- আপনি হিটলারকে কেন অপছন্দ করেন?
- সে ইহুদিদের মারছে, ইউরোপ কাপাইছে, দুনিয়াতে যুদ্ধ লাগাইছে।
- ভারতীয়দের আর মুসলমানদের কিছু করছে ?
- হ..ওই দিক দিয়ে ভালো লোক আছিল।
- ভালো লোক ছিল তাহলে অপছন্দ করেন কেন?
- তুমি বাসায় আইসো, তোমার আন্টি তোমার কথা বলছিলো কয়েকদিন আগে।
এভাবেই মানুষ বুঝে না বুঝে একে অপরকে ঘৃণা করে। নিরপরাধ ১ জন ইহুদি যদি হিটলারের নাৎজি পার্টি দিয়ে আক্রান্ত হয় তার নিন্দা করা উচিত। এটা কি মানুষের সহজাত ত্রুটি অথবা ভাবনার ফুসরত মেলেনি তাই বলে ভুলভাল বকে যান, আমার জানা নেই। অপ্রিয় সত্য কথা বললে বা শুনলে ঘৃণার প্রবনতা কখনো কখনো মানুষকে চরম অকৃতজ্ঞ প্রাণীতে পরিণত করে। বুঝার সুবিধার্থে একটা দৃষ্টান্ত দেয়া যাক মহামতি হিটলারকে নিয়ে।
সাহেবরা ভারতীয়দের অর্থাৎ আমাদের পূর্বপুরুষদের জোঁকের মত চুষেছে। ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে এই উপমহাদেশ। আমাদের সম্পদ লুটে তারা তৈরি করেছে আধুনিক ইংল্যান্ড। অথচ দেখুন ১৯৪৩ সালের "বেঙ্গল ফেমিন" নিয়ে আমাদের দেশের অনেকের রাজনৈতিক গুরু চার্চিল বলেছিলেন, ভারতীয়রা ইঁদুরের মত বংশবিস্তার করে, তাদের না খেয়ে মরা উচিত। আর ফলশ্রুতিতে চার্চিল সাহেবের কথা অনুযায়ী, বাংলার মানুষ অভুক্ত কুকুরের মতো জীবন যাপন করেছিলো। না খেয়ে বাংলা অসহায় খেটে খাওয়া মানুষগুলো মরে পড়েছিল রাস্তার মোড়ে মোড়ে। কোনো প্রকার সাহায্য আসেনি এই দুর্ভিক্ষ পীড়িত বাংলায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা যখন তুঙ্গে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস বুঝেছিলেন বৃটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চাই। কারণ এখন তারা দিশেহারা, সঠিক রণকৌশল থাকলে কোটি কোটি ভারতীয় পাবে স্বাধীনতা। যার ফলশ্রুতিতে তার জার্মানি ভ্রমণ, হিটলারের মুখ দর্শনের প্রয়াস এবং ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী যুদ্ধের প্রস্তাবনা।
জল গড়িয়েছে অনেক দূর, আজ আমরা স্বাধীন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নেতাজীর নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ হয় ঠিকই, তবে হিটলারকে কেন যেন আমরা মেনে নিতে পারিনা। অথচ হিটলার সাহেবের ওই যুদ্ধে অংশগ্রহণ ছিল ভারতীয়দের জন্য শাপে বর। পরবর্তী রাজনৈতিক অবস্থাতে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। এর জন্যই হিটলার সাহেবকে মহামতি বলেছি। ভেবে দেখুন একবার, আপনি যদি এই মুহূর্তে ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে হিটলারের পরোক্ষ ভূমিকা সমর্থন করেন, তাহলে একজন স্বাধীনতাকামী। অপরপক্ষে হিটলারের ভূমিকা সমর্থন করে আপনি হয়ে গেছেন একজন মানবতাবিরোধী, কেননা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত পৃথিবীতে আছে হিটলারের প্রত্যক্ষ ভূমিকা।
তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের অবস্থান কি হতে পারে? আর যদি বিতর্ক এড়িয়ে চলেন আপনি কিন্তু অকৃতজ্ঞ মানুষে পরিণত হতে পারেন!
এই কথাগুলোর প্রেক্ষাপট উপনিবেশবাদ। যদি প্রশ্ন করা হয় কেন হিটলার বিরুদ্ধে জনমত সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল, অনেক রকম হেন-তেন বা তেনা প্যাচানো উত্তর পাওয়া যায়। বাস্তবতা হলো এই ইউরোপিয়ানরা শোষণ প্রিয় জাতি, একইসাথে উপনিবেশবাদের গুরুজন। নিজ ভূখণ্ডের বাইরে তারা এই সকল অপকর্ম করেছিল। হিটলারই প্রথম ব্যক্তি যিনি ইউরোপিয়ান হয়ে পোল্যান্ড আক্রমণের মাধ্যমে ইউরোপে ইউরোপিয়ান উপনিবেশ স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন।
আমাদের যে শ্বেতাঙ্গ দেবতারা শাসন করতেন, তারা ঠিকই জানতেন আমাদের উপর কোন মন্ত্র পাঠ করে ২০০ বছরের জন্য পরাধীন করা যায়। সেই একই মন্ত্র তাদের উপর কেউ পাঠ করবে এটা কি মেনে নেয়া যায়?
