১.মানবতা
জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ)। ভারতীয়দের মুখে দিল্লী যাওয়ার পর থেকেই শুনে আসছি এর গুণকীর্তন। একজনকে বললাম নিয়ে চল দেখি তোদের পছন্দের ইউনিতে। প্রায় ১০০০ একরের উপর পাথর ও সবুজ পরিবেশে বিশাল মনোরম ক্যাম্পাস। ঢুকেই কিছুদূর গিয়ে বাম পাশে দেখি একদল ছেলেমেয়ে নাচের অনুশীলন করছে। ভারতন্যাটাম বা কত্থক নয়। এ একেবারে বলিউডি মশলা নাচ। অরগানাইজড। ডেডিকেটেড। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সিনক্রোনাইজ সেই নাচ দেখলাম। আমার বন্ধুটি জানালো প্রায় প্রতিদিন এখানে এই অনুশীলন চলে। বেশ তো!
আর একটু এগিয়ে যেতেই দেখি বেশ বড়-সড় একটি মিছিল আসছে। স্লোগানগুলো বাংলায় তরজমা করলে এমন হয়, ‘ইসরাঈল নিপাত যাক, মানবতা মুক্তি পাক’। ‘প্যালেস্টাইনের উপর আগ্রাসন বন্ধ হোক’। ‘ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব চাই’। ‘পূঁজিবাদ নিপাত যাক’। সে সময় ঈসরাইল গাজাতে হামলা চালাচ্ছিল। তারই প্রতিবাদস্বরূপ এই মিছিল।
একেবারে বাঙালী স্টাইল। তবে এখানে এই পরিবেশে প্যালেস্টাইনের মুক্তি নিয়ে চিন্তিত মানুষ দেখে বেশ অবাক হলাম। ভারতীয় বন্ধুটি জানালো এটাই জেএনইউ এর সৌন্দর্য। ভারতসহ বিশ্বের যেখানেই মানবতা ভূলন্ঠিত হোক, সেখানের জন্যই জেএনইউ এর মন পোড়ে। উদারনৈতিক ও ক্ষুধামুক্ত একটি বিশ্বের স্বপ্ন দেখে এখানকার বেশির ভাগ ছাত্র। এরাই ভারতের বহুধাবিভক্ত সমাজে লিংকারের কাজ করছে দেশ-বিদেশ ছড়িয়ে থেকে। ক্যাম্পাসের দেয়ালগুলোতে এইসব নিয়ে স্লোগান ও চিকায় ভরে আছে।
ভিতরের গল্পঃ পৃথিবীতে নিজেকে প্রথমে ‘মানুষ’ ভাবনার মানুষের সংখ্যা নিদারুনভাবে কমে গেলেও একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায় নি রে গেদু!
২.আয়নার ওপিঠ
একদিন দিল্লী জামে মসজিদের পাশে চাঁদনি চকে কয়েকজন মিলে হাঁটছি। তখন ডিসেম্বরের কলজে হিম করা ঠান্ডা। তাপমাত্রা ৩/৪ ডিগ্রির কাছে থাপড়াথাপড়ি করছে। সাথে যোগ হয়েছে হিমালয় থেকে পালিয়ে আসা কনকনে হাওয়া।
শুক্রবার। কাজ শেষে সন্ধ্যার একটু আগেই সেন্টুর হোটেল থেকে এখানে চলে এসেছি কিছু কেনাকাটা করার জন্য। রাত প্রায় আটটা বাজে। হঠাৎ দেখি একটি গলির মতো জায়গায় বিশাল একটি জটলা। লোকজনের হুড়োহুড়ি। মানে আমাদের ত্রান বিতরণ করলে যেমন লুটোপুটি হয় আর কি! ঐ লুটোপুটির আসর থেকে টমের মতো পল্টি দিয়ে যারা বের হয়ে আসছে তাদের হাতে দুটো-তিনটে করে ‘জিনিস’।
হ্যাঁ, জিনিস মানে বিয়ার, স্কচ, হুইস্কি, রাম, ব্রান্ডি, ভদকা, জিন, ওয়াইন, দেশী দারু, ফেনি, আরক সহ নানা প্রকারের, নানা আকারের, নানা রঙের, নানা ডিজাইনের বোতল। নো লাইসেন্স। নো এইজ ভ্যারিফিকেশন। চাহিবামাত্র কড়াক হাজির।
আমি একজন ভারতীয় বন্ধুর দিকে তাকালাম, রহস্য কি? উনি জানালেন কাল থেকে দুইদিন উইকেন্ডের ছুটি। এইসময় সবাই পঙ্গপালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐসব জিনিসের প্রতি। দিন দিন নাকি এটা ভীষণ বেড়ে চলেছে। পাশেই দেখলাম দাঁড়ানো একটি ট্রাক থেকে বিজয় মালিয়ার কিংফিশার ব্রান্ডের মাল আনলোড হচ্ছে।
ভীষণ চাহিদা। প্রচুর যোগান। লাগামহীন পান। অসংখ্য রেই...।
ভিতরের গল্পঃ কিছুদিন পরেই (ডিসেম্বর, ২০১২) এরকমই এক রাতে কিছু মাতালের হাতে সম্ভ্রম হারিয়ে নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হয়েছিল বোন নির্ভয়াকে। আধুনিক হতে গিয়ে কিছু লোক প্রায় ‘ক্যাপিটাল অব রেইপ’ বানিয়ে ফেলেছিল হাজার বছরের এই ঐতিহ্যবাহী শহরটাকে!
