somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

GPS কী ও কিভাবে কাজ করে

২৭ শে আগস্ট, ২০০৯ রাত ১২:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


একসময় মানচিত্র, কম্পাস, স্কেল ইত্যাদি দিয়ে মেপে ও অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের সাহায্যে ভূপৃষ্ঠের কোন স্থানের অবস্থান (Position) নির্ণয় করা হত। বিজ্ঞানের উন্নয়নও নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনে এখন খুব সহজে ও নিখুঁতভাবে পৃথিবীর কোন স্থানের অবস্থান সম্পর্কে জানতে যে প্রযুক্তি ব্যবহার হয় তার নাম Global Positioning System বা সংক্ষেপে GPS। গাড়ি, জাহাজ, প্লেন, ল্যাপটপ এমনকি নতুন মডেলের মোবাইল ফোনেও এখন GPS রিসিভার থাকে। বিজ্ঞানের জটিল বিশ্লেষনে না গিয়ে এখানে সংক্ষেপে ও সরলভাবে GPS-এর বেসিক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবো।

ইতিহাস
US Military নিজস্ব প্রয়োজনে GPS প্রযুক্তির প্রাথমিক কাজ শুরু করে ১৯৭৭ সালে। এরপর ধাপে ধাপে এর উন্নয়ন ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ১৯৯৫ সালে ২৪টি স্যাটেলাইটের সমন্বয়ে সৃষ্ট নেটওয়ার্ককে পৃথিবীর সব জায়গা থেকে ব্যবহারযোগ্য একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সিস্টেম হিসেবে ঘোষণা করে। সেইসাথে সিস্টেমটি বিশ্বের বেসরকারী লোকদের ব্যবহারের জন্যও উম্মুক্ত করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইতে অবস্থিত স্যাটেলাইট ট্রেকিং ষ্টেশন থেকে US Military স্যাটেলাইটগুলোর নিয়ন্ত্রন ও মনিটরিং করে।

বেসিক কনসেপ্ট
GPS প্রযুক্তির বেসিক কনসেপ্ট সর্বসাধারণের বুঝার সুবিধার্থে একটি উদাহরণ তুলে ধরলাম:
মনে করুন আপনি বাংলাদেশের কোন জায়গায় হারিয়ে গেলেন। আপনি জানেন না জায়গাটির নাম কী, আপনি জানেন না আপনার আশেপাশে কোন শহর বা লোকালয় আছে কিনা! আপনি ঠিক করতে পারছেন না কোনদিকে যাবেন! এসময় (A) নামে একটা লোকের দেখা পেলেন তারও একই অবস্থা, পথ হারিয়ে ফেলেছে। তবে তার কাছে বাংলাদেশের একটা মানচিত্র আছে কিন্তু তা কোন কাজে আসছে না। কারণ আপনারা কোন জায়গায় আছেন তা জানলেই তো মানচিত্র দেখে আশেপাশের শহর কোনটি, কোনদিকে যেতে হবে, কতদূর যেতে হবে ইত্যাদি জানা যাবে।


এসময় X, Y, Z নামে তিনজন লোকের দেখা পেলেন। X বললেন আপনারা ঢাকা থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে আছেন, কিন্তু ঢাকার কোনদিকে (উ:, দ:, পূ: প: ) আছেন তা বলেনি। (A) তার মানচিত্রে ঢাকাকে কেন্দ্রবিব্দু ধরে ১১০ কিলোমিটারকে ব্যাসার্ধ (মানচিত্রের স্কেলে) ধরে একটি বৃত্ত আকঁল। (উপরের ছবির সবুজ বৃত্ত দ্রষ্টব্য)। অর্থাৎ যেসব জায়গার উপর দিয়ে সবুজ লাইনটি গেছে সেসব জায়গার কোন একটিতে আপনারা আছেন।

