শব্দউপাসক
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
ঘুণেধরা চৌকির ক্ষয়িষ্ণু পায়ার কাছে এক চুপচাপ আরশোলা। শুঙ্গ দুটি নড়ছে। ঘড়িতে রাত বারোটা বেজে চুয়ান্ন। পেন্ডুলাম টিকটিক। ঘণ্টাধ্বনি বিকলাঙ্গ। বিগত দুটি প্রহর নিঃশব্দে কেটেছে।
ছেঁড়া পর্দা আর ভাঙ্গা কাঁচের ফাঁক দিয়ে বারোটা ছাপ্পান্ন মিনিটের হাওয়া যখন হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লো এই শয়নকক্ষে, নোংরা অন্ধকার গলির তলপেট মোচড়ানো ঘ্রাণ তার সঙ্গ দিতে ভোলেনি। ভ্যাপসা গরম আর আর্দ্রতাপুষ্ট ঘর্মগ্রন্থির সাথে নাক সিটকানো গন্ধ এখন ঘরটাতে। নিচু ছাতের কোনে মাকড়সার ঝুল। কাঠের পাটাতনে যান্ত্রিক পাখার ঘড়্ঘড়্। তিনটি ব্লেড গোনা যাচ্ছে। পাখার ঠিক নিচে ক্যাঁচ্ক্যাঁচে চৌকি। চাদর উলট-পালট। কুঁচকে আছে। তার মাঝে এক ঘুমন্ত মানুষ। আর চাদর ছাড়া এক বিক্ষিপ্ত মানুষ। এক কোনে ছোট্ট টেবিল। চেয়ার নেই। টেবিলের উপর চামড়া উঠা হাতব্যাগ আর রোদে পোড়া ঝোলা। পাশেই ছোট আলনা। তাতে ফেলে রাখা পরিধেয় বস্ত্র। ধূসর প্যান্ট। সাদা শার্ট। কালো শাড়ি। আর মেঝেতে পড়ে থাকা নীল ওড়না। চন্দ্রালোক অনুপস্থিত দোতলার এই অন্ধকার খুপড়িতে। পরিবর্তে ষ্ট্রিটল্যাম্পের চল্লিশ পাওয়ারের আলোয় দেয়ালে বসে থাকা সাদা প্রজাপতিটা চুপচাপ দেখে নিলো ধূলিময় মেঝের সস্তা মাদুরের উপর এলেমেলো ছড়ানো অন্তর্বাসগুলোর ফাঁক দিয়ে শুঙ্গ নেড়ে চলে যাওয়া এক কালচে আরশোলা।
দূরে কোথাও রেল-শব্দ। গভীর রাতের নির্জন গলি আর আর্দ্র বিছানা। রাস্তায় দুটো মাতালের গান আর পাশের ঘরগুলোর ফিসফাস। সস্তা পারফিউম উপ্চে প্রকট ঘামের গন্ধ। লেপটানো সাদা অভ্রচূর্ণ।
আগন্তুকের গরম লাগছে। চিৎ হয়ে শুয়ে সে তিনটি পাখা গুনছিলো।
এক দুই তিন। এক’টা দুই হয়ে যাচ্ছে। দুই’টা তিন।
আর ঘড়িতে রাত একটা বেজে সাত।
পাশের অবয়বটি কেঁপে উঠলো। স্যাঁতস্যাঁতে গরমে স্বপ্ন দেখছে বুঝি।
নগ্ন হাত। নিরাভরণ গ্রীবা। উন্মুক্ত পৃষ্ঠদেশ। অর্ধনগ্ন পশ্চাদদেশ। এলেমেলো চুলের ফাঁক গলে চল্লিশ পাওয়ারের আলোয় অভিক্ষিপ্ত চোখের কালশিটে আর নাগের ডগার বিন্দু ঘাম। ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেলছে। নড়ে উঠছে। অগ্রসরমান হস্ত অদৃশ্য দেয়ালে বাঁধা পেয়ে ফিরে এলো। অচেনা অবয়ব স্বপ্ন দেখুক।
স্বপ্ন।
দুই ঘণ্টা আগের মুহূর্তগুলোও আগন্তুকের কাছে এখন স্বপ্ন বটে। কিংবা দুঃস্বপ্ন। তবে এক অদ্ভুত শারীরিক পরিতৃপ্তিকে সে অস্বীকার করতে পারলো না। মাথার দপদপ ব্যথাটা আর নেই। হালকা হয়ে গেছে। বস্তুজগত স্বচ্ছ ও সহজবোধ্য। প্রগাঢ় সন্তোষসাধন। পরম পরিতুষ্টি।
কিন্তু...
