না, বিজ্ঞান নয়, আলোচনা করছি মনস্তত্ত্ব নিয়ে।
১.
ছেলেবেলায় আমার ইশকুল পালাবার অভ্যাস ছিল না তেমন, তবে ইশকুল অত ভালোও লাগত না, যেতে ইচ্ছ করত না। কিন্তু যেতে হত, যেতাম। বাবা সন্দেহ করত আমি আসলে ইশকুলে যাই-ই না, তিনি কয়েকদিন জিজ্ঞেস করেছেন, ইশকুলের নাম করে বের হয়ে বইয়ের ব্যাগ আসলে কই লুকিয়ে রাখিস?
এই প্রশ্নটায় আমার খুব আত্মসম্মানে লাগত। যে কাজ আমি করিইনি, সেটাই আমাকে শুনতে হত! এবং আরও খারাপ লাগত যে, ইশকুলের নাম করে বের হয়ে ব্যাগ কোথাও লুকিয়ে রেখে বাইরে ঘোরা যায়, এই চালাকিটা বাবাই নিজের অজান্তে শিখিয়ে দিচ্ছেন!
অনেক মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করে, কিংবা কেবল পরিবারের অযথা সন্দেহসূচক অপমানকর কথার কারণেই জেদ করে বখাটে কারও সাথে প্রেম করতে শুরু করে!
উপরে আমি দুইটা উদাহরণ দিলাম, এগুলো একটা মানুষকে পজিটিভ থেকে নেগেটিভ করে ফেলার নমুনা। একটা ভালো মানুষকে আপনি খোঁঁচা মেরে মেরে কথা বলে নেগেটিভ করে তুলতে পারেন। আবার একটা নেগেটিভ মানুষকে আপনি পজিটিভ কথা বলে বলে উৎসাহ দিয়ে পজিটিভ করে ফেলতে পারেন।
পজিটিভ উৎসাহের ক্ষমতা সম্পর্কে একটা উদাহরণ দেই, তখন রেবতী মোহন পাইলট স্কুলে পড়ি, ক্লাস আমার ভালো লাগত না। পাইলট স্কুল, খুব কড়াকড়ি! আমি পড়াশোনায় ভালো ছিলাম, রেজাল্টে ভালো ছিলাম না। সেখানে জাহাঙ্গীর আলম নামে একজন শিক্ষক ছিলেন, খুবই ভয়ানক। ক্লাসে এলে সবাই কাঁপত, খুব পৈচাশিক আনন্দ নিয়ে পেটাতেন ছাত্রদের।
সেই ভয়ানক স্যার একদিন আমাকে দাঁড় করালেন, আমার প্রস্রাবের উপক্রম হল। স্যার বললেন, সবাই এই ছেলেটাকে দেখ! এই ছেলেটার চলাফেরা আচার আচরণে এমন কিছু আছে যা তোমাদের কারও নেই! তোমরা এই ছেলেটাকে ফলো করবা এখন থেকে, আমি একে তোমাদের ক্যাপ্টেন বানালাম!
সবাই আকাশ থেকে পড়ল, আমাকে কেউ তেমন চেনেও না। নিজেও অবাক হলাম, আমার রোল তখন ৮৬! রোল এক থেকে পাঁচের মধ্যে না হলে তো ক্যাপ্টেন হওয়া যায় না। আমি ওই স্যারের ক্লাসের সময়গুলোতে ক্যাপ্টেন হয়েছিলাম কিনা মনে নেই, কিন্তু সেই থেকে আমি পাল্টে গেলাম, প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস এলো, পরের বছর ফার্স্ট হলাম!
এরপর থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
সেই আমি একই আমি ছিলাম, শুধু একটু উৎসাহই আমাকে আমূল পাল্টে দিল!
২.
