আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-৩)
জান কি আমি এ পাপ-আঁখি মেলি তোমারে দেখেছি চেয়ে
গিয়েছিল মোর বিভোর বাসনা ওই মুখপানে ধেয়ে।
হাট থেকে বেড়িয়ে আসার পরদিন সকালে ঘরের সামনে মাটির বারান্দায় মোড়ার ওপর আমি বসে আছি। দুধের সস্তি দিয়ে খেজুর গুড়ের পুর ভরা গরম গরম ভাপা পিঠা আর তেলে ভাজা বাসি ভাত দিয়ে নাস্তা খাওয়া শেষ। আলেয়া এসে আমার হাত ধরে টানাটানি শুরু করলো, ‘মেজভাই, চলেন আমাদের উত্তর পাড়ার আম বাগান থেকে বেড়িয়ে আসি। গাছে কত মুকুল ধরেছে দেখবেন।’
আমি বললাম, ‘আজ থাক, আর একদিন যাবো। আজ শরীরটা ভালো লাগছে না রে। কেমন যেন ম্যাজ ম্যাজ করছে।’
আসলেই গতকাল গরুর গাড়িতে ঝাঁকুনি খেয়ে হাটে যাওয়া আসা করায় শরীরে বেশ ব্যথা হয়েছে। ব্যথা থেকে একটু জ্বর জ্বর ভাব। শহরের মানুষদের জন্য এভাবে যাতায়াত করা আসলেই খুব কষ্টকর। আমার ভাইবোনরা না গিয়ে ভালোই করেছে।
আলেয়া চট করে সবার সামনেই আমার কপালে আর বোতাম খোলা জামার ভেতরে বুকে হাত দিয়ে বললো, ‘জ্বর টর নাই। আপনার কিচ্ছু হয়নি মেজভাই। চলেন, বাগানে গেলে আপনার ভালো লাগবে। খুব সুন্দর জায়গা।’
আমি আড়চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি, তিনি এসব খেয়ালই করেননি। উঠানে চুলার পাশে চাচীদের সাথে বসে তিনি ভাপা পিঠা বানানো দেখছেন আর পান খেতে খেতে গল্প করছেন। তবে বড় চাচীমা উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। বড়ভাই আলেয়ার আবদার শুনতে পেয়ে ঘর থেকে বললেন, ‘এই পাগলি, উত্তর পাড়া গেলে ছাতা নিয়ে যাস। আজ খুব রোদ উঠেছে। হেনার কিন্তু রোদ সহ্য হয় না।’
‘ছাতা নিচ্ছি বড়ভাই।’ বলাও সারা, ঘর থেকে আলেয়ার ছাতা নিয়ে বেরোনোও সারা।
আমাদের বাড়ি থেকে গ্রামের উত্তর পাড়া যাবার সংক্ষিপ্ত পথ হলো বিলের ধানী জমি ঘেঁষে আইলের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। কাঁচা সড়ক দিয়ে গেলে অনেক দূর হয়। সরু আইলের ওপর দিয়ে হাঁটতে আলেয়া অভ্যস্ত হলেও আমি অনভ্যাসের কারণে পা টিপে টিপে এগোচ্ছি। ফলে বার বার আলেয়ার পিছে পড়ে যাচ্ছি। তার ওপর বাতাসে ছাতা সামলানো এক ঝামেলা। আমার দুরবস্থা দেখে শেষে আলেয়া আমার হাত থেকে ছাতা কেড়ে নিয়ে আমার মাথার ওপর ধরে পিছে পিছে আসতে লাগলো। ওর মুখ দেখে বুঝলাম শহরের আলু আলু স্বভাবের মানুষ নিয়ে গ্রামের এবড়ো খেবড়ো শক্ত আইলের ওপর দিয়ে হাঁটতে সে খুব মজা পাচ্ছে। বিলের জমিতে নিড়ানির কাজে ব্যস্ত ক্ষেত মজুররা সবাই সরকারের নাতনিকে চেনে। কিন্তু আমাকে কেউ চেনে না। কাজ ফেলে তারা উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিচ্ছে আমাদের। আলেয়া খুশি হয়ে তাদেরকে বলছে, ‘আমার মেজভাই। রাজশাহী থেকে এসেছে। আমাদের উত্তর পাড়ার আমবাগান দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।’
‘হাঁ, হাঁ, মা। যাও।’
ওদের একজন আরেক জনকে বলছে, ‘হামিদ ভাইয়ের ছেলে। মিলিটারিরা শহরে সব বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। দশ হাজার লোক মেরে ফেলেছে, শুনিস নি?’
