somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চোরাবালি (২০১২) : বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের সুদিনের পূর্বাভাস।

০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৩ ভোর ৫:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


চোরাবালি (২০১২) : বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের সুদিনের পূর্বাভাস।
..............আদিম পুরুষ........

রেদোয়ান রনির 'চোরাবালি' দেখলাম। আলমাসে প্রচন্ড ভিড়। এত দর্শক সর্বশেষ দেখেছিলাম 'মনপুরা'র শোতে। ডিজিটালি দেখানো হয়েছে। সুতরাং প্রিন্টের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর। প্রজেক্টরের কারণে হোক অথবা অন্য যে কারণেই হোক পিক্সেল রেজুলেশন কম মনে হয়েছে। দিনে রোদের দৃশ্যগুলোও কেমন ঘোলাটে। পুরো মুভিতেই অমন ছিল। বিষয়টাকে পিসিতে মুভি দেখার সময় স্ক্রিন কনট্রাস্ট কমিয়ে দিলে যেমন দেখায় তার সাথে তুলনা করা যায়। ভাল লাগার মধ্যে ৩৫ মি.মি ফিল্মের মত স্ক্রিন ঝির ঝির করা, লম্বা দাগ পড়া এসব মুক্ত ছিল। তখন বুঝলাম ডিজিজাল ফিল্ম বানালেই তা সিনেমা হলে দেখানোতে পুরোপুরি ''সিনেমা'' ভাবটা পাওয়া যায় না। পর্দার সাইজ এবং প্রজেকশন পয়েন্ট থেকে দূরত্বের অনুপাত হিসেব করে সেই মাপের উন্নত ডিজিটাল প্রজেকশন সিস্টেম না থাকলে কোথায় যেন শুণ্যতাটা রয়ে যায়। এখানেও তেমনই ঘটেছে। আলমাসের পর্দা ৭৫ মি.মি ফিল্মের জন্য আদর্শ। ৩৫ মি.মি ফিল্মেরই নিয়মিত প্রদর্শনী হয় এখানে। হার্ড ডিস্ক থেকে দেখানো হয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল বাসায় পিসিতে মুভি দেখছি। ৩৫ মি.মি ফিল্মের মত রঙিন, ঝলমলে রিফ্লেকশনটা নেই। কেমন ঘোলাটে, ধোঁয়াশা। সাউন্ড ডলবিতে করা। ডলবি সাউন্ড চালানোর মত সাউন্ড সিস্টেমতো এখানে নেই। হার্ডডিস্ক থেকে লাইন টেনে সনাতন সাউন্ড সিস্টেমে অ্যাড করাতে সাউন্ডের নিচু বীটগুলো অস্পষ্ট শোনাচ্ছিল। এ কারণে আইটেম গানটার সাউন্ড মাঝে মাঝে কানে নয়েজের মত বাজতেছিল।



ছবিটির প্রেক্ষাপট আর দশটি সনাতন বাংলাদেশি ছবির চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। পুরনোতে কিছু নতুন মসলা যোগ হয়েছে মাত্র। ইতিবাচক দিক এবং সবচেয়ে ব্যাতিক্রমধর্মী প্রবণতা ছিল অহেতুক গৎবাঁধা ফর্মুলাটিক রোমান্টিক গানের অনুপস্থিতি। অবহ সংগীতও ব্যতিক্রম মনে হয়েছে। প্রচলিত বাংলা ছবিগুলোর অবহ সংগীত দেখা যায় প্রায় একই। তাই কেউ টিভিতে বাংলা ছবি চললে খুব সহজেই অবহ সংগীতের কল্যাণে বুঝে নিতে পারে এটা বাংলা ছবি। এই ছবির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমটা হলো প্রতিটি দৃশ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বীট রচনা করা হয়েছে। আইটেম গানটি আইটেম গানের মতই হয়েছে। পরিচালক যে উদ্দেশ্যে গানটি ছবিতে রেখেছেন তা ষোল আনা সফল। সেট, কোরিওগ্রাফী সবই মসলাদার হিন্দি আইটেম সং ''চিকনি চামেলী (অগ্নিপথ)'' কে মনে করিয়ে দিবে।

