জয়ি জন্মাবার পর আজ ৯৯ তম দিন। আমার লেখাপড়ার সূত্রে প্রবাসেই ওর জন্ম। ও গর্ভে থাকার পুরোটা সময় আমার কেটেছে থিসিস এর কাজ করে। ঘন্টার পর ঘন্টা ল্যাপটপে বসে থাকার কারনে আমার খুব সুখকর অভিজ্ঞতা যেমন ছিলো না, আবার খুব ভয়ংকর অভিজ্ঞতাও নেই। আজিরা জ্ঞান দিয়ে জীবন অতিষ্ট যেমন কেউ করে নি, তেমন খুব শরীর খারাপ থাকলেও পাশে বসে থাকার সার্বক্ষণিক কেউও ছিলো না। মেরাজ ব্যস্ততার মধ্যেও খুব হাসি খুশি রাখার চেষ্টা করতো, পরিবারের বাহিরে ফোনের ওপাশে সবসময় পাশে পেয়েছি সুমি আপু, বান্ধবী শাহিমা, ওর পিচ্চি রাহমাম, প্রিমা আর বিদোরা আপুকে। বনে খুব করে খেয়াল রেখেছে অরিন আর আজিম ভাই, পিচ্চি স্মৃতি, নওশিন, আমার থিসিস সুপারভাইজর, কোর্স কোঅর্ডিনেটর, বন্ধু জোহানেস, ওর গার্লফ্রেন্ড নিকোলা এবং আরো অনেকেই। থিসিস এডিটিং এ প্রচন্ড হেল্প করেছে মায়াজ, বন্ধু সরণ আর ম্যাগী। কাউকেই খুব ধন্যবাদ দেয়া হয় নি, এই মানুষগুলোকে আমার এত আপন লাগে যে ঘটা করে ধন্যবাদ জানাতে সংকোচ লাগে।
জয়িকে আমি জন্ম দিয়েছি স্বাভাবিক পদ্ধতিতে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিকস ছাড়া কোন জটিলতা ছিলো না, আমার ডক্টর বলেছিলেন যে সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রনে রাখলে স্বাভাবিকভাবেই আমরা জয়িকে পাবো। সবকিছু ঠিকঠাক ছিলো, কিন্তু জয়ি জন্মাবার ১০ দিন আগে মেরাজ ই-বাইক থেকে বরফে পিছলে পরে শোল্ডারবোনে চিড় ধরায় নিয়ে আসে। সেটা ছিলো মন্দের ভালো, কাজ আর পড়াশোনার চাপে মেরাজকে আমি বাসাতেই পেতাম না, অসুস্থ্য হাত/ কাধ নিয়ে সে বাসায় থাকার সুযোগ পেয়েছিলো। জয়ির আসার প্রস্তুতি, রান্না করে ফ্রিজ বোঝাই করে রাখা, মেরাজের একটু আধটু টেইক কেয়ার করা এসবের মধ্যে একদিন মধ্যরাতে টের পেলাম পানি ভেঙ্গে যাচ্ছে। প্রস্তুতিকালীন কোর্সে আমাদের জানিয়েছিলো এরকম অবস্থায় করণীয় কি, এতটুকু বিচলিত বোধ করি নি। সকাল হতেই ফোন করলাম হাসপাতালে, ওরা জানালো প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে যেন চলে যাই। গেলাম, যেতে যেতে দুপুর হয়ে গেল। মজার মজার অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশে থাকতে হাসপাতালে গেলে এসে মনে হতো একটা গোসল দেই, এখানে যেয়ে মনে হলো বাসাতেই আছি, ঝাঁ চকচকে নয় একদমই কিন্তু ঝকঝক তকতক সবকিছু।
পানি তো ভেঙ্গে গেছে বেশ কয়েকঘন্টা হয়ে গেছে, কিন্তু কন্ট্রাকসন কিছুতেই ছিলো না। পরে কর্তব্যরত ডক্টর মেডিসিন সাজেস্ট করলেন। তবুও কন্ট্রাকসনের কোন খবর নেই। রুমমেটকে জিজ্ঞাসা করলাম, হাউ ইজ ইট, আই মিন দ্য কনট্রাকসন। ও যেটা বললো সেটা বাংলা করলে দাঁড়ায়, চিন্তা কইরো না, ইয়খন হবে তুমি বুঝবা। এবং কিছুক্ষণ পরেই বুঝলাম। রাতে মেরাজকে থাকতে দেবে না, করিডোরে বসার যায়গায় মেরাজ আর আমি খুনসুঁটি করছি। আমি ভাবলাম কন্ট্রাকসন যেহেতু নাই, মেরাজকে চলে যেতে বলি বাসায়, দরকার হলে চলে আসতে পারবে, মিনিট দশেকের দূরত্ব। আর ইউটিউব দেখে ম্যানুয়ালি কন্ট্রাকসন ইন্ডিউস করার কিছু এক্সারসাইজ করে ফেলি। এটা যে কাজে দেবে তখনো বুঝি নাই।
