মাত্র ফজরের আজান দিল। উৎকণ্ঠায় কাল সারা রাত ঘুম হয় নি। এক ফোটাও না। কাফরুল এর মসজিদের ইমাম সাহেব অনেক সুর করে লম্বা আজান দেয়। ইদানিং ঢাকা শহরের অনেক ইমাম খুব দ্রুত আজান দেয়। মনে হয় রচনা পাঠ করছে। হয়ত, এই কাঠ পাথরের শহরের ইমাম সাহেবরাও অনেক ব্যাস্ত।
কাল রাতে খাবার পর থেকে শুধু বারান্দায় বসে বসে গোল্ডলিফ সিগারেটের সর্বনাশ করেছি। মশাদের অনেক দিন পরে একটা ভাল ভুরিভোজ হল। একটা মশা, আমার পাশেই মেঝেতে উল্টো হয়ে পড়ে আছে। খেয়ে পেট ফুলে নড়তে পারছে না। দুই আগুলের টিপ্ দিয়ে অনায়াসে মারা যেত , কিন্তু ইচ্ছা করছে না। এত আনন্দ নিয়ে আরও কিছুক্ষণ ওর বেঁচে থাকা উচিত।
আজ ঢাকা ভার্সিটির নতুন ব্যাচের ক্লাস শুরু হচ্ছে। না , আমার ঢাকা ভার্সিটিরতে পড়ার সৌভাগ্য হয় নি। কোনরকম প্রাইভেট ভার্সিটিতে এডমিট হয়েছি। শায়লা এর বান্ধবী এর কাছ থেকে গুপ্ত খবর নেওয়া, সে আমাকে জানিয়েছে আজ ও ভার্সিটি যাবে। কিন্তু কখন তার ক্লাস সেটা সে জানে না। তাই আমাকে একদম সকাল থেকে সেখানে তাকে খোঁজাটা সমীচীন বলে মনে হচ্ছে।
সাদা ছোপ করা ফুল হাতা শার্ট, হাত গুটিয়ে কব্জির একটু উপরে রেখেছি বরাবরের মত। মোটা জিন্স প্যান্ট , ১২০ টাকার নিউমার্কেটের চপ্লল। হাতে শায়লার সেই উপহার দেওয়া ঘড়িটা। যদিও ঘড়িটা চলছে না। প্রয়োজন না থাকলেও, আমরা অনেক কিছু অভ্যাস থেকে করি।
আকাশ ঘন কাল। কাল বৈশাখির আগে যে মেঘটা জমে ঠিক তেমন। তবে এখন বৈশাখ না, ভাদ্র মাস। তবুও মেঘ জমে আছে, ঠান্ডা বাতাস আছে একটা। উৎকণ্ঠার মাঝে ভালোই লাগছে। ৬ টা বাজে আলো ফোটার কথা, তবে মনে হচ্ছে ভোর রাত। পকেটের অবস্থা খুব বেশি সুবিধার না।
কাল মেসের বাজার করার পর টিউশনির ৩০০ টাকা অবশিষ্ট আছে। যদি দেখা হয়, কোথায় গিয়ে যদি বসতে হয়, তবে কি করব জানি না। ৫০০ টাকার নিচে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়া চিন্তার বিষয়। নিজের অপরাগতা প্রকাশ করা পুরুষদের ভিতর নাকি থাকতে নাই। তবে আমার কাছে দেখা হওয়াটা ইম্পর্টেন্ট।
আজ তিন মাস হল শায়লা আমার সাথে কোন রকম যোগাযোগ করে না। নাম্বার পাল্টে ফেলেছে। আমার ধারনা, সে মোটামুটি সিন্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে , "একলা চল রে "
কিন্তু আমার এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমি একলা চলতে পারছি না। শায়লা আমার ছোট্ট বেলার প্রেমিকা। কাল্পনিক হলেও সত্যি। "হঠাৎ বৃষ্টি" মুভির মত সেই হাফ প্যান্ট পড়া বয়সে তাকে আমি "ভালোবাসি" বলেছি। যদিও ভালোবাসা কি, এটা আমি এই মুহুর্তেও হয়ত ধরতে পারিনি।
শুধু তাকে নিজের সাথে সবসময় বেঁধে রাখার তীব্র ইচ্ছা। তাকে চোখ, মুখ, নাক দেখতে না পাওয়ার কেমন যেন একটা চোখের কষ্ট। তার লম্বা লম্বা আংগুল গুলু ছুতে না পারার কেমন যেন একটা হাতের কষ্ট। এত কষ্ট নিয়ে কিভাবে বেঁচে থাকা যায় ? দেবদাস বেচারাকে এই কারনে শরৎ বাবু মদ দিয়ে দিয়ে মেরে ফেলছেন, তাও পারবতির শশুর বাড়ির ফটকে। ভাবা যায়!