ইতিহাসের ভিন্ন পর্যালোচনা প্রয়োজন। যুদ্ধে পরাজিত হওয়া মানে এই নয় তারা নিকৃষ্ট। বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ মহাকাব্য রচনা করে অন্তত তাই বলার চেষ্টা করেছে। রামের গুণকীর্তন হয় বলে মেঘনাদ এবং রাবনকে নিয়ে ভাবা যাবে না, এরকম কোন বাধ্যবাধকতা আছে কি?
আমি নিজের দোষ ঢাকতে গিয়ে প্রায়ই বলি, দোষে-গুণে মানুষ। অন্য কেউ বলে কিনা আমার জানা নেই। তবে কেন যেন অন্যের সমালোচনা করতে গেলে দোষে-গুণে মানুষ ব্যাপারটি ভুলে যাই। এটা অন্যদের হয় কিনা তাও আমার জানা নেই। যুগে যুগে ঘটে যাওয়া এইসকল ইতিহাসের নিরপেক্ষ পর্যালোচনা অনেক প্রশ্নের যেমন অবতারণা করে, ঠিক একইভাবে ব্যক্তির অবস্থান কি হওয়া উচিত তা নিয়েও প্রশ্ন-সংশয়ের খেলা খেলে যায়।
হিটলার সাহেবের গুণকীর্তন করার কোন ইচ্ছা আমার নেই। উপরে বর্ণিত ঘটনা গুলো দিয়ে মনের কিছু ভাবনা এবং কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি মাত্র। কেননা, আমি চারপাশে আজ উপনিবেশবাদের প্রেতাত্মা সাম্রাজ্যবাদ আর আদিপত্যবাদ দেখতে পাই, যা ভর করে আছে বাংলাদেশের উপর। কোনোভাবেই নতুন দাসত্বের শিকার হতে চাই না পিতামহদের মতো।
আপাতদৃষ্টিতে উপনিবেশবাদ আমাদের চারপাশে নেই। এরপরও কিছু কথা থেকে যায়, থেকে যায় কিছু সংশয়। কোটি কোটি মানুষের ভালো থাকার স্বপ্নগুলো কোন কারনে আজও বাস্তবায়ন হয়নি পৃথিবীতে। কিছু শব্দ এবং কৌশলের পরিবর্তন হয়ে শোষণের নতুন রূপ জন্ম নিয়েছে। আমরা বুঝে হোক বা না বুঝে হোক অনেক সময় সক্রিয় বা নীরব সমর্থক হিসেবে কাজ করি।
যেমন ধরা যাক আধিপত্যবাদ শব্দটি। এটি উপনিবেশবাদ শব্দটির সমার্থক একটি শব্দ। কার্যক্রম তুলনামূলকভাবে আরো ভয়াবহ। আমাদের চোখের সামনে সবচেয়ে ভালো দৃষ্টান্ত প্রতিবেশী দেশ ভারত। আমরা উপমহাদেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাই উপনিবেশবাদের অভিশাপ, আর তাই রক্ত দিয়ে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা। আজ উপমহাদেশে আপাতদৃষ্টিতে তিনটি স্বাধীন দেশে বিভক্ত (আফগানিস্তান, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান একসময় অন্তর্ভুক্ত ছিল ভারতবর্ষের সাথে)। তবু দেখা যায় ভারত প্রতিবেশী দেশের উপর ব্রিটিশ পন্থায় উপনিবেশ এবং আমেরিকান কায়দায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে যাচ্ছে। কি দোষে দুষ্ট ছেলেতে পরিণত হলো ভারতের পররাষ্ট্রনীতি? অনেকের মতে চাণক্য নীতি, তবে আমার জানা নেই এর উত্তর। প্রতিরোধের সম্মুখীন ভারতকে যখন বেগ পেতে হচ্ছে, ভারতের মতোই একই কৌশলে বন্ধু বেশে তখন হাজির আরেক সম্রাজ্যবাদী চীন। শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেশ দখলের চেষ্টা করে যাচ্ছে চীন তা, বিশ্ব ব্যাংক এবং ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ডের দেখানো ভার্সন ২.০। চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি দিনদিনই ভার্সন ডেভলপ করে যাচ্ছে। ঋণের ফাঁদে ফেলে শ্রীলংকার হাম্বানটোটা বন্দর কে নিজেদের করে নিল ৯৯ বছরের জন্য, শুধু তাই নয় রাজনৈতিক মারপ্যাচে বদলে দিয়েছে শ্রীলংকার ক্ষমতাসীন দলকে। রাখাইন রাজ্যে সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করার জন্য চুক্তি করে চীন-মায়ানমার সরকার, তাতেও আছে শোষণের হাতিয়ার, লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা আজ তাই ভূমিহীন উদ্বাস্তু।
