somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পীরদের দাবী: রাসূলুল্লাহ (সঃ)-সর্বত্র হাযির-নাযির???

১৬ ই নভেম্বর, ২০১১ রাত ১২:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আসসালামু আলাইকুম
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আমাকে এই লেখাটা শেয়ার করার তৌফিক দান করেছেন।
----------------------------------------------------------------------------------
রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ‘ইলমুল গাইব’ ও মীলাদে উপস্থিতির সাথে সম্পৃক্ত আরেকটি প্রচলিত বানোয়াট কথা যে, তিনি ‘হাযির-নাযির’

অর্থ এবং সঙগা: হাযির-নাযির দুইটি আরবী শব্দ। (حاضر) হাযির অর্থ উপস্থিত। (ناظر) নাযির অর্থ দর্শক, পর্যবেক্ষক বা সংরক্ষক। ‘হাযির-নাযির’ বলতে বোঝান হয় ‘সদাবিরাজমান ও সর্বজ্ঞ বা সবকিছুর দর্শক’। অর্থাৎ তিনি সদা-সর্বদা সবত্র উপস্থিত বা বিরাজমান এবং তিনি সদা সর্বদা সবকিছুর দর্শক। স্বভাবতই যিনি সদাসর্বত্র বিরাজমান ও সবকিছুর দর্শক তিনি সর্বজ্ঞ ও সকল যুগের সকল স্থানের সকল গাইবী জ্ঞানের অধিকারী। কাজেই যারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে ‘হাযির-নাযির’ দাবি করেন, তাঁরা দাবি করেন যে, তিনি শুধু সর্বজ্ঞই নন, উপরন্তু তিনি সর্বত্র বিরাজমান।

----------------------------------------------------------------------------------

এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়:
=> প্রথমত, এই গুণটি শুধুমাত্র আল্লাহর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ আল্লাহ বারংবার এরশাদ করেছেন যে, বান্দা যেখানেই থাক্ তিনি তার সাথে আছেন, তিনি বান্দার নিকটে আছেন… ইত্যাদি। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সম্পর্কে কখনোই ঘুনাক্ষরেও কুরআন বা হাদীসে বলা হয় নি যে, তিনি সর্বদা উম্মাতের সাথে আছেন, অথবা সকল মানুষের সাথে আছেন, অথবা কাছে আছেন, অথবা সর্বত্র উপস্থিত আছেন, অথবা সবকিছু দেখছেন। কুরআনের আয়াত তো দূরের কথা একটি যয়ীফ হাদীসও দ্ব্যর্থহীনভাবে এই অর্থে কোথাও বর্ণিত হয় নি। কাজেই যারা এই কথা বলেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নামে মিথ্যা কথা বলেন।

কোনো একটি সহীহ, যয়ীফ বা মাউযূ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, তিনি বলেছেন ‘আমি হাযির-নাযির’। অথচ তাঁর নামে এই মিথ্যা কথাটি বলা হচ্ছে। এমনকি কোনো সাহাবী, তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী বা ইমাম কখনোই বলেন নি যে, ‘রাসূলুল্লাহ (সঃ) হাযির-নাযির’

=> দ্বিতীয়ত, কুরআন-হাদীসে বারংবার অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ও দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ‘ইলমুল গাইব’ বা গোপন জ্ঞানের অধিকারী নন। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে ‘হাযির-নাযির’ বলে দাবি করা উক্ত সকল স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন আয়াত ও হাদীসের সুস্পষ্ট বিরোধিতা করা।


=> তৃতীয়ত, আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন হাদীসে তিনি বলেছেন, উম্মাতের দরুদ-সালাম তাঁর কবরে উপস্থিত করা হয়। আর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে হাযির-নাযির বলে দাবি করার অর্থ হলো, এ সকল হাদীস সবই মিথ্যা। উম্মাতের দরুদ-সালাম তাঁর কাছে উপস্থিত হয় না, বরং তিনিই উম্মাতের কাছে উপস্থিত হন!! কাজেই যারা এই দাবিটি করছেন, তাঁর শুধু রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নামে মিথ্যা বলেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না। উপরন্তু তাঁরা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ) -কে মিথ্যাবাদী বলে দাবি করেন, নাঊযু বিল্লাহ! নাঊযু বিল্লাহ!!

----------------------------------------------------------------------------------
এ সকল মিথ্যার উৎস ও কারণ:

এখানে পাঠকের মনে প্রশ্ন হতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এইরূপ ইলমুল গাইবের অধিকারী, হাযির-নাযির, ইত্যাদি যখন কোনো হাদীসেই বর্ণিত হয়নি এবং কুরআনেও এভাবে বলা হয় নি, তখন কেন অনেক মানুষ এগুলি বলছেন? তাঁরা কি কিছুই বুঝেন না?

এই বইয়ের পরিসরে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। তবে সংক্ষেপে বলা যায় যে, ইলমুল গাইব, হাযির-নাযির ও অন্যান্য বিষয়ে বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর নামে বলার পিছনে দুটি কারণ প্রধান:

প্রথম কারণ: এ বিষয়ক কিছু বানোয়াট কথা বা বিভিন্ন আলিমের কথার উপর নির্ভর করা। পাশাপাশি দ্ব্যার্থ বোধক বিভিন্ন আয়াত বা হাদীসের উপর নির্ভর করে সেগুলিকে নিজের মতানুযায়ী ব্যাখ্যা করা। আর এ সকল দ্ব্যর্থ বোধক আয়াত ও হাদীসের বিশেষ ব্যাখ্যাকে বজায় রাখতে অগণিত আয়াত ও হাদীসের স্পষ্ট অর্থকে বিকৃত করা বা ব্যাখ্যার মাধ্যমে সেগুলিকে বাতিল করে দেওয়া।


=> ইসলামের পূর্ববর্তী ধর্মগুলির বিভ্রান্তির যে চিত্র কুরআন কারীমে উল্লেখ করা হয়েছে তাতে আমরা দেখতে পাই যে, এই বিষয়টি ছিল বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ। একটি উদাহরণ উল্লেখ করছি। আল্লাহ ঈসা (আ)-কে বিনা পিতায় জন্ম দিয়েছেন, তাকে ‘আল্লাহর কালিমা’ ও ‘আল্লাহর রূহ’ বলেছেন। কিন্তু কখনোই তাঁকে ‘ঈশ্বর বা ঈশ্বরের সত্ত্বার (যাতের) অংশ বলেন নি।

=> প্রচলিত বাইবেলেও নেই যে যীশু নিজেকে ঈশ্বর বলে দাবী করেছেন। কিন্তু খৃস্টানগণ দাবি করলেন, যেহেতু ‘আল্লাহর কালাম’ আল্লাহর গুণ ও তাঁর সত্বার অংশ, সেহেতু যীশু ঈশ্বরের অংশ। আল্লাহর রূহ তাঁরই সত্ত্বা। যেহেতু যীশুকে ঈশ্বরের আত্মা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে সেহেতু তিনি ঈশ্বরের যাতের অংশ, ঈশ্বরের জাত ও ঈশ্বর… ((God Incarnate))। এই অপব্যাখ্যার উপর নির্ভর করে তারা বাইবেলের অগণিত স্পষ্ট বাক্যের অপব্যাখ্যা করে এই আসমানী ধর্মটিকে সম্পূর্ণ বিকৃত করে। এ জন্য আল্লাহ এরশাদ করেছেন:
يا أهل الكتاب لا تغلوا في دينكم ولا تقولوا على الله إلا الحق إنما المسيح عيسى ابن مريم رسول الله وكلمته ألقاها إلى مريم وروح منه فآمنوا بالله ورسله ولا تقولوا ثلاثة
“হে কিতাবীগণ, দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না এবং আল্লাহ্ সম্বন্ধে সত্য ব্যতীত বলো না। মরিয়ম তনয় ঈসা মাসীহ আল্লাহর রাসূল, এবং তাঁর বাণী, যা তিনি মরিয়মের নিকট প্রেরণ করেছিলেন এবং তাঁর থেকে (আগত) আত্মা (আদেশ)। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে উপর ঈমান আন এবং বলিও না ‘তিন’…।


=> এভাবে আল্লাহ তাদেরকে বাড়িয়ে বলতে নিষেধ করলেন। আল্লাহ যতটুকু বলেছেন ততটুকুই বল। তাকে আল্লাহর কালিমা ও আল্লাহর রূহ বল, কিন্তু এ থেকে বাড়িয়ে ও ব্যাখ্যা দিয়ে তাকে ‘ঈশ্বর’ বা ‘ঈশ্বরের জাত’ বলো না এবং ত্রিত্ববাদের শিরকের মধ্যে নিপতিত হয়ো না।

=> ইসলামের প্রথম যুগ থেকে যারা বিভ্রান্ত হয়েছে তাদের মধ্যেও একই কারণ বিদ্যমান। খারিজী, শিয়া, কাদারিয়া, জাবারিয়া, মুরজিয়া, মু’তাযিলী ইত্যাদি সকল সম্প্রদায়ই কুরআন-সুন্নাহ মানেন। একটি কারণেই তারা বিভ্রান্ত হয়েছেন। কুরআন ও হাদীসে যা কিছু বলা হয়েছে সাহাবীগণ তা সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করতেন। এগুলির মধ্যে কোনো বৈপরীত্য দেখতেন না এবং ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের চেষ্টা করতেন না। কুরআন-হাদীসে যা বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁরা তাকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। যেমন, কুরআন কারীমে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া কারো কোনো হুকুম নেই। আবার অন্যত্র বিভিন্ন বিষয়ে মানুষকে হাকিম বানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাহাবীগণ উভয় বিষয় সমান ভাবে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু খারিজীগণ একটিকে গ্রহণ করেছে এবং অন্য সকল নির্দেশকে বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে বাতিল করেছে।


=> অনুরূপভাবে কুরআন কারীমে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার কথা ও কর্মের কারণে বিপদাপদের কথা বলা হয়েছে। তেমনি সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছায় হয় তাও বলা হয়েছে। সাহাবীগণ উভয় কথায় সমানভাবে বিশ্বাস করেছেন। এগুলির মধ্যে কোনো বৈপরীত্য খুঁজেন নি। কিন্তু কাদারিয়া, জাবারিয়া, মু’তাযিলা বিভিন্ন সম্প্রদায় একটি কথাকে মূল হিসাবে গ্রহণ করে বাকি কথাগুলিকে বিভিন্ন অপব্যাখ্যার মাধ্যমে বাতিল করে দিয়েছেন।

=> কুরআন কারীমে পাপীদের অনন্ত জাহান্নাম বাসের কথা বলা হয়েছে। আবার শিরক ছাড়া সকল পাপ আল্লাহ ইচ্ছা করলে ক্ষমা করতে পারেন বলেও বলা হয়েছে। অগণিত সহীহ হাদীসে পাপী মুমিনের শাস্তিভোগের পরে জান্নাতে গমনের কথা বলা হয়েছে। সাহাবীগণ সবগুলিই সমানভাবে মেনেছেন। কিন্তু বিভ্রান্ত সম্প্রদায়গুলি একটিকে মানতে অন্যটিকে বাতিল করেছেন।


=> ‘ইলমুল গাইব’ বা ‘হাযির-নাযির’ বিষয়টি ইসলামের প্রথম কয়েকশত বৎসর ছিল না। পরবর্তী কালে এর উৎপত্তি। এ বিষয়েও একই অবস্থা পরিলক্ষিত হয়।

কুরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া আসমান-যমীনের মধ্যে কেউ গাইব জানেন না। বিভিন্ন আয়াতে বারংবার বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ () ‘গাইব’ বা অদৃশ্য বিষয় জানেন না। মক্কী সূরায়, মদনী সূরায়, মদীনায় অবতীর্ণ একেবারে শেষ দিকের সূরায় সকল স্থানেই তা বলা হয়েছে। এর বিপরীতে একটি আয়াতেও বলা হয় নি যে, ‘রাসূলুল্লাহ () ‘আলিমুল গাইব’। তিনি ‘গাইবের সবকিছু জানেন’ এ কথা তো দূরের কথা ‘তিনি গাইব জানেন’ এই প্রকারের একটি কথাও কোথাও বলা হয় নি। তবে বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ এরশাদ করেছেন, এগুলি গাইবের কথা আপনাকে ওহীর মাধ্যমে জানালাম… ইত্যাদি।


=> বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ () অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তিনি ‘গাইব’ বা অদৃশ্য জ্ঞানের মালিক নয়, তিনি মনের কথা জানেন না, তিনি গোপন কথা জানেন না এবং তিনি ভবিষ্যত জানেন না।

=> আয়েশা, উম্মু সালামা, আসমা বিনত আবী বাকর, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ, আনাস ইবনু মালিক, আবূ সাঈদ খুদরী, সাহল ইবনু সা’দ, আমর ইবনুল আস প্রমুখ প্রায় দশ জন সাহাবী (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) থেকে অনেকগুলি সহীহ সনদে বর্ণিত ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের হাদীসে রাসূলুল্লাহ () বলেছেন যে, কেয়ামতের দিন অনেক মানুষ আমার কাছে (হাউযে পানি পানের জন্য) আসবে, যাদেরকে আমি চিনতে পারব এবং তারাও আমাকে চিনতে পারবে, কিন্তু তাদেরকে আমার কাছে আসতে দেওয়া হবে না, বাধা দেওয়া হবে। আমি বলব : এরা তো আমারই উম্মত। তখন উত্তরে বলা হবে:
إِنَّـكَ لاَ تَـدْرِيْ مَـا عَـمِـلُوا بَـعْـدَكَ
“আপনার পরে তারা কী আমল করেছে তা আপনি জানেন না।”

=> এ সকল অগণিত সহীহ হাদীসের বিপরীতে একটি হাদীসেও তিনি বলেন নি যে, আমি ‘আলিমুল গাইব’, বা আমি সকল গোপন জ্ঞানের অধিকারী, অথবা আমি তোমাদের সকল কথাবার্তা বা কাজ কর্মের সময় উপস্থিত থাকি, অথবা আমি ঘরে বসেই তোমাদের সকল কাজ কর্ম ও গোপন বিষয় দেখতে পাই … এইরূপ কোনো কথাই তিনি বলেন নি।


তবে বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সঃ) অনেক ভবিষ্যতের সংবাদ প্রদান করেছেন, অনেক মানুষের গোপন বিষয় বলে দিয়েছেন, কোনো কোনো হাদীসে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, স্বপ্নে বা সালাতের মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি জান্নাত, জাহান্নাম সবকিছু দেখেছেন। তিনি সালাতে দাঁড়িয়ে পিছনের মুসল্লীদেরকেও দেখতে পান বলে জানিয়েছেন। কিন্তু কখনোই বলেন নি যে, তিনি পর্দার আড়ালে, ঘরের মধ্যে, মনের মধ্যে বা দূরের কোনো কিছু দেখেন। বরং বারংবার এর বিপরীত কথা বলেছেন।


=> এখন মুমিনের দায়িত্ব হলো এ সব কিছুকে সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করা। কুরআনের বিভিন্ন স্পষ্ট আয়াত ও বিভিন্ন সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে মুমিন বিশ্বাস করেন যে, রাসুলুল্লাহ (সঃ) ‘গাইব’ জানতেন না। আবার কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও বিভিন্ন হাদীসের ভিত্তিতে মুমিন বিশ্বাস করেন যে, মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম রাসূলকে ওহীর মাধ্যমে গাইবের অনেক বিষয় জানিয়েছেন। তাঁর জ্ঞান ছিল সকল নবী-রাসূলের জ্ঞানের চেয়ে বেশি ও পূর্ণতর।