৩.বন্ধন
রমজান মাস শুরু। চিন্তা হচ্ছিল কীভাবে ইফতার সেহেরী করব এখানে? কারণ তখনও দিল্লী ততটা পরিচিত হয়ে উঠে নি। চানক্যপুরী। হোটেল লীলা প্যালেস ও নেহেরু পার্কের মাঝের কর্ণারে একটি সুন্দর জায়গাতে কিছু ফাস্টফুডের দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। লোকজনের ভালোই আনাগোনা এখানে। পাশে বিভিন্ন দেশের এমব্যাসি থাকায় বিদেশীর আনাগোনাও প্রচুর।
সেখানেই ইফতারের আগে একটি জায়গায় অস্থায়ীভাবে নামাজের জায়গা বানানো হয়েছে। পাশ দিয়ে হাঁটার ব্যস্ত রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে সেখানে থামলাম আমরা। বেশ সুশ্রী এক টুপি-দাঁড়ি-পাঞ্জাবী-পাগড়ি পরিহিত যুবক এসে আমাদের পরিচয় জানতে চাইল। দিলাম। নিমন্ত্রণ করল। তখন প্রায় ইফতারের সময় হয়ে এসেছে। সুন্দর আয়োজন ইফতারের। নানা পদের ফলমূল। লুচি-হালুয়া। এক গ্লাস লাচ্ছি। একেকদিন একেক ধরণের খাবার। ফ্রিতে খাওয়ানো হচ্ছে সবাইকে। মুসলিম-হিন্দু-ক্রিশ্চিয়ান যে কেউ বসে যেতে পারে। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকজন অবাক হয়ে দেখছে। আমাদের টিমেও নানা দেশের নানা ধর্মের লোক। খেয়ে কেউ খুশি হয়ে ওদের ফান্ডে টাকা দিলে সেটাও নেওয়া হয়। সারা রমজান মাস এভাবেই চলবে। আমরা জানালাম রমজান মাসে আমরা মাঝে মাঝে এখানেই ইফতার করতে চাই। আমরা টাকা দিতে গেলে এক মুরুব্বি এসে জড়িয়ে ধরে বললেন আপনারা আমাদের ভিনদেশী মেহমান। কিছুতেই টাকা নিলেন না।
জানালো তারাবীর নামাজও এখানে হয়। আমাদের জন্য আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। তারাবীর নামাজের পর প্রতিদিনের জন্য চিকেন/মাটন বিরিয়ানির আয়োজন। অর্থাৎ নামাজ শেষে ভরপেট খেয়ে দেয়ে চলে আস। পরে আমরা উনাদের একটি চ্যারিটি ফান্ডে কিছু টাকা পয়সা দিলেও প্রায় পুরোটা মাস আমাদের দাওয়াত দিয়ে ইফতার ও তারাবীর পর মেহমানদারী করিয়েছিল। শুধু আমরা না ওখানে আসা অন্য মুসলিম ভাইদেরও তাই। কিছু ধনী মুসলিম ব্যবসায়ী আছে ঐ এলাকায়। উনারায় নাকি এটি চালু করেছে কয়েক বছর আগে রোজাদারী মানষের কষ্টের কথা ভেবে।
ভিতরের গল্পঃ দেশ-কাল-স্থান ভিন্ন হলেও ভাতৃত্ববোধ বুঝি এমনই! সকল মত-পথের সাথেই যদি এরকমই বন্ধন হত তাহলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা কি আরো রঙিন হয়ে উঠত না!!
৪.বন্ধুত্ব
সেন্টুর হোটেল বাইরে থেকে ফিরলাম। ডিনার ৭টা থেকে ৯টা। তখন সাড়ে আটটা। ভাবলাম তাড়াতাড়ি করে হাতব্যাগটা রুমে রেখে ফ্রেশ হয়েই দৌড় দিব খাওয়ার জন্য। রুমমেট আগেই চলে এসেছে। লিফট থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে রুমের দরজার কার্ড পাঞ্চ করতে গিয়ে দেখি খোলা। হুড়মুড় করে ঢুকে ব্যাগটা বেডে ছুঁড়ে ফেলেই স্ট্যাচু হয়ে গেলাম।
রুমমেটের বেড থেকে তিন জোড়া হরিণী চোখ যুগপৎ বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাঁ করে তাকিয়ে আছি কমলা কালারের বিয়ের লেহেঙ্গা পরে থাকা রাধা ও সুন্দরী গোপীদের দিকে। এ জিনিস আমাদের রুমে আসল কি করে?