না কোন কিন্তু নয়। সে শুধুই বর্তমানে আছে এখন। এখানেই থাকতে চায়। অতীতকে ফ্যানের দুইনম্বর পাখাটায় লট্কে দিয়ে ভবিতব্যগুলোকে ছুড়ে দিলো সে গলির মাতালদের স্বচ্ছন্দ স্বরযন্ত্রে। ছন্দিত স্পন্দনে ঘুরে বেড়াক ওগুলো। অনুশোচনা নেই। খচ্খচে ভাবগুলো বিভ্রম শুধু। অলীক। ঘেমে উঠা শরীর আর পাশের উষ্ণ দেহ আজ প্রকৃত বাস্তবতা। প্রত্যক্ষ বর্তমান। আত্মগ্লানি আর অপরাধবোধ আজ নির্বিবেক। অনৈতিকতাগুলো পাশের খুপড়িগুলোর শীৎকারের মতোই অকৃত্রিম।
হঠাৎ উঠে বসলো সে। চৌকির একদিকে মাথা ঝুঁকিয়ে চিবুকে হাত রেখে শান্ত চোখে চুপচাপ দেখে নিলো অন্তর্বাস আর অন্তর্বসনদের এনট্রপি। সহবাসের পরের মুহূর্ত থেকেই একা হতে ইচ্ছে হচ্ছিলো তার। কেমন গুমট শ্বাসরোধ ভাব। ছটফট অস্থিরতা, তথাপি উদগ্র দৈহিক সন্তুষ্টি। এ এক অন্তহীন উপসেবন, বুঝে গেলো সে। পুনঃপুনঃ আসক্তি। মানসিক কাঠামোগুলো নড়েচড়ে বসেছে। দেয়ালের টিকটিকিটা তাই ক্ষণে ক্ষণে এই আবদ্ধ কুঠুরীর মাঝে ঘোষণা করছে এক লুম্পেন উপসেবকের অস্তিত্ব। শব্দহীন এক শব্দউপাসক যে খুঁজে বেড়াচ্ছে ধ্বনিসমষ্টির চ্যালিস।
পাশের কুঠুরীগুলো চুপচাপ হয়ে আসছে এখন। শ্রান্তি আর ক্লান্তি। আগন্তুক উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় টেবিলের উপর রাখা জলের পাত্রটির দিকে। তেষ্টা পেয়েছে। জলসেবনের পর কাঁপা হাতে তুলে নেয় পরিচ্ছদ। ধূসর প্যান্ট। সাদা শার্ট। অন্তর্বাসগুলো। আনমনে পরিধান করে নেয় ওগুলো। মেঝেতে লুটিয়ে থাকা পাদুকায় পদাঙ্গুলি ঢুকোতে ঢুকোতেই আচমকা মাতাল ঘূর্ণিহাওয়া জাপ্টে ধরে তাকে। বদ্ধবৈরী সেই বিষাদ। দেয়ালগুলো এগিয়ে আসছে। পড়ে যায় আগন্তুক। নিয়ন্ত্রণ হারায়। ধূলিময় মেঝেতে বসে পড়ে সে। দু’এক ফোঁটা অশ্রুজলে কর্দমাক্ত গৃহতল।
ওহ্ ঈশ্বর!
ঈশ্বর কোথায়। আজ এই আবদ্ধ কামরায় জড়বস্তুর অবস্থানই কাম্য।
জীবন নিশ্চেতন। কর্মচাঞ্চল্যরহিত।
অশ্রুপূর্ণ মানসে আগন্তুকের মনে পড়ে কিছু। মনে পড়ে কে কবে তাকে বলেছিলো - তুমি পূর্ণ নও হে কবি। তোমার অপরিণত অন্তর্জ্ঞান যথেষ্ট নয়। তুমি তো সংসারত্যাগী নও। তুমি তো নিজেকে ছুড়ে দাও না বিশ্ব-বিশৃঙ্খলায়। আত্মসচেতন তুমি তাই সর্বদা রইবে সাধারণদের কাতারে। তুমি ভয় পাও তোমার মনস্কামনা। সন্ত্রস্ত তুমি চেপে রাখো তোমার কাম। তোমার অভিলাষ। তুমি ভীত। তুমি ভীরু। তুমি শব্দহীন। ভাবহীন। মহাকালের রহস্য তোমার কাছে অধরাই থাকবে।
ভাঙ্গা কাঁচের জানালা খুলে যায় হঠাৎ।
আগন্তুকের হাতের মুঠোয় কিছু সাদা পৃষ্ঠা।
পরক্ষণেই ছিঁড়ে যায় ওগুলো।
ছেঁড়া টুকরোগুলো ভাসতে থাকে ধূলোয়।
আগন্তুক বের হয়ে আসে আবদ্ধ কামরা থেকে। চুলগুলোকে বেঁধে ফেলে। চুপচাপ জড়িয়ে নেয় নীল ওড়না। সরু করিডোর দিয়ে সিঁড়ির গোড়ায় নেমে আসতেই দেখা হয়ে যায় সরল সোজা নির্ভেজাল মানবপ্রজাতির সাথে।
আফা কুন সমস্যা অয় নাই তো?
আহিলকারের দাঁত কেলানো হাসি অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গেলো কিছু কড়কড়ে নোট। অতঃপর নিস্তরঙ্গ পদযুগল নেমে এলো পূতিগন্ধময় মূত্রভেজা পথে। মহার্ঘ শূন্য ধ্বনিসমষ্টিগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে রাতের শেষভাগে নির্জন গলির নিরন্তর আঁধার পার হচ্ছে কোন এক ছদ্মবেশধারী শব্দউপাসক। নির্মেঘ হাওয়ায় তার পেলব ঠোঁট শুধু গুঞ্জরনে...
Is the day long,
O Lesbian maiden,
And the night endless
In thy lone chamber...
...but how far
Too brief will the night be,
When I returning
To the dear portal
Hear my own heart beat...
মেঘ করেছে আকাশে।
ঘনবসতিপূর্ণ কোন এক শহরের নিষিদ্ধ কোন গলিতে প্রাচীন গ্রিসের লেসবস দ্বীপের অস্পৃশ্য হাওয়ার ঊর্ধ্বমুখে নির্বাণপ্রাপ্তি। আর বৃষ্টিফোটার মতন টুপটুপিয়ে ঝরে পড়ছে অতীন্দ্রিয় শব্দসমষ্টি।
২১টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
মা
মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।
অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন
কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।
একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প
তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে
ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন
জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।
সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন