বাথরুম থেকে চিৎকার করে কথাগুলো বললো ফয়সল। শার্টটা তাড়াতাড়ি আয়রন করে বিছানার উপর ঠিক করে রাখলো।
বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে দেখে নীশা জিজ্ঞেস করে কোথাও মিটিং আছে কিনা। কোনো জবাব না দিয়েই বেরিয়ে যায় ফয়সল।
গাড়ীতে উঠবে ঠিক এমন সময় মোবাইল বেজে উঠলো। ওপাশ থেকে নীশার গলার আওয়াজ শোনা যায়,"আমি কি তোমার সাথে যেতে পারি? আমি গাড়ীতেই থাকবো, যতক্ষন তোমার মিটিং চলবে। কিছুক্ষন তোমার সাথে বসা হবে আর রাস্তায় একটু ঘুরেও আসা হবে।"
না বলতে যেয়ে ও কি মনে করে বললো,"যে কাপড়ে আছো,সেই কাপড়েই নেমে এসো। আমাকে টাইম মেইনটেইন করে চলতে হয়। অলরেডি ছ'টা বেজে গেছে।"
গাড়ীতে বসে কিছুটা অস্বস্তিবোধ হচ্ছে নীশার। কেনো সে আসলো, ঘরে থাকলেই তো পারতো।
গাড়ীর ভেতর থেকে বাইরের আকাশটার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। কত বড় ঐ আকাশ। ওর বিশালতার চাদরকে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে তার।
মা মারা যাবার পর থেকে একদমই একা হয়ে গেছে সে। আগে কোনো কষ্টে এভাবে কখনো ভেঙে পরেনি সে। কারণ সব সমস্যার সহজ সমাধান মা'র কাছে ছিলো। মনটা নিমিষেই ভালো হয়ে যেতো।
ছোটবেলা শুনেছে, কেউ মারা গেলে আকাশের তারা হয়ে যায়। তাই প্রায় রাতেই ছাদে গিয়ে মাকে খোঁজে সে। জানে, একথা কেউ শুনলে হাসবে। কি দরকার সব কথা সবাইকে জানাবার। থাকুক না ঐ আকাশ আর ওর নিজের মাঝে একান্ত আপন হয়ে কথাগুলো।
ধানমন্ডির একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ীটা এসে থামলো। ফয়সল নামতে নামতে বললো, "এদিকে কোন কাজ থাকলে সেরে নাও। আমার কাজ শেষ হলে ফোন করলে চলে এসো।"
বসে বসে চিন্তা করলো, কোথায় যাবে সে এখন। যাবার কোনো জায়গাও তো নেই, যেখানে গেলে ভালো লাগবে। কতক্ষণ এভাবে রাস্তায় ঘুরবে সে। অনেক চিন্তার পর মনে হলো নীশার এক মামাত ভাই আছে , মহম্মদপুর থাকে। কিছুদিন আগে একটা ছেলে হয়েছে। ওদের সাথে দেখা করে আসলে হয়।
হঠাৎ করে উপস্হিত হওয়াতে কিছুটা অবাক হলো ওরাও। "কি ব্যাপার, গরীবের ঘরে হাতির পাড়া, পথ ভুলে আসলে মনে হয়?"
নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, " না রে ভাই, আসার ইচ্ছে থাকলেও আসা হয়ে উঠে না। তাই আজকে চলে আসলাম।" আসলেই কি তাই?
ঘড়ির কাটা আট, সাড়ে আট করে সাড়ে নয়টায় গিয়ে পৌছল। কোনো ফোন আসেনা। এভাবে আর কতক্ষণ বসে থাকা যায়।
নীশা নিজে থেকেই ফোন করে ফেলে। ওপাশ থেকে উত্তর আসে,"এখন আসো।"
পৌছে যায় গাড়ী নিয়ে। আবার ফোন দেয় সে। কিছুক্ষণ পর নেমে আসে ফয়সল।
গাড়ীতে বসার পর, জানতে চাইলে বলে,"মিটিং ওয়াজ সাকসেসফুল।" কিছুটা কৌতুহলী হয়েই নীশা জানতে চায়," মিটিংটা কার সাথে ছিলো?"
" বিদেশী একজন ক্লাইন্ট"- উত্তর দেয় ফয়সল।
কিছুদিন পরের কথা, প্রতিদিনের মতো সেদিন ও অফিসে কাজ করছিলো ফয়সল। মোবাইলটা বেজে উঠলো । কম্পিউটার থেকে চোখ সরিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে বাসার কাজের মেয়েটা বললো, "খালু, খালাম্মা জানি কেমন মরার মতো পইরা আসে বিছানার মধ্যে। কখন থেইক্কা ডাকতাসি, কোনো উত্তর দিতাসে না।"
কিছুটা বিরক্ত হয়েই , মিটিং বাদ দিয়ে বাড়ীর দিকে রওনা দেয় সে।
সাথে সাথে নিয়ে যাওয়া হলো ইউনাইটেড হসপিটাল।
ডাক্তার দেখেই বললো এটেম্ট টু সুইসাইড কেস।
"প্রায় আধা বোতল ঘুমের ঔষুধ খেয়ে ফেলেছে ," হাতের কাছে পাওয়া বোতল দেখে বললো ফয়সল।
"স্টমাক ওয়াশ করতে হবে "-বলেই এমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলো নীশাকে।
দুইদিন পর ফিরে এলো ওরা। ডাক্তার ডিসচার্জের সময় কি কি সব বুঝিয়ে বললো , ফয়সলকে। দুর থেকে সব দেখলো নীশা। কিন্তু সে ছিলো নিশ্চুপ। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে তার। সব কাজ বাদ দিয়ে আজ ফয়সলকে এভাবে ছুটাছুটি করতে হচ্ছে।
পরদিন সকাল থেকে সব কিছুই যেন পাল্টে গেলো।
ঘুম ভাংলো ফয়সলের ডাকে। হাতে চায়ের কাপ, আর একগুচ্ছ লাল গোলাপ।
নীশা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "এসব কার জন্য?"
"এই লাল গোলাপ আমার জীবনের সেই ব্যাক্তির জন্য, যাকে আমি সবচেয়ে ভালোবাসি। শুধু বলা হয়নি তাকে।"
সাথে সাথে মনে পড়ে গেলো, দু'বছর আগের এমন প্রতিটা সকালের কথা। কিন্তু একটা দুর্ঘটনাই সব কিছুই তছনছ করে দিলো।
সুখবরটা পেয়েছিলো বিয়ের দুমাস পর। নিজের ভেতরে একটু একটু করে বেড়ে উঠছে তার নিজেরই অংশ। এ পাওয়া যে কি, তা ভাষায় হয়তো প্রকাশ করতে পারে না সে।
ঘটনার দিন, বিজনেস ফাইল ভুল করে বাসায় রেখে যায় ফয়সাল। বাসায় আসবার মতো সময় হবেনা ভেবে, নীশাই ফাইল নিয়ে রওনা হয় অফিসের দিকে।
গাড়ী থেকে নেমে অফিসের ভেতরে যাবার জন্য যেই মাত্র ঘুরেছে, অমনি ঘটে গেলো সেই ঘটনা।
এক ছিনতাইকারী পাশ থেকে ব্যাগটা ছিনিয়ে নেবার সময়, হাতের ছুরি দিয়ে আঘাত করে গেলো তার তলপেট বরাবর। আর যা হবার তাই ঘটে গেলো।
সারাজীবন আর মা হবে না জানিয়ে দিল ডাক্তার। এই আঘাতটা সহ্য করতে পারেনি নীশা। একটু একটু করে বিষন্নতা তাকে পেয়ে বসছিলো।
এই কষ্ট থেকে নিজেকে আড়াল করবার জন্য হয়তো ফয়সল ও কাজের মধ্যে ব্যাস্ত হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু না চাইতেও দূর হয়ে যাচ্ছিলো নীশার কাছ থেকে।....
এভাবে ,নীশা যে ওর জীবন থেকে চলে যাবার চেষ্টা করবে , এ যেন চিন্তাই করতে পারেনা ফয়সল। বেঁচে থাকাই তো ওর জন্য। তাহলে?
না আর না। অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গেছে। সময়কে এখানেই রুখে দাড়াতে হবে।
"এই ক্ষুদ্র জীবনের যতটুকু অবশিষ্ট, সেটুকু নিয়েই আমরা বেঁচে থাকবো। বেঁচে থাকবো শুধু দুজনের জন্য। পরিপূর্ণ হবো দুজনাতেই।"
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ১২:৫৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