বাংলাদেশ সরকার বারবার যখন রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চায় আন্তর্জাতিক মহলে, তাতে বিরক্ত হয় চীন। এই বিরক্তি প্রকাশ লক্ষ লক্ষ মানুষের ভবিষ্যৎ করেছে অনিশ্চিত। যারা বাম রাজনীতির মতাদর্শ সম্পর্কে আমার মতো খুব সামান্য ওয়াকিবহাল আছেন, তারা জানেন বাম রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য, জনগণের অধিকার নিশ্চিত। তবে চীন কোন ধরনের বামপন্থী দল দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে এ ব্যাপারে বাম ঘরনার লোকজন ভালো বলতে পারবেন।
ফরাসিদের হাত আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের লাল রক্তে রঞ্জিত, এখনো তাদের নিয়ন্ত্রণে আফ্রিকা। তবে ব্যবসায়িক চীন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকাতে। তারা একদিন আফ্রিকানদের হাতে সোনালী শেকল পরাবে, আজ নয়তো কাল, ইতিহাস অন্তত তাই বলে। একই সাথে এটি নিশ্চিত, ইউরোপ মুক্তি পাবে না চীনের ভূ-রাজনৈতিক কৌশল থেকে।
এখনই আমাদের মুক্তির উপায় খোঁজা উচিত। কেননা বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধু হিসেবে বিবেচিত ভারত এবং চীন। উভয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো ব্যবসায়িক হাত বাড়িয়ে আমাদের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব হরণের নীল নকশা করে যাচ্ছে। বছরের পরিক্রমায় তাদের মত বন্ধু থাকলে শত্রুর প্রয়োজন হয় না এটা প্রমাণিত। দাসত্ব বরণ করে মুক্তির জন্য আস্ফালন ঠিক নয়। যদিও আমরা ইতিমধ্যে মানসিক দাসত্ব গ্রহণ করেছি। উদাহরণস্বরূপ, আমরা কমবেশি একমত, আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি মানবতাবিরোধী, তাদের সামাজিক অস্থিতিশীলতা তাদের উন্নতি সম্পর্কে আমাদের ধারণা দেয়। তৃতীয় বিশ্বে অবস্থান করা আমার মত সাধারন মানুষ ডলারের লোভে স্বপ্নে দিন গুজার করে, অর্থনৈতিক মুক্তি কামনা করে ব্যাংক ভর্তি ডলার দিয়ে। আমেরিকা এই জায়গাতে এতটা সফল যে, হাজারো বিপ্লবীকে তারা নপংসুকে পরিণত করেছে। সেই একই পথ অনুসরণ করছে চীন এবং ভারত। তাই হিটলার-মুসোলিনি ঘৃণার পাত্র হলেও আমেরিকা চীন এবং প্রতিবেশী ভারতের সরকারপ্রধানরা আমাদের কাছে এতটা ঘৃণিত নয়। দেশে দেশে রাজনৈতিক দলগুলোকে একিভাবে হাতের মুঠোয় নিয়েছে চীন। সস্তা দরে জিনিসপত্র ক্রয় করে চৈনিক গুণগান করে যখন আমরা দুই টাকা সঞ্চয় করি তখন মনের অবচেতনে সেই দাসত্বের সাথে মধুর আলিঙ্গন হয় আমাদের, যেমন আলিঙ্গন হয় ভারতীয় সিনেমা, গান এবং নায়ক-নায়িকাদের জীবনাচরণ দেখে।
একার ভালো থাকার যে প্রবণতা, তা বস্তুবাদের অভিশাপ। আর এই অভিশাপ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ সামষ্টিক উন্নয়নের ভাবনায় রয়েছে। যেমন করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সামষ্টিক ভালো থাকার স্বপ্ন। আজকের ত্যাগ আমাদের আগামী দিনগুলোতে ভালো রাখবে তাতে আমরা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী। আর এই আশাকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম হাতিয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবনা। জনগণের এই মানসিক পরিবর্তন খুলে দিতে পারে অনেক সম্ভাবনার দুয়ার। নতুন দিনের আশায় তরুণদের অগ্রগামী ভূমিকার প্রত্যাশা নিয়ে আজকের মতো এখানেই বিদায়।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০২০ বিকাল ৪:০৪