কোন নারী যদি একা জীবন কাটাতে চায় তখন তাকে সমীহের চোখে দেখা হয়! স্বাধীনচেতা, আত্মনির্ভরশীল, পুরুষের দাসত্ব বিরোধী ইত্যাদি ইত্যাদি বিশেষণে অলঙ্কৃত হয় সে! কিন্তু একজন পুরুষ যদি একা জীবন কাটাতে চায় তখন সমাজ তাকে প্রশংসা নয়, বলা যায় খুবই নিকৃষ্ট করে দেখে!
মন্তব্যটা নারী পুরুষ বিদ্বেষ মূলক ঠেকতে পারে বা দুর্বোধ্য শোনাতে পারে; এখানে বিদ্বেষের কিছু নেই, বাস্তবতাটা বিশেষ একটা সমস্যা তুলে ধরতেই উল্লেখ করা হল, পরবর্তী পাঠে তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে বলেই বিশ্বাস করি।
পরিবার বিষয়টা সহজে মানতে চায়নি, জোর করে বিয়ে দেবার চুড়ান্ত সব চেষ্টা করেছে, আমি শেষমেশ মানাতে পেরেছি যে আমার কারও প্রতি কোন অভিযোগ নেই, নিজের ব্যক্তিগত দর্শনের কারণেই আমি বিয়ে বিহীন একাকী জীবন কাটাতে চাই! খুব সহজে মানেনি কেউ, পনেরটা বছর ঘর ছেড়ে অন্য শহরে গিয়ে ছিলাম। আমার মা শোকে শোকেই মারা গেলেন! আমি নিশ্চিত, আমার পরিবারের সবাই অর্থাৎ ভাই বোন এবং মরার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মা নিজেও- আমার এই একাকী জীবনের জন্য প্রত্যেকেই নিজ নিজকে দায়ী ভেবেছে! জীবিতরা এখনও ভাবছে!
আমার বয়স এখন আটচল্লিশ! বুড়ো হয়ে গেছি পুরোপুরি! আমার ভাই বোন নিজ নিজ সংসার জেঁকে বসেছে, তবু সবার সহমর্মিতার অর্ধেক দৃষ্টি থাকে আমার দিকে! ওরা পারলে আমাকে এখন শিশুর মতই লালন পালন করতে চায়! কিন্তু ওদের তো সংসার আছে, নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন আছে, আমি সেখানে ঝামেলা হব না বলেই নিজের পথ নিজে করেছি। একা একটা বাড়িতে থাকি। বাড়িটা কোনমতে নিজে করেছি। একজন চিরকুমারকে কোন বাড়িওয়ালা যে বাসা ভাড়া দিতে চান না এই সহজ সত্যটা আপনারা সকলেই তো জানেন!
চিরকুমারের জীবন কাটাতে গিয়ে যেসব সমস্যার শিকার হয়েছি তাই লিখছি এখন। একজন পুরুষ বিয়ে করছে না মানেই প্রথমে সবার যে চিন্তাটা মাথায় আসে তা হল পৌরুষের অক্ষমতা! সবাই সন্দেহে ভোগে, নিশ্চয়ই সঙ্গমের ক্ষমতা নেই, কিংবা হিঁজড়া নয় তো!
কী অদ্ভুত না? মানদণ্ড এই সঙ্গমের যোগ্যতা! কানাঘুষা শুনতে হয়েছে বিস্তর! অনেকে ইঙ্গিতে এমনও জানতে চেয়েছে যে উত্তেজনা উঠলে কী কী করেন! কেউ কেউ সমকামী ভেবেও এড়িয়ে চলেছে! কখনও কোন বাচ্চাকে কোলে নিতে গেলেও তা ভালোভাবে নেওয়া হয়নি। বিকৃত যৌনরুচির বলে সন্দেহ করেছে! চিরকুমার হতে গিয়েই জেনেছি, সব কিছুরই আবর্তে মানুষের কেবলই যৌন চেতনা! ওটাই প্রধান মাপকাঠি!
কোথাও গেলে পেছনে অনেকগুলো সন্দিহান চোখ আটকে থাকে আমার দিকে, আমি টের পাই!
তারপর থেকে আর কারও বাচ্চাকে কোলে নেবার সাহস হয়নি। একটা সন্তানের লোভ আমার বরাবরই হত। একবার বাচ্চা দত্তক নেবার সিদ্ধান্ত নিলাম। যোগাযোগ করলাম এক এতিমখানায়! আমি বিবাহিত নই জেনে তারা আর রাজি হল না! আমার নিজেরই সংসার নেই, আমি বাচ্চা পালব কিভাবে! তার উপর আমার শখ ছিল একটি মেয়ের! কোন কর্তৃপক্ষই রাজি হল না, কেউ কেউ পার্ভার্ট বলে সন্দেহও করল! আশা ছেড়ে দিলাম শেষমেশ!
দিনকে দিন বিচ্ছিন্ন হতে লাগলাম সমাজ থেকে, একঘরে হয়ে পড়লাম পুরোপুরি! এখন বয়স আটচল্লিশ, চামড়ায় ভাজ পড়েছে, মাথার চুল ঝরে গেছে অনেকাংশেই, নিজের চিরচেনা শরীরটাকে দুর্বল হিসেবে আবিষ্কার করতে আরম্ভ করেছি! প্রায়ই মনে হয়, এই একটা মানবজীবন পেলাম, কেমন তরতর করে শেষ হয়ে গেল! কবি শহীদ কাদরী মারা গেলেন জার্মানিতে, খবর পেলাম! মরার সময় নাকি কেউ পাশে ছিল না! কবি হেলাল হাফিজের কথা শুনলাম, একা থাকেন, এক গ্লাস পানি ঢেলে দেবার মত একজন মানুষের অভাবও কখনও কখনও বোধ করেন! এই বার্ধক্যে এসে এখন নতুন করে ভাবতে বসেছেন, আজীবন একা থাকার এই সিদ্ধান্ত কি ভুল ছিল, না সঠিক!
আমি বুঝতে পারি, একা একা মরে যাবার মত কষ্টের কিছু নেই। জীবন একটাই পেয়েছি, হিসেব কষিনি, দেনা পাওনাও রাখিনি। একা থেকে ভুল করেছি কি না ভাবি না কখনও, শুধু জানি, আবেগের অসম্মান করিনি, যা আমার কাছে সুন্দর ছিল, তাকে নষ্ট হতে দিইনি।
জীবনের যা সঞ্চয় তা দিয়ে একটি এতিমখানা খোলার কথা ভাবছি, আমার এই বাড়িটাতেই শুরু করব। একটি সন্তানের হাহাকার ছিল, এবার আমি শত শত শিশু পাব, আমার নিজের রক্ত কথা না বলুক, শত সন্তানের রক্ত আমার হয়ে কথা বলবে সেই বা কম কী!
শুভরাত্রি!
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:০৮