আলেয়া ওদের ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে গেলেও ওদের কথাবার্তা শুনতে পেয়ে চিৎকার করে বললো, ‘না, না, দশ হাজার না, পঁচিশ হাজার। তাই না মেজভাই?’
আমি গরমে হাঁটতে হাঁটতে অস্থির। আলেয়ার কথায় সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বললাম, ‘হয়েছে, আর বক বক করিস না। এখন চল। আর কতদূর?’
‘এই তো এসেই গেছি। ওই যে তাল গাছের সারি দেখছেন না, বাঁ দিকে কয়েকটা ছনের ঘর, ওটা পার হলেই আমাদের আমবাগান।’
এসেই গেছি শুনে আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু তারপরেও আরো আধা ঘণ্টা হেঁটে অবশেষে যখন সত্যি সত্যিই আম বাগানে পৌঁছালাম, তখন রীতিমতো আমার ঘাম ছুটছে। গ্রামের মানুষের এই এক সমস্যা। তারা এসে গেছি বললেও আরো এক দেড় মাইল হাঁটতে হয়। আমি ঘেমে নেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও আলেয়া বাড়ি থেকে রওনা হবার সময় যেমন তরতাজা ছিল, তেমনই আছে। শুধু ওর নাকের ডগায় কয়েক ফোঁটা ঘাম চিক চিক করছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘হায় আল্লাহ! মেজভাই, আপনি তো শেষ! থামেন, থামেন।’
বাগান সংলগ্ন কামলা ও ক্ষেতমজুর শ্রেনির গরিব মানুষের কিছু কুঁড়েঘর থেকে ঘোমটা টানা কয়েকজন মহিলা আর বস্ত্রহীন কিছু বাচ্চা কাচ্চা বেরিয়ে এসে আমাদেরকে অবাক চোখে দেখছিল। আলেয়া ছুটে গিয়ে তাদের কিছু বলতেই মুহূর্তের মধ্যে বসার জন্য খেজুরের পাটি, কলসের ঠাণ্ডা পানি আর মাটির সানকিতে একমুঠো গুড় এসে হাজির। আমাদের সামনে এসব নামিয়ে রেখে ঘোমটা টানা মহিলারা দূরে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী চোখে আমাদের দেখতে লাগলো।
আমি একটুখানি গুড় মুখে দিয়ে ঢক ঢক করে দু’গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেয়ে ফেললাম। এতে বেশ আরাম হলো। আলেয়াকে বললাম, ‘তুই পানি খাবি না?’
বুঝতে পারছি, আলেয়া বহু কষ্টে হাসি চেপে রেখেছে। সে বললো, ‘খাচ্ছি।’ ছেলেমেয়েগুলো আমাদের দু’জনকে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল। আলেয়া পানি খেয়ে ওদের তাড়া দিতেই সবাই ছুটে পালালো।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা উঠে পড়লাম বাগান দেখতে। বাগানের সব গাছেই মুকুল এসেছে। বাতাসে হালকা মিষ্টি গন্ধ। গাছের পাতায় পাতায় মৌমাছিদের গুঞ্জন। আলেয়া একটা একটা করে গাছ দেখায় আর বলে, ‘এটা গোপালভোগ, এটা ল্যাংড়া, এটা খিরসাপাত.........।’
‘আচ্ছা আলেয়া, তোকে একটা কথা বলবো?’
