প্রথমেই বলে নিতে চাই, আমার এ লেখাটি তাদের জন্য, যারা নিজেদের মুসলিম বলে দাবী করছি।
১
হিজরী সপ্তম সাল। আজকের সুপার পাওয়ার আমেরিকার মতো তখন দুটি সুপার পাওয়ার পৃথিবীতে কর্তৃত্বরত ছিলো, যার একটি হলো পারস্য সাম্রাজ্য আর আরেকটি হলো রোমান সাম্রাজ্য। পারস্যের সম্রাট পরাক্রমশালী খসরু পারভেজ। রোমানদের সাথে তখন পারস্যের যুদ্ধ চলছে। সম্রাটের জাঁকানো দরবারে চলছে নীতি নির্ধারণী সভা। বাইরে অতিরিক্ত ফোর্স পাহারায় বিদ্যমান। এমন সময় রাজ দরবারের প্রধান ফটকে ধুলি ধুসরিত চেহারা আর বাবলা গাছের কাঁটা দিয়ে আটকানো ছালা সদৃশ পোষাক গায়ের এক অচ্ছুত আরব লোক ফটক রক্ষীদের কাছে এলো।
“কি চাই?।“
“আমি সম্রাট খসরু পারভেজের সাথে দেখা করতে চাই”।
ফটক রক্ষীদের হাসি শুরু হলো। সম্রাটের সাথে যেখানে নামী-দামী লোকেরই দেখা করার সুযোগ নেই, সেখানে এই আরব, যার আবার পোষাকের এ অবস্থা? দূর দূর করে তারা লোকটিকে তাড়িয়ে দিলো। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। ঘুরে ফিরে এসেই সম্রাটের সাথে দেখা করার কথা বলতে লাগলো।
“আমাকে সম্রাটের কাছে নিয়ে চলো, একটি চিঠি আমি তার কাছে পৌঁছে দিয়ে চলে যাব”।
“কার চিঠি তুমি নিয়ে এসেছো?”
“আল্লাহর রাসুলের চিঠি”।
দ্বার-রক্ষীদের হাসি দ্বিগুন হলো। তখনকার পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সকলেই অনুন্নত আরবদের ঘৃণা করত, এমনকি এদের সাথে মিশতেও সংকোচ বোধ করত। এহেন আরবদের একজন লোক, যাকে সে রাসুল বলে পরিচয় দিচ্ছে- তার এক মূল্যহীন চিঠি পরাক্রমশালী পারস্য সম্রাটের কাছে পৌঁছানোর দুঃসাহস দেখাচ্ছে? এবার তাকে অপমান করেই তাড়িয়ে দেয়া হলো।
এভাবে তিনদিন চলে গেলো। বেয়াড়া সে আরব লোকটিকে দেখা গেলো এখনো প্রাসাদের দ্বারের সামনে ঘুর ঘুর করছে আর রক্ষীদের বলে চলেছে-
“তোমরা আমার কথা শোন, আমি কিছু চাইতে এখানে আসিনি, কেবল এই চিঠিটি পৌছে দিয়েই আমি চলে যাব।“
সেদিন সম্রাটের সভাকক্ষে চলছিলো জরুরী সভা। আলোচনার এক পর্যায়ে আরবদের প্রসঙ্গ এলো। আরবদের ব্যাপারে একেকজন একেক রকম মত দিলেন। সম্রাট বললেন,
“এ ব্যাপারে একজন প্রকৃত আরবের মত জানলে ভালো হত, শহরে কেউ আছে নাকি আরবের?”
সবাই মাথা নাড়লো, কেউ নেই। ঘটনাক্রমে সেদিন রাজ সভাকক্ষে রক্ষীদের এমন একজনের দায়িত্ব ছিলো, যে আগের দিন প্রাসাদের দ্বারে ডিউটি দিয়েছে। সে বলল-
“মহামান্য সম্রাট, গত তিনদিন ধরে এক আরব আপনার কাছে একটি চিঠি দেবার জন্য বাইরে ঘুর ঘুর করছে। সে বলছে কোন কিছু চাইতে সে আসেনি, কেবল আল্লাহর রাসুল বলে দাবীদার এক আরবের একটি চিঠি নিয়ে এসেছে”।
সম্রাট বললেন, “এক্ষুনি যাও আর সে থাকলে তাকে নিয়ে এসো”।
রক্ষী বাইরে এলো। যথারীতি সেই আরব দ্বার-রক্ষীদের সাথে বাদানুবাদ করছিলো। দ্বার রক্ষীদের ছোখ ছানাবড়া করে দিয়ে তাকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো সভাকক্ষের প্রহরী। জীর্ণ মলিন পোষাকের সে লোকটা দৃঢ় পদক্ষেপে দরবারে প্রবেশ করলো। ঘোষকদের একজন চিৎকার করে উঠলো, “মহামান্য সম্রাটকে মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ করো”।
লোকটি ঘোষণা করল-
“আমি মুসলিম এবং মুসলিমরা আল্লাহ ছাড়া কারো সামনেই মাথা নত করে না”।
সকল সভাসদের বিস্ময় চূড়া স্পর্শ করল। সবাই সে প্রসঙ্গ ভুলে গিয়েছিল যা জানার জন্য এ আরব লোকটিকে ডাকা হয়েছিল। সম্রাটের পক্ষ থেকে ভয়ংকরতম আদেশের অপেক্ষা সবাই করছিল। সম্রাট শক্ত মুখে বললেন,
“তুমি এখানে কেন এসেছো?”
“আমি আল্লাহর রাসুলের পক্ষ থেকে একটি চিঠি নিয়ে আপনার কাছে এসেছি”।
সম্রাটের ইশারায় চিঠি নেবার জন্য একজন পারিষদ এগিয়ে এলেন। লোকটি তার হাতে চিঠি দিতে অস্বীকার করে বলল,
“রাসুলুল্লাহ সাঃ পত্রটি সরাসরি আপনার হাতে দেয়ার নির্দেশ আমাকে দিয়েছেন। আমি তাঁর আদেশের বিরুদ্ধে যেতে পারিনা”।
সম্রাট বললেন, “তাকে আমার কাছে আসতে দাও”।
চিঠিটি হাতে নিয়ে সম্রাট হীরা অধিবাসী তাঁর সেক্রাটারীর হাতে দিয়ে পড়তে দিলেন। চিঠি খোলা হলো। শুরু হলো পড়া।
“পরম করুণাময় আল্লাহর নামে শুরু করছি। আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজের প্রতি......।“
সম্রাট ক্রোধের সাথে পড়া থামিয়ে দিলেন।
“এত বড় স্পর্ধা? আমার নামের আগে তার নাম লিখেছে?”
