আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-৪)
কাহারে জড়াতে চাহে দুটি বাহুলতা
কাহারে কাঁদিয়া বলে, ‘যেয়োনা, যেয়োনা।’
বাড়ি ফিরে আমি কয়েক ডজন হাঁচি দিলাম। গা-মাথা মুছে শুকনা কাপড় চোপড় পরে ভাই বোনদের সাথে ভাত খেতে বসে মাথার যন্ত্রণা শুরু হলো। শিরশিরে ঠাণ্ডায় কাঁপছি দেখে বড় চাচীমা একটা চাদর এনে জড়িয়ে দিলেন আমার গায়ে। তিনি ঘন ঘন আমার কপালে হাত দিয়ে দেখতে লাগলেন আর বিড় বিড় করে বকা ঝকা করতে থাকলেন আলেয়াকে। কাপড় পাল্টে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দু’হাত পেছনে নিয়ে লম্বা ভেজা চুলগুলো গামছা দিয়ে ঝাড়ছিল আলেয়া। বড় চাচীমার বকবকানি শুনতে শুনতে সে বললো, ‘আমার কী দোষ? মেজভাইই তো বললো, চল্, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি যাই। কী মেজভাই, তুমি বলনি?’
আলেয়া আমাকে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ করে বলা শুরু করে দিয়েছে আমবাগানের সেই ঘটনার পর থেকেই। সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন একটা পর্যায় হয়তো আসে, যখন সম্বোধনগুলো এভাবেই আপনা আপনি বদলে যায়।
আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, ‘হাঁ, হাঁ, আমিই বলেছি। ওর কোন দোষ নাই।’
ভাত খেয়ে বিছানায় শোবার পর পরই আমার গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। বড় চাচীমা ট্রাঙ্ক খুলে দু’টো ভারি কাঁথা নিয়ে এসে ঢেকে দিলেন আমাকে। আলেয়ার মুখ শুকিয়ে গেল। ভাত না খেয়ে আমার খাটের পাশে মোড়া পেতে বসে রইল সে। বড়ভাই আলেয়াকে সব সময় পাগলি বলে ডাকতেন। খবর পেয়ে ঘরে ঢুকে তিনি আমার কপালে হাত দিয়ে দেখে তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন, ‘আরে, এটা কোন জ্বর হলো নাকি? কিচ্ছু হয়নি।’ তারপর আলেয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এই পাগলি, তুই ওর কাছে পিঠে থাক। আমি ছোট চাচাকে দিয়ে মনি ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ আনিয়ে দিচ্ছি। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
গ্রামের একমাত্র কোয়াক ডাক্তার মনিবাবুর বাড়ি সরকার বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে কুড়ি মিনিটের পথ। তিনি একাধারে এ্যালোপ্যাথি ও হোমিওপ্যাথি দু’রকম চিকিৎসাই করেন। কবিরাজিতেও তাঁর হাত ভালো। আধা ঘণ্টার মধ্যেই কাঁচের বোতলে সাদা কাগজ কেটে দাগ দেওয়া মনিবাবুর লাল রঙের মিকশ্চার আর কয়েকটা কালো রঙের খাবার বড়ি এসে গেল। বড় চাচীমা বাড়ির ঘানি ভাঙ্গানো শর্ষের তেলে রসুনের কোয়া থেঁতলে দিয়ে কুসুম কুসুম গরম করে এনে আমার বুকে পিঠে হাতে পায়ে ডলতে শুরু করলেন। মা এসে দেখে বড় চাচীমাকে বললেন, ‘তোর এই ছেলে ছোটবেলা থেকেই দুর্বল। রোদ বৃষ্টি কিচ্ছু সহ্য করতে পারে না। এখন তুই বাবা ঠেলা সামলা। আমি একটু দক্ষিন পাড়া যাবো। মিলিটারিরা রাজশাহীর পুলিশ লাইনে কিভাবে আগুন দিল সে ঘটনা রমজানের মায়েরা জানে না। এখন না গেলে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে। আমি গেলাম।’
মা চলে গেলেন। বড় চাচীমা আলেয়াকে ভাত খেয়ে আসার জন্য ধমক দিলেন। আমি বিছানায় উঠে বসে আলেয়াকে বললাম, ‘তুই এখনো ভাত খাসনি? যা, যা, ভাগ। ভাত খেয়ে এসে তারপরে এ ঘরে ঢুকবি। যা, বলছি।’
মুখ কাঁচু মাচু করে আলেয়া ভাত খেতে চলে গেল। বড় চাচীমা তেল ডলা বন্ধ করে আমার মাথাটা তাঁর বুকের মধ্যে নিয়ে কাঁদতে লাগলেন। আমি যতই বলি এই সামান্য সর্দি জ্বর ভালো হয়ে যাবে, বড় চাচীমার কান্না ততই বেড়ে যায়। আরো বেশি করে আমাকে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে দোয়া দরূদ পড়ে আমার গায়ে ফুঁ দিতে থাকেন।
বিকেলের দিকে জ্বর একটু কম মনে হলো। একটু ঘুম ঘুম ভাব এল চোখে। আমি ঘুমিয়ে পড়েছি ভেবে বড় চাচীমা তেল মালিশ করা বন্ধ করে পা টিপে টিপে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন বাইরে থেকে। একটু পরে ঘরের বারান্দায় চাচীদের সাথে আলেয়ার অনুচ্চ স্বরে কথাবার্তা শোনা গেল।
‘বিশ্বাস করেন চাচী, আমি মেজভাইকে নিয়ে নূরীদের বাড়ি যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মেজভাই জেদ ধরলো বৃষ্টিতে ভিজবে বলে। আমি কী করবো বলেন?’
