আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-৫)
এ প্রলয়-মাঝখানে--অবলা জননী প্রাণে
স্নেহ মৃত্যুজয়ী
এ স্নেহ জাগায়ে রাখে কোন্ স্নেহময়ী?
এক সপ্তাহ ধরে জ্বর সর্দি কাশিতে ভুগে আমি বেশ কাহিল হয়ে গেলাম। বুকে কফ জমে শ্বাসকষ্টের মতো হলো। বড় চাচীমা আমাদের গ্রাম থেকে এক ক্রোশ পথ দূরের এক গ্রাম থেকে একজন পীরের দেওয়া তাবিজ আর পানি পড়া নিয়ে এলেন। মনি ডাক্তারের মিকশ্চারের পাশাপাশি সেই পানি পড়া আমাকে খেতে হলো। বড় চাচীমা দোয়া দরূদ পড়ে আমার ডান হাতে তাবিজ বেঁধে দিলেন। রসুন ছেঁচে শর্ষের তেলে মেখে সেই তেল দিয়ে বুক পিঠ আর হাত পা মালিশের বিরাম নাই। সাতদিন ধরে গোসল নাই, তার ওপর সারা গায়ে রসুনের উৎকট গন্ধ। সেই গন্ধে মাঝে মাঝে আমারই নাক জ্বালা করে, অথচ আলেয়া ও বড় চাচীমার কোন সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হয়না।
একটু আরাম পেলে বারান্দায় এসে বসি। খারাপ বোধ করলে আবার ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি। ছায়াসঙ্গীর মতো আলেয়াও প্রায় সব সময় আমার সাথে। মাথা টিপে দেয়, হাতে পায়ে তেল ডলে দেয়, ওষুধ খাবার সময় হলে ওষুধ আর পানির গ্লাস হাতে সে হাজির। বারান্দায় বসলে যত্ন করে চাদর দিয়ে গা ঢেকে দেয়। ঘরে কেউ না থাকলে আমার গলা জড়িয়ে ধরে মুখের কাছে মুখ নিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘একটু কী আরাম পাচ্ছো মেজভাই?’ ‘পাচ্ছি’ বললে আলেয়ার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ‘না রে, ভালো লাগছে না’ বললে ওর মুখে নেমে আসে রাজ্যের অন্ধকার।
আমার অসুখ নিয়ে মায়ের তেমন কোন দুঃশ্চিন্তা নাই। দেখাশুনার জন্য আমার আর এক মা তো আছেই। মা তাঁর পাড়া বেড়ানো আর পান আলাপাতা খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে আমাকে দেখতে এসে কঠিন গলায় বলেন, ‘যা, বেশি করে বৃষ্টিতে ভিজগে, যা! বদমাশ ছেলে কোথাকার!’
মায়ের কথা শুনে আলেয়া কুঁকড়ে যায়। পাথরের মূর্তির মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সে।
এক সপ্তাহ পর থেকে আমার অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করলো। জ্বর চলে গেল। সর্দি কাশিও কমে গেল। কিন্তু শরীর খুব দুর্বল হয়ে গেল। বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় বসতে গেলে মাথা ঘুরে ওঠে। কষ্ট থেকে রেহাই পেয়ে আমার একটু ভালো লাগছে দেখে আলেয়ার ছটফটানি আবার নতুন করে শুরু হলো। কাঁচা মরিচ আর শর্ষের তেল দিয়ে মাখানো চাল ভাজা নিয়ে সে হাজির। বাড়ির পেছনে একটা ডালিম গাছ ছিল। সেই গাছের পাকা, আধা পাকা সব ডালিম পেড়ে নিয়ে এল সে।
শিং মাছের ঝোল দিয়ে আমার দুপুরের ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বাড়ির বাইরে কাকে যেন উচ্চ স্বরে ধমকাচ্ছে আলেয়া। যাকে ধমকানো হচ্ছে, সে যদি এক ঘণ্টার মধ্যে শিং মাছ নিয়ে না ফিরে আসে তো তার মাথা কামিয়ে তাতে চুন কালি মাখিয়ে দেওয়া দেওয়া হবে। শাস্তি অবশ্য সেখানেই শেষ না। এরপর তার গলায় গরুর দড়ি পরিয়ে গোয়াল ঘরে গরুদের সাথে বাঁশের খুঁটিতে বেঁধে রাখা হবে।
লোকটি এই ভয়ংকর শাস্তির ভয়ে মাটির হাঁড়ি ভর্তি শিং মাছ নিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যেই হাঁপাতে হাঁপাতে সরকার বাড়িতে ফিরে এল। আলেয়া ইতিমধ্যে বাড়ির চাকর বাকরদের নিয়ে ছুটাছুটি করে চালকুমড়া, কাঁচা পেঁপে, করলা ও কচুর লতি জোগাড় করে ফেলেছে। সে এখন উঠানে রান্নাঘরের সামনে কোমরে দু’হাত রেখে দাঁড়িয়ে শিং মাছের ঝোল কী দিয়ে রান্না করা হবে তা’ নিয়ে চাচীদের সাথে শলা পরামর্শে ব্যস্ত। বারান্দায় আমার সামনে কফ ফেলার জন্য একটা চিলিমচি রাখা হয়েছে। আমি খুক খুক করে কেশে চিলিমচিতে কফ ফেলে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখি, আলেয়া নেই। আমার ঘরে ঢুকে সে এখন বিছানার চাদর, বালিশের কভার, গামছা, লুঙ্গি সব বদলে দিতে ব্যস্ত। তার এখন কথা বলার সময় নেই।
বারান্দায় বসিয়ে রেখে আমার মাথা ধোয়ানো হলো। বড় চাচীমা গামছা দিয়ে আমার ভেজা মাথা যথাসম্ভব ঘষে ঘষে মুছে চুল আঁচড়ানোর জন্য একটা চিরুনী আলেয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আলেয়া চুল আঁচড়াতে গিয়ে সিঁথি উল্টা পাল্টা করে ফেললো। ঘর থেকে একটা হাত আয়না নিয়ে এসে আমার সামনে ধরে সে জিজ্ঞেস করলো, ‘ঠিক আছে মেজভাই?’