=> একান্ত প্রয়োজন না হলে কোনো ব্যাখ্যার মধ্যে যেতে নেই। একান্ত প্রয়োজনে ব্যাখ্যা করলেও গুরুত্বের কম বেশি হবে কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে। স্পষ্ট কথাকে অস্পষ্ট কথার জন্য ব্যাখ্যা সাপেক্ষে বাতিল করা যাবে না। বরং প্রয়োজনে স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন কথার জন্য অস্পষ্ট বা দ্ব্যর্থবোধক কথার ব্যাখ্যা করতে হবে। ‘খবর ওয়াহিদ’ একক হাদীসের জন্য কুরআনের স্পষ্ট বাণী বা মুতাওয়াতির ও মশহূর হাদীস বাতিল করা যাবে না। প্রয়োজনে কুরআন বা প্রসিদ্ধ হাদীসের জন্য একক ও দ্ব্যর্থ বোধক হাদীসের গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা করতে হবে।


=> কিন্তু যারা ইলমুল গাইবের দাবি করেন তাঁরা এ সকল দ্ব্যর্থবোধক বা ফযীলত বোধক আয়াত ও হাদীসকে মূল ধরে এর ভিত্তিতে অগণিত সুস্পষ্ট আয়াত ও হাদীসকে ব্যাখ্যার মাধ্যমে বাতিল করে দেন। পাঠকের হৃদয়ঙ্গমের জন্য এখানে তাঁদের এইরূপ তিনটি ‘দলীল’ আলোচনা করছি।

(১) কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে ‘শাহিদ’ ও ‘শাহীদ’ (شاهد وشهيد) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই শব্দ দুইটির অর্থ ‘সাক্ষী’, ‘প্রমাণ’, ‘উপস্থিত’ ((witness, evidence, present) ইত্যাদি। সাহাবীগণের যুগ থেকে পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত মুফাস্সিরগণ এই শব্দের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে (সঃ) দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব দিয়ে ও সাক্ষীরূপে প্রেরণ করেছেন। যারা তাঁর প্রচারিত দ্বীন গ্রহণ করবেন, তিনি তাঁদের পক্ষে সাক্ষ্য দিবেন। এছাড়া পূর্ববর্তী নবীগণ যে তাদের দীন প্রচার করেছেন সে বিষয়েও তিনি এবং তাঁর উম্মাত সাক্ষ্য দিবেন। অনেকে বলেছেন, তাঁকে আল্লাহ তাঁর একত্বের বা ওয়াহদানিয়্যতের সাক্ষী ও প্রমাণ-রূপে প্রেরণ করেছেন।

এখানে উল্লেখ্য যে, অনেক স্থানে মুমিনগণকেও মানব জাতির জন্য ‘শাহীদ’ বলা হয়েছে। অনেক স্থানে আল্লাহকে ‘শাহীদ’ বলা হয়েছে।


যারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে ‘সকল অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী’ বা ‘হাযির-নাযির’ বলে দাবি করেন তাঁরা এই ‘দ্ব্যর্থবোধক’ শব্দটির একটি বিশেষ অর্থ গ্রহণ করেন। এরপর সেই অর্থের ব্যাখ্যার ভিত্তিতে কুরআনের সকল সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন বাণী বাতিল করে দেন।

তাঁরা বলেন, ‘শাহিদ’ অর্থ উপস্থিত। কাজেই তিনি সর্বত্র উপস্থিত। অথবা ‘শাহিদ’ অর্থ যদি সাক্ষী হয় তাহলেও তাঁকে সর্বত্র উপস্থিত থাকতে হবে। কারণ না দেখে তো সাক্ষ্য দেওয়া যায় না। আর এভাবে তিনি সদা সর্বদা সর্বত্র বিরাজমান বা হাযির-নাযির ও সকল স্থানের সকল গোপন ও গাইবী জ্ঞানের অধিকারী।

তাঁদের এই ব্যাখ্যা ও দাবির ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়:


প্রথমত, তাঁরা এই আয়াতের ব্যাখ্যায় সাহাবী, তাবিয়ী ও পূর্ববর্তী মুফাসসিরদের মতামত নিজেদের মর্জি মাফিক বাতিল করে দিলেন।


দ্বিতীয়ত, তাঁরা একটি দ্ব্যর্থবোধক শব্দের ব্যাখ্যাকে মূল আকীদা হিসাবে গ্রহণ করে তার ভিত্তিতে কুরআন ও হাদীসের অগণিত দ্ব্যর্থহীন নির্দেশনা নিজেদের মর্জিমাফিক বাতিল করে দিলেন। তাঁরা এমন একটি অর্থ গ্রহণ করলেন, যে অর্থে একটি দ্ব্যর্থহীন আয়াত বা হাদীসও নেই। সাহাবী, তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী বা কোনো ইমামও কখনো এ কথা বলেন নি।

তৃতীয়ত, তাঁদের এই ব্যাখ্যা ও দাবি মূলতই বাতিল। তাদের ব্যাখ্যা অনুসারে প্রত্যেক মুসলমানকেই ‘সর্বজ্ঞ’, ‘ইলমে গাইবের অধিকারী’ ও হাযির-নাযির বলে দাবি করতে হবে। কারণ মুমিনগণকেও কুরআনে ‘শাহীদ’ অর্থাৎ ‘সাক্ষী’ বা ‘উপস্থিত’ বলা হয়েছে এবং বারংবার বলা হয়েছে যে, তাঁরা পূর্ববর্তী সকল উম্মাত সহ পুরো মানব জাতির সম্পর্কে কেয়ামতের দিন সাক্ষ্য দিবেন। আর উপস্থিত না হলে তো সাক্ষ্য দেওয়া যায় না।

কাজেই তাঁদের ব্যাখ্যা ও দাবি অনুসারে বলতে হবে যে, প্রত্যেক মুমিন সৃষ্টির শুরু থেকে বিশ্বের সর্বত্র সর্বদা বিরাজমান এবং সবকিছু দেখছেন ও শুনছেন। কারণ না দেখে তাঁরা কিভাবে মানবজাতির পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবেন?!