সত্যিই এ ছিলো অচিন্তিনিয় ব্যাপার। বিশাল পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে কখনও এমন হয়নি বা কেউ এমন দুঃসাহসও করেনি। ক্রুদ্ধ সম্রাট চিঠি পড়তে ইশারা করলেন। রাসুলুল্লাহ সাঃ এর ছিঠিটা ছিল এমন-
পরম করুণাময় আল্লাহর নামে শুরু করছি-
আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজের প্রতি।
সে ব্যক্তির প্রতি সালাম, যে হিদায়াতের অনুসরণ করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান আনে। তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর কোন শরীক নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসুল। আমি তোমাকে আল্লাহর প্রতি আহবান জানাচ্ছি, কারণ আমি সকল মানুষের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত। যারা বেঁচে আছে, তাদেরকে পরিণাম সম্পর্কে ভয় দেখানো এবং কাফিরদের উপর সত্য কথা প্রমাণিত করাই আমার কাজ। কাজেই তুমি ইসলাম গ্রহণ করো, তাহলে শান্তিতে থাকবে। যদি এতে অস্বীকৃতি জানাও, তাহলে সকল অগ্নি উপাসকের পাপও তোমার উপরই বর্তাবে।
স্তব্ধ হয়ে সম্রাট চিঠি শেষ করলেন। মুহূর্তকাল পর তিনি চিঠিটি কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেললেন। সেই আরব লোকটির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“অন্য কোন রাজার দূত হলে এরকম চিঠির জন্য আমি দূতকে হত্যা করতাম। কিন্তু তুমি এসেছো এমন এক লোক আর এমন এলাকা থেকে যে তোমাকে হত্যা করাও আমি সমীচিন মনে করছি না। আগামীকাল সূর্যাস্ত পর্যন্ত তোমাকে সময় দেয়া হলো। এর ভেতরে তুমি আমার সাম্রাজ্য ত্যাগ করবে, অন্যথায় যেখানেই তোমাকে পাওয়া যাবে, সেখানেই তোমার জীবন সাঙ্গ হবে”।
অবিচলিত লোকটিকে বের করে দেয়া হলো। ফটকের বাইরে এসে সামান বেঁধে সে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। আলোচ্য লোকটি ছিলো রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন হুজাফাহ আস-সাহমী।
সম্রাট খসরু দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁর রাজধানী মাদায়েন থেকে হাজারো মাইল পেরিয়ে ইয়েমেন পর্যন্ত তাঁর সীমানা বিস্তৃত। তিনি তাঁর অনুগত ইয়ামেনের শাসক ‘বাযান’ কে চিঠি লিখলেন- “তোমার ওখান থেকে তাগড়া সৈন্য পাঠিয়ে আরবের নবী দাবীদার সেই ব্যক্তিকে ধরে দ্রুত আমার কাছে পাঠিয়ে দাও”। রাজকীয় দূত চিঠি নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলো ইয়ামেনের পথে।
এদিকে আব্দুল্লাহ বিন হুজাফাহ ছুটে চলেছেন হাজার হাজার মাইল দূরের মদীনার পথে। গহীন মরুর বুকের তপ্ত দিন আর ঘুটঘুটে রাতে তিনি আর তাঁর প্রতিপালক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই। আল্লাহু আকবার। এ কোন গল্প কাহিনী নয়, এ হলো আজকের আমাদের অস্তিত্বের মতোই বাস্তব।
আব্দুল্লাহ বিন হুজাফাহ মদীনায় পৌঁছুলেন আর খসরুর রাজকীয় দূত পৌঁছালো ইয়েমেন। আব্দুল্লাহ রাসুলুল্লাহ সাঃ এর কাছে সবিস্তারে চিঠির সবকিছু বর্ণনা করলেন। সব শুনে তিনি একটি কথাই বললেন, “আল্লাহ তাঁর রাজ্যকে ছিন্ন করে ফেলবেন যেভাবে সে আমার চিঠিকে ছিঁড়েছে”। (এর মাত্র বছর কয়েক পরের কথা। রাসুলুল্লাহ সাঃ এর মৃত্যু হয়েছে এবং উমার ইবন খাত্তাব রাঃ এর শাসনকাল চলছে। বিখ্যাত সাহাবা সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রাঃ এর নেতৃত্বে যখন মুসলিম সেনাবাহিনী মাদায়েনে খসরুর সুবিশাল রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করছিলো, সকলের চোখ দিয়ে তখন ক্রমাগত ঝরছিলো অশ্রু। যে প্রাসাদে একদিন রাসুল সাঃ এর চিঠি আর তাঁর দূত আব্দুল্লাহ বিন হুজাফাহকে নিকৃষ্ট বলে অপমান করা হয়েছিলো, আজ সে প্রাসাদওয়ালারা তাদেরই ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো। চিরদিনের অপরাজিত পারস্য সাম্রাজ্য আল্লাহ মুসলিমদের হাত দিয়েই ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছিলেন)।
এদিকে ইয়েমেনের শাসক বাযান খসরুর রাজকীয় ফরমান পেয়ে কাল বিলম্ব না করে তাঁর সেনাবাহিনীর ছোট একটি সুপ্রশিক্ষিত দলকে মদীনার পথে পাঠিয়ে দিলেন। তখন হুদাইবিয়ার সন্ধি চলছে, আর চলছে যুদ্ধবিরতি। প্রায় সমগ্র আরব তখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইসলামের ছায়াতলে এসে আশ্রয় নিয়েছে। হাজারো বছরের আরব ইতিহাস আমূল বদলে গেছে। হিংসা আর হানাহানির বদলে বইছে শান্তির সুবাতাস। রাসুলুল্লাহ সাঃ কে গ্রেফতারের জন্য পাঠানো ইয়েমেনী ছোট্ট বাহিনী পরিবর্তিত আরবের এই চেহারা দেখে বিস্মিত হচ্ছিল। পথিমধ্যে রাসুল সাঃ সম্বন্ধে খোঁজ নিয়ে তাঁর প্রভাব দেখে তারা চিন্তিত হয়ে পড়ছিল। দীর্ঘ সফর করে দলটি একসময় তায়েফ এসে পৌঁছুল। ঘটনাক্রমে সেখানে তাদের সাথে মক্কার কুরাইশদের একটি ব্যবসায়ী দলের সাথে দেখা হল। ওদের আগমনের উদ্দেশ্য জানতে পেরে তারা ভীষণ খুশি হল। মক্কায় ফিরে গিয়ে তারা মক্কাবাসীদের সুসংবাদ দিল-“এবার তোমরা উল্লাস করতে পারো। পারস্য সম্রাট খসরু এবার মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। তার অনিষ্ট থেকে এবার তোমাদের মুক্তি মিলবে”।
ইয়ামানের দলটি মদীনায় পৌছালো। মদীনায় তারা রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সাথে দেখা করল। এতদিন তারা রাসুলুল্লাহ সাঃ এর কথা আর তাঁর অদ্বিতীয় আদল ও ইনসাফের কথা শুনে এসেছে, এবার সামনা সামনি তাঁর সুবিশাল ব্যক্তিত্বের মুখোমুখি হয়ে তারা হতভম্ব হয়ে পড়ল। শুরুতে তাদের ইচ্ছা ছিল এই নবী দাবীদার লোকটিকে সবার সামনে বেঁধে, টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাবে। আজ রাসুলের সামনে এসে তাঁরা কেবল এটুকুই বলতে পারল-
“শাহানশাহ খসরু আমাদের বাদশাহ ‘বাযান’কে লিখেছেন, তিনি যেন আপনাকে নেওয়ার জন্য লোক পাঠান। আমরা তাঁরই নির্দেশে আপনাকে নিতে এসেছি। আমাদের আহবানে সাড়া দিলে আপনার যেন মঙ্গল হয় এবং তিনি যেন আপনাকে কোন ধরণের শাস্তি না দেন সে ব্যাপারে আমরা খসরুর সাথে কথা বলবো। আর আমাদের আহবানে সাড়া না দিলে দয়া করে একটু বুঝে শুনে দেবেন, কারণ আপনাকে আর আপনার জাতিকে ধ্বংস করার ব্যাপারে তাঁর শক্তি ও ক্ষমতাতো আপনার জানাই আছে”।
রাসুলুল্লাহ সাঃ মৃদু হেসে বললেন, “আজ তোমরা বিশ্রাম করো, আগামীকাল আমি এ ব্যাপারে তোমাদের জানাবো”।
তারা সেদিনের মত চলে গেলো বিশ্রাম নিতে, পরদিন আবার এলো রাসুল সাঃ এর কাছে। তিনি তাদের বললেন,
“তোমরা আর কখনো খসরুর দেখা পাবেনা, আল্লাহ তাকে ধ্বংস করেছেন। অমুক মাসের অমুক তারিখ তার পুত্র শিরওঁয়া তাকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেছে”।
বিস্ময়ে তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিলো। তারা বলল,
“আপন কি বলছেন তা-কি ভেবে দেখেছেন? আমরা কি ‘বাযান’কে একথা লিখে জানাবো?”
তিনি বললেন, “হ্যাঁ। আর তোমরা একথাও লিখবে যে, আমার এ দ্বীন খসরুর সম্রাজ্যের প্রান্তসীমা পর্যন্ত পৌছবে। তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ কর, তোমার অধীনে যা কিছে আছে তা সহ তোমার জাতির কর্তৃত্ব তোমাকে দেয়া হবে”।
গ্রেফতারী পরোয়ানা পাওয়া কোন লোকের কাছ থেকে এরকম অদ্ভুতুড়ে কথা শুনে কখনও কোন রাজকীয় সেনাবাহিনীর বিশ্বাস করার কথা নয়, বরং এ হতে পারে গ্রেফতার এড়ানোর কৌশল। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাঃ এর ব্যক্তিত্ব ও কথাগুলো ছিলো এমন যে, দলটি দ্রুত তা লিখে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ফেরার পথে।
দীর্ঘ সফরের পর তারা এসে পৌঁছালো বাযানের দরবারে। ভরা সভায় তারা সকল ঘটনা বাযানকে খুলে বলল। সব শুনে বাযান বললো-
“মুহাম্মাদ যা বলেছে তা সত্য হলে তিনি অবশ্যই নবী। আর সত্য না হলে আমরা তাকে উচিৎ শিক্ষা দেব”।
আলোচনা চলছে এমন সময় বাযানের কাছে শিরওঁয়ার বার্তাবাহক এসে পৌঁছালো। ঘোষক উচ্চস্বরে পাঠ করতে লাগলো-
“অতঃপর আমি খসরুকে হত্যা করেছি। আমার জাতির পক্ষ থেকে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই তাকে হত্যা করা হয়েছে। ............ আমার এ পত্র তোমাদের কাছে পৌঁছানোর পর তোমার আশে পাশের লোকদের নিকট থেকে আমার আনুগত্যের অঙ্গীকার নেবে”।
আবেগে আপ্লুত বাযান শিরওঁয়ার চিঠি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়, তার সাথে সাথে তার আশ পাশে সকলেই ইসলাম গ্রহণ করে। শীঘ্রই সমস্ত ইয়েমেন ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নেয়।
এই ছিলেন রাসুলুল্লাহ সাঃ আর এই ছিলো আল্লাহর মনোনীত দীন-ইসলাম।
