ব্লগার রাসেল পারভেজ দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগে বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চিরবিদায় নিলেন ব্লগার রাসেল পারভেজ, যাকে ২০১৩ সালে গণজাগরণমঞ্চের আন্দোলনের উত্তাল সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মামলায় কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পুলিশ আরও তিন ব্লগারের সঙ্গে গ্রেপ্তার করেছিলেন। পিএইডি গবেষণার জন্য জাপান ঘুরে আসার পর গতবছর রাসেলের ইউরিনারি ব্লাডার ক্যান্সার ধরা পড়ে। এরপর মুম্বাই টাটা মেমোরিয়ালে চিকিৎসা চলে তার। পরে অপরেশন করে তার ব্লাডার ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন পর ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে শরীরের অন্যান্য অংশেও। গতকাল বুধবার আসরের নামাজের পর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি মসজিদে রাসেলের জানাজা হয়। আজ বৃহস্পতিবার জোহরের পর দিনাজপুরে গ্রামের বাড়িতে আরেক দফা জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হবে।
বাংলা ব্লগোস্ফিয়ারে অত্যন্ত সুপরিচিত নাম রাসেল পারভেজ। কমিউনিটি বাংলা ব্লগ সামহয়্যার ইন ব্লগের একেবারে শুরুর দিকের ব্লগার রাসেল ( ........) যাঁর পুরো নাম মোহাম্মদ রাসেল পারভেজ। 'আমার ব্লগে' রাসেল পারভেজ নামে লিখতেন। বিভিন্ন সময় তাঁর লেখা সাড়া জাগিয়েছে ব্লগ আঙ্গিনায়। ব্লগার পরিচয়ের বাইরে তাঁর সাধাসিধে জীবনযাপন আর দেশপ্রেমে মুগ্ধ অনেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র রাসেল যুক্তরাষ্ট্রে মাস্টার্স করেন। দেশে ফিরে শিক্ষকতা শুরু করেন একটি স্কুলে। ২০১৩ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর সেখান থেকে তার চাকরি চলে যায়। জামিনে মুক্তির পর পিএইচডির জন্য জাপানে যান রাসেল। সেখান থেকে ফিরে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে।
রাসেলের স্ত্রী আসমা বেগম লিপিও একই বিষয় নিয়ে পড়েছেন। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিতেই তিনি শিক্ষকতা করছেন। দুটি ছেলে-মেয়ে রয়েছে তাদের। ব্লগার রাসেল পারভেজের অকাল প্রয়ানে আমরা গভীর ভাবে শোকাহত। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং তার শোকসম্ভস্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।
২০০৬ সালে কমিউনিটি বাংলা ব্লগে লেখালেখি শুরু করেন রাসেল পারভেজ। সেসময় তাঁর লেখার বিষয় ছিল বিজ্ঞান এবং সামাজিক বিভিন্ন ইস্য। এক সাক্ষাৎকারে রাসেল বলেন, ‘‘বিজ্ঞান বিষয়ক লেখার সময় বিভিন্ন বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আমি পদার্থ বিজ্ঞান পড়েছি এবং আমার পড়াশোনার মূল জায়গাটি ছিল সৃষ্টিতত্ত্ব। এখন সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে পদার্থ বিজ্ঞানের বক্তব্যের সঙ্গে অনেকক্ষেত্রেই অনেকের দ্বিমত আছে। এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কিছু ধর্ম বিষয়ক বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু ধর্ম এবং বিজ্ঞানের বাইরে কোনো ধরনের ধর্ম বিদ্বেষী লেখালেখি আমি করিনি।''
পটভূমি