একজন হিংলিশে জানতে চাইলেন আমার পরিচয়। আমিও পালটা জানতে চাইলাম আপনারা আমাদের রুমে কি করছেন? যদিও আমার ভারতীয় রুমমেট মাঝে মাঝে ওর প্রেমিকাকে রাজস্থানের জয়পুর থেকে আনত। তখন আমি কাবাব মে হাড্ডি হয়ে লবিতে উদাস হয়ে হেমন্ত দা’র গান শুনতাম 'অলিরও কথা শুনে বকুল হাসে, কই তাহার মতো তুমি আমার কথা শুনে হাসো না তো। ধরারও ধূলিতে যে ফাগুন অাসে, কই তাহার মতো তুমি আমার কাছে কভু অাসো না তো'। । এবার একসাথে তিনজনকে দেখে একটু ভড়কেও গেলাম। দম আছে ভায়ার। সাথে আবার বিয়ের পোশাক। আমার তথৈচব অবস্থা উনারা বুঝতে পেরে প্রতিউত্তরে জানালেন রুম নাম্বার চেক করে ঢুকেছি কিনা। তাড়াতাড়ি দরজার কাছে এসে দেখি ভুল করে রুম নং ৩০২ এর জায়গায় ২০২ এ ঢুকে পড়েছি। হায় রে ক্ষুধা!!
একটা বলদামার্কা ভেটকি মাছের মতো হাসি দিয়ে ‘সরি’ বলতেই উনারা হৈ হৈ করে উঠলেন। ইতোমধ্যে রুমে আরো কিছু ছেলেমেয়ে, মহিলা এসে ঢুকল। সবাই আমার এই কাণ্ডে হেসে খুন। আমিও উনাদের দাঁত কেলানিতে অংশগ্রহন করলুম। পরে ডিনারের কথা স্মরণ হতেই উনাদের বললাম ডিনারের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। যেতে হবে। আমার এই ব্যস্ততাই উনারা আমাকে উপস্থিত দাওয়াতই দিয়ে বসলেন উনাদের সাথেই বিয়ের ডিনার তথা বিয়েতে অংশগ্রহণ করতে। ইনসিস্ট করল। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। জানালাম আমি মুসলিম। প্রতিউত্তরে প্রিটি প্রিটি গার্লের ‘কিয়া বাত হ্যায় জান, কাম অন’। এতদিন শুধু রুমের জানালা দিয়ে সুইমিংপুলের পাশে বিয়ের খানা-পিনা আর আয়োজন দেখতাম। আজকে সুযোগ হল নিজেও অংশ নেওয়ার।
এরকম বিয়ে শীতকালে প্রায় প্রতিদিন লেগেই থাকে সেন্টুর হোটেলে। সরকারী হোটেল। ডিসকাউন্ট পায় সরকারী আমলা ও নেতারা। এরপর সেইরাতে উনাদের সাথে বেশ মজা করেই পার করলুম। ডিজে পার্টিতে পাঞ্জাবী স্টাইলে কৃষ্ণ সেজে রাধাদের সাথে নাচও দিতে বাধ্য হলুম। রাত তিনটার দিকে কন্যা সম্প্রদানের লগ্ন আসল। মালাবদল হল। আকস্মিকভাবে চমৎকার কিছু মানুষের সাথে পরিচয় হয়ে গেল যা এখনো অটুট রয়েছে।
ভিতরের গল্পঃ ভারতীয়রা বিয়েতে প্রচুর খরচ করে। বিশেষ করে পাঞ্জাবী বিয়েগুলোতে বেশি। এই একটি জায়গাতে কিপ্টামুর কোনো চিহ্ন দেখতে পাই নি। এ ছাড়া প্রতিটা বিষয়ে এদের কিপ্টামু কিংবদন্তি পর্যায়ের!!
ছবি: লেখক। ইন্ডিয়া গেট। সেন্টুরের বিয়ের অায়োজনের ছবি (রুম থেকে তোলা)। জেএনইউ'র দেয়ালচিত্র।
@দিল্লী কড়চাঃ কিছু ঘটনার মুখোমুখী-৩
@দিল্লী কড়চাঃ কিছু ঘটনার মুখোমুখী-২
@দিল্লী কড়চাঃ কিছু ঘটনার মুখোমুখী-১
**********************************************************************************************
©অাখেনাটেন/২০১৮