হেটে হেটে ১৪ নাম্বার বাস স্টপে চলে এসেছি। সিগারেট ভালোই সঙ্গ দিচ্ছে। সকাল হওয়াতে একদম সামনে সিট্ পেয়ে গেলাম। ড্রাইভার মামাকে দেখে মনে হচ্ছে ফুরফুরে মেজাজে আছে , তিনি জানলা থেকে মুখ বের করে মনের আনন্দে সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে গুন গুন করছে।
এখন বাংলাদেশ ডিজিটাল হয়েছে। ময়লা তেল চিটচিটে সিটের বাসেও টিভি থাকে, আমার বাসেও আছে। সেখানে পুরানো দিনের গান চলছে। এখন একটা সুবীর নন্দীর গান বাজছে। অনেক দরদ দিয়ে গাইছেন তিনি।
“আমার এ দুটি চোখ
পাথর তো নয়
তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়?
কখনো নদীর মতো
তোমার পথের পানে
বয়ে বয়ে যায়”
মনে হচ্ছে, পারফেক্ট সবকিছু আজ আমার জন্য এবং আমি কিছুটা আশ্বস্ত আজ শায়লার সাথে দেখা হবে। এর আগে পর পর চারটা দিন নিয়ম করে সকাল ৬ টা থেকে সন্ধ্যা ৭ টা পযন্ত ফার্মগেটে ওর ভার্সিটির কোচিং এর সামনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখা পায় নি। বিধাতা আমার দিকে মুখ তুলে তাকালোই না চার চারটা দিন। তবে আজ, কেন জানি মনে হচ্ছে ওর সাথে দেখা হবে, বিধাতা আজ তাকাবে আমার পানে।
বাস আর বৃষ্টি একই সাথে চলতে শুরু করেছে। আজ এই আবহাওয়াতে ওর সাথে দেখা না হওয়াটা প্রকৃতির অন্যায় করা হবে আমার সাথে। দেখতে দেখতে বারডেম এর সামনে আসার পর সদ্য গোফ এর রেখা পড়া হেলপার ছেলেটা,
”শাহবাগ আইছে নামেন”
বলতেই আমি নেমে গেলাম। বৃষ্টির যেন আজ মহা আনন্দ, সর্ব শক্তি দিয়ে তারা মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে আকাশ থেকে। কিন্তু শায়লার কাছে পৌছাতে আজ বৃষ্টির বাধা হবার কোন কারণ নেই।
ভিজতে ভিজতে রাস্তা পার হয়ে গেলাম। এটুকুতেই টুপটুপে ভিজিয়ে দিয়েছে আমাকে। জিন্সের প্যান্ট ভিজে ভারী হয়ে আছে। হাটতে কিছুটা প্যারা খাচ্ছি। শাহবাগের ফুলের দোকানদার এখনো তাদের ফুল সাজাচ্ছে দোকানে। বৃষ্টির কারণে আজ তারা কিছুটা বিব্রত, বেচা বিক্রি কম হবে বলে হয়ত। আমি একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দোকানদার কিছুটা সোসাইল ডিসটেন্স বজায় রাখছে সে ভিজে যাবে বলে।
বললাম, গোলাপ কত করে ভাই ?
সে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল , কয়টা নিবেন?
- দাম এর উপর ডিপেন্ড করছে।
- আচ্ছা, ১০ টাকা করে দিয়েন।
- আচ্ছা তাহলে ১০ টা দাও। দামাদামি করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। পৃথিবির সব কিছু দামাদামি করে হয় না। আজকে তোমার গোলাপের কোন দামাদামি হবে না।
লোকটা, কিছুটা আমার অযাচিত কথা শুনে বিরক্ত হল, তবু্ও সে ১০ টা গোলাপ দিয়ে, কিছু পাতা ছেটে সুন্দর একটা গোলাপের তোড়া করে আমার হাতে দিল। বিগত একযুগে যত বার দেখা হয়েছে আমি শায়লাকে একটার বেশি গোলাপ দেয় নি। ও গোলাপের পাপড়ি গুলা জমিয়ে রাখত। বলত, আমাদের বাসার ঘর হবে শুকনো গোলাপের পাপড়ি দিয়ে।
গোলাপ হাতে নেওয়া এর পর বৃষ্টি যেন আরোও শক্তি সঞ্চয় করলো। প্রকৃতি সাথে সাথে ঝড় এর মত দমকা হাওয়া ছাড়ল। ঠান্ডা লাগছে বাতাস এর কারনে। শীতে কাপছি নাকি, দেখা না হবার দুশ্চিন্তায় কাপছি বুঝতে পারছি না।
কেন জানি হাসি পাচ্ছে আমার এই মুহূতের। নিজেকে বড় মাপের প্রেমিক মনে হচ্ছে। দেবদাস, বাচ্চা আমার কাছে। ও তো গল্পে। আর আমি মুহুর্তে দাড়িয়ে। ঝড় বৃষ্টির মাঝে এক তোড়া গোলাপ হাতে প্রেমিক তার প্রেমিকার সাথে দেখা করার আশায় শাহাবাগের রাস্তায় হেটে যাচ্ছে। প্রেমিক জানে না দেখা হবে নাকি হবে না। এই পৃথীবির কেউ জানে না। আচ্ছা, প্রেম তুমি কি এমনই ? তুমি কি এভাবেই মহান হয়েছ?