২
২০০০সাল। গভীর রাতের ঢাকা শহরে হেঁটে যাচ্ছিল এক যুবক। যুবকের চিন্তা-চেতনা জুড়ে ছিল একটি মানুষ, নাম- হুমায়ুন আহমেদ। তাঁর সৃষ্ট কাল্পনিক এক চরিত্র ‘হিমু’ যুবকের অন্তরের সাথে যেন এক হয়ে মিশে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে হিমু নামের এই অবাস্তব চরিত্র যুবকটির জীবনকেও বাস্তবতার বাইরে এনে ফেলে দিয়েছিল। পরীক্ষায় ফেল যুবকটির নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হিমুর পটে আঁকা, ছকের বাইরে জীবনের কোন কিছুই তার ভালো লাগতনা। বাবা-মা যথেষ্ট সামর্থবান থাকায় তাকে অর্থকষ্টে পড়তে হয়নি বটে, তবে তারই মত এরকম হাজার হাজার ‘হিমুর হ্যালুসিনেশনে’ পড়া যুবক পরিবার-প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্যুত হয়ে নিজেদের সোনালী সময়গুলো শেষ করে দিয়েছিল। যখন বাস্তব জীবনে তারা ফিরে এসেছিল, তখন তারা দেখেছে নিষ্ঠুর এই সমাজে তারা কেবল করুণার পাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। অসহায় বাবা-মার চোখের পানি যখন তার বুকে বিঁধতে শুরু করেছে, ততক্ষনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল আর বুয়েট থেকে পাশ করে বন্ধুরা যখন রোজগারে নেমে পড়েছে, তখন সে কলেজের গন্ডিও পেরোতে পারেনি। হিমু নামের অজানা যে যাদু তাকে ঘিরে ধরেছিল, আজও তা বহাল তবিয়তে আছে। আজও অনেক যুবক গভীর রাতে ঘুরছে হলুদ পাঞ্জাবী গায়ে, সুন্দরী কোন ‘রূপা’র আশায় বিভোর থেকে।
যে মানুষটি তাঁর কথা আর লেখার যাদু দিয়ে এরকম হাজারো যুবকের মাথা বিগড়ে দিয়েছেন, যাঁর সকল কথাই অনেক লোক নিখাদ বলে ধরে নিয়েছে, তাঁর অবস্থাটা কি? হ্যাঁ, যখন খেটে খাওয়া কোন দরিদ্র পিতার সন্তান সে মানুষটির বই পড়ে বড়লোক কোন রূপা বা কোন ফুপুর দেখা পাবে বলে স্বপ্নের সাগরে ভাসছিল, তখন তার বাবা-মা উপোষ থেকে তার পরীক্ষার ফি জমাচ্ছিলেন, আর তাকে ঘোরে ফেলে দেয়া সে লেখক তার সুবিশাল ‘দখিন হাওয়া’য় নিরাপদ রাত যাপন করছিলেন। তার সামনে ছিল অ্যাপল কম্পিউটার (যা হয়ত সারা বাংলাদেশে হাতে গোনা কয়েকটি আছে), হাতে ছিল দামী সিগারেটের প্যাকেট। লোকটি হাজারো যুবককে ঘোরে ফেলেছিলেন বটে, তবে নিজে কখনও হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে রাস্তায় নামেননি। সভ্যতা-আধুনিকতার নামে, নাটক-সিনেমার নামে ছেলে আর মেয়েদের অবাধ মেলামেশার হাট বসিয়েছিলেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢেলে বানানো তাঁর ‘নুহাস পল্লী’তে।
যে আল্লাহর একক মালিকানার রাজত্বে বসে তিনি অন্যায় ও আশ্লীলতার সয়লাব বইয়ে দিচ্ছিলেন, সে আল্লাহ এবং তাঁর মনোনীত রাসুল এবং ইসলামকে তিনি সুকৌশলে তামাশার বস্তুতে পরিণত করেছি্লেন।
৩
উপরে দুটি সময়ের দুটি ভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করেছি। কেন?
কোন আদর্শকে অনুসরণ করে মানুষ কিভাবে তার পথ ও পন্থা নির্ণয় করে নেয় তার একটা উদাহরণ দেয়ার জন্য। যে কোন মানুষ স্বভাবগত বা সহজাত ভাবে নিজের জন্য একটি আদর্শ ঠিক করে নেয়। এমনকি যে ব্যক্তি বলে আমি কাউকে আদর্শ মানি না, সেও সচেতন বা অবচেতন মনে নিজেকে বিশেষ কারো একজনের মত তৈরী করে নিতে ভালোবাসে। মানুষের এই স্বভাবজাত প্রবণতার ফলে দেখা যায় কেউ মাইকেল জ্যাকসনের মত রক স্টার হতে চায়, কেউ হতে চায় টেন্ডুলকারের মত স্পোর্টসম্যান, কেউ শাহরুখ খানকে ছুঁয়ে দেখতে পারাটা জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি বলে জানে, আর কেউ শাহবাগের আজিজ মার্কেটের আড্ডাকে জীবন দর্শনের তীর্থ বলে জানে। তবে সমস্যা হলো একটাই, আর তা হলো ‘একটিমাত্র জীবন’। আর তাই- যে আদর্শকে আমি অনুসরণ করে চলেছি তা যদি এমন হয় যা আমাকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে, তা থেকে দূরে থাকাই সবার কর্তব্য হওয়া উচিৎ। ইসলামকে যে নিজের ধর্ম হিসাবে মেনে নেয়নি তার কথা আলাদা, এবং তাকে উদ্দেশ্য করে এ লেখাটি নয়। তবে যে ব্যক্তি ইসলামকে নিজের দীন বা জীবনের ম্যানুয়াল হিসেবে মেনে নিয়েছে, জীবনের আদর্শ তার জন্য শ্বাস নেবার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। যদি কেউ রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলকে আদর্শ হিসাবে মানে বা বলে বেড়ায়, অথবা বিশেষ কোন লোকের জন্ম বা মৃত্যু দিবসে বলে বেড়ায় “তিনি হলেন আমাদের সবার জন্য আদর্শ”, কিংবা জেনে বা না জেনে “আমরা অমুক আদর্শের সৈনিক” বলে বক্তৃতা করে- তারা মুখে মুখে যতই বলুক আমরা রাসুল সাঃ এর উম্মাত ও তাঁর অনুসারী, কবরে যখন প্রশ্ন করা হবে “মান নাবীউকা?” বা “তোমার নবী কে?”