গান্ধীজী বলেছেন, খারাপ শুনো না, খারাপ দেখো না, খারাপ বলো না, খারাপ ভেবোও না। কোথায় বলেছেন জানি না, মাঝেমাঝে সিনেমায় শুনতে পাই, কথাটা ভালো লাগে। প্রবাদেও আছে, নিয়্যত গুণে বরকত! আপনার মনে যদি প্রথমেই কু-ডাক আসে তবে তার ফল ভালো হবেই না। দোষটা ওই জিনিসের না, দোষটা আপনার নেগেটিভিটির। ধরুন, একটা টেবিলে চারজন খেতে বসেছেন, একই খাবার খাচ্ছেন, কেবল তার মধ্যে আপনার মনে খাবারটা নিয়ে অভক্তি কাজ করছিল এবং শেষে কেবল আপনারই পেট খারাপ হল আর কারোই কিছু হল না। এরকম প্রমাণ আপনারা অনেকবারই পেয়েছেন।
আপনি শুভ চিন্তা করলে শুভটাই ঘটবে, কেউ আপনাকে হিংসে করলে বা আক্রমণ করলেও আপনার তরফ থেকে যদি সে বাঁকা আচরণের বদলে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ পায় সে তখন পাল্টাতে বাধ্য।
৩.
ভালোবাসার মানুষকে আমরা মায়া উথলে ওঠার জন্য বলি, আমি মরে গেলে কী করবা?
কিংবা ভয় দেখাতে বলি, এমন করলে হারিয়ে যাব কিন্তু!
কিংবা অভিমান করে বলি, তোমাকে আর ভালোবাসি না!
এই সবগুলো কথাই নেগেটিভ এবং এগুলো দিয়ে আপনি সম্পর্কের ক্ষতিটা ছাড়া ভালো কিছু করছেন না। প্রিয়জনের মৃত্যু অনেক বড় একটা ধাক্কার নাম, আপনি সেই সিরিয়াস বিষয়টাকে রোজ রোজ বলে বলে এমন স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন যে তারও সয়ে যাবে এবং আপনি মরলেও তখন আর তার অতটা কষ্ট হবে না! ওই হারিয়ে যাওয়া, ওই ভালো না বাসা এই সবগুলোই একই পর্যায়ের প্রভাব ফেলে চেতনায়!
"অফিসে নিশ্চয়ই আরেক কলিগের সাথে খাতির করছ, না?"
কিংবা "আমি যদি এতই খারাপ হই তবে কার কাছে যাবি যা!"
তামাশা করেও এমন কথা স্বামী বা স্ত্রীকে বলা উচিত না সে আপনাদের মাঝে যতই বিশ্বাস থাকুক! এমন কথাটা বলে মজা করা মানেই বিষয়টা তখন ইজি হয়ে গেল, তখন ওটা ভাবতেও আর সঙ্কোচ লাগবে না, করতেও সঙ্কোচ লাগবে না।
সঙ্গীকে কেবল সন্দেহের বশে এমন কিছু চার্জ করাও উচিত না। জিনিসটা যদি সত্য না হয়, আপনাদের মধ্যকার বিশ্বাসের বন্ধনটায় ফাটল ধরে যাবে!
আপনি যদি রাজা হন, অতিরিক্ত কমান্ড বা সতর্কতার নামে আপনি আপনার একনিষ্ঠ সেবককেও বৈরী করে তুলতে পারেন। যে সৈনিক আপনার জন্য জান দিতে প্রস্তুত, তাকে যদি বলে বসেন যে, আমি কাউকেই বিশ্বাস করি না! তখন ওই একনিষ্ঠ সেবকই আপনাকে ঘৃণা করতে শুরু করবে, দেখা গেল যে সে-ই আপনার জানের জন্য হুমকী হয়ে উঠেছে!
অপ্রিয় অসুন্দর জিনিসগুলোকে ঢেকে রাখতে হয়, এগুলোকে কখনও সামনে আনতে নেই। মানসিকতা পজিটিভ হলে দানবের সঙ্গেও সৌহার্দ্য করা যায়, আর নেগেটিভ হলে আপন ভাইও দূরে সরে যাবে। সিম্পল!
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১৯ বিকাল ৩:২৩