(২) কুরআন কারীমে অন্যত্র এরশাদ করা হয়েছে:
النَّـبِـيُّ أَوْلَى بِالْمُـؤْمِـنِيـنَ مِـنْ أَنْـفُسِهِمْ وَأَزْوَاجُهُ أُمَّـهَـاتُـهُمْ وَأُوْلُو الْأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَى بِبَعْضٍ فِي كِتَابِ اللَّهِ
“নবী মু’মিনগণের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর এবং তাঁর স্ত্রী তাদের মাতা। এবং আল্লাহর কিতাবে আত্মীয়গণ পরস্পর পরস্পরের ঘনিষ্ঠতর।”

এখানে ‘আউলা’ (أولى) শব্দটির মূল হলো ‘বেলায়াত’ (الولاية), অর্থাৎ বন্ধুত্ব, নৈকট্য, অভিভাবকত্ব ইত্যাদি। “বেলায়েত” অর্জনকারীকে “ওলী” (الولي), অর্থাৎ বন্ধু, নিকটবর্তী বা অভিভাবক বলা হয়। ‘আউল’ অর্থ ‘অধিকতর ওলী’। অর্থাৎ অধিক বন্ধু, অধিক নিকটবর্তী, অধিক যোগ্য বা অধিক দায়িত্বশীল (more entitled, more deserving, worthier, closer)|

=> এখানে স্বভাবতই ‘ঘনিষ্ঠতর বা নিকটতর বলতে ভক্তি, ভালবাসা, দায়িত্ব, সম্পর্ক ও আত্মীয়তার ঘনিষ্ঠতা বুঝানো হচ্ছে। মুমিনগণ রাসূলুল্লাহকে তাঁদের নিজেদের সত্ত্বার চেয়েও বেশি আপন, বেশি প্রিয় ও আনুগত্য ও অনুসরণের বেশি হক্কদার বলে জানেন। এই ‘আপনত্বের’ একটি দিক হলো যে, তাঁর স্ত্রীগণ মুমিনদের মাতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।


আবার উম্মাতের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দরদ ও প্রেম তার আপনজনদের চেয়েও বেশি। রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বয়ং এই আয়াতের ব্যাখ্যায় এ কথা বলেছেন। হযরত জাবির, আবূ হুরাইরা প্রমুখ সাহাবী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন:
ما من مؤمن إلا وأنا أولى به في الدنيا والآخرة اقرؤوا إن شئتم النبي أولى بالمؤمنين من أنفسهم فأيما مؤمن مات وترك مالا فليرثه عصبته من كانوا ومن ترك دينا أو ضياعا فلـيـأتني (فإلي وعلي، علي قضاؤه) فأنا مولاه
“প্রত্যেক মুমিনের জন্যই দুনিয়া ও আখেরাতে আমি তার অধিকতর নিকটবর্তী। তোমরা ইচ্ছা করলে আল্লাহর বাণী পাঠ কর: “নবী মু’মিনগণের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর”। কাজেই যে কোনো মুমিন যদি মৃত্যুবরণ করে এবং সে সম্পদ রেখে যায়, তবে তার উত্তরাধিকারীগণ যারা থাকবে তারা সেই সম্পদ গ্রহণ করবে। আর যদি সে ঋণ রেখে যায় বা অসহায় সন্তান-সন্ততি রেখে যায় তবে তারা যেন আমার নিকট আসে; সে ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব আমার উপরেই থাকবে। কারণ আমিই তার আপনজন।”

কিন্তু ‘হাযির-নাযির’-এর দাবিদারগণ দাবি করেন যে, এখানে দৈহিক নৈকট্য বুঝানো হয়েছে। কাজেই তিনি সকল মুমিনের নিকট হাযির আছেন।


=============================================

এখানেও আমরা দেখছি যে একটি বানোয়াট ব্যাখ্যার ভিত্তিতে তারা কুরআন ও হাদীসে অগণিত দ্ব্যর্থহীন নির্দেশকে বাতিল করে দিচ্ছেন। তাঁর স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ব্যাখ্যাকেও গ্রহণ করছেন না। সর্বোপরি তাদের এই ব্যাখ্যা সন্দেহাতীতভাবেই বাতিল। কারণ এই আয়াতেই বলা হয়েছে যে “আত্মীয়গণ পরস্পর পরস্পরের ঘনিষ্ঠতর”। অন্যত্রও বলা হয়েছে যে, “আত্মীয়গণ একে অপরের ঘনিষ্ঠতর বা নিকটতর।” তাহলে এদের ব্যাখ্যা অনুসারে আমাদের বলতে হবে যে, সকল মানুষই হাযির নাযির। কারণ সকল মানুষই কারো না কারো আত্মীয়। কাজেই তার সদাসর্বদা তাদের কাছে উপস্থিত এবং তাদের সবকিছু দেখছেন ও শুনছেন!