‘তুই কেন বললি না যে বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হবে?’
‘হায় আল্লাহ! বলেছি না! কতবার বলেছি। আমার কথা শুনলে তো!’
‘ওরা শহরের ছেলে। তোদের মতো কী গাঁয়ের ভূত? রোদ বৃষ্টি কী ওদের সহ্য হয়? দাদার বাড়ি এসে ছেলেটা কী বিপদে পড়লো!’
‘হাঁ, হাঁ, চাচীমা, সে কথাও বলেছি। দাদাজান জানতে পারলে ভীষণ বকা ঝকা করবে। আমার কথা শুনলোই না।’
এরপর আর কথাবার্তা নাই। আমার ঘুম ঘুম ভাব ছুটে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে ডাক দিলাম, ‘আলেয়া।’
সে বোধহয় আমার ঘরের দরজার ওপাশেই ছিল। হুড়মুড় করে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে বললো, ‘মেজভাই, আমাকে ডাকছো?’
‘হাঁ, আমার কাছে এসে বস্।’
আলেয়া ভয়ে ভয়ে আমার খাটের পাশে রাখা মোড়ার ওপর এসে বসলো। বড় চাচীমা দরজা দিয়ে উঁকি মেরে গেলেন। মেজ ও ছোট চাচীমাও তাই করলেন। তবে তাদের কেউ একজন যাবার সময় দরজা ভেজিয়ে দিয়ে গেলেন। ঘরে তখন শুধু আমি আর আলেয়া।
‘তুই আমাকে নূরীদের বাড়ি নিয়ে যেতে চেয়েছিলি?’
আলেয়া চুপ। চেহারায় অপরাধীর ছাপ। চোরা চোখে আমাকে দেখছে সে।
‘তুই আমাকে বলেছিলি বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হবে?’
উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল আলেয়া।
‘তুই আমাকে বলেছিলি গাঁয়ের ভূতদের রোদ বৃষ্টি সহ্য হয়, শহরের ভূতদের হয় না? বলেছিলি এ কথা? বল্! চুপ করে আছিস কেন?’
আলেয়ার মাথা আরো নিচু হয়ে গেল।
‘এই, তাকা আমার দিকে।’
আমার ধমক খেয়ে মাথা তুলে করুণ চোখে তাকালো আলেয়া। আমি বললাম, ‘এ বাড়িতে থার্মোমিটার আছে?’
‘সেটা কী মেজভাই?’
‘বুঝেছি। থার্মোমিটার নাই।’
‘নাই তো কী হয়েছে? তুমি বলো না, আমি এক্ষুনি জোগাড় করে আনছি।’ উত্তেজিত আলেয়া ফিরে গেছে তার আগের ফর্মে।
আমি বললাম, ‘ওটা দিয়ে জ্বর মাপা হয়।’
‘ও, বুঝেছি। জ্বর মাপলে তাড়াতাড়ি জ্বর ভালো হয়ে যায়।’ দাঁত দিয়ে আঙ্গুল কামড়ে ধরে একটু ভাবলো আলেয়া। তারপর বললো, ‘মনি ডাক্তারের কাছে থাকতে পারে। কী নাম বললে মেজভাই?’
‘আরে বাবা, থার্মোমিটার।’
‘থারবোম নিটার, থারবোম নিটার......’ মুখস্থ করতে করতে মোড়া থেকে উঠে এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আলেয়া।
‘এই শোন্, শোন্।’ আমার কথা কানে যাবার আগেই সে বাড়ি থেকে হাওয়া।
আধা ঘণ্টার মধ্যে ঠিক জিনিসটি নিয়েই হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল সে। বুড়ো মনি ডাক্তারও ওর পিছে পিছে এলেন আরো বেশি হাঁপাতে হাঁপাতে। একটা পুরাতন সাইকেল চালিয়ে আলেয়ার পিছে পিছে ধাওয়া করতে করতে এসেছেন তিনি। সরকার বাড়িতে ঢুকে সাইকেল রেখে চেঁচামেচি করছেন তিনি, ‘এই আলেয়া, কোথায় গেলি তুই?’
