১৯৪৭ সালের শেষ দিকে মহিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন সিলেটের জুড়ী স্টেশনের স্টেশনমাষ্টার৷ দেশ বিভাগের পর সারা দেশে তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছে৷ এদেশের হিন্দুরা দলে দলে আসাম চলে যাচ্ছে৷ এমন সময়েরই এক ঘটনা৷ শাকাত বক্স নামের কুখ্যাত এক ডাকাত জুড়ী স্টেশনের কাছাকাছি এলাকায় এক হিন্দু সাধুর সবকিছু ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছিল৷ ভর দুপুরের অনেকগুলো মানুষ নির্বাকভাবে সে ঘটনাটি দেখছিল৷ কিন্তু কারোর সাহস হচ্ছিল না শাফাত বক্স ডাকাতকে কিছু বলার৷ তখন মহিউদ্দিন আহমেদের দশ বছরের ছেলে দুহাত মেলে ডাকাতটির পথ আগলে দাঁড়ায়৷ তারপর চারপাশের লোকজন এসে কুখ্যাত ডাকাতটিকে ধরে ফেলে৷
উপরে বর্ণিত ঘটনার দশ বছরের ছেলেটি, যিনি শাফাত ডাকাতের পথ আগলে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর নাম আবু তাহের৷ ভবিষ্যতের কিংবদন্তি কর্নেল তাহের৷ বহু বছর পর যিনি ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন আর মৃত্যুর মিনিটখানেক আগে নিজ হাতেই গলায় পরে নিয়েছিলেন ফাঁসির মোটা দড়ি৷ তাঁর সাহস দেখে জেলার, ডাক্তার, জল্লাদ সবাই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল৷
বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ আর মা আশরাফুন্নেছা৷ বাবার স্টেশন মাস্টারের চাকরির সুবাদে আবু তাহেরের জন্ম আসামের বদরপুরে ১৯৩৮ সালের ১৪ নভেম্বর৷ পৈতৃক নিবাস বর্তমান নেত্রকোণা জেলার পূর্বধলার কাজলা গ্রামে৷ কিন্তু গ্রামে কোনো দিন স্থায়ীভাবে থাকা হয়ে উঠেনি তাঁদের৷ বাবার বারবার বদলি তাহের ও তাঁর ভাই বোনদের বিচিত্র অভিজ্ঞতার শৈশব উপহার দিয়েছে৷ কখনো আসামের গহিন জঙ্গলে আমলকী বন খুঁজতে যাওয়া আবার কখনো ভাই বোনদের সঙ্গে দল বেঁধে শহরের অলিগলি ঘুরে বেড়িয়ে শৈশবকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি৷
১৯৫২ সাল৷ আবু তাহেরের বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ তখন চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর স্টেশনে চাকরি করেন৷ তাহেরর শিশুসুলভ সাহসিকতার সাথে তখন সবে রাজনৈতিক মাত্রা যোগ হচ্ছে৷ তখনকার একটা ঘটনা- রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলন সবে শেষ হয়েছে৷ একদিন তাহের খবর পেলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ষোলশহর স্টেশন পেরিয়ে দোহাজারী যাবেন৷ ঐদিন তাহের তাঁর কিছু বন্ধু নিয়ে একটি ঝোপের আড়াল থেকে ট্রেনে পাথর ছুঁড়ে মারেন৷ এই ঘটনা নিয়ে অবশ্য পরে মহিউদ্দিন আহমেদকে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল৷ তাঁকে হুমকি দেয়া হয়েছিল পুর্নবার এরকম ঘটনা ঘটলে তাঁর চাকরি চলে যাবে৷
এভাবেই রাজনৈতিক চেতনাগুলো পাকাপোক্ত ভাবে আসন করে নিচ্ছিল ভবিষ্যত্ কর্নেলের মস্তিস্কে৷ যা একদিন তাঁকে মানুষের মুক্তির পথ খোঁজার জন্য বিপ্লবী করে তুলেছিল৷ 'প্রবর্তক' স্কুলে পড়ার সময় তাহেরের এক শিক্ষক ছিলেন যিনি মাস্টারদা সূর্যসেনের সহযোগী৷ ঐ প্রবীণ শিক্ষকের কাছ থেকে কিশোর তাহের শুনতেন কীভাবে তাঁরা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুট করেছিলেন, কীভাবে তাঁরা ব্রিটিশবিরোধী নানা আন্দোলন করতেন৷ প্রবীণ শিক্ষক সেইসব জায়গায় তাহেরকে নিয়ে যেতেন ৷ আর