আচমকা আমার প্রশ্ন শুনে থমকে গেল আলেয়া। ভয়ে ভয়ে বললো, ‘কী কথা মেজভাই?’
‘চল, কোথাও গিয়ে বসি।’
‘পাটিটা নিয়ে আসি?’
‘না, না, পাটি লাগবে না। ঘাসের ওপর বসবো, চল।’
কিছুদূর হেঁটে একটা মোটাসোটা আম গাছের আড়ালে সবুজ ঘাসের ওপর বসে পড়লাম আমরা দু’জন। ছেঁড়া প্যান্ট পরা খালি গায়ের ছয় সাত বছর বয়সের একটা মেয়ে আমাদের পিছে পিছে আসছিল। আলেয়া ওকে ধমক দিয়ে বললো, ‘এই নূরী, যা ভাগ এখান থেকে।’
মেয়েটা উল্টো পথে ছুটে পালালো। আমি বাগানের চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম কোথাও কেউ নেই। আসার সময় দেখা কুঁড়ে ঘরগুলোও চোখের আড়ালে পড়ে গেছে।
নিশ্চুপ বসে আছি আমরা দু’জন। গাছের পাতায় পাতায় উড়ে বেড়ানো মৌমাছিদের গুঞ্জন ছাড়া চারদিক নিস্তব্ধ। দূরে কোথাও ‘কুহু’ ‘কুহু’ শব্দে একটা কোকিল ডাকছে। আলেয়া আগ্রহভরে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি মাথা নিচু করে থেমে থেমে বললাম, ‘আমার সাথে তোর যে বিয়ে হবে এ কথা তুই কবে জেনেছিস?’
‘ও আল্লাহ, এই কথা?’ আলেয়া যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। বললো, ‘সে তো আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই জানি। ধুর, আমি ভেবেছি কী না কী!’
আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, ‘আমাকে তো তুই আগে সেভাবে দেখিস নি। আমি বড় হওয়ার পর এই প্রথম গ্রামে এলাম। যদি আমাকে তোর পছন্দ না হতো, তাহলেও কী তুই আমাকে বিয়ে করতে রাজী হতি?’
আলেয়া খিল খিল করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে উঠে আম গাছের চার পাশে একটা চক্কর দিয়ে এসে আবার আগের জায়গায় বসে পড়লো সে। তারপর বললো, ‘আমার আবার পছন্দ অপছন্দ কী? আপনার সঙ্গে তো আমার বিয়ে হবেই। বড়মা কথা দিয়েছে না! এখন এসব কথা থাক না মেজভাই। চলেন, বাগান দেখি।’
‘না আলেয়া। আমার কথা একটু মনোযোগ দিয়ে শোন।’
সিরিয়াস কথার মধ্যেও দুষ্টামি করার স্বভাব আছে আলেয়ার। আমার কথা শুনে সে একটু নড়ে চড়ে বসলো। তারপর দু’হাতে দুই গাল চেপে ধরে মাথাটা সামান্য বাঁকা করে দুষ্টামি ভরা চোখে সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বেশ বলেন, শহরবাবু’
‘শহরবাবু মানে?’
