১. ফারাক
২০১২। নেহেরু প্যালেস যাচ্ছি একটি ইলেকট্রনিক গ্যাজেট কিনতে। পাবলিক বাসে উঠেছি। সাথে এক শ্রীলংকান। দুজনেরই প্রথম দিল্লীর পাবলিক বাসে উঠা। যদিও এর আগে মেট্রো দিয়ে বেশ কয়েকবার চলাচল করেছি।
সিটে বসে আছি। ভাড়া নেওয়ার জন্য কেউ আসছে না। গন্তব্য স্থানের কাছাকাছি আসার আগে এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম ভাড়ার ব্যাপারে। উনি একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে পেছনে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।
তাকিয়ে দেখি মাঝবয়সী এক লোক একটি ঝোলা ও টিকেট কাটা মেশিন নিয়ে পেছনের দিকের সিটে মহারানা প্রতাপসিংহের মতো বসে আছে। যাত্রীরা উনার কাছে গিয়ে ভাড়া দিয়ে এসে আবার নিজের সীটে বসছে। আমিও আমাদের দুজনের ভাড়া দিয়ে আসলাম একটু বিস্ময় নিয়ে। ইউরোপ-আমেরিকা নিদেন পক্ষে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা ফার ইস্টের দেশ হলেও কথা ছিল। আমাদের পাশের বাড়িতে বিস্ময়কর সিস্টেম।
পরে ভারতীয় এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম এ ব্যাপারে। দিল্লীর পাবলিক পরিবহনে এই বাসগুলো বিভিন্ন লাইনে লাল ও সবুজ রঙয়ের এসি ও নন-এসি হিসেবে চলাচল করে। আর টিকেট মাস্টার একজন সরকারী কর্মচারী। কেউ ভাড়া না দিয়ে যায় না সাধারণত। মাঝে মাঝেই চেক হয় বাসে। টিকিট না থাকলে ২০০ রুপি জরিমানা। সুশৃঙ্খলভাবে এভাবেই শত শত বাস বিভিন্ন লাইনে যাত্রী পরিবহন করে চলেছে।
ভিতরের গল্পঃ একই রকম ব্রাউন মানুষ; একই রকম দূষিত পরিবেশ; একই রকম ভারতীয় পরিবহন। অথচ প্রিয় ঢাকা...। ভিন্নতায় পরিপূর্ণ। কী আইনে! কী শাসনে! কী প্রয়োগে!
২. নীচুতা
উপমহাদেশের অন্যতম গুণী ব্যক্তিত্ব ভারতীয় সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামের একটি সেমিনারে যোগ দিয়েছি। উনি তখনও আসেন নি। ইতোমধ্যে তেহরান থেকে আসা আমাদের সাথের একজন মেয়ে (মেয়েটি আফগানী কিন্তু থাকে ইরানে) নওরোজ উপলক্ষে মিষ্টি জাতীয় কিছু একটা এনেছে। আমাদের সকলের মাঝে বিতরণ করে সে বাইরে চলে গেল। আমার পাশে সমমনা ভারতীয় বন্ধু। মিষ্টিটি খেয়ে পানি খাওয়ার জন্য বের হতে গিয়ে শুনি আরো কিছু পরিচিত ভারতীয় আমার পাশে বসা হিন্দু বন্ধুটিকে তিরস্কার করছে। কেন সে ঐ হিজাব পরা মেয়ের হাতের মিষ্টিটি খেল? আরো কিছু বলছিল...।
পরে আমার বন্ধুটিকে বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞেস করলে উত্তরে উইলিয়াম সেক্সপিয়ারকে কোট করে বলেছিল, ‘হেল ইজ এমটি অ্যান্ড অল দ্যা ডেভিলস অ্যার হেয়ার’।
ভেতরের গল্পঃ যে ঘৃণার বিষবাষ্প আমাদেরকে প্রেতাত্মার বলয়ের মধ্যে রেখেছে তা বিদূরিত হতে আর কত শতাব্দী অপেক্ষা করতে হবে?