তাঁকে প্রেরণা দেয়ার জন্যই হয়ত বলতেন, 'আমাদের বয়স ছিল তখন ঠিক তোমার মতো৷' ১৫-১৬ বছরের বালক তাহের বিপ্লবের কথা শুনে শিহরিত হতেন৷ কিন্তু খুব বেশি দিন তিনি সেই শিক্ষকের সঙ্গে থাকতে পারলেন না৷ কারণ আবার বাবার বদলি৷ এবার গেলেন কুমিল্লায়৷ তাহের ভর্তি হন কুমিল্লার 'ইউসুফ' স্কুলে৷ বিতর্ক, আবৃত্তি আর খেলাধুলা করে স্কুলে নিজের পরিচিতি বাড়াতে খুব বেশি সময় লাগেনি তাঁর৷ ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে তাঁর যে টুকটাক যোগাযোগ অথবা এর প্রতি যে আগ্রহ ছিল তা অটুট ছিল কুমিল্লায় এসেও৷ বরং কুমিল্লায় এসে তা আরো নতুন মাত্রা পায়৷ 'কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া' কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের তরুণ নেতা তাহের উদ্দিন ঠাকুরের সাথে তাঁর পরিচয় হয়৷ সেইসাথে কুমিল্লাতে এসে তাঁর পরিচয় হয় প্রচুর বইয়ের সঙ্গে৷ যা তাঁর সামনে উন্মোচন করে দেয় নতুন এক জগতের৷ তাহের পরিণত হতে থাকে মূলত তখন থেকেই৷
মাধ্যমিক পাশ করার পর তাহের উদ্দিন ঠাকুরের আমন্ত্রণে কুমিল্লার 'ভিক্টোরিয়া' কলেজে ভর্তি হবার ইচ্ছা ছিল তাঁর৷ কিন্তু আপত্তি করলেন বড় ভাই আরিফ৷ তাঁর ধারণা ছিল ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হলে ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগী হয়ে যাবেন তিনি৷ তাই বড় ভাইয়ের ইচ্ছায় তাঁকে ভর্তি হতে হয় সিলেটের এম.সি. কলেজে৷ দিন রাত শুধু বই পড়তেন৷ পাঠ্য বই যতটা না পড়তেন তার চেয়ে বেশি পড়তেন বাইরের বই৷ বিশেষ করে বিভিন্ন দেশের বিপ্লবের ইতিহাস বেশি পড়তেন তিনি ৷ তখন থেকেই তাঁর মধ্যে বিপ্লবী চেতনা জাগ্রত হতে থাকে৷ রুশ বিপ্লব, চীন বিপ্লব, এমনকি সাঁওতাল বিদ্রোহ, নানকর আন্দোলন এসব ইতিহাস পড়ে বিপ্লবের জন্য পরিকল্পনা করতেন৷ কিন্তু বিপ্লবের পথ খুঁজে পেতেন না৷ তাই পরিকল্পনা করলেন লেখাপড়া শেষ করে সেনাবাহিনীতে যাবেন৷ পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়ে সামরিক শিক্ষা গ্রহণ করে পাকিস্তানিদের এ দেশ থেকে বিতাড়িত করবেন৷
এম.সি. কলেজ থেকেই বি.এ. পাস করেন৷ সেনাবাহিনীতে ভর্তি হবার সুযোগের অপেক্ষায় থাকাকালীন কিছুদিন চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের দুর্গাপুর স্কুলে শিক্ষকতা করেন৷ লক্ষ্য স্থির ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন৷ কিছুদিন পর সে সুযোগ আসে৷ কিন্তু মৌখিক পরীক্ষায় সুরা মুখস্থ বলতে না পারায় সেই সুযোগ হাতছাড়া হয়৷ কিছুটা হতাশ হলেও আশাহত হন না তিনি৷ অপেক্ষায় থাকেন পরবর্তী সুযোগের জন্য৷ আর এই অবসরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে এম.এ. ভর্তি হন৷ কিন্তু এম.এ. পড়া শেষ করার পূর্বেই পুনর্বার সুযোগ পেয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি৷ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিপ্লব সংগঠিত করার চিন্তা নিয়ে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬১ সালে বালুচ রেজিমেন্টে কমিশন পান৷ প্রশিক্ষণকালীন তাঁর নিষ্ঠা অফিসারদের নজরে পড়ে৷ তাঁকে প্যারাকমান্ডো দলে সুযোগ দেওয়া হয়৷ ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে কাশ্মীর আর শিয়ালকোট সেক্টরে যুদ্ধ করেন তিনি৷ সে যুদ্ধে তিনি আহতও হন৷ একমাত্র বাঙালি অফিসার হিসাবে তাঁকে 'মেরুন প্যারাস্যুট উইং' নামক সম্মাননা প্রদান করা হয়৷
১৯৬৯ সালের ৭ আগস্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে ছুটি নিয়ে এসে তাহের বিয়ে করেন লুত্ফাকে৷ কিন্তু শুরুর দিকে একসাথে থাকা হয়নি তাঁদের৷ স্ত্রী লুত্ফা তখন ময়মনসিংহে লেখাপড়া করছিলেন৷ আর তাহেরকে কর্তব্য পালনের জন্য চট্টগ্রাম ব্যারাকে চলে যেতে হয়৷ বিয়ের কিছুদিন পর প্রথম বাঙালি আর্মি হিসেবে তিনি আমেরিকায় ট্রেনিং এর জন্য যান৷ কথা ছিল পরীক্ষা শেষ করে লুত্ফাও যাবেন আমেরিকায়৷ কিন্তু ট্রেনিংয়ের নিয়মের কড়াকড়ির জন্য যাওয়া হয়নি লুত্ফার৷ ট্রেনিং শেষে তাহের আর লুত্ফা ইংল্যান্ডে বেড়াতে যান তাহেরের ছোট বোন শেলী আর লুত্ফার বড় ভাই রাফি আহমেদের আতিথ্যে৷ তাহের ও লুত্ফা দম্পতির এক মেয়ে ও দুই ছেলে৷ মেয়ে জয়া আর দুই ছেলে যীশু আর মিশু৷ লুত্ফা তাহের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উচ্চপদে চাকুরি করে সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন৷ মেয়ে জয়া যার জন্ম ১৯৭১ সালে৷ তিনি এখন স্বামীসহ অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসী৷ বড় ছেলে আবু কায়সার যীশুর জন্ম ১৯৭৫ সালে৷ বাংলাদেশে একটা মোবাইল ফোন কোম্পানিতে চাকুরি করতেন৷ বর্তমানে তিনি কর্মসূত্রে সিঙ্গাপুর বসবাস করছেন৷ ছোট ছেলে আবু আহসান মিশু লন্ডনের ব্রাইটনে 'সাক্সেস' বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন৷ আর তাহেরের ভাই বোনরা প্রায় সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত৷
১৯৭১ সালে পূর্ববঙ্গের মানুষ যখন মুক্তির জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল কর্নেল তাহের তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে৷ চাকুরির কারণে সেইসময় ইসলামাবাদে বসবাস করছিলেন তিনি৷ ইসলামাবাদে তাহেরের বড় ভাই আরিফুর রহমানও থাকতেন৷ আর পাশের কোয়ার্টারে থাকতেন ক্যাপ্টেন পারভেজ মোশাররফ (পরবর্তীতে যিনি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন)৷ দুই পরিবারের মধ্যে একটা সখ্য গড়ে উঠেছিল৷ তখন এভাবে দিন যাচ্ছিল তাহেরের৷ তবে তাঁর রাজনীতি চর্চার অভিজ্ঞতার কারণে অনেকটা আগাম বুঝে ফেলেছিলেন যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী৷ বিপদ ঘনিয়ে যেতে পারে ভেবে ১৯৭১ সালের শুরুর দিকেই স্ত্রী লুত্ফাকে দেশে পাঠিয়ে দেন৷
তাঁর অনুমান মিথ্যে প্রমাণিত হয়নি৷ ২৫ মার্চ ১৯৭১ 'অপারেশন সার্চ লাইট' নামে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পাকবাহিনী৷ ২৬ মার্চ ভোরেই সারা দেশেই জানাজানি হয়ে যায় এই নিষ্ঠুরতার কথা৷ ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জেও খবর পৌঁছে গিয়েছিল৷ লুত্ফা তাহের ইসলামাবাদ থেকে ফিরে রাজধানীর ভয়াবহতার কথা ভেবে ঈশ্বরগঞ্জে আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ তিনি ছিলেন সন্তানসম্ভবা৷ ইসলাবাদে তাহের তাঁকে বলেছিলেন তাঁদের একটা মেয়ে হবে৷ নাম হবে জয়া৷ তাহেরের কথা যেন সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল৷ ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল যুদ্ধের দামামার মধ্যে জন্ম নেয় জয়া৷ কিছুদিন পর লুত্ফা তাহেরের কাছে ঈশ্বরঞ্জকেও নিরাপদ মনে হয়নি৷ কারণ, শোনা যাচ্ছিল পাক সেনারা ময়মনসিংহ অবধি এসে পড়েছে৷ শেষে লুত্ফা তাহের শিশু জয়াকে নিয়ে স্বামীর পৈতৃক ভিটা শ্যামগঞ্জের কাজলায় আশ্রয় নেন৷