Y বললেন আপনারা রংপুর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে আছেন, কিন্তু কোনদিকে (উ:, দ:, পূ: প: ) আছেন তা বলেনি। (A) তার মানচিত্রে রংপুরকে কেন্দ্রবিব্দু ধরে ১৫০ কিলোমিটারকে ব্যাসার্ধ (মানচিত্রের স্কেলে) ধরে একটি বৃত্ত আকঁল। (উপরের ছবির নীল বৃত্ত দ্রষ্টব্য)। অর্থাৎ যেসব জায়গার উপর দিয়ে নীল লাইনটি গেছে সেসব জায়গার কোন একটিতে আপনারা আছেন। কিন্তু একই সাথে X ও Yএর তথ্যকে সঠিক হিসেবে নিলে আপনাদের অবস্থান গোপালপুর অথবা ময়মনসিংহে। কারণ সবুজ ও নীল বৃত্ত দুটি পরষ্পরকে এ দুটি জায়গায় ছেদ করেছে। গাণিতিক ও জ্যামিতিক হিসাবে শুধুমাত্র এ দুটি জায়গা থেকেই ঢাকার দুরত্ব ১১০ ও রংপুরের দুরত্ব ১৫০ কিলোমিটার।

Z বললেন আপনারা সিলেট থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরে আছেন। (A) তার মানচিত্রে সিলেটকে কেন্দ্রবিব্দু ধরে ১৪০ কিলোমিটারকে ব্যাসার্ধ (মানচিত্রের স্কেলে) ধরে একটি বৃত্ত আকঁল। (উপরের ছবির লাল বৃত্ত দ্রষ্টব্য)। অর্থাৎ যেসব জায়গার উপর দিয়ে লাল লাইনটি গেছে সেসব জায়গার কোন একটিতে আপনারা আছেন। উল্লিখিত নিয়মে আমরা দেখতে পাচ্ছি সবুজ, নীল এবং লাল বৃত্তটি পরষ্পরকে শুধু একটি বিন্দুতে ছেদ করেছে, সেটি হল ময়মনসিংহ! অর্থাৎ তিনটি বৃত্তের Intersection point (ময়মনসিংহ) থেকে X, Y এবং Z তিনজনের তথ্যই সঠিক। এভাবেই আপনারা জানলেন আপনাদের অবস্থান ময়মনসিংহে।

এখন আমরা বলতে পারি: X, Y এবং Z নামের তিনটি স্যাটেলাইট থেকে প্রেরিত বিশেষ তথ্য A নামের GPS রিসিভার গ্রহণ করে গাণিতিক ও জ্যামিতিক হিসাবের মাধ্যমে ডিজিটাল মানচিত্রে আপনার বর্তমান অবস্থানটি (Position) উল্লেখ করার যে পদ্ধতি/সার্ভিস তার পূর্ণনাম Global Positioning System ও ডাকনাম GPS।

স্যাটেলাইট:
GPS সিস্টেমের মূল অংশ হচ্ছে ২৭টি স্যাটেলাইট (24 active, 3 Reserve) ও GPS রিসিভার। ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০০০০ কিলোমিটার উপরে ৬টি অরবিটে ২৪টি স্যাটেলাইট পৃথিবীর চারিদিকে ২৪ ঘন্টায় দুইবার করে ঘুরছে।


পৃথিবী ও স্যাটেলাইটের ঘুর্ণায়ন অবস্থায় একটি GPS রিসিভার কিভাবে নিকটস্থ স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগ করে তার দৃশ্য

অরবিটগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে পৃথিবীর যেকোন জায়গা থেকে যে কোন সময় কমপক্ষে চারটি স্যাটেলাইট দৃশ্যমান হয়। স্যাটেলাইটগুলো প্রতিনিয়ত দুধরনের সংকেত (signal) প্রেরণ করছে ; L1ও L2। L1 হচ্ছে বেসামরিক লোকের জন্য, যার ফ্রিকোয়েন্সী 1575.42 MHz (UHF band)। এই সংকেতের জন্য প্রয়োজন Line of sight। অর্থাৎ যোগাযোগের সময় স্যাটেলাইট ও রিসিভারের মাঝখানে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারবে না। L1 সংকেতে যেসব তথ্য থাকে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে: "I'm satellite X", My position is Y এবং "This information was sent at time Z". তাছাড়া থাকে almanac data ও ephemeris data। সংকেতগুলো আসে আলোর গতিতে (৩০০,০০০ কিলোমিটার/সেকেন্ড)। প্রতিটি সংকেতে sending time লেখা থাকে।