৩. সাদা মন
সেন্টুর হোটেল। ভারতীয় সেই বন্ধুর রুমে গেলাম। সে কানে হেডফোন লাগিয়ে ল্যাপটপে গান শুনছে। কাছে যেতেই উচ্ছ্বসিত হয়ে ‘ইয়ার, হোয়াট অ্যা সিঙ্গার’। স্ক্রিনে দেখি ঝাঁকড়া চুলের এক বয়স্ক মহিলা বসে দুলে দুলে গান গাচ্ছে। এই গানে কিসের এত উচ্ছ্বাস বুঝলাম না। মহিলাকেও জীবনে দেখেছি বা গান শুনেছি বলেও মনে হল না।
ওর মাথা থেকে হেডফোনটা টেনে নিয়ে গানের কিছু লাইন শুনে আরো অবাক হলাম। ওর দিকে তাকাতেই ‘ইয়ার, মস্ত সিঙ্গার হ্যায়’। ‘কামাল কার দিয়া’ বলে আমাকে...। আরো হাবিজাবি হিন্দিতে বলছিল। যেহেতু হিন্দি তেমন বুঝি না, তাই ওর এই লম্ফঝম্ফও আমার মনে দাগ কাটছে না। কিন্তু যে জিনিসটা আমাকে অবাক করল তা হচ্ছে সে একজন মোটামুটি প্র্যাকটিসিং হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে এই মহিলার নবী, আলী, আল্লাহ রিলেটেড গান মুগ্ধ হয়ে ধ্যান সহকারে শুনছে।
আর আমি যখন মিন মিন করে বললাম এই শিল্পীকে আমি চিনি না। সে তখন আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন পৃথিবীর সবচাইতে নাদান ব্যক্তিটি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শেষে জানলাম উনার নাম ‘আবিদা পারভীন’। আরো অবাক হলাম যখন সে জানাল উনি একজন পাকিস্তানী। এরপর ওর রুমে গেলেই সেই আবিদা পারভীনের কাওয়ালী ধাঁচের সুফি গানগুলো শুনাত। আমিও ভীষণ ভক্ত হয়ে গেলাম উপমহাদেশের এই গুণী শিল্পীর। পরে অবশ্য সরাসরি উনার গান শুনার সৌভাগ্য হয়েছে।
এরপর ও একদিন নিয়ে গেল নেহেরু পার্কে দেশী-বিদেশী ধ্রুপদী সঙ্গীত শুনাতে। সেদিনের দালের মেহেন্দির রাজন কে রাজা গানটির সুর এখনও কানে বাজছে। সেদিন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা স্ট্যান্ডিং ওভেশন দিয়েছিল গানটি শুনে।
কয়দিন আগে সেই বন্ধুটিই সুদূর সুইডেনের ক্যারোলিনস্কা ইন্সটিটিট থেকে ইমেইল করেছে। বিখ্যাত কোক স্টুডিওর একাদশ সিজনের সুফি ঘরানার গান শুনার আমন্ত্রণ জানিয়ে।
ভিতরের গল্পঃ এখনো কিছু সেইন মানুষ আমাদের চারপাশে আছে বলেই পৃথিবীটা এত সুন্দর! ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-মত-পথ ভিন্ন হলেও সহিঞ্চু ও বিশুদ্ধ মন জীবনকে আরো রঙিন করে তুলতে পারে।
ছবি: লেখক। প্রথমটি ভারতের অন্যতম বৃহৎ ও ব্যয়বহুল দিল্লীর অক্সোধাম মন্দির। দ্বিতীয়টা, দিল্লী জামে মসজিদ উঠান থেকে বিকেল বেলা তোলা।
দিল্লী কড়চাঃ কিছু ঘটনার মুখোমুখী-২
দিল্লী কড়চাঃ কিছু ঘটনার মুখোমুখী-১
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ৮:৩২