=> অন্য আয়াতে এরশাদ করা হয়েছে যে, নবী (সঃ) ও মুমিনগণ মানুষদের মধ্যে ইবরাহীম (আ)-এর সবচেয়ে ‘নিকটতর’ বা ঘনিষ্ঠতর। এখানে দাবি করতে হবে যে, সকল মুমিন ইবরাহীমের নিকট উপস্থিত…!


=> অন্য হাদীসে ইবনু আব্বাস (রা) বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ () মদীনায় আগমন করেন, তখন ইহূদীদের আশূরার সিয়াম পালন করতে দেখেন। তিনি তাদের এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। তারা বলে, এই দিনে আল্লাহ মূসা (আ) ও ইস্রায়েল সন্তানদেরকে ফেরাউনের উপর বিজয় দান করেন। এজন্য মূসা (আ) কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এই দিন সিয়াম পালন করেন। তখন তিনি বলেন:
نـحـن أولى بـمـوسى منـكم (منهم) فأمـر بصـومه
“তোমাদের চেয়ে আমরা মূসা (আ)-এর নিকটতর। একথা বলে তিনি এই দিনে সিয়াম পালনের নির্দেশ প্রদান করেন।”


=>>>>>>>>>>>>>>>>>এখন এই ব্যাখ্যা অনুসারে আমাদের দাবি করতে হবে যে, আমরা মুসলিম উম্মাহর প্রত্যেক সদস্য মূসার কাছে উপস্থিত ও বিরাজমান!!

(৩) আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেন,
صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللَّهِ  ذَاتَ يَوْمٍ فَلَمَّا قَضَى الصَّلاةَ أَقْبَلَ عَلَيْنَا بِوَجْهِهِ (رَقِيَ الْمِنْبَرَ) فَقَالَ أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي إِمَامُكُمْ فَلا تَسْبِقُونِي بِالرُّكُوعِ وَلا بِالسُّجُودِ وَلَا بِالْقِيَامِ وَلا بِالِانْصِرَافِ (أَتِمُّوا الصُّفُوفَ) فَإِنِّي أَرَاكُمْ أَمَامِي وَمِنْ خَلْفِي (خَلْفَ ظَهْرِي/مِنْ وَرَاءِ ظَهْرِي)، فِي الصَّلَاةِ وَفِي الرُّكُوعِ إِنِّي لأَرَاكُمْ مِنْ وَرَائِي كَمَا أَرَاكُمْ (مِنْ أَمَامِيْ)
একদিন রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করলেন। সালাতের পরে আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে (অন্য বর্ণনায়: মিম্বরে আরোহণ করে) তিনি বলেন: হে মানুষেরা, আমি তোমাদের ইমাম। কাজেই তোমরা আমার আগে রুকু করবে না, সাজদা করবে না, দাঁড়াবে না এবং সালাত শেষ করবে না। (অন্য বর্ণনায়: কাতারগুলি পূর্ণ করবে।) কারণ আমি তোমাদেরকে দেখতে পাই আমার সামনে এবং আমার পিছনে, যখন তোমরা রুকু কর এবং যখন তোমরা সাজদা কর। (অন্য বর্ণনায়: সালাতের মধ্যে এবং রুকুর মধ্যে আমি আমার পিছন থেকে তোমাদেরকে দেখি যেমন আমি সামনে থেকে তোমাদেরকে দেখি।)


এই হাদীস থেকে আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর একটি বৈশিষ্ট্যের কথা জানতে পারছি। হাদীসটি পাঠ করলে বা শুনলে যে কেউ অনুভব করবেন যে, বিষয়টি স্বাভাবিক দৃষ্টি ও দর্শনের বিষয়ে। মানুষ সামনে যেরূপ সামনের দিকে দেখতে পায়, রাসূলুল্লাহ (সঃ) সালাতের মধ্যে সেভাবেই পিছনে দেখতে পেতেন।

হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে স্পষ্টভাবেই জানা যায় যে, এই দর্শন ছিল সালাতের মধ্যে ও রুকু সাজাদরা মধ্যে। অন্য সময়ে তিনি এইরূপ দেখতেন বলে কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি।

ইবনু হাজার আসকালানী বলেন:
ظاهر الحديث إن ذلك يختص بحالة الصلاة ويحتمل أن يكون ذلك واقعا في جميع أحواله
“হাদীসের বাহ্যিক বা স্পষ্ট অর্থ থেকে বুঝা যায় যে, পিছন থেকে দেখতে পাওয়ার এই অবস্থাটি শুধুমাত্র সালাতের জন্য খাস। অর্থাৎ তিনি শুধু সালাতের মধ্যেই এইরূপ পিছন থেকে দেখতে পেতেন। এমনও হতে পারে যে, সর্বাবস্থাতেই তিনি এইরূপ দেখতে পেতেন।


