উনাদের জানা থাকে। এটা কি একটা ভাববার বিষয় নয়? মানলাম, আপনারা অনেক সৎ, আইনত অবসরের পর যে কোন চাকুরি করতে পারেন, কিন্তু আপনারা কি একটু সাধুতা দেখাতে পারেন না?
কেন আপনাদের কি কম দেওয়া হয়েছে? দেশকে অনেক সার্ভিস দিয়েছেন, এখন একটু অবসরে যান, গলফ টলফ খেলেন, বউ বাচ্চাদের সময় দেন। আর কত?
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০০৯ ভোর ৪:৪৫