যে দেশকে শোষণ মুক্ত করার প্রত্যয় নিয়ে একদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন সে স্বপ্ন পূরণের দারুণ সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে৷ কিন্তু তিনি নিজে আটকে আছেন শত্রুর আনুগত্যে৷ বিষয়টা ভাবতেই তাঁর অসহ্য লাগছিল৷ বাংলাদেশি অন্যান্য অফিসারদেরকে সঙ্গে নিয়ে পালানোর পরিকল্পনা করলেন তিনি কিন্তু তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ অফিসার তাঁকে নিরুত্সাহিত করলেন এবং তাঁরা অজুহাত দেখালেন যে তাহের যদি একাও পালায় তবে তাঁর জন্য সেখানকার সব বাঙালি অফিসাররা বিপদে পড়তে পারেন৷ এই যুক্তি দেখিয়ে তাঁরা তাহেরকে অনেকদিন বিরত রাখেন৷ কিন্তু তাহের ভাবছিলেন পিছনে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা৷ যেদিনগুলোতে বিপ্লবের চিন্তা মাথায় ঘুরত সব সময়৷ এখন সে বিপ্লব থেকে তাঁকে দূরে থাকতে হচ্ছে৷ বিষয়টা তাঁকে চরম হতাশায় ফেলে দিয়েছিল৷ আরো হতাশা যুক্ত হলো যখন তাহেরের পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা উপর মহলে ফাঁস হয়ে গেল৷ মেজর জেনারেল বি.এম মোস্তফা তাহেরকে ডেকে পাঠিয়ে বলল- 'পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও সরকার নিয়ে তুমি খারাপ মন্তব্য করেছো৷' আর এই অজুহাতে তাহেরকে নজরবন্দি করা হলো৷ কিন্তু তাহেরের ভেতর সার্বক্ষণিক চিন্তা পাকিস্তান থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেই হবে৷ শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন দেলোয়ার আর ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীকে সঙ্গে পান তাহের৷ তাঁদের দুজনকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে পালানোর পথ খুঁজতে শুরু করলেন তিনি৷ তাঁরা তিনজন জানতেন পালানোর সময় ধরা পড়লে নির্ঘাত মৃত্যুদন্ড৷ তবু স্বদেশের টানে তাঁরা অটুট৷
২৯ এপ্রিল বিকেলে তাহের, দেলোয়ার আর পাটোয়ারী পাকিস্তানি সেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে স্বদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন৷ কিছু খাবার আর পানীয় নিয়ে, নানা ধরনের ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে, সংশয়- সন্দেহকে দূরে ঠেলে অবশেষে তাহের তাঁর দল নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে পৌঁছান৷
দেশে পৌঁছেই তিনি প্রথমে দেখা করেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম.এ.জি ওসমানীর সঙ্গে৷ ওসমানী কর্নেল তাহেরকে সমগ্র বাংলাদেশের যুদ্ধাবস্থা নিরিখ করে তাঁকে রিপোর্ট করার দায়িত্ব দেন ৷ সেমতো কাজে নেমে যান তাহের৷ তিনি এগারোটি সেক্টরে তাঁর গবেষণা চালিয়ে দেখেন যে, বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল নিয়ে গঠিত হওয়া ১১ নম্বর সেক্টরটি যুদ্ধের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনার৷ ঠিক তখনি 'জেড ফোর্স' গঠিত হলে জিয়াউর রহমান 'জেড ফোর্সের' দায়িত্ব নিলে কর্নেল তাহের এগারো নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব চান৷ জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানীও রাজি হন তাহেরের কথায়৷ শুরু