এই দ্বিতীয় সম্ভাবনা হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিপরীত। তা সত্ত্বেও যদি তা মেনে নেওয়া হয় এবং মনে করা হয় যে, তিনি সর্বদা এইরূপ সামনে ও পিছনে দেখতে পেতেন, তবুও এ হাদীস দ্বাারা কখনোই বুঝা যায় না যে, তিনি দৃষ্টির আড়ালে, ঘরের মধ্যে, পর্দার অন্তরালে, মনের মধ্যে বা অনেক দূরের সবকিছু দেখতে পেতেন। তা সত্ত্বেও যদি কুরআন ও হাদীসের বিপরীত ও বিরোধী না হতো, তবে আমরা এই হাদীস থেকে দাবি করতে পারতাম যে, তিনি এভাবে সর্বদা সর্বস্থানের সর্বকিছু দেখতেন এবং দেখছেন। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন আয়াতে ও অগণিত সহীহ হাদীসে সুস্পষ্টত ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বারংবার এর বিপরীত কথা বলা হয়েছে। মূলত মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়মত রাসূল (সঃ)-কে এইরূপ ঝামেলা ও বিড়ম্বনাময় দায়িত্ব থেকে ঊর্ধ্বে রেখেছেন।


কিন্তু ‘ইলমুল গাইব’ বা ‘হাযির-নাযির’ দাবিদারগণ এখানে ‘তোমাদেরকে দেখতে পাই’ কথাটির ব্যখ্যায় বলেন যে, তিনি সদা সর্বদা সর্বস্থানে সর্বজনকে দেখতে পান। আমরা দেখছি যে, এই ব্যখ্যাটি শুধু হাদীসটির বিকৃতিই নয়, উপরন্তু অগণিত আয়াত ও হাদীসের সুস্পষ্ট বিরোধী।


=> সর্বোপরি সামনে ও পিছনে ‘দেখা’ বা ‘গায়েবী দেখা’ দ্বারা ‘সদা সর্বদা সর্বত্র উপস্থিতি’ বা সবকিছু দেখা প্রমাণিত হয় না। কুরআন কারীমে এরশাদ করা হয়েছে যে, শয়তান ও তার দল মানুষদেরকে গায়েবীভাবে দেখে:
إِنَّـهُ يَـرَاكُـمْ هُـوَ وَقَـبِـيـلُهُ مِنْ حـَيْثُ لا تَـرَوْنَـهُمْ
“সে (শয়তান) ও তার দল তোমাদিগকে এমনভাবে দেখে যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না।”
এখানে কি কেউ দাবি করবেন যে, যেহেতু “তেমাদিগকে দেখে’ (يراكم) বর্তমান কালের ক্রিয়া, সেহেতু শয়তান ও তার দলের প্রত্যেকে সদা সর্বদা সকল স্থানের সকল মানুষকে একই ভাবে দেখতে পাচ্ছে বা দেখেইে চলেছে?!


=> এভাবে আমরা দেখছি যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নামে এ সকল বানোয়াট ও মিথ্যা কথা যারা বলেন, তাঁরা তাঁদের কথাগুলির পক্ষে একটিও দ্ব্যর্থহীন সুস্পষ্ট আয়াত বা হাদীস পেশ করছেন না। তাঁরা অপ্রাসঙ্গিক বা দ্ব্যর্থবোধক কিছু আয়াত বা হাদীসকে মনগড়াভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং এরপর এইরূপ ব্যাখ্যার উপরে নির্ভর করে তাঁরা অগণিত আয়াত ও সহীহ হাদীস বাতিল করে দেন।

=> যারা এইরূপ ব্যাখ্যার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মর্যাদা বৃদ্ধি করতে চান তাঁদের নেক নিয়্যাত ও ভক্তি-ভালবাসার বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তাঁরা ভাল উদ্দেশ্যে ওহীর নামে মিথ্যা বলেছেন এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নামে এমন কথা বলেছেন যা তিনি কখনোই নিজের বিষয়ে বলেন নি।

=> দ্বিতীয় কারণ: এ সকল কথাকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মর্যাদা-বৃদ্ধিকর বলে মনে করা এবং এ সকল কথা বললে তাঁর প্রতি ভক্তি, ভালবাসা ও শ্রদ্ধা বৃদ্ধি বা পূর্ণতা পাবে বলে মনে করা।

নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ভক্তি ও ভালবাসা এবং তাঁর প্রশংসা করা ঈমানের মূল ও মুমিনের অন্যতম সম্বল। তবে এ জন্য কুরআন কারীমের অগণিত আয়াত ও অগণিত সহীহ হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশের বাইরে আমাদের যয়ীফ, মিথ্যা, বানোয়াট কথা বলতে হবে, বা যুক্তি, তর্ক, ব্যাখ্যা, সম্ভাবনা ইত্যাদি দিয়ে কিছু কথা বানাতে হবে এই ধারণাটিই ইসলাম বিরোধী।


এ সকল ক্ষেত্রে মুমিনের জন্য নাজাতের একমাত্র উপায় হলো, সকল ক্ষেত্রে বিশেষত আকীদা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আক্ষরিকভাবে কুরআন ও সুন্নাহর উপর নির্ভর করা। আমাদের বুঝতে হবে যে, আকীদা বা ধর্মীয় বিশ্বাস এমন একটি বিষয় যা প্রত্যেক মুমিনকেই একইভাবে বিশ্বাস করতে হবে। আমলের ক্ষেত্রে কোনো আমল কারো জন্য জরুরী আর কারো জন্য কম জরুরী বা অপ্রয়োজনীয় হতে পারে। কিন্তু বিশ্বাসের বিষয় তা নয়। তা সকলের জন্য সমান। এজন্য আলিমগণ বলেছেন যে, বিশ্বাসের ভিত্তি হবে কুরআন কারীম বা মুতাওয়াতির হাদীসের উপর। অর্থাৎ যে বিষয়টি বিশ্বাস করা মুমিনের জন্য প্রয়োজন সেই বিষয়টি অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর সকল সাহাবীকে জানিয়েছেন এবং সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষাতেই জানিয়েছেন। আর এইরূপ বিষয় অবশ্যই কুরআনে থাকবে বা ব্যাপক প্রচারতি ‘মুতাওয়াতির’ হাদীসে থাকবে।