- এর উত্তরে স্বভাবতঃই তাদের মুখ দিয়ে বের হবে “নাবীউ লালন সাঁই”, “নাবীউ সালমান খান” বা “নাবীউ মাও সে তুং” (“আমার নবী ছিলো লালন সাঁই”, “আমার নবী ছিলো সালমান খান” বা “আমার নবী ছিলো মাও সে তুং”) ইত্যাদি। মানব জগতে চেহারা ও মননে কোটি-বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ভ্যারিয়েশন বা বৈচিত্র সৃষ্টিকারী মহান আল্লাহ এজন্যই অনুসরণ করার জন্য অসাধারণ সব মানুষ পৃথিবীতে নবী হিসাবে পাঠিয়েছেন এবং আমাদের ডেকে বলেছেন, “লাক্বাদ কা-না ফী রাসুলুল্লাহি উসওয়াতুন হাসানা” বা “তোমাদের জন্য রাসুলের জীবনই হলো উত্তম আদর্শ”।
উপরে উল্লেখ করা দুটি ঘটনা থেকে আমরা দেখেছি, কিভাবে ইসলাম এবং রাসুলুল্লাহ সাঃ এর আদর্শ মক্কার এক অখ্যাত মেষপালক আব্দুল্লাহ বিন হুজাইফাকে অকুতভয় এক মানুষে পরিণত করেছিলো, যে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় পেতো না। আর হুমায়ুন আহমেদের তৈরী কাল্পনিক এক হিমুর আদর্শ কিভাবে মানুষকে অবাস্তব এক ঘোরের মধ্য আটকে ফেলেছিলো।
প্রসঙ্গতঃ আমার জীবনের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। আজ থেকে প্রায় আঠারো বছর আগের কথা। কুমিল্লা টাঊন হলে বইমেলা চলছে। মেলায় হুমায়ুন আহমেদ এসেছেন আর অটোগ্রাফ দিচ্ছেন- বন্ধুদের কাছে এ খবর পেয়ে অনেক কষ্টে জমানো কটি টাকা দিয়ে ‘আমার আছে জল’ বইটা কিনে আমি লাইনে দাঁড়ালাম। বইয়ের উপরে নিজেই কলম দিয়ে লিখলাম “একজন অন্ধ ভক্তকে...”। দীর্ঘ সময় পর যখন আমার পালা এলো তখন মন বলছিলো আমার লেখাটা পড়ে হয়তো তিনি কিছু কথা বলবেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “অন্ধ ভক্তের নাম কি?”। আমি নাম বললাম। তিনি আমার নাম লিখে লিখলেন “...... কে শুভেচ্ছা” আর নীচে অটোগ্রাফ দিয়ে সরে যেতে ইশারা করলেন। অন্য কথা না বলাতে মনটা খারাপ থাকলেও সেই বইটা আমি বহুদিন যত্ন করে কাছে রেখেছিলাম। তাঁকে সত্যিই আমি ভীষণ ভালোবাসতাম। কখনও হিমু, কখনও মিসির আলি হিসাবে নিজেকে ভাবতেও ভালোবাসতাম। ‘ছায়াসঙ্গী’ ধরণের গল্প পড়ে কয়েক মাস গা ছমছম করত। ‘এইসব দিনরাত্রি’ পড়ে অনেক দিন আর অনেক রাত্রি আমি ঘোরের ভিতর থেকেছি। গুলতেকিন আর শাওন সংক্রান্ত জটিলতায় আমার ঘোর কিছুটা কাটতে শুরু করে যদিও ইসলামের জ্ঞান আমার তখন প্রায় শূন্যের কোঠাতেই ছিলো।
ধীরে ধীরে আমি আবিষ্কার করলাম এই ভদ্রলোকটি অত্যন্ত সচেতন আর সূক্ষ্মভাবে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলকে হেয় করে চলেছেন। বিকৃত অঙ্গভঙ্গী আর অতি অভিনয়কারী কিছু মানুষ- যারা ‘স্যার স্যার’ করতে করতে তাঁকে ইলাহ বানিয়ে ফেলেছে, এদের ব্যবহার করে তিনি গাইয়েছেন- “দীনের নবী মোস্তফায়, রাস্তা দিয়া হাঁইট্যা যায়, একটা পাখি বইসা ছিলো গাছেরো শাখায়...”। এই গানটা এমন যে তা রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সুবিশাল ব্যক্তিত্বের সাথে যায়না। বাংলাদেশের অনেক ভিক্ষুক “আমার আল্লাহ নবীজীর নাম...” জাতীয় কিছু গান গেয়ে ভিক্ষা করে ঠিকই কিন্তু তাও হয়তো হুমায়ুন আহমেদের বানানো গানটির চেয়ে ভালো, যদিও এভাবে আল্লাহ আর রাসুলের নাম ভাঙিয়ে ভিক্ষা করার ব্যাপারে রাসুল সাঃ এর কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
একটা সময় যখন তাঁর লেখা পাগলের মত পড়তাম, তখন তাঁর কিছু কিছু লেখা মাঝে মাঝে ধাঁধাঁয় ফেলে দিত যে তিনি আদৌ আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখেন কিনা। মাহফুজ আহমেদের নেয়া তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের বইটা পড়ে তাঁর সম্বন্ধে জেগে উঠা সামান্য সে সন্দেহ কেটে গেছে যখন তিনি বলেছেন “আমি ভীষণভাবেই আস্তিক”।