‘শহরে থাকেন, তাই।’
‘তুই একটা ফাজিল মেয়ে।’ আমি গম্ভীর হবার চেষ্টা করে বললাম, ‘দেখ, গ্রামের সমাজে তোর বয়সী মেয়েরা বিয়ের উপযুক্ত সেটা ঠিক আছে। কিন্তু তের চৌদ্দ বছর বয়সের একটা মেয়ে তো আসলে নাবালিকাই। আমিও তো সবে ষোলো পার হয়ে সতেরতে পড়েছি। এই বয়সে বিয়ের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ.........।’
আমার কথা শেষ না হতেই আলেয়া অধৈর্য হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে টানাটানি শুরু করলো। বললো, ‘চলেন তো মেজভাই, বাগান দেখে আসি।’
আমি বসে থাকলাম। আলেয়া আবার আমার হাত ধরে মৃদু টান দিয়ে বললো, ‘ওঠেন।’
আমি তারপরেও উঠলাম না। হাত ইশারায় ওকে বসতে বললাম আমার পাশে। ওর কী মনে হলো কে জানে, কোন আপত্তি ছাড়াই আমার গা ঘেঁষে বসে পড়লো। তারপর অনেকক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ। কারো মুখে কোন কথা নাই। গাছের ডালে মৌমাছিরা গুন গুন করছে। আমি দু’হাত হাঁটুর ওপর তুলে বসে আছি। কিভাবে কথা শুরু করবো বুঝতে পারছি না। অনেকক্ষণ পর আলেয়া ওর একটা হাত তুলে আমার হাতের ওপর রাখলো। আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। মনে হলো পুরো শরীরটা অসাড় হয়ে গেছে। আলেয়া একটু ঘুরে বসে ওর টানা টানা দুই চোখ মেলে তাকালো আমার দিকে। তার সেই কাজল কালো চোখে অসহায় দৃষ্টি। যেন প্রবল বর্ষণের আগে চোখে তার থমথমে ঘন কালো মেঘ। সে খুব করুণ কণ্ঠে বললো, ‘আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি, তাই না মেজভাই? আপনি শহরের ছেলে, আর আমি পড়ালেখা না জানা গ্রামের মেয়ে। পছন্দ না হওয়ারই কথা।’
মনে হলো, আমার বুকের মধ্যে একটা হাতুড়ির ঘা পড়লো। আমার পক্ষে আর স্থির থাকা সম্ভব হলো না। আলেয়াকে এক টানে আমার বুকের মধ্যে নিয়ে ওর পিঠে এলো মেলো হাত বুলাতে শুরু করলাম। আলেয়া দু’হাতে প্রাণপণে জাপটে ধরলো আমাকে। আমি থর থর করে কাঁপছি, আলেয়াও। দু’জনের জীবনে সম্পূর্ণ নতুন এই ঘটনায় দু’জনেই বাকরুদ্ধ।
এভাবে আমরা কতক্ষণ ছিলাম জানি না। এক সময় আলেয়া নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললো, ‘বাগান দেখবেন না মেজভাই?’
নিজেকে সামলে নিতে আমার একটু সময় লাগলো। স্বাভাবিক হবার পর আমি ফিস ফিস করে বললাম, ‘বাগান দেখার চাইতে তোকে দেখা ভালো। তুই আমার সামনে বসে থাক। আমি তোকে প্রাণ ভরে দেখি। আমার বউকে তো বাড়িতে ভালো করে দেখারই সুযোগ পাই না।’
আলেয়া বললো, ‘দেখতে মানা করেছে কে?’
‘না রে, লজ্জা লাগে।’
‘ও বাবা, এ ছেলের আবার লজ্জাও আছে!’ বলে আলেয়া হাসতে হাসতে আমার বুকের মধ্যে মুখ লুকালো। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই ফোঁপাতে লাগলো ও। আমি বললাম, ‘কাঁদছিস কেন?’