এছাড়া আরো বুঝতে হবে যে, বিশ্বাসের ভিত্তি ‘গাইবী’ বিষয়ের উপরে। এ সকল বিষয়ে ওহীর নির্দেশনা ছাড়া কোনো ফয়সালা দেওয়া যায় না। কর্ম বিষয়ে কুরআন বা হাদীসে সুস্পষ্ট বিধান নেই এরূপ অনেক নতুন নতুন বিষয় উদ্ভাবিত হয়, এজন্য সেক্ষেত্রে কিয়াস ও ইজতিহাদের প্রয়োজন হয়। যেমন মাইক, ধুমপান ইত্যাদি বিষয়। কিন্তু বিশ্বাস বা আকীদার বিষয় সেরূপ নয়। এগুলিতে নতুন সংযোজন সম্ভব নয়। এজন্য এ বিষয়ে কিয়াস বা ইজতিহাদ অর্থহীন। আল্লাহর গুণাবলি, নবীগণের সংখ্যা, মর্যাদা, ফিরিশতাগণের সংখ্যা, সৃষ্টি, কর্ম, দায়িত্ব ইত্যাদি বিষয়ে ইজতিহাদের কোনো সুযোগ নেই। কুরআন ও হাদীসে যেভাবে যতটুকু বলা হয়েছে তাই বিশ্বাস করতে হবে। এ সকল ক্ষেত্রে আমরা ওহীর কথাকে যুক্তি দিয়ে সমর্থন করতে পারি, কিন্তু যুক্তি দিয়ে কোনো কিছু সংযোজন বা বিয়োজন করতে পারি না।


এজন্য মুমিনের মুক্তির একমাত্র উপায় হলো, কুরআন কারীমের সকল কথাকে সমানভাবে গ্রহণ করা এবং কোনো কথাকে প্রতিষ্ঠার জন্য অন্য কথাকে বাতিল বা ব্যাখ্যা না করা। অনুরূপভাবে সকল সহীহ হাদীসকে সহজভাবে মেনে নেওয়া। ব্যাখ্যার প্রয়োজন হলে সাহাবীগণের অনুসরণ করা। আমিন।

=============================================
মূল বই: হাদীসের নামে জালিয়াতি: প্রচলিত মিথ্যা হাদীস ও ভিত্তিহীন কথা

ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
পি-এইচ. ডি. (রিয়াদ), এম. এ. (রিয়াদ), এম.এম. (ঢাকা)
অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স
ঝিনাইদহ, বাংলাদেশ

আল্লাহ আমাদের সত্য বুঝার ও আমল করার তৌফিক দান করুন।

সর্বশেষ শেষ করছি একটি কোরআনের আয়াত দিয়ে:-

সূরা নিসা-১১৫> যারা রাসুলের বিরুদ্ধাচারণ করে এবং সত্য পথ প্রকাশিত হওয়ার পরও তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় আমি (আল্লাহ) তাকে সেদিকেই পরিচালিত করবো যেদিক সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে "নিক্ষেপ করবো জাহান্নামে"।

সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০১১ রাত ১:৫২
২৭টি মন্তব্য ২৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আমার ড্রোন ছবি।

লিখেছেন হাশেম, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩

বৃহত্তর প্যারিস তুষারপাত।

ফ্রান্সের তুলুজ শহরে বাংলাদেশের প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনার।

হ্যাসল্ট, বেলজিয়াম।

ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী ফ্রান্সের ফ্রিওল আইল্যান্ড।


রোডেসিয়াম এম রেইন, জার্মানি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতার সুফল কতটুকু পাচ্ছে সাধারণ মানুষ

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:২৮

(১) আমলা /সরকারের কর্মকর্তা, কর্মচারীর সন্তানদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব হতাশাজনক। মুক্তিযুদ্ধের ১৯৭১ সালের রক্ত দেওয়া দেশের এমন কিছু কখনো আশা কি করছে? বঙ্গবন্ধু এমন কিছু কি আশা... ...বাকিটুকু পড়ুন

এলজিবিটি নিয়ে আমার অবস্থান কী!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১০ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৫

অনেকেই আমাকে ট্রান্স জেন্ডার ইস্যু নিয়ে কথা বলতে অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়ে একজন সাধারণ মানুষের ভূমিকা কী হওয়া উচিত- সে বিষয়ে মতামত চেয়েছেন। কারণ আমি মধ্যপন্থার মতামত দিয়ে থাকি। এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলমানদের বিভিন্ন রকম ফতোয়া দিতেছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩


আপন খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুফাতো বোনের বা ছেলের, মেয়েকে বিবাহ করা যায়, এ সম্পর্কে আমি জানতে ইউটিউবে সার্চ দিলাম, দেখলাম শায়খ আব্দুল্লাহ, তারপর এই মামুনুল হক ( জেল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×