আলেয়া আমার হাতে থার্মোমিটার দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, ‘এই নাও।’ তারপর দরজা দিয়ে মাথা বের করে মনি ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘কাকা, এই ঘরে আসেন।’
জানা গেল, মনি ডাক্তার একজন রুগীর জ্বর দেখছিলেন। সে সময় আলেয়া ঘরে ঢুকে ‘থারবোম নিটার’ আছে কী না জানতে চেয়ে যখন শুনেছে যে মনিবাবুর হাতের সেই বস্তুটিই ‘থারবোম নিটার’, তখন সেটা সে ছোঁ মেরে তাঁর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে দে ছুট। আমার মতো ‘এই শোন্, শোন্’ বলে চিৎকার করেও তাকে থামাতে পারেননি মনি বাবু। শেষে তিনি সাইকেলে চড়ে ওকে ধাওয়া করতে করতে সরকার বাড়িতে চলে এসেছেন।
যাহোক, বাড়িসুদ্ধ সবাই আমার ঘরে এসে হাজির। মনি ডাক্তার থার্মোমিটার দিয়ে আমার জ্বর মেপে আশ্বস্ত করলেন, জ্বর বেশি না। তার দেওয়া ওষুধগুলো যেন ঠিক মতো খাওয়া হয়। সব ঠিক হয়ে যাবে।
দাদাজান ও আব্বার সাথে আমার অসুখের ব্যাপারে দু’চারটা কথা বলে মনি ডাক্তার চলে গেলেন। আলেয়া ছাড়া আর সবাই বেরিয়ে গেল আমার ঘর থেকে। আমি আলেয়াকে বিছানায় আমার পাশে বসার ইঙ্গিত করে শুয়ে পড়লাম। মাথার যন্ত্রণাটা আবার বাড়ছে। বুকের ভেতর সাঁই সাঁই করছে। আলেয়া ভয়ে ভয়ে বিছানায় আমার পাশে এসে বসলো। আমি কিছু বলার আগেই আমার মাথা টিপতে শুরু করে দিল সে। আমার তপ্ত কপালে ওর শীতল হাতের ছোঁয়া ভালোই লাগছিল। কিন্তু জ্বর বাড়তে থাকায় স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। আমি ওর একটা হাত কাঁথার ভেতর দিয়ে টেনে আমার বুকের ওপর রেখে চেপে ধরলাম। ক্লান্ত স্বরে বললাম, ‘আমার কাছে একটু বসে থাক্।’
আলেয়ার চোখে পানি। টপ্ করে এক ফোঁটা পানি আমার কপালের ওপর পড়ে ছড়িয়ে গেল চারপাশে। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘কথায় কথায় কাঁদিস কেন? জ্বর হয়েছে, সেরে যাবে। মানুষের অসুখ বিসুখ হয় না?’
আলেয়া কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, ‘আমার জন্যেই আজ তোমার এই দশা হলো।’
আমি বললাম, ‘আচ্ছা বেশ, তোর জন্যে আমার জ্বর হলো, তোর জন্যেই আবার সেরে যাবে।’
আলেয়া বোকার মতো আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘সেটা কিভাবে?’
‘তুই আমার কাছে থাকলে আমি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবো।’
আলেয়ার মুখে কষ্টের হাসি। সে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বললো, ‘তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না মেজভাই।’
‘সত্যি যাবি না তো?’
‘আল্লাহর কসম, কোরানের কসম।’
আমি কাঁথা সরিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। তারপর আলেয়ার ডান হাতটা ধরে আমার কপালে ঠেকিয়ে বললাম, ‘এই দেখ, আমার জ্বর অর্ধেক ভালো হয়ে গেছে।’
আলেয়া আঁতকে উঠে বললো, সর্বনাশ, কী জ্বর! মা, মা, মেজভাইয়ের মাথায় পানি ঢালতে হবে। তাড়াতাড়ি এসো। বলতে বলতে আলেয়া এক ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
জ্বরের ঘোরে বড় চাচীমার মুখটা আমার কাছে ঘোলা ঘোলা লাগছে। আমার খাটের চার পাশে কারা যেন হৈ হৈ করছে। আমি কাউকে চিনতে পারছি না। আমার মাথার বালিশটা খাটের ধারে নিয়ে তার ওপর বিশাল একটা মান কচুর পাতা বিছিয়ে তাতে আমার মাথা রেখে বদনা দিয়ে পানি ঢালা হচ্ছে। আমার অনুভূতি শক্তি ভোঁতা হয়ে গেছে। শুধু এটুকু বুঝতে পারছি, আলেয়া আমার একটা হাত ধরে আছে।
****************************************************
আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-৬)