তবে আল্লাহর করুণায় যখন ইসলামকে কিছুটা জানতে শুরু করেছি তখন দেখেছি ঈমান আর আস্তিকতার ভিতরে রয়েছে অনেক তফাৎ। আস্তিকতা হলো এমন একটা বিষয় যা মানুষ মাত্রেরই ‘ফিতরাত’ বা সহজাত প্রবৃত্তি। যেকোন মানুষ, তা সে যে ধর্মেরই হোকনা কেন, সৃষ্টিকর্তার উপস্থিতি এবং তাঁর সুবিশাল প্রভাবের বিষয়টি অনুভব না করে পারেনা। এমনকি হাতে গোনা দু-একজন ছাড়া বাকি সব নাস্তিক মৃত্যুর পর তাদের জানাজা না দেয়া, বা ধর্মীয়ভাবে সৎকার না করার কথা বলে যায়না। আস্তিকতা বা ঈমান বিষয়ে প্রথম আমি জানতে পারি কুরআন, সুন্নাহ ও ইসলামের প্রকৃত ইতিহাসে, যেখানে দেখা যায় মক্কার সকল কাফির এবং তাদের নেতৃত্ব দানকারী আবু জাহল, আবু লাহাব বা আবু সুফিয়ানরা ভীষণভাবে আল্লাহকে বিশ্বাস করত। এমনকি তাদের দেব-দেবী বা মূর্তিগুলোকে তারা আল্লাহকে পাবার মাধ্যম হিসেবেই কেবল বিবেচনা করতো, কিন্তু জানত যে চুড়ান্ত ক্ষমতা কেবল আল্লাহরই। তাদের স্বজন-সহকর্মীদের নাম ছিল আব্দুল্লাহ, উবাইদুল্লাহ ইত্যাদি, অথচ আল্লাহ এদেরকেই কুরআনে কাফির বলেছেন। এদের সম্বন্ধে আল্লাহ বলেন,
“তুমি যদি তাদের জিজ্ঞেস কর কে তাদের সৃষ্টি করেছে, তারা অবশ্যই বলবে আল্লাহ, এরপরও তারা কোথায় ফিরে চলেছে?” (সুরা যুখরুফঃ ৮৭)
“যদি তুমি তাদের জিজ্ঞেস কর এ নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল কে সৃষ্টি করেছেন, তারা অবশ্যই বলবে আল্লাহ”। (সুরা লুকমানঃ ২৫)
"যদি তুমি তাদের জিজ্ঞেস কর, কে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, এরপর তা দিয়ে মৃত মাটিকে সঞ্জীবিত করেন, তবে তারা অবশ্যই বলবে আল্লাহ। বল, সমস্ত প্রসংশা আল্লাহরই, কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা বোঝে না”। (সুরা আনকাবুতঃ ৬৩)
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ যতবার কুফর আর শির্ক সম্পর্কে বলেছেন, সকল স্থানে তিনি তাদেরকেই উদ্দেশ্য করেছেন, যারা আস্তিকতায় বিশ্বাসী, নাস্তিকতায় নয়। সমস্ত কুরআনে কেবলমাত্র একটি আয়াতে তিনি নাস্তিকদের কথা উল্লেখ করেছেন।
সুতরাং হুমায়ুন আহমেদ বা আর যে কেউ যতই আস্তিক বলে নিজেকে প্রচার করুকনা কেন, ঈমানের সংজ্ঞার সাথে মিলাতে গেলে সবাইকেই আল্লাহর বেঁধে দেয়া শর্ত পূরণ করে তবেই ঈমানের প্রকৃত দাবী নিয়ে দাঁড়াতে হবে। ইসলাম কেউ গ্রহণ করা বা না করা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার। তবে একই সাথে নিজেদের মুসলিম দাবী করা এবং আল্লাহর কোন বিধানের সমালোচনা বা অবজ্ঞা করার অধিকার কারো নেই, যে কাজটি হুমায়ুন আহমেদ অহরহ করছেন।
বেশী দূরে যাবার দরকার নেই, অতি সম্প্রতি প্রথম আলোতে তাঁর লেখা কলাম ‘নিউইয়র্কের আকাশে ঝকঝকে রোদ’-এ তার তিন মেয়ের প্রসঙ্গে ‘তিন ডব্লিউ’ শিরোনামে একটি কলামের কথাই বলছি। বড় মেয়ে নোভা (আল্লাহ ইসলামের জন্য তার অন্তরকে উন্মুক্ত করে দিন) প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, “অতি সম্প্রতি সে আমেরিকা থেকে পিএইচডি ডিগ্রী করেছে, আর আমেরিকা থেকে পিএইচডি’র সাথে হিজাবও সাথে করে নিয়ে এসেছে। মাশাল্লাহ, কেয়া বাত হায়”। হুমায়ুন আহমেদ এ পর্যন্ত কোন লেখায় সচেতনভাবে আল্লাহর প্রসংশা করে মাশাআল্লাহ, সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেননি। তবে আল্লাহর সাথে সম্পর্কযুক্ত ইসলামী এ পরিভাষাগুলো তিনি নিজে বা তাঁর লেখা কোন চরিত্র দিয়ে অনেকবারই অবজ্ঞা করে বলেছেন, যেমনটি এবার নিজের মেয়ের হিজাব নিয়ে বললেন। হিজাব হলো এমনই একটি বিধান, যা আল্লাহ সকল মুসলিম নারীদের জন্য ফরজ করেছেন। হিজাবের বিরুদ্ধে কাফির আর নাস্তিক সমাজের সমালোচনা আর বিরোধিতার ইতিহাসও হাজারো বছরের। সমস্যা হলো মুসলিম বলে দাবীদার কেউ যখন আল্লাহর এমন কোন বিধান নিয়ে কটাক্ষ করে, এমনকি সন্দেহ পোষণ করে, সে আর মুসলিম থাকে না।
আল্লাহ তাঁকে সঠিক পথ দেখান, তিনি স্লো পয়জনের মত মানুষের মনে আল্লাহ আর তাঁর রাসুলের প্রতি অবজ্ঞা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। নিজে যা করেননা, তা মানুষকে করার জন্য উৎসাহিত করেন। হলুদ পাঞ্জাবী পরে শূণ্য পকেটে যে ছেলেটি অবাস্তব মোহে হিমু হয়ে রাস্তায় হাঁটে, সে ছেলেটি জানেনা, যে লোকটি তাকে এ পথে নামিয়েছেন, অগাধ টাকা থাকলেও তিনি তার একটি বেলা খাবারের দায়িত্ব নিতেও অস্বীকার করবেন। যখন মিসির আলী নামের কাল্পনিক এবং নাস্তিক কোন চরিত্রকে জীবনের আদর্শ হিসাবে কোন তরুন গ্রহণ করে নিজেকে ধংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে, তখন সেই তরুণের মা হয়ত গভীর রাতে তাহাজ্জুদের সিজদায় আল্লাহর কাছে ছেলেটির জন্য কাঁদছে। আল্লাহ এ ধরণের কবি-সাহিত্যিকদের সম্পর্কে কী স্পষ্টভাবেইনা কুরআনে বলেছেন-
“আর কবিদের (যারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট) তো পথভ্রষ্ট লোকেরাই অনুসরণ করে। তুমি কি দেখনা যে তারা (কল্পনার হাওয়ায় চড়ে) প্রতিটি ময়দানে উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়ায়?, এবং এমন কথা বলে, যা তারা নিজেরেই বিশ্বাস করে না”। (সুরা আশ শুআরাঃ ২২৪-২২৬)
কুরআনের এ আয়াতগুলো যখন নাজিল হয়েছিলো, তখন আরব উপদ্বীপের কয়েকজন বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন যাদের মধ্যে ছিলেন হাসসান বিন সাবিত, ক্বাব বিন মালিক, আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহাহ প্রমুখ। আয়াতগুলো শোনার পর তাঁরা ভীষণ ভড়কে গেলেন। দু চোখের পানি যেন আর বাঁধ মানছিল না। শেষ পর্যন্ত তারা রাসুলুল্লাহ সাঃ এর কাছেই ছুটে এলেন। তাদের কথা শুনে রাসুলুল্লাহ সাঃ বললেন, “সম্ভবতঃ তোমরা পরের আয়াতগুলো শোননি”। এরপর তিনি তাদের পরবর্তি আয়াতগূলো শোনালেন, যা হলো-
“তবে তারা ব্যাতিত, যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে এবং বেশী বেশী আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তাদের উপর অত্যাচার হওয়ার পর প্রতিশোধ গ্রহণ করে। যারা অত্যাচার করেছে, তারা অচিরেই জানতে পারবে তাদের গন্তব্যস্থল কেমন”।
তাই আমরা সে সকল কবি সাহিত্যকদের ভালোবাসতে পারি বা অনুসরণ করতে পারি, যারা আল্লাহ ও রাসুলের উপর ঈমান রাখে এবং রাসুলুল্লাহ সাঃ এর নির্দেশিত পথে সৎকাজ করে।
আল্লাহর কথা হলো চুড়ান্ত ও শেষ সত্য এবং আল্লাহর আয়াত অনুযায়ী আমরা যদি এমন কোন কবিকে অনুসরণ করি যে আল্লাহর নির্দেশিত পথে ঈমান আনেনি এবং সৎকাজ করেনি, তবে নিশ্চয়ই আমরা পথভ্রষ্টতার মধ্যেই আছি এবং যার পরিণতি আগুন ছাড়া আর কিছুই নয়। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন, তিনি আমাদের আলোর পথ দেখান।
৪
জাফর ইকবাল। কোন কোন গোষ্ঠী তাঁকে এমনভাবে উপস্থাপনা বা ব্যবহার করে যেন তিনি এ দেশের বিবেক। হুমায়ূন আহমেদ যেমন মাঝে মাঝে নিজেকে আস্তিক বলে জাহির করেছেন, এই লোকটি নিজেকে আস্তিক বলা তো দূরের কথা, সজ্ঞানে কোনদিন আল্লাহর নামটি কোন লেখায় লিখেছেন কিনা সন্দেহ আছে। এ জাতির দুর্ভাগ্য যে, এমন একজন মানুষ আজ আমাদের কোমলমতি অনেক শিশু কিংবা কিশোরের মন মগজ দখল করে ফেলেছেন।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এ লোকটির কালো থাবা পড়ে তা এক ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে। একটা সময় ছিলো যখন ‘ইসলামিয়াত’ নামের সাবজেক্টটিতে অন্তত কুরআনের কিছু আয়াত বা কিছু হাদীস পড়ানো হতো, যা ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় পড়ার ফলে সামান্য কিছু ইসলামী জ্ঞান আমরা হয়তো পেতে পারতাম। কিন্তু আজ ধর্ম বিবর্জিত এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যেখানে ইসলামী জ্ঞানে মুর্খ এক বিকলাঙ্গ প্রজন্ম তৈরী হতে যাচ্ছে।
এখন যেমন কোন লোক মারা গেলে তার আত্মীয়-স্বজন কোন হুজুরের কাছে গিয়ে ‘কি করতে হবে, এখন মাসয়ালা কি, কত কদম পায়ে হেঁটে লাশ কবরে রাখতে হবে’ জাতীয় অপ্রয়োজনীয় ও অথর্ব প্রশ্ন করে, আর নিজেদের দীনকে বিক্রী করে পয়সা কামানোর জন্য ওঁত পেতে থাকা এক শ্রেণীর আলেমও “এভাবে করাটাই উত্তম...” জাতীয় ধোঁয়াশাচ্ছন্ন কথা বলে আল্লাহ ও রাসুলের সাথে সম্পর্কহীন কোন মাসয়ালা প্রদান করে, ঠিক তেমনি এ শিক্ষা ব্যবস্থা এমন এক প্রজন্ম বের করে আনতে যাচ্ছে, যারা এখনকার চেয়েও অধিক জাহিলিয়াতে পরিপূর্ণ থাকবে।