সাত দিনের জ্বরে গাল মুখ বসে গেছে। চোখের নিচে কালি। তার ওপর আবার উল্টা পাল্টা সিঁথির জন্য মাথার চুল উদ্ভট দেখাচ্ছে। নিজেকে চিনতে আমার কষ্ট হলো। তবু আলেয়াকে খুশি করার জন্য বললাম, ‘হাঁ, ঠিক আছে।’ আলেয়া মহা খুশি। বললো, ‘এখন থেকে তোমার চুল আমি আঁচড়ে দেব।’
দুপুরে খেতে বসে কী যে হলো, বড় চাচীমাকে মা বলে ডেকে ফেললাম। বললাম, ‘মা, তুমি আর আলেয়া আমার সাথেই খাও না!’
বড় চাচীমার দুই চোখ সাথে সাথে জলে ভরে গেল। আলেয়া বললো, ‘আমরা তো খেতে পারবো না মেজভাই। মা আর আমি দু’জনেই রোজা আছি।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন, রোজা কেন?’
আলেয়া বললো, ‘মা তো তোমার অসুখ হওয়ার পরদিন থেকেই রোজা করছে। আর আমি তিনটা রোজা মানত করেছিলাম। আজকেরটাই শেষ।’
বড় চাচীমা নামাজে বসে মানত করেছিলেন, যতদিন আমার অসুখ ভালো না হবে ততদিন তিনি রোজা থাকবেন। অসুখ ভালো হলে তিনি পীরের দরগায় শিরনি দেবেন। ওদের মা-মেয়ের এই রোজা থাকার কথা আমাকে কেউ বলেনি। ওদের চাল চলন ও চেহারার মধ্যে সারাদিন অনাহারে থাকার কোন লক্ষণও আমি টের পাইনি। অথবা হয়তো নিজের অসুস্থতাজনিত কষ্টের কারণে ওদের এই কষ্টের ব্যাপারটা আমি বুঝতেই পারিনি।
কিন্তু এটা শোনার পর এখন আর আমার গলা দিয়ে ভাত নামছে না। দুষ্টামি করার জন্য আমার নিজের মায়ের হাতে কতদিন মার খেয়েছি। কিন্তু কোনদিন কেঁদেছি বলে মনে পড়েনা। অথচ এখন আমার খুব কান্না পাচ্ছে। নিজেকে সামলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। ভালোবাসাও যে মানুষকে কাঁদাতে পারে, জীবনে সেদিনই প্রথম সে অভিজ্ঞতা হলো আমার। ওদের ভালোবাসা আর মমত্ববোধের কাছে হেরে গিয়ে আমার দুই চোখ ঝাপসা হয়ে এল। আমার চোখে পানি দেখে আলেয়াও নিঃশব্দে কাঁদছে। বড় চাচীমা আমার কপালে চুমু দিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বললেন, ‘তুমি অসুস্থ মানুষ, বাবা। সবে একটু সুস্থ হয়ে উঠেছ। এখন পেট ভরে না খেলে আবার অসুখ বেড়ে যাবে। আজ সাত আটদিন হলো তেমন কিছু খেতে পারোনি। আজ দু’মুঠো ভাত পেট ভরে খাও, বাবা। দেখে আমার জানটা ঠাণ্ডা হোক। সোনা মানিক আমার।’
আমি কান্না সামাল দিতে দিতে বললাম, ‘তোমরাও আমার সাথে খাও না, মা। আমার তো এখন অসুখ ভালো হয়ে গেছে। আর রোজা রাখার দরকার কী?’
‘না, বাবা। নিয়ত করা রোজা ভাঙ্গতে হয় না। আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। আমার ছেলে সুস্থ হয়েছে। আল্লাহ রহমানুর রহিম। কাল থেকে নিশ্চয় খাবো।’
আমি আর কিছুতেই খেতে পারি না। চোখের জলে মাছের ঝোলে ভাতের থালা একাকার হয়ে যায়। বুকের ভেতর থেকে দলা পাকানো কান্না উঠে আসে গলায়। আমার তিন মাসের পালক মা আমার জন্ম জন্মান্তরের মা হয়ে তাঁর অন্তরের সবটুকু দরদ ঢেলে দিয়ে আদর করছেন আমাকে। হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে বলছেন, ‘খাও বাবা, খাও।’
আলেয়া তার স্বভাব মতো উধাও হয়ে হয়ে গেছে। হয়তো কোথাও কোন আড়ালে বসে কাঁদছে। আমি নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে ভাত খাচ্ছি। বড় চাচীমা আমার পিঠে তাঁর স্নেহময় হাত বুলিয়ে আদর করছেন। এই আদরের কাছে রক্তের সম্পর্কও ফিকে হয়ে যায়। সত্যি, কী বিচিত্র এই পৃথিবী!
*********************************************************
আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-৭)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১০:৪৮