সামনে সব খালি প্লট থাকায়, বড় রাস্তা পর্যন্ত দেখা যায় ওদের তিনতালা থেকে। শীতের কুয়াশায় চারপাশ তখনও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছেনা।
বেতের ঝুলন্ত চেয়ারে দোল খেতে খেতে কি যেন এক চিন্তায় মগ্ন হয়ে যায় সে। চোখ বন্ধ করলেই সব কিছু পরিষ্কার দেখতে পায়।
ঘটনাটা ঘটেছিলো বছর দুয়েক আগে। স্কুল থেকে হেটেই বাড়ি ফিরতো ঐশী। বেশ কিছুদিন ধরেই কিছু ছেলে উত্যক্ত করছিলো তাকে।
একদিন পথ আটকে গায়ে হাত দেয়, ছেলেগুলো। কষে চড় মেরে বসলে, জোড় করে গাড়ীতে উঠিয়ে নিয়ে যায় তারা । অনেক ধস্তাধস্তির পর কিছুদুর নিয়ে ছেড়ে দেয় তাকে।
বরাবরই হেটে স্কুলে যেতে নারাজ ছিলো ঐশী। কিন্তু বাবার কথা ছিলো, " যারা নিজেরা ভালো, তাদের সাথে কখনো খারাপ কিছু হয়না। আব ভালো তো জগৎ ভালো।"
বাবাদের যুগে ওসব ঘটনা হতোনা, তাই অনেক কিছুই তারা স্বাভাবিক ভাবেই মানতে চাইতেন না।
নিজের কাছেই নিজেকে ভীষণ ঘেন্না লাগছে তার। ঘরের বাইরের দুনিয়াটা এতো বর্বর। ভীষণ অস্থির লাগে; বাবার উপর রাগ হয় অনেক।
হঠাৎ বাবার ডাকে সম্বিত ফিরে আসে তার।
" জ্বী বাবা, আসছি... " বলেই ভেতরে চলে যায়।
কলেজের ফার্স্ট ইয়ার বলে , পড়ার চাপটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা ঐশী। ক্লাসে যায় সময় মতই আর ফিরে ও আসে ওভাবেই। নিয়মের কোন হের ফের হয়না।
ফিজিক্সের ২/৩ চ্যাপ্টার , কেমিস্ট্রীর আধখান চ্যাপ্টার কখন যে শেষ হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন এ যেন ওর মাথায় ঢুকছেনা। কেন এমন হচ্ছে ওর সাথে, আরও অনেকেই তো আছে ওর ক্লাসে। তাদের মাঝে আর কেউ কি আছে যে কিনা এই সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে?
ছোটবেলায় টুকটাক ছড়া লিখতো বলে বাবার কাছে কয়েকদিন বকা খেয়েছে। বাবার ভাষায় , কবিতা লিখলে মানুষ পাগল হয়ে যায়। তাই ওদিকটা ইচ্ছে থাকলেও আর সাহস করে যাওয়া হয়নি।
গানের গলা বেশ ভালোই ছিলো ঐশীর। নিজের ছোটবেলায় মা গান গাইতেন বলে, বাবার অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ঘরোয়া আসরগুলোতে মার উৎসাহেই গান গাওয়া হতো তার।
দিনের সবচেয়ে সুন্দর সময় তার কাছে এই সকালটাই। একা একা নিজেকে চিনবার চেষ্টা করে সে। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রায়ই জিগ্গেস করে জানতে চায়, আদৌ কি ওর প্রয়োজন ছিল এই পৃথিবীতে।
অনেক ছোট ছোট ইচ্ছের একটি ছিল, সেতার বাজানো শিখা। বাবার সাথে অনেক ঝগড়া করেও রাজী করাতে পারেনি মা। অনেক রাত অবধি জেগে, ছোট বোনের সাথে স্কেচ করে সে; পাছে বাবা দেখে ফেলে এই ভয়ে।
রাত দশটার পর টিভি দেখা বন্ধ। শুধু মা দেখবেন। কিন্তু যেদিন ডালাস হয়, সেদিন মা খুব সাবধানেই ওদের নিয়ে বসতেন, টিভির সাউন্ড কম করে দিয়ে।
পড়াশোনা ঠিক মতো হচ্ছেনা, ক্লাসে যেতেও ইচ্ছে করে না আজকাল। রেজাল্ট খুব খারাপ হয়েছে। অথচ টিচারের কোন কমতি নেই।
বাবার কথা, "যে যে সাবজেক্টে টিচার লাগবে নাও, কিন্তু পড়াশোনা ঠিকমতো হওয়া চাই।"
যেকোন বাবাই এটা চাইবেন।
মাঝে মাঝে খুব অভিমান হতো ,তার বাবার উপর।
" কেন বাবা বুঝতে চায়না, আমার ইচ্ছেগুলোকে কেন গলাটিপে হত্যা করা হবে।"
এইজন্য বাবার উপর রাগগুলো একটু একটু করে বাড়তে থাকে।
হয়তো এখন বুঝবেনা ঐশী।
সময় লাগবে বুঝতে। তাদের যুগ আর এখনকার যুগের মধ্যে হয়তো অনেক তফাৎ। তারপর ও।
বাবারা কি কখনো খারাপ চাইতে পারে ? এই ধ্রুব সত্য, সর্বকালের সবার জন্য। একেই কি বলে জেনারেশান গ্যাপ ?