আলেয়া কোন উত্তর না দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেই থাকলো। কিছুক্ষণ কাঁদার পর শান্ত হলো সে। তারপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো চুপচাপ। আমি ওর থুঁতনিতে হাত দিয়ে মুখটা তুলে ধরে বললাম, ‘বউ হিসাবে তোকে পছন্দ হবে না এমন বোকা এই দুনিয়ায় কেউ আছে নাকি? তোকে দেখলে আমার মনে হয় যেন এইমাত্র ফোটা একটা টকটকে লাল গোলাপ দেখছি।’
কাঁচ ভাঙ্গার মতো আওয়াজ করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো আলেয়া। উঠতি বয়সের মেয়েদের এই এক ব্যাপার। এই হাসে তো এই কাঁদে। হাসি কান্নার কোন আগাম সংকেত নাই। হাঁটু সমান লম্বা চুলগুলো পাশ থেকে টেনে এনে লজ্জায় মুখ ঢেকে আলেয়া ছুটে পালালো আমার সামনে থেকে। একটু পরেই আবার ফিরে এল সে। বললো, ‘অনেক বাগান দেখা হয়েছে। এখন চলেন বাড়ি যাই। আকাশের অবস্থা ভালো না। বৃষ্টি আসতে পারে।’
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, সত্যিই একটু একটু করে কালো মেঘ জমছে পশ্চিমে। আগের দিনও বৃষ্টি হয়েছে। সোঁদা মাটির গন্ধে মাতাল এলোমেলো হাওয়ার গতি বাড়ছে। বাগানের মৌমাছিরা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির অস্থিরতা মানুষের চেয়ে ভালো বোঝে ওরা। মধু সংগ্রহে ক্ষান্ত দিয়ে নিজ নিজ মৌচাকে ওরা ফিরতে শুরু করেছে। হয়তো ওরা আমাদেরও বলতে চাইছে, ‘অনেক তো হলো, এখন বাড়ি যাও। প্রেম কাননে কাল আবার এসো।’
বাড়ি ফেরার পথে উল্টাপাল্টা বাতাসের সাথে সাথে শুরু হলো ঝমাঝম বৃষ্টি। বিস্তীর্ণ বিলের মাঠে কোন জনপ্রাণী নাই। দৃষ্টি সীমার মধ্যে নাই কোন ঘরবাড়িও। চাষিদের বহু কাংখিত বর্ষণ। রসকষহীন শুকনো মাঠে ধানের চারাগুলো প্রকৃতির দানে আরও সবুজ হবে। হাসি ফুটবে চাষিদের মুখে।
আলেয়া ছাতা ফুটিয়ে আমার মাথার ওপর ধরার চেষ্টা করলো। কিন্তু দমকা বাতাসে উল্টে গিয়ে ওর হাত থেকে ছুটে গেল সেটা। দু’জন মিলে ছুটোছুটি করে পাকড়াও করা হলো ছাতাটাকে। তবে পুরোপুরি ভিজে গেলাম আমরা দু’জনেই। মধুপুর আসার পর থেকে আমি প্যান্ট শার্ট ছেড়ে লুঙ্গি আর তিন পকেটওয়ালা জামা পরা ধরেছি। যেমন দেশ, তেমন বেশ। কিন্তু বৃষ্টিতে সপসপে ভেজা লুঙ্গিকে ঠিকমতো সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। আমার দুরবস্থা দেখে আলেয়ার সে কী আনন্দ! সে চিৎকার করে বললো, ‘মেজভাই, তোমার কোমরে লুঙ্গিতে গিঁট দাও আর লুঙ্গি হাঁটুর ওপর তুলে পরো। না হলে বেইজ্জত হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি। আমি কী সাহায্য করবো তোমাকে?’
‘যা, ভাগ্। আমার কাছে এলে থাপ্পড় খাবি। ওদিকে মুখ করে থাক, আমি লুঙ্গিটা বেঁধে নিই।’
আলেয়া কিছুক্ষণ মুখ ফিরিয়ে থাকার পর অধৈর্য হয়ে বললো, ‘হয়েছে?’
‘একটু, একটু থাম।’ অবশেষে অনেক ধ্বস্তাধস্তির পর সফল হয়ে বললাম, ‘হাঁ, এবার তাকা।’
আলেয়া মুখ ফিরিয়ে আমাকে দেখে হেসে অস্থির। আনন্দে গদ গদ হয়ে সে বললো, ‘তোমাকে দেখে জালালের মতো লাগছে।’
‘জালালটা কে?’