ভাবতে ভাবতেই শাহবাগ থানা পার করে ঢাকা ভার্সিটির মসজিদ গেটের সামনে চলে এলাম। সকাল হওয়াতে তেমন ছাত্র ছাত্রী নেই। ভাবছি কতক্ষণ আজ খুঁজতে হবে তাকে ,এফবিএস এর প্রতিটা ক্লাস রুমের সামনে যেয়ে খোঁজা কি ঠিক হবে ? ও কি বিব্রত হবে ? জানি না ! তবে ওর দেখা পাওয়া যে, আমার জন্য আজ মহা গুরুত্পূন। আজ আমি অনেক স্বার্থপর।
ছাতা হাতে অনেক স্টুডেন্টকে দেখা যাচ্ছে ক্লাসের দিকে যাচ্ছে। অনেকে একটু অবাক হয়ে গোলাপ হাতে আমাকে দেখছে। হয়তো ভাবছে,এসেছে আজ মহান প্রেমিক আমাদের এই ক্যাম্পাসে। অনেক প্রেমিক হয়ত এভাবে ঘুড়ে বেড়ায় এই ক্যাম্পাসের জন্ম থেকে।
হটাৎ দূরে একটা সাদা বিন্দুতে আমার চোখ আটকে গেলো। বুকের ভিতর জমাট বাধা কিছু প্রবল বেগে হাতুড়ির মত আঘাত করতে শুরু করল। আচ্ছা গলায় এটা কি আটকে যাচ্ছে ? জানিনা ! বৃষ্টির কারণে দৃষ্টিসীমা কমে এসেছে। ১০ হাত দূরেও ঠিক মত দেখা যাচ্ছে না। বিন্দুটা অনেক দূরে। তবে আলোকবষ দুরে নয়। মাথায় একটা ছাতা আছে বলে মনে হচ্ছে। এই মুহূর্তে, আমার জীবনের লক্ষ্য শুধু একটাই, যত দ্রুত সম্ভব ওই বিন্দুটার কাছে পৌঁছাতে হবে।
দৌড় দিলাম কিছু না ভেবে , কম দামি স্যান্ডেলটা এমন সময় রসিকতা করতে ভুল করল না। বৃষ্টি , কাদা, প্রীতিকুল আবহাওয়া আমি উপেক্ষা করতে পারলেও , স্যান্ডেলটা পারল না। একটার ফিতে ছিড়ে গেল। একজুতা পায়ে বিন্দুটার যতই কাছে যাচ্ছি ততই সেই এক যুগ ধরে চেনা চেহেরাটা স্পষ্ট হচ্ছে। এত আনন্দ হচ্ছে কেন? আচ্ছা আমি কি কাদছি? আনন্দ অস্রু কি এটা?
সাদা একটা লং কামিজে শায়লা। মাথায় ছাতাটা অনেক নিচ করে ধরা বলে চোখ দেখা যাচ্ছে না। আমি এক পায়ে জুতা, এক হাতে গোলাপ নিয়ে ওর সাম্নে গিয়ে দাড়িয়ে গেলাম। বৃষ্টি যেন কিছুটা এই মুহুর্তে ক্লান্ত। বেগ কিছুটা কমে এসেছে তবে থামছে না।
-শায়লা, কেমন আছ?
ওর চোখের মাঝে সেই চেনা উৎফুল্ল বোঝা গেল।
-ভাল আছি।
বলে চুপ করে আমাকে দেখছে। ছাতাটা হাত থেকে মাটিতে পড়ে আছে। বাতাসে কিছুটা দুরে চলে যাচ্ছ। এই ধরণীতে শুধুমাত্র আমি, সে আর ভেজা লাল গোলাপ ছাড়া কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। বৃষ্টি, সে তো অপেক্ষায় আছে।
ভেজা গোলাপ গুলু ওর হাতে দিয়ে, চিৎকার করে,
" ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি"
বলতেই শায়লা মাটির দিকে তাকিয়ে কাদতে শুরু করে দিল। বৃষ্টি যেন সব কান্না লুকিয়ে দিচ্ছে। কেউ দেখছে না তারা কাদছে। আনন্দ বইছে ভুবনে, সব যেন আগের মত হতে চলছে।
শায়লা ধীরে ধীরে তার ডানহাত সাম্নের দিকে এগিয়ে দিল। ধরতে গিয়ে দেখি, অনামিকা নামের সেই লম্বা আংগুলে যেখানে আমি ঘাস এর আংটি পড়াতাম, সেখানে একটা দামি ডায়মন্ড এর আংটি। তারপর হাত ছুয়ে দেখার আর সাহস হয় নি।
বৃষ্টি, কান্না, মেঘ আজ কেন একজোট হয়ে আছে? বিধাতা কেন তাকালে আজ আমার দিকে?
চরম আন্নন্দের মুহুর্তের পরেই মানুষের মৃতু্্য হওয়া উচিত। তাতে হয়ত সুখ নিয়ে এপার অতিক্রম করে ওপারে গিয়ে অপেক্ষা করা যায়।