GPS রিসিভার
GPS রিসিভার সংকেতটির reciving time থেকে sending time বিয়োগ করে runtime বের করে। runtime দিয়ে ৩০০০০০ কে গুণ করলে রিসিভার থেকে স্যাটেলাইটটির দুরত্ব বের হয়। এভাবে চারটি স্যাটেলাইটের দূরত্ব বের করে রিসিভার প্রতিটি স্যাটেলাইটের পজিশনকে কেন্দ্রবিন্দু করে প্রতিটির দূরত্বকে ব্যাসার্ধ ধরে চারটি ত্রিমাত্রিক বৃত্ত (sphere) অঙ্কন করে। তারপর বৃত্তগুলোর Intersection point দিয়ে 3-D Trilateration ক্যালকুলেশনের মাধ্যমে পজিশন নির্ণয় করে। ত্রিমাত্রিক পদ্ধতিতে গোলক (sphere) সৃষ্টি করে Trilateration ক্যালকুলেশনের মাধ্যমে সঠিক ফলাফলের জন্য কমপক্ষে চারটি স্যাটেলাইটের তথ্য প্রয়োজন হয়। অনেকসময় ৪র্থ স্যাটেলাইটের পরিবর্তে পৃথিবীর পরিধিকে ৪র্থ বৃত্ত হিসেবে ধরেও হিসাব করা হয়।



GPS সিস্টেমে সময় মাপের ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ১ লক্ষ ভাগের ১ সেকেন্ড = ৩ কিলোমিটার। এত ক্ষুদ্র সময় মাপতে পারে ব্যয়বহুল Atomic clock (accuracy ন্যানোসেকেন্ড) যা স্যাটেলাইটের আছে কিন্তু রিসিভারের নাই। রিসিভার স্যাটেলাইট থেকে প্রেরিত pseudo-random code কে synchronize করে নিজের ঘড়িকে আপ-টু-ডেট করে নেয়, অর্থাৎ স্যাটেলাইট ও রিসিভার উভয়ের ঘড়ির কারেন্ট টাইম একই হয়ে যায়। সাধারণ মানের GPS রিসিভার (±10m) সঠিক পজিশন দেখাতে পারে। Global Positioning System এর higher accuracy-র (±1m) জন্য ব্যবহার হয় Differential GPS। এই সিস্টেমে মহাশূন্যের স্যাটেলাইট ছাড়াও ল্যান্ড স্যাটেলাইট থেকেও তথ্য নেওয়া হয়। জিপিএস সফটওয়্যারে (জিপিএস ম্যাপ) রাস্তাঘাট ছাড়াও পেট্রোল পাম্প, পুলিশ স্টেশন, হোটেল/রেস্টুরেন্ট, পর্যটন স্থান, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ইত্যাদির তথ্য থাকে। কারেন্ট পজিশনের আশেপাশে উল্লিখিত কোন কিছু থাকলে জিপিএস ডিভাইসের ডিসপ্লেতে তা প্রদর্শন করে।
গাড়ি, জাহাজ, প্লেন ছাড়াও বড় বড় শহরে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রনে, যুদ্ধে শত্রুসেনার ট্রেকিং রাখতে, বোমা-মিসাইলের নিশানাকে সঠিক করতে, কোন বিশেষ স্থানের উপর নজর রাখতে GPS সিস্টেম ব্যবহার হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের GPS-র বিকল্প হিসেবে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন তৈরি করছে global navigation satellite system (GNSS)। যাকে বলা হয় Galileo। এটি ২০১৩ সাল থেকে চালু করা হবে। GLONASS নামে রাশিয়ার নিজস্ব নেভিগেশন সিস্টেম আছে যা মহাশূন্য গবেষনা ও সামরিক কাজে ব্যবহার হয়। চীনও Beidou-2 নামে তাদের নিজস্ব নেভিগেশন সিস্টেম তৈরির প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে।
----------------------------------------------------------
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট, উইকিপিডিয়া, HowStuffWorks,
Introduction to GPS: The Global Positioning System, Second Edition by Ahmed El-Rabbany
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০১০ রাত ২:৩১
৩৮টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×