হয় কর্নেল তাহেরের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কাঙ্ক্ষিত অধ্যায়৷ জুলাই মাসে তিনি ১১ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকেন৷ কিন্তু দুর্ভাগ্য যে তিনি যুদ্ধটি শেষ করতে পারলেন না৷ কামালপুর অপারেশনের মাধ্যমে যুদ্ধের সবচেয়ে সম্ভাবনার দুয়ারটি খুলতে গিয়ে ঐ অপারেশনে তিনি মর্টার সেলের আঘাতে আহত হন৷ আহত তাহেরকে চিকিত্সার জন্য ভারতের পুনা, লক্ষ্ণৌ ইত্যাদি জায়গায় ঘুরতে হয়৷ মোটামুটি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসেন ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে৷ জেনারেল এম.এ.জি ওসমানী তখনো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান৷ যুদ্ধাহত তাহেরকে সেনাবাহিনীর শৃঙখলা বজায় রাখার বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে 'এডজোটেন্ট জেনারেল' পদ দেন৷ তাহের তাঁর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন৷ কিন্তু কিছুদিন পরই তাঁকে কুমিল্লার ৪৪ বিগ্রেডিয়ার জিয়াউর রহমানের স্থলাভিষিক্ত করা হয়৷
১৯৭২ সালের শেষের দিকে কর্নেল তাহের একটি উত্পাদনক্ষম সেনাবাহিনী গঠনের রূপরেখা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেন৷ কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাহেরের স্বপ্নের সে রূপরেখা গ্রহণ না করায় অভিমানে তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন৷ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার পর দুই বছর কর্নেল তাহেরকে বাধ্য হয়ে অনেকটা বাঁধা-ধরা জীবন যাপন করতে হয়৷ বাল্যকাল থেকেই যিনি শোষণমুক্ত সমাজের কথা ভাবতেন, নেতৃত্ব ছিল যাঁর সহজাত গুণ সে মানুষটিকে একেবারে নিষ্ক্রিয় জীবন-যাপন করতে হয়৷ সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নেয়ার দুই বছরের মধ্যে রাজনীতিতে যোগদান বা দল গঠন না করার আইনি বাধা ছিল৷ তাই ঐ দুই বছর তিনি ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক চাকুরি করেন অনেকটা জীবিকার তাগিদে, আবার অনেকটা কর্মহীনতাকে দূর করতে৷
১৯৭৪ সালে সে আইনি বাধা দূর হলে কর্নেল তাহের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল('জাসদ')-এর হয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেন৷ তাহেরের দীর্ঘ জীবন সামরিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে অতিবাহিত হলেও রাজনীতির চর্চা তাঁর ছাত্র জীবন থেকেই ছিল৷ শখের রাজনীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহারের রাজনীতি নয়৷ ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন প্রতিবাদী আর বিপ্লবী মানুষ৷ 'কমিউনিস্ট মেনিফিস্টো' তাঁর ছাত্র জীবনেই পড়া ছিল৷ সেই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তিনি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেন এবং তিনি বিপ্লবের স্বার্থে বামপন্থী মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন৷
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে নিহত হন সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল ও বিপথগামী অফিসারের ষড়যন্ত্রে ও প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে৷ ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে খালেদ মোশাররফ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে৷ খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখল করেই জিয়াউর রহমানকে বন্দি করেন৷ কর্নেল তাহের রাজনীতির চর্চা করতেন বলেই তিনি ব্যক্তিগতভাবে চাইতেন না রাষ্ট্র সামরিক যাঁতাকলে পিষ্ট হোক ৷ কারণ ইতিহাস বলে সামরিক শাসন রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না৷ তাই তিনি এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান৷ 'জাসদ' এর নেতৃত্বে কিছু সংখ্যক সিপাহীর সহযোগিতায় ১৯৭৫ এর ৭ নভেম্বর এক ঐতিহাসিক বিপ্লবের মাধ্যমে মেজর জিয়াকে মুক্ত করে আনেন তিনি৷
কর্নেল তাহের চেয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক সরকার৷ সেখানে সমাজের মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকবে না৷ কিন্তু তাঁর বিপ্লব হিতে বিপরীত হয়ে গেল৷ পাল্টা ঐ অভ্যুত্থানের পর মেজর জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর 'চিফ অফ স্টাফ' নিযুক্ত হয়ে রাষ্ট্রকে পুণরায় সামরিক জান্তার কবলে পতিত করেন৷ ২৩ নভেম্বর জিয়উর রহমান কর্নেল তাহেরকে সামরিক সরকারে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান৷ কিন্তু তাহের 'জাসদ' ছাড়া ব্যক্তিগত সুবিধা ভোগ করার পক্ষপাতি ছিলেন না বলেই জিয়াউর রহমানের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন৷
২৪ নভেম্বর ১৯৭৫৷ সামরিক সরকার তার চরিত্র অনুযায়ী কর্নেল তাহেরসহ জাসদের ৩৩ জন নেতাকে বন্দি করে৷ বলা যায় এখানে কর্নেল তাহেরের সমস্ত বিপ্লব ও জীবনের যবনিকা হয়ে যায়৷ তারপর তাঁর সমগ্র পরিবার চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে৷ পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্য রাষ্ট্রীয় ক্রোধের দ্বারা বিচলিত হন৷ ১৯৭৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত তাহেরকে কবে কোন জেলখানায় রাখা হতো তা রাষ্ট্রীয়ভাবে গোপন করা হতো
১৯৭৫ এর ২৫ নভেম্বর থেকে ১৯৭৬ সালের জুন পর্যন্ত কর্নেল তাহের-এর স্ত্রী, পুত্র, কন্যাসহ সমগ্র পরিবার চরম উত্কন্ঠায় কাটায়৷ জুন মাসের শেষের দিকে পত্রিকায় খুব ছোট করে খবর ছাপা হয়৷ রাষ্ট্রীয় এই বন্দিদের বিচারের জন্য স্পেশাল ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হবে৷ জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহেই কেন্দ্রীয় কারাগারে তারকাঁটা দিয়ে স্থান নির্দিষ্ট করে কর্নেল তাহেরসহ ৩৩ জন বন্দির বিচার শুরু হয়৷ এর মধ্যে কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলাও দেয়া হয়৷ ঐ বিচারের দিন ৬ মাস পর স্ত্রী লুত্ফার সাথে দেখা হয় কর্নেল তাহেরের৷ স্ত্রী লুত্ফা ভাবতে পারেননি যে জীবিত তাহেরের সাথে ঔটাই হবে তাঁর শেষ দেখা৷ সেই দিনটা ছিল ১৯ জুলাই৷
স্পেশাল ট্রায়ালে কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আদেশ হয়৷ তাঁর পরিবারকে অন্ধকার আর অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়ে ২১ জুলাই ভোরবেলা কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়৷ কিংবদন্তি বিপ্লবী তাহের কবিতা আবৃত্তি করতে করতে ফাঁসির মঞ্চে এগিয়ে গেলে সমাপ্তি হয় এক বিপ্লবী জীবনের৷
তথ্য :
১. 'ক্রাচের কর্নেল'- শাহাদুজ্জামান।
২. ডলি আহমেদ (কর্নেল তাহেরের ছোট বোন)। এবং
৩. লুত্ফা তাহের।