ছবির কাহিনী প্রচলিত মূলধারার বাংলা ছবিগুলোর মতই। কিন্তু প্রচলিত গল্পের ব্যতিক্রমী উপস্থানই এখানে মুখ্য। নায়কের চেয়ে ভিলেনের গুরুত্ব এখানে বেশি। নায়িকাকেও অন্য দশটা বাংলা ছবির মত '' নায়িকা'' হিসেবে একটি অলংকারের মত রাখার চাইতে কাহিনীর প্রয়োজনে আনা হয়েছে। জয়া আহসানের অভিনয় 'গেরিলা'তে দেখেছিলাম। এখানে সেই তেজটা নেই। অনুসন্ধানী রিপোর্টারের চরিত্রে যতটুকু অভিনয় দেয়া দরকার ততটুকুই দিয়েছেন। নায়িকাসুলভ অভিব্যক্তির চেয়ে ছবিতে অভিনীত চরিত্রের পেশা সুলভ অভিব্যক্তিকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন এবং সফলও হয়েছেন। পোষাক পরিকল্পনাও তাকে চরিত্রের সাথে মিশে যেতে সহায়ক হয়েছে। নারী চরিত্র গুলোর মধ্যে ভিলেনের রক্ষিতার ভূমিকায় অভিনয় করা মেয়েটি এক কথায় দূর্দান্ত অভিনয় করেছেন। একজন সাহসী উঠতি মডেলের ভূমিকায় চরিত্রের সাথে পুরো মিশে গেছেন। ওনাকে খুব বেশি স্ক্রিনিং দেয়া হয়নি। যতক্ষণ পর্দায় ছিলেন ওনার ভূমিকার প্রতিটি দৃশ্য উপর্যুক্ত আবেগের সাথে পুরোপুরি নিঁখুতভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। নারী চরিত্র দুটোর মধ্যে অভিনয় দক্ষতা বিচারে নিরপেক্ষভাবে জয়া আহসানের চাইতে ওই মডেলের ভূমিকায় অভিনয় করা মেয়েটির পাল্লা অনেক ভারী হবে। স্থূলদেহবল্লরীর নায়িকার যুগ হয়ত শেষ হতে চলল।



পুরো ছবিটি মূলত শহীদুজ্জমান সেলিম একাই টেনে নিয়ে গেছেন। আমি বাংলা নাটক দেখিনা। তাই উনিও আমার কাছে অনেকটা অপরিচিত। উনি টেলিভিশন জগতের ভালো অভিনেতাদের একজন এটা জানতাম। এখানে ওনার অভিনয় দেখে মনে হয়নি উনি সিনেমায় অভিনয়ে নবিশ। মূলত ওনাকে কেন্দ্র করেই কাহিনী এগিয়েছে। গ্যাংস্টার লিডারদের বাইরের মুভি গুলোতে বিশেষত ভারতের হিন্দি ছবি গুলোতে বাঘা বাঘা যেসব ভিলেন দেখানো হয় তাদের চাইতে কোন অংশে কম নয়। বরং তাঁদেরকেও ছাড়িয়ে গেছেন বলতে হয়। কোন দৃশ্যে ওনাকে অপ্রস্তুতভাব অবস্থায় দেখা যায়নি। আমাদের আগামী বছরের চলচ্চিত্রে জাতীয় পুরস্কার উনি পাচ্ছেন এটা নিশ্চিত ধারণা করা যায়। সকল অভিনেতা সব সময় সমান অভিনয় দক্ষতা দেখাতে পারেননা বিভিন্ন কারণে। যখন কোন চরিত্রে নিজের দেয়ার মত সবটুকু উপাদান পান তখন সে চরিত্রে অভিনেতা সফল হন। শহীদুজ্জমান সেলিমের ক্ষেত্রেও এমন ঘটেছে।



