এডভেঞ্চারের শুরু
শীতটা একটু জাঁকিয়ে বসতেই আমি আর আমার দোস্ত ঠিক করলাম হেব্বি একটা জোসিলা মাফলার আর জ্যাকেট কিনতে হবে। এখন, সেই হেব্বি জ্যাকেট আর মাফলারের খোঁজে ভার্সিটি এলাকা চইসা ফালাইছি। কিন্তু যখনই জ্যাকেট আর মাফলারে “হেব্বি” ভাবটা আসে, তখনই সেটার দাম এমন হুহু করে বাড়তে থাকে যে, আমরা টাশকিত হয়ে পিঁছু হটি।
দাম শুনে অবস্থা এমন যে, আমরা ঠিক করলাম দুজনে দুটা জ্যাকেট না নিয়ে শেয়ারে একটাই কিনে নিয়ে যাই। একদিন ও পড়বে আরেকদিন আমি। কিন্তু শরীরের মাপজোকে বিশেষ পার্থক্য থাকায়, এই অভূতপূর্ব প্ল্যান সংসদে পাশ হল না।
মনে বহুত আশা ছিল, এই সব কিনার পরেও ২টা এনিমেশন মুভির ডিভিডি কিন্যা বাড়ি যামু। কিন্তু, দাম শুনে মনে হচ্ছিল, উলটা মানিব্যাগটাই বেঁচে দিয়ে যেতে হবে।
যা হওয়ার তাই হল, গরীবের একসময়ের ভরসা(পাস্ট টেন্স) নিউমার্কেটে খোঁজ নেবার জন্য রওনা হলাম। তখন বাজে চারটা। পৌঁছে দেখি বাজে ৫ টা। এটা দেখি, সেটা দেখি। তেমন একটা ভাল লাগে না, আবার ভাল হলে সাইজ হয় না, আবার সব মিললে দাম মিলে না।
সব কিছু মিলিয়ে পর্যদুস্ত। মাথামুথা ঘুরায়া গেছে অতক্ষণে। নিউমার্কেট থেকে বের হয়ে দেখি সাতটা বেজে গেছে। ভাবলাম শেষ ভরসা হিসেবে গাউছিয়া খুঁজে দেখি। যেদিকে তাকাই শুধু নারী জাতির পোশাক, জ্যাকেট আর তেমন চোখে পড়ে না। ত ভাবলাম, সামনের দিকে হয়ত আরও অনেক দোকান পাব।
ওদিকে রাত হয়ে যাচ্ছে। সড়ে আটটার পরে আবার বাস নাই।
তাড়াতাড়ি চোখ বুলাচ্ছি চারিদিকে।
আমার দোস্ত আমাকে টান মারল মার্কেটের ভিতর। আমাদের প্ল্যান ছিল ফুটপাতের ভীড় এড়িয়ে মার্কেট গুলোর ভেতর দিয়ে একটা শর্টকাট মারার, যেন সামনের দিকের দোকান গুলোয় তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়।
এইটাই শেষমেষ হয়ে দাঁড়ালো কাহিনী।
এডভেঞ্চারের পর্যায়পথ
এইটা আসলে শর্টকাট ছিল না রে ভাই। এইটা ছিল ইয়ে গলি। মানে, এইখানে শুধু লাখ লাখ কোটি কোটি ইয়ে বিক্রী হচ্ছে। ইয়ে মানে হল, সংস্কৃতে বক্ষবন্ধনী আর বাংলায় ব্রেসিয়ার (বাংলায় চাপা মাইরা পাশ করসি আজীবন)। আমি আর আমার দোস্ত ত পুরা হতবাক। বাপরে এত এত দোকান, ডিসপ্লে ত শুধু এই সব। আমাদের নাক কান সব লাল হয়ে গেছে।
পরের ঘটনা আরও ভয়াবহ। চারিদিকে শুধু নারী জাতি। খুকি, বয়স্কা, আপু, ইয়ে, আন্টি সব শুধু নারী জাতি। য়ার সবাই আমাদেরকে দেখতেছে । না জানি ওরা কী মনে করতেছিল। উহাদের ধারণা, “ এই ছেলেগুলি বখাটে তস্কর ব্যতীত আর কিছুই নহে। উহারা এখানে এসব ইয়ে কিনিয়া কোন মেয়েকে গিফট দিতে ইচ্ছুক,তাহা নির্ণয় ন জানি।”
আমরা ত লজ্জায় ঘামায়া গেছি।
বের হওয়ার জন্য এ গলিতে যাই, সেদিকে ঘুরি, কিন্তু সবখানেই সেইম অবস্থা। কোথাও বের হওয়ার পথ নেই। কোন দিক দিয়ে ঢুকছিলাম, মনে নাই। দোকানদাররা আবার মাঝে মাঝে ডাকতেছিল, “ আপারা নিয়া যান।সব কম দাম। ” আমি আর আমার দোস্ত ডরাইয়া গেসি পুরা।