‘আমাদের বাড়ির রাখাল। গরু চরায়, খড় কাটে আর ফুট ফরমাস খাটে।’
আলেয়া ভীষণ খুশি। একে তো আকাশ ভাঙ্গা ঝমাঝম বৃষ্টি, তার ওপর আমাকে জালালের মতো দেখাচ্ছে। আলেয়ার জন্য আনন্দের অনেক উপকরণ। গাঁয়ের মেয়েদের কাছে বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দই আলাদা। কাদা পানি ডিঙ্গিয়ে প্রজাপতির মতো উড়তে উড়তে চললো সে। কিছুদূর যায় আর আমার জন্য থামে। আমি কর্দমাক্ত আইলের ওপর দিয়ে কোন মতে হাঁচড়ে পাঁচড়ে ওর কাছে এলে আমার হাত ধরে সাথে নিয়ে হাঁটার চেষ্টা করে। কিন্তু আমি ওর সাথে তাল মেলাতে পারি না। বার বার পিছিয়ে পড়ি। আমার এসব আনাড়িপনা দেখে আলেয়ার খুশির সীমা নাই। সে হেসে অস্থির। আমাকে মাঝে মাঝে ছেড়ে দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সামনে ছুটে যায় সে। দূর থেকে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘শহরের ভদ্দরলোকেরা গ্রামে এলে এমন শাস্তিই পেতে হয়, বুঝেছেন জনাব?’
আলেয়ার মতো দ্রুত হাঁটতে পারছি না বটে, তবে বৃষ্টিতে ভিজতে আমারও মন্দ লাগছে না। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে যখন চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, তখন আমি হাত দিয়ে চোখ মুছে সামনে আলেয়াকে খুঁজছি। কখনো সে দূরে, আবার কখনো সে কাছে। জগতের সব আনন্দ এসে যেন ভর করেছে ওর মধ্যে। পিঁপড়ের মতো ধীরে ধীরে হাঁটছি বলে কখনো সে ঠাট্টা করছে আমাকে, আবার কখনো কাছে এসে আমার হাত ধরে হাঁটতে সাহায্য করছে।
মেয়েটা এমনিতে খুব ছটফটে, তার ওপর পেয়েছে আকাশ ভাঙ্গা ঝমঝমে বৃষ্টি। ওর কাণ্ড কারখানা দেখে আমি মনে মনে খুব মজা পেলেও মুখে কিছু বলছি না। অবিরল বৃষ্টির পানি চোখ থেকে মুছে ওকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করছি। এভাবে দেখতে দেখতে আমার দুই চোখ যেন আমার অজান্তেই আটকে গেল আলেয়ার শরীরে। বৃষ্টিতে ভিজে ওর কামিজ সেঁটে গেছে শরীরের সাথে। বুকের সাথে লেপটে থাকা ওড়নার অস্তিত্ব বোঝা যায় না। আমার ষোলো সতের বছরের জীবনে নারী দেহের এই আঁকাবাঁকা ঢেউ এভাবে এর আগে আর কখনো দেখিনি। বৃষ্টিতে ভেজা কিশোরী মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে গোলাপের ফুটন্ত কুঁড়ি যেন সবে পাঁপড়ি মেলতে শুরু করেছে। নারী দেহের মধ্যে প্রকৃতি যে এত সৌন্দর্য লুকিয়ে রেখেছে, জানার সুযোগ হয়নি কোনদিন। সত্যিই চোখ ফেরানো কঠিন।
চোখের আর দোষ কী? সৌন্দর্যের সার্থকতা তো তা’ দেখার মধ্যে। বেরসিক বৃষ্টির ফোঁটা বার বার সেই অপূর্ব দৃশ্য থেকে আড়াল করে ফেলছে আমার চোখ দুটোকে। হয়তো আমাকে সাবধান করে বলছে, তুমি পুরুষ পতঙ্গ নারীর ওই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। কিন্তু পতঙ্গরা তো পুড়ে মরার জন্যই আগুনে ঝাঁপ দেয়। নারীর অগ্নিশিখায় পুড়ে দগ্ধ হবার জন্যই তো পুরুষের সৃষ্টি। প্রকৃতির এই অমোঘ বিধানকে অস্বীকার করতে পেরেছে কে?
কেউ না।
******************************************************
আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-৫)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১০:৪১