সকালের ঝগড়ার রেশটা তখনও ছিলো। তাই অবস্থা বুঝে সখিনাই তিশাকে রাতের খাবার খাইয়ে , বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে , নিজের বাড়ির দিকে রওনা হলো।
ভাংগা রাস্তার দুপাশের বড় বড় সোয়েরেজ পাইপে প্লাস্টিক দিয়ে ঘর বানিয়ে থাকছে ওদেরই বস্তির অনেকে। শোনা যাচ্ছে, বস্তির ঘর ভাংতে আসবে সরকারের লোকেরা।
কিছু করবার নেই জেনেই ,ওসব নিয়ে মাথা ঘামায় না সখিনা।
ঘরের কাছাকাছি আসতেই দেখা গেলো, একজন লোক দাড়িয়ে আছে ঠিক ওর দরজার সামনে। কালো মুখের গড়ন, গলায় সবুজ মাফলার প্যাচানো, লুঙী পরা, পান চিবিয়ে চিবিয়ে মুখ লাল করে বিচ্ছিরি ভাষায় কথা বলছে লোকটা।
সখিনাকে দেখামাত্রই, একটা বাজে ভাষা ব্যবহার করে জিগ্গেস করল," ওই মাতারী তোর ভাতার কই?"
"হের আইতে দেরী হইবো", বলে কোনরকমে ঘরে ঢুকে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করলো ওই বদমাশটার কুনজর থেকে।
সারাদিন রিক্সা চালিয়ে যা টাকা-পয়সা কামাই হয় ,তার পুরোটাই শেষ করে আসে জুয়া খেলা আর বাংলা পানিতে। মাঝে মাঝে সখিনাকেও হতে হয় বন্দক। তাই পয়সা উসুল করবার জন্য ঘর পর্যন্ত চলে আসে শকূনগুলো।
হঠাৎ চ্যাঁচা মেচি শুনে দরজা খুলে দাড়ায় সখিনা কি হলো দেখবার জন্য। পুলিশের দাবড়ানি খেয়ে ,এলোপাথাড়ি দৌড়াচ্ছে হিরোইন বিক্রেতারা।
মারতে মারতে নিয়ে যাচ্ছে হিরোইন খোরদের ,পুলিশ কনস্টেবলরা।
তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দেয়, পাছে কোলের ছেলেটা ওসব দেখে না ফেলে। কিন্তু ভয় হয়, কতদিন এভাবে আড়াল করতে পারবে। ভাবতে ভাবতেই চুলোয় দুমুঠ চাল বসায়।
ঘরটা ঝাড়ু দেবার জন্য যেইমাত্র সখিনা উঠে দাড়াল, অমনি শামু হাত থেকে ঝাড়ুটা নিয়ে বললো," মা , আইজকা ঘরের কাম আমিই করমু। আমি বড় হইয়া বাবার মতো রিক্সা চালামু না, আমি হমু হলুদ গাড়ীর ডেরাইভার। তোমারে ট্যাকা আইনা দিমু, তুমি আর কাম করবা না। এই জায়গাই আমরা ছাইড়া দিমু,মা।"
ছেলের কথা অবাক হয়ে শোনে সখিনা। এভাবে কেউ ওর মাথার উপর ছায়া ধরবে, আশার আলো দেখাবে ,এ যেন ভাবতেই পারেনি কখনো। অবশ্য সখিনাদের ভাগ্যটাই এমন।
বিছানাপত্র পরিষ্কার করে, তার উপর একটা পেপার বিছিয়ে দেয় শামু। গরম ভাত আর আলুর ভর্তা থালায় নিয়ে শামুকে ডাক দিয়ে সখিনা বলে, " আইও বাজান, আইজকা তোমারে ভাত আমিই খাওয়ায় দিমু।" দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে সে। মা আর সন্তানের সম্পর্ক- এক নাড়ী ছেড়া সম্পর্ক।
শামুকে কোলের মধ্যে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ায় সখিনা। রাত বাড়ার সাথে সাথে আশপাশ নিস্তব্ধ হয়ে আসতে থাকে। এক পর্যায় চোখ লেগে আসে তারও।
হঠাৎ লোকজনের চিৎকারে ঘুম ভেংগে গেলো সখিনার। কি হচ্ছে কিছু বুঝে উঠবার আগেই দেখতে পেলো আগুন। ঘরের কোণা অবদি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কোনরকমে শামুকে কোলে তুলে, পরনের একখান কাপড়, ছেড়া কাঁথা আর বালিশটা নিয়ে বেরিয়ে আসে সে।
চোখের সামনে পুড়ে যাচ্ছে সমস্ত বস্তি। মানুষের হাহাকার, কান্নার রোল পরে গেলো চারদিকে। কেউ কেউ কোনরকমে জানটা নিয়ে বেরিয়ে এলো।
পাশের লেক থেকে পানি নিয়ে আগুন নিভানোর চেষ্টা করছে লোকজন। ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি সরু-ভাংগা রাস্তা দিয়ে কোনরকমে এসে পৌছলেও পানির উৎস পাওয়া যাচ্ছেনা। কিভাবে বাঁচাবে তাদের এই বসতভূমিকে। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিইবা করতে পারবে ওরা যেখানে ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীরাই হাল ছেড়ে দিয়েছে। আগুনের লেলিহান শিখায়, সমস্ত আকাশ লাল হয়ে গেলো।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ১০:৫১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