ইসলামী জ্ঞানের কিছু স্তর আছে। তিন বছর বয়সী একটি বাচ্চা যেমন জানে যে আগুন হলো গরম আর বরফ হলো ঠান্ডা, তেমনি মুসলিম মাত্রেরই এ জ্ঞানটা রাখা আবশ্যক যে, কোন কাজটি আমার জন্য অপরিহার্য এবং কোন কাজটি করলে আমার জন্য জাহান্নামের আগুন নিশ্চিত। আল্লাহ যদি কোন মানুষকে কেবল এজন্যই জান্নাতে দেবেন যে তার একটি ইসলামী নাম আছে বা সে মুসলিম ঘরে জন্মেছে, তাহলে আমাদের পাশের প্রতিবেশী অমুসলিম ভাইটি তো আল্লাহর কাছে গিয়ে বলবে, “আল্লাহ, আপনিই তো আমাকে ওই ঘরে পাঠিয়েছেন, আমি তো নিজে যাইনি। শুধু কি এই জন্যই আমাকে আজ জান্নাত থেকে বঞ্চিত করে অমুককে জান্নাতে দেবেন, যে সারা জীবন আমার মতই কাটিয়েছে?” আমাদের জানা উচিৎ শ্রেষ্ঠতম বিচারক এবং ইনসাফকারী আল্লাহ কখনওই এমনটি করবেন না। আজ আমরা দুর্ভাগা এ মুসলিম জাতি জানিইনা যে শির্ক কি, কুফর বলতে কি বোঝায় বা বিদয়াত কি। আমরা হয়ত জানিই না যে আল্লাহ ওয়াদা করেছেন শির্কের অপরাধ তিনি কখনও ক্ষমা করবেন না এবং তা করলে অবধারিত জাহান্নাম। আমরা জানি না যে আল্লাহকে বাদ দিয়ে কবরের ‘অলীর” কাছে চাওয়া শির্ক, আল্লাহকে বাদ দিয়ে কোন ব্যক্তির কাছে কিছু মানত করা শির্ক কিংবা প্রতিদিন সকালে খবরের কাগজে নিজের রাশিফল দেখে তা বিশ্বাস করা শির্ক। রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন “দীনের ভেতর প্রত্যেক নতুন আবিষ্কার হলো বিদয়াত, প্রত্যেক বিদয়াত হলো পথভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক পথভ্রষ্টতার গন্তব্য হবে জাহান্নাম”। আমরা হয়ত জানি না যে, যে মিলাদের সময় আরো জোরে চিৎকার করে আমরা বেশী নেকীর আশা করছি- তা একটি বিদয়াত, মিলাদুন্নবী-আখেরী চাহা সোম্বা-শবে মিরাজ ইত্যাদি নামের যেসব দিন আমরা ভক্তি সহ পালন করে যাচ্ছি সেগুলো একেকটি বিদয়াত, মৃত ব্যক্তির খাটিয়া কাঁধে নিয়ে চল্লিশ কদম হাঁটা বা দশ কদম পর পর কাঁধ পরিবর্তন করা সবই বিদয়াত। এ কাজগুলো করলে পূণ্য বা নেকী তো দূরের কথা, নিশ্চিত পথভ্রষ্টতায় পড়ে আগুনের দিকেই যেতে হবে-যেহেতু রাসুল সাঃ তাই বলেছেন এবং তিনি কখনও মিথ্যা বললেননি।
সব মানুষই যেমন জানে আগুনে হাত দেয়া যাবে না এবং এর জন্য কাউকে ‘ফায়ার এক্সপার্ট’ হতে হয়না, তেমনি ইসলামের এই মৌলিক জ্ঞানগুলো সকল মুসলিমেরই জানা আবশ্যক ছিলো এবং এ জানাটা শুধুমাত্র আলেম সমাজের কাজ নয়। ‘ফায়ার এক্সপার্ট’ আমরা তাকে বলতে পারি যিনি জানেন কত ডিগ্রী তাপ সহ্য করার ক্ষমতা কোন বস্তুটি রাখে অথবা যিনি আগুন বিষয়ক এরকম প্রায় সকল সূক্ষ্ম জ্ঞানই রাখেন। তেমনি আলেম হচ্ছেন তিনি, যিনি হবেন ইসলামের উপর বিশেষজ্ঞ।
আজ আমাদের দুর্ভাগ্য যে আবশ্যিক ইসলামী জ্ঞান বিবর্জিত এই শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে এবং এক শ্রেণীর আলেমদের ধর্ম ব্যবসার কারণে আমাদের সন্তানেরা ইসলামী জ্ঞানে অজ্ঞ এক অথর্ব শ্রেণীতে পরিণত হচ্ছে। বন্ধুত্বের শ্লোগান তুলে আজ কৈশরে নারী-পুরুষে অবাধ মেলামেশার ভয়াবহ ব্যাপারটিকে স্বাভাবিক করে ফেলা হয়েছে। ‘ডিজুস দুনিয়ার’ নতুন প্রজন্ম আজ রাতের পর রাত নতুন নতুন মেয়ে বন্ধুর সাথে অশ্লীল আলাপে মত্ত থাকছে। ফ্লার্ট, গার্লফ্রেন্ড, ক্যারিয়ার ইত্যাদির ভীড়ে আজ তারা ভুলেই গেছে যে এ পৃথিবীতে তাদের একটি নির্দিষ্ট মিশনেই তাদের প্রতিপালক আল্লাহ পাঠিয়েছেন। আজ এদের যদি বলা হয় দশ জন ফিল্ম স্টারের নাম বলতে, এরা পারবে গড় গড় করে তা বলে দিতে। যদি বলা হয়- দশ জন ক্রিকেটারের নাম বলো, এরা তার চেয়ে দ্বিগুন বলে দিতে পারবে। অথচ এদের যদি বলা হয় রাসুলুল্লাহ সাঃ এর দশ জন সাহাবীর নাম বলো, এদের অধিকাংশই নিশ্চিত তা পারবে না। আর এভাবেই সফল হয়েছেন জাফর ইকবাল এবং তার সহচরেরা।
আমি আগেই বলে নিয়েছি আমার এ লেখাটি হলো তাদের জন্য যারা আজ নিজেদের মুসলিম বলে দাবী করছি। আমরা যদি নিজেদের তা-ই ভাবি, তাহলে আমাদের জেনে রাখতে হবে যে, ইসলাম হলো সকল জাতীয়তার উর্ধ্বে। রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, “মুমিনরা হলো একটি দেহের মতো। এর একটি অঙ্গ আঘাতপ্রাপ্ত হলে পুরো শরীর জ্বর অনুভব করে” (মুসলিম)। রসুলুল্লাহ সাঃ এর জীবনকালেই মদীনার আনসার এবং মক্কার মুহাজিরদের মধ্যে মুনাফিকদের গোপন ইন্ধনে একবার যুদ্ধংদেহী অবস্থা হয়েছিল। তিনি খবর পেয়ে এদের সবাইকে এক করে বসিয়ে এমন বক্তব্য দিয়েছিলেন যে, তাদের সবার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। সহীহ

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