পরে অবশেষে এক ভদ্রলোকের দেখা। সম্ভবত, উনার স্ত্রী (অথবা যেই হোক) পাশের কোন দোকানে ইয়ে চয়েস করতেছিলেন। আমরা উনার কাছে জানতে চাইলাম যে 'বের হবার রাস্তা' কোনটা? উনি চোখমুখ কুঁচকে উত্তর দিলেন,”পেছন দিকে।” দোস্তের কান লাল হয়ে গেসে আরও। আমি ঢোঁক গিললাম। বললাম, “ ইয়ে,সেইটা ত জানি। কিন্তু পিছনে ত অনেক গলি, কোনটাতে যেতে হবে?” দোস্তও যোগ দিল, “ ভাই বের হবার রাস্তাটা একট্য পরিষ্কার করবেন? ” লোকটা নাক মুখ কুঁচকে ফেলল। বলল, “ যেদিক দিয়ে ঢুকেছেন, তার নিচে দিয়েই বের হবার রাস্তা। একদম মেইন রোডে পৌঁছাবেন। ” এখন মনে হল, এইটাও ত জানি। কিন্তু কান নাক সহ এতক্ষণে হাত পাও লাল হয়ে গেছে।
এই ব্যাটার সাথে কথা বলে আর লাভ নাই। বুঝা শেষ। উনি “বের হবার পথ” পরিষ্কার করার আগ্রহ দেখালেন না। উলটা ঘুরে চলে গেলেন।
এক দোকানদারের কাছে যেতেই এমন এক অর্থপূর্ণ হাসি দিল সে, যে জীবনটাই অর্থশূন্য হয়ে গেল। মানুষ আমাদের এমন ভাবে !! এই ব্যাটাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করার মানে হয় না।
আমার অবস্থা এমন যে, মনে হচ্ছিল যেন কেঁদেই ফেলব। প্রযুক্তির যতই উন্নতি হোক, গুগল ম্যাপ, গুগল আর্থ যাই –ই থাকুক, আমাদের এই চিপাগলির গোলক ধাধা থেকে বের করার জন্য কোন প্রযুক্তিই আমাদের সাহায্য করতে পারল না।
বিভিন্ন দোকানের ডিসপ্লে, দরদাম(এইসব ইয়েরও এত ভয়ংকর দাম শুনে জ্যাকেট কিনতে না পারার দুঃখ চলে গেসিল), আর দোকানকার এবং উপস্থিত নারী জনতার ভ্রুকুটি তে হাত পা লাল হওয়া শেষ করে পায়ের আঙ্গুলও লাল হওয়া শুরু করেছে।
পরে সমস্ত লজ্জার মাথা খেয়ে দরদাম করা এক সুন্দরী আপুর কাছে যেয়ে মাথা চুলকে ডাক দিলাম, “ আপু, প্লিজ লাগে, প্লিজ, আমাদের একটা কথা শুনেন। আপনি ব্যস্ত বুঝতে পারছি, আর বিরক্তও করতে চাই না। আসলে, আমরা বের হতে চাই। বের হবার পথ কষ্ট করে দেখাতে হবে না, মুখে বললেই আমরা বুঝতে পারব। ”
মেয়েটা আসলেই মনে হয় বিরক্ত হল। কারণ, আমরা অতক্ষণ ঘুরে ফিরে আসলে বের হওয়ার রাস্তার খুব কাছাকাছি এসে গিয়েছিলাম। মেয়েটা ডান দিক দেখি বলল, “ এদিকে একটু এগুলেই সিঁড়ি পাবেন, নিচে নেমে সোজা যাবেন। ”
শেষের কবিতা
দুটি অবুঝ বালক মধু কণ্ঠের নির্দেশ শ্রবণ করিয়া, ধীরে মাথা নাড়াইয়া, অবশেষে কামরূপ কামাক্ষা থেকে প্রাণ নিয়া বাহির হইবার পথের সন্ধান পাহিয়া, সে পথে দৃঢ় সংকল্পে পা বাড়াইলো।
আমাদের “ইয়ে এডভেঞ্চার” এখানেই সমাপ্তি।
অশ্রুসজল উপসংহার
সবশেষে শীত চলে যাবে সামনেই, এই সব ভেবে ভেবে আগের বছরের সোয়েটার আর নতুন মাফলার নিয়েই খুশি থাকতে হয়েছে।
© আকাশ_পাগলা
এই ক্যাটাগরীর সব পর্বের কাহিনী সত্যি। তাই দম ফাটানো হাসির কৌতুক আশা না করাই ভাল। এই ক্যাটাগরীর অন্যান্য পর্বের লিংক দিলাম। Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১১ রাত ৮:০৬