মেরাজ চলে গেছে, রুমে আমি আর রুমমেট। এবার শুরু হলো কন্ট্রাকসন। এবং খুব শর্ট ইন্টারভালে! আমার অর্জিত বিদ্যা বলে এরকম হবার কথা নয়। রুমমেট বললো নার্সকে ডাকো, ডাকলাম, সে বললো আরো কিছুক্ষণ দেখো। ততক্ষণে আমার মাথা নষ্ট অবস্থা। নার্সের কিছুক্ষণ সময় গড়িয়ে তিন ঘন্টা পেরিয়ে গেছে, রুমমেট বলতেছে তুমি চিল্লাও না ক্যান, আমি বললাম তুমি ঘুমাইতেছো তাই! ও বললো কন্ট্রাকসনে না চিৎকার করলে নার্স গুরুত্ব দেবে না। এইসব কথার মাঝখানে নার্স বললো তোমার মিডওয়াইফের সাথে দেখা করো উপরে যেয়ে। গেলাম, সে জানালো সার্ভিক্স চার সেন্টিমিটার ওপেন হয়েছে। আর কিছুক্ষন, আমি বললাম এই পেইন আর নিতে পারছি না। ও বলে কি চাও, আমি বললাম এপিডিউরাল নেব, ও বললো তুমি তোমার হাসবেন্ডকে আসতে বলো। মেরাজ আসতে আসতে আমি লেবার রুমে। এপিডিউরাল এর প্রভাবে পেইন প্রায় নাই, যেটুকু আছে সেটুকু কিছু মনে হচ্ছে না। ঘুমাচ্ছি, মেরাজের সাথে বকবক করতেছি আর জয়িকে দেখে কি বলবো ভাবতেছি।
এর মধ্যে এপিডিউরালের ডোজের প্রভাব শেষ হয়ে গেল। মিডওয়াইফ এসে বললো যে আর দেব না, তোমার সার্ভিক্স দশ সেন্টিমিটার খুলে গেছে। কংগ্রাচুলেশন্স। ওর কথা মধ্যেই পেইন টের পাচ্ছি আবারো। এবার আর চুপ করে না থেকে চিৎকার দেয়া শুরু করলাম। পেইন না কমলেও মনে হচ্ছিলো আরাম পাচ্ছি। এর মধ্যে মিডওয়াইফ বলে, তার ডিউটি শেষ, নতুন আরেকজন টেইক ওভার করবে। আমার মনে হচ্ছিলো একবার বলি যে আপা একটু পরে যান, কিন্তু ওই যে আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে! যিনি নতুন আসলেন, উনি খুবই অভিজ্ঞ এবং ফ্রেন্ডলি। আমাকে বলে গেলেন এখনই পুশ করার চেষ্টা করো না, আমি বেবির পজিশন দেখবো আগে। যেহেতু আমি অপেক্ষা করছিলাম, জয়ি বুঝতে পারছিলো না কেন, এবং ওর সাথে যেহেতু কেউ কমিউনিকেট করে নাই, ও নিজের মত করে বের হবার চেষ্টা করছিলো। ফলাফলস্বরূপ ওর মাথা ক্যানেলের আগে চলে গিয়েছিলো। মিডওয়াইফ এই অবস্থায় ডক্টর ডেকে নিয়ে আসেন, একজন সিনিয়র ও একজন জুনিয়র এসেছিলেন। মেরাজ তার ভাঙা কাধ নিয়ে কিছুক্ষণ পর পর একটু পানি খাও, একটু পানি খাও করে যাচ্ছে। জুনিয়র ডক্টর মেরাজের অবস্থা দেখে নিজে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরলেন। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, এনার্জি ফুরিয়ে যাচ্ছে, পেইন সহ্য করতে করতে রেসপন্স করার কোন অবস্থায় আমি ছিলাম না। সে অবস্থায় ওনাকে আমার মনে হচ্ছিলো সাক্ষাত দেবদূত! উনি শক্ত করে হাত ধরে বললেন, আই উইল হেল্প ইউ। একটা সময় জয়ি বার্থ ক্যানেলের শেষ প্রান্তে, আমি বোধশক্তিহীন জড় পদার্থ হয়ে গেলাম। শুনতে পারছি সবকিছু, বুঝতে পারছি কিন্তু নিজের শরীরটা নিয়ন্ত্রনে নেই। আমার একবার মনে হয়েছিলো মৃত্যুর ঠিক পরপরেই বোধ হয় আমরা এরকম কিছু এক্সপেরিয়েন্স করি। মস্তিস্ক সক্রিয় কিন্তু শরীর নয়। সম্বিতে ফিরলাম, জয়ির হার্টবিট পাচ্ছে না ডক্টর। আমাকে বারংবার বলা হচ্ছে মিসেস আফরিন মুভ ইউর পজিশন, বাচ্চার হার্টবিট পাওয়া যাচ্ছে না। সম্বিতে ফিরলেও নিজের শরীরকে ঠেলে রিলোকেট করাকে পাহাড় ঠেলার মত কষ্টকর মনে হচ্ছে। নড়তে পারছি না কিছুতেই। মেরাজকে ডক্টর বলছে প্লিজ ট্রান্সলেট, হোয়াই শি ইজ নট রেসপন্ডিং। আমি শুনতে পারছি মেরাজ বলছে, শি আন্ডারস্টান্ডস হোয়াট ইউ আর আস্কিং, দ্যাট ইজ নট দ্য প্রব্লেম। ক্যান উই ট্রাই সামথিং এলস প্লিজ!