২০১৩ সালে ঢাকার শাহবাগে তখন আব্দুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে আন্দোলন চলছিলো, যিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের যুদ্ধাপরাধী ছিলেন। এই আন্দোলন চলাকালীন সময়ে আহমেদ রাজীব হায়দার নামক একজন ব্লগার খুন হন। তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর একজন কড়া সমালোচক ছিলেন। হেফাজতে ইসলামের মত কিছু মুসলিম সংগঠন ব্লগারদের ইসলাম বিরোধী আখ্যা দেয় এবং যারা ইসলাম ধর্ম অবমাননা করেছে তাদের শাস্তির দাবী জানায়।
শাহবাগে যারা আন্দোলন করছিলো তাদের এরা নাস্তিক হিসেবে ঘোষণা করে। এইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার কিছু ব্লগ এবং ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়। এরপর ব্লগে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে চারজন ব্লগারকে সরকার গ্রেফতার করে। তারা হলেন: রাসেল পারভেজ, মশিউর রহমান, সুব্রত অধিকারী শুভ এবং আসিফ মহিউদ্দীন। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এর পক্ষ থেকে সামহোয়্যার ইন ব্লগ কে বাধ্য করা হয় তারা যেন আসিফ মহিউদ্দীনের লেখা ব্লগ অপসারন করে নেয়। Human Rights Watch এই পদক্ষেপের নিন্দা জানায়। একই সাথে নিন্দা জানায় Amnesty International, the Center for Inquiry, Reporters Without Borders, the Committee to Protect Journalists সহ আরো অনেক সংগঠন। এভাবে ঘটনাটি আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টিগোচর হয় এবং তারা বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ শুরু করেন। ফলশ্রতিতে ১২ই মে পারভেজ এবং ১২ই জুন শুভ জামিনে মুক্তি পায় । তিনমাস জেলে থাকার পর আসিফ ২৭শে জুন মুক্তি পান।
"হেফাজতে ইসলাম অসহিষ্ণু ও উগ্রবাদী": রাসেল পারভেজ
জেল থেকে বের হবার পর ডয়চে ভেলকে দেওয়া রাসেল পারভেেজের সাক্ষাৎকার।
শারীরিক অসুস্থতার মধ্যেও রাসেল পারভেজ সোশাল মিডিয়াতে সক্রিয় ছিলেন। গত ১৮ জানুয়ারি ফেইসবুকে তার সর্বশেষ পোস্টটি ছিল ধর্ষণ প্রসঙ্গে:
শাররীক আগ্রাসন যতই ভয়াবহ হোক না কেনো উপযুক্ত চিকিৎসায় এবং পর্যাপ্ত বিশ্রামের পর নিরাময় হয়। অমোচনীয় ক্ষতচিহ্ন এবং আঘাতের স্মৃতি টিকে থাকে- হয়তো টিকে থাকে আতংক- অসয়াহত্বের অনুভবগুলো। ধর্ষণ , আমার মনে হয়, শাররীক আঘাতের চেয়ে অহং এবং আত্মমর্যাদার ক্ষত- যে ধর্ষণের বিচার চায়- সে নিজস্ব আত্মমর্যাদায় যেটুকু ধাক্কা লেগেছে- সেটুকুর ক্ষতিপুরণ চায়।
গল্প-উপন্যাসের চরিত্রের বানানো বুলিতে আমরা যে সমাজকে সৃজন করি নিজের কল্পনায়- আমাদের রাষ্ট্র তেমন কোমল-মানবিক নয়। আমাদের সম্পর্কগুলোকে আমরা যেমনটা পবিত্র কল্পনা করি- আমাদের সম্পর্কগুলো তেমন পবিত্র না। সম্পর্ক টিকে রাখার দায় থেকে যতজন কত ধরণের অপরাধের সহযোগিতা করছে- কতজন নিরীহ মানুষকে ভুক্তভোগী করছে- কতজনের জামার নীচে সারি সারি ব্লেডের ক্ষতচিহ্ন- আমরা দেখছি না। আত্মমর্যাদা আহত হওয়ার পরও যে মানুষগুলো প্রতিদিন ঘুম থেমে উঠছে- প্রতিদিন নিজের সাথে লড়াই করছে- অথচ পারিবারিক কারণে নিজের অপমানের বিচার চাইতে পারছে না- এইসব মানুষগুলোর জীবনে শান্তি আসুক।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
পত্র-পত্রিকা, ব্লগ ও ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১০:৫৭