ছবিতে নায়ক চরিত্রে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত ছিলেন। প্রথম দিকে ওনাকে সক্রিয় নায়কোচিত কোন দৃশ্যে দেখা যায়নি। গ্যাংস্টারের আশ্রিত সহযোগী হিসেবে গুপ্ত হত্যা, গুম ইত্যাদি নানাবিধ অপরাধকর্মে তাকে দেখা যায়। ফ্ল্যাশব্যাকের মত এসব খুনের দৃশ্য দেখানো হচ্ছিল কোন রকম পূর্বপ্রস্তুতি কিংবা কারণ, প্রক্ষাপট ছাড়াই। সংলাপবিহীন এসব দৃশ্যে ইন্দ্রনীলকে গ্যাংস্টারের উপযুক্ত সহযোগীর মতই মনে হচ্ছিল। ভিলেন শহীদুজ্জমান সেলিমের সাথে তার সংক্ষিপ্ত সংলাপ গুলোতে কতক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক এবং কতক ক্ষেত্রে নার্ভাসনেসের প্রকাশ স্পষ্ট ছিল। ছবির চিত্রনাট্যে ইন্দ্রনীলের চরিত্রটিতে সংলাপ আরেকটু বেশি থাকলে চরিত্র চিত্রায়নে ওনার ভূমিকাটা আরো বেশি বোঝা সহজ হত। কিছু দৃশ্যের উল্লেখ না করলেই নয়। ইন্দ্রনীলের গ্যংস্টারের সহযোগী হয়ে অপরাধ জগতে প্রবেশের কারণ হিসেবে ফ্লাশব্যাকে ওনার ছোটবেলার যেসব দৃশ্য দেখানো হয় ওই দৃশ্যগুলোর চিত্রায়নই পুরো ছবির মধ্যে সবচেয়ে ভালো হয়েছে। একটি মারের দৃশ্য ছিল। যেখানে অন্যায় মিথ্যা অভিযোগে ইন্দ্রনীলের মাকে প্রকাশ্যে গ্রামের উন্মুক্ত স্থানে শাস্তি দেয়া হচ্ছিল। হাত পা বেঁধে বেত মারার দৃশ্যে মায়ের ভূমিকার চরিত্রটির আবেগের কমতি ছিল না। কিন্তু যিনি বেত মারছিলেন বেতের আঘাত মহিলাটির গায়ে না লেগে উপর থেকে উঠে যাচ্ছিল। এই দৃশ্যটি নিখুঁত করতে পারলে পুরো ফ্ল্যাশব্যাকটি নিখুঁত হত। কিশোর ইন্দ্রনীলের ভূমিকায় যে শিশুটি অভিনয় করেছে তার অভিনয় দেখে মনে হয়নি ছবি দেখছি। এমন আবেগ, এমন অভিব্যক্তি কেবল বাস্তব ক্ষেত্রেই সম্ভব। কিশোরটি অভিনয়ে উৎরে গেছে। পুরো ছবিটির হিসেবে মূল্যায়ন করলে ইন্দ্রনীলকে দর্শক ছবি দেখতে যাওয়ার আগে যেভাবে কল্পনা করবেন তার অনেক কিছুই ছবিতে পাবেন না। কেমন নিস্প্রভ, রোবটিক ধরণের একই রকম আরোপিত অভিব্যক্তি পুরো ছবি জুড়ে।



একটি বিশেষ চরিত্রে এ.টি.এম শামসুজ্জমান ছিলেন। উনি উনার স্বভাবজাত কমেডি দিয়ে দর্শকদের বিনোদন দিয়েছেন। প্রচলিত মূলধারার কাহিনীর অনুগত হলেও কিছু কিছু সামাজিক অসংগতির কারণে সৃষ্ট সমস্যা এখানে জোরালোভাবে উঠে এসেছে। অপরাজনীতি, বিচার ব্যাবস্থা, সুবিধাবাদীদের স্বীয়স্বার্থে ধর্মের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে মানুষকে নির্যাতন, সত্য প্রকাশে মিডিয়ার ভূমিকা, দূর্নীতিবাজ পুলিশ , বিচারব্যাবস্থা অর্থাৎ সমসাময়িক ইস্যুগুলো ছবিটিতে উঠে এসেছে। একমাত্র আইটেম গানটিই যা একটু দৃষ্টিকটু। এটি উপেক্ষা করতে পারলে স্বপরিবারে হলে গিয়ে উপভোগ করার মত একটি ছবি 'চোরাবালি'। বাংলাদেশি ছবির সুদিন ফিরছে এটি তারই পূর্বাভাস।
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×