ঠিক সেই মূহুর্তে আমি এইটুকুর জন্য শুধু এইটুকুর জন্য মেরাজ এর প্রতি জমে থাকা অনেক অনেক অভিমান ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। আমি জানতাম জয়িকে পৃথিবীতে আনতে দাবার ছক যেকোন মুহুর্তে উলটে যেতে পারে। আমি মেরাজকে বার বার বলেছিলাম যে জয়ি আগে, মেরাজ বলতো তোমরা দুই জনই সমান গুরুত্বপূর্ণ। ওরকম একটা মুহুর্তে মেরাজ যেভাবে ডক্টরকে কনভিন্স করে ফেলেছিলো যে ‘অন্য কিছু করো এবং তাড়াতাড়ি‘ তাতে আমি আরেকবার মেরাজকে কেন ভালোবাসি সেটা বুঝলাম। ডক্টর বুঝতে পেরেছিলেন এবং সাথে সাথে জয়ির মাথায় ইলেক্ট্রোড লাগিয়ে হার্টবিট পাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। আমি বোধ হয় হাঁটুতে ভর দিয়ে কারো হাত ধরে ছিলাম, একচুল নড়াচড়া করতে পারছি না। এর মধ্যে মোস্ট সিনিয়র একজন ডক্টর এসে জয়েন করলেন। আমাকে বললেন আমি হেল্প করবো, কিন্তু তোমাকেও আমাদেরকে হেল্প করতে হবে। আমরা তোমার বেবির মাথা ফিল করতে পারছি, তুমি ওকে ফিল করতে চাও? আমার মনে হচ্ছিল আমি অবসাদের সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছি, কুটোটা ধরে নিজেকে তুলবো এমন কোন শক্তিও নেই। কিছুতেই জয়িকে হেল্প না করতে পারার অপরাধবোধে আমি ডানে বায়ে মাথা নাড়াচ্ছি, যার অর্থ না। ডক্টর হেসে বললেন, নো প্রব্লেম মিসেস আফরিন, কিন্তু তোমাকে পজিশন চেইঞ্জ করতেই হবে, তাহলে আমরা তোমাকে এবং বেবিকে হেল্প করতে পারবো। এই কথায় কাজ হলো। শেষ চেষ্টার অংশ হিসেবে হোক বা এখনো অন্য জীবনে পাড়ি দেইনি সেটা নিজের কাছে প্রমাণ করতেই হোক, আমি ডক্টরের নির্দেশ পালন করতে সক্ষম হলাম। এর ঠিক এক মিনিটের মধ্যে সকাল ৭.২৭ মিনিটে জন্ম নিলো জয়ি, একটা তুলতুলে মানবশিশুকে আমি বুকের মধ্যে ধরে আছি, যে শিশুটা একান্তই আমার, সে হালকা কান্না করে থেমে গেল, ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মেরাজকে মিডওয়াইফ বলছে নাঁড়ি কাটতে, এতটুকু সময়ে আমার জীবনে অত সুখ কখনো আসেনি!
সবকিছু ছাপিয়ে সেদিন রাতে আমার এবং মেরাজের স্মৃতি থেকে দুইটা জিনিস না বললেই নয়:
এক. আমার জীবনে এতবার আমাকে মিসেস আফরিন বলে কেউ সম্বোধন করে নি। আমি মনে হয় সেদিন রাতে আমার ফার্স্ট নেম ভুলেই গিয়েছিলাম।
দুই. মেরাজ বলছে আমি পুরোটা সময় অস্বাভাবিক ভদ্র আচরন করছি, আমি নরমালি ও অত ভদ্র থাকি না!
সবাইকে মা দিবসের শুভেচ্ছা!
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০২৩ রাত ৩:১৬