না, ঠিক তা না, এই সমস্যা ঐশীর নয়।
সে তার বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে। বাবার জন্য সব করতে পারে সে। বাবা তার আদর্শ।
তাহলে ? কোথায় যেন হিসাবে ভুল হয়ে যাচ্ছে। ও কি নিজেকেই চিনতে পারছেনা ?
মা এসে বসেন ওর পাশে। জানতে চান সমস্যা কোথায়।
উফ ! কি অসহায় লাগছে তার নিজেকে । সেদিনের সেই ঘটনাটার কথা কেবল মা কেই জানিয়েছে সে। আজও বলতে চাচ্ছে কিছু, কিন্তু কী বলবে বুঝতে পারছেনা।
সাহায্য চাই তার, কিন্তু সেই সাহায্য কিভাবে দরকার তার, তাতো জানা নেই।
কলেজ থেকে ফোন আসে বাবার কাছে। প্রিন্সিপাল স্যার সোজা জানিয়ে দিলেন, ওকে আর কলেজে রাখা সম্ভব না।
ঐশীর বাবা কথাগুলো শুনছেন আর বেঁচে থাকার সমস্ত আগ্রহ যেন হারিয়ে ফেলছেন। কলেজ থেকে রওনা হলেন, গেটের কাছে এসে দাড়িয়ে পড়লেন। কোথায় যাবেন, কেন যাবেন,কিছুই মাথায় আসছেনা। আশপাশ সব অন্ধকার হয়ে আসছে।
গেট ধরেই মাটিতে বসে পরলেন। কতক্ষণ বসে ছিলেন বলতে পারবেন না। কোনরকমে একটা রিক্সা নিয়ে বাসায় পৌছলেন।
ঘরে ঢুকতেই মা ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিলেন। সম্ভবত প্রেসার অনেক হাই।
ডাক্তার ,বছর দুয়েক আগেই বলেছিলেন, হার্টে দুটো বড় ব্লক আছে । অপারেশান লাগবে। কিন্তু বাবার কাছে ঐশীর ভবিষ্যতই আগে।
দরদর করে ঘামছে ঐশী। ভীষণ অস্থির লাগছে।
"মনে হচ্ছে, বাবার শিকারের বন্দুক দিয়ে নিজেকে শেষ করে দেই।
আমার মতো মেয়ে দিয়ে আমার বাবার কি হবে? অপদার্থ একটা মেয়ে, ছিঃ ছিঃ !"
বিড় বিড় করতে করতে এগিয়ে যায় বাবার ঘরের দিকে।
ঘর থেকে মা বেরিয়ে আসেন। "কোথায় যাচ্ছিস ঐশী? তোর বাবাকে এই মাত্র মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে এলাম। এখন ঘুমোচ্ছে। কিছু কি লাগবে? "
আশ্চর্য হয়ে গেলো সে। মা একবার রাগ ও করলেন না। আজ বাবার যা অবস্থা, সেটা শুধু তার জন্যই।
বিকেলে বাবা ডেকে পাঠালেন ঐশীকে। অপরাধী মন নিয়ে এগিয়ে যায় সে। সামনে মোড়া দেখিয়ে বসতে বললেন তাকে।
"চা খাবি, মা ? "
পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখে, সে আর বাবা ছাড়া আর তো কেউ নেই ঘরে। তবে কি বাবা তাকেই বললো?
ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার। বাবাকে জড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। ঠিক তখনই বাবার হাতটা মাথার উপর বুলিয়ে দিতে দেখে , জোরে কেঁদে ফেললো সে।
"আমাকে, তোমরা কেউ বকছোনা কেন , বাবা ?" বলে বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে।
মা এসেও হাতটা রাখলেন ঐশীর মাথার উপর।
মনে হচ্ছিলো, সেই ছোট্ট ঐশী, যে বাবা মার হাত ধরে একটু একটু করে চলতে শিখেছিলো।খোঁজ-খবর নিয়ে একজন ভালো সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো ঐশীকে।
এখন নিয়মিত ঔষুধ খাচ্ছে সে।
তবে সমস্যাটা অনেকদিন পর পর দেখা দেয়। ঐশী এখন নিজেই বুঝতে পারে , কিভাবে কখন ঔষুধের ডোজ বাড়াতে বা কমাতে হবে।
এম,বি,এ করে একটা মাল্টি ন্যাশনাল কম্পানীতে ভালো বেতনের চাকরী করছে সে।
বাবার হার্টের দুটো স্টেন্ট লাগানো হয়েছে। উনি এখন পুরোপুরি সুস্থ।
মা আছেন সেই আগের মতোই।ছোট বোনটার বিয়ের কথা চলছে। সবকিছুর দায়িত্ব এখন ওর।
বাবার ছেলেও সে, মেয়েও সে ই।
জীবনে বিয়ে করবেনা সিদ্ধান্তটা ঐশীর নিজের। কারণ ও জানে, ওর যে সমস্যা, তাতে কাউকে সুখী করার চেষ্টায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও দুঃখী করেই ফেলবে ।
বাবা-মার কাছে সন্তান কখনো বোঝা হয়না। তাঁরা সব কিছু হাসিমুখে অন্তর থেকে খুশী খুশী মেনে নেন। তাই সন্তানরা যেকোন বয়সেই সন্তান।
আমাদের সব কষ্টের কথা, অভিমানের কথা, তাই তাদের কাছেই।
সব জ্বালাতন তো আমরা তাই বাবা-মাকেই করি, করবোও।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ১০:১৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



