তিন পুরুষের গরুর দালালী। ছাতন ব্যাপারী নিজেও পাঁচ দশক ধরে এই ব্যবসার সাথে জড়িত। এখন বহু সম্পদের মালিক। দিনাজপুরের প্রত্যন্ত সীমান্তবর্তী গ্রামে বাস। একমাত্র ছেলে মকবুল ওরফে কবি ম্যাকবেল পাটোয়ারীর সাথে বাবা ছায়েতুন পাটোয়ারীর ওরফে ছাতন ব্যাপারীর বিরাট গণ্ডগোল চলছে। গরুর দালালী বাদ দিয়ে ছেলের মহাকবি হওয়ার লালিত স্বপ্নে ছাতন ঠান্ডা বরফ কুচি ঢেলে দিয়েছেন। সাথে ১৪৪ ধারা জারি বাড়ির আশেপাশে। শোনা কথা, এখন নাকি কবি ম্যাকবেল পাটোয়ারী আত্রাই নদীর পাড়ে টং ঘর করে এলাকার উঠতি পোলাপানদের কবি হওয়ার তালিম দিচ্ছেন। এদিকে ভাতিজা বাতাসু কাকা ছাতনের মহা ভক্ত। ব্যবসাটা ভাল বুঝে নিয়েছে সে কাকার থেকে।
সেই ভাতিজা বাতাসু বেশ কিছু দিন থেকে ছাতনকে বুঝানোর চেষ্টা করছে ঢাকা শহরটা দেখার। ছাতন ব্যাপারীর নিজেরও বহুদিনের খায়েস রূপের নগরী ঢাকা দেখার। কিন্তু খরচের কথা উঠলেই ছাতন চুপ।
তবে বাতাসু ছাতনকে বশ করেছে অবশেষে। স্থানীয় ময়ূরপক্ষী পরিবহনে করে গাবতলীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় তারা। এত বড় বাসে ছাতন এই প্রথম উঠেছে। বড় বড় সোজা ছিটগুলো দেখে ছাতনের মন ভালো হয়ে যায়। ভাবে, ঢাকাতে সব বড় বড় লোকেদের কাজ কাজবার, বাসের সিট তো বড় হবেই।
এরপরে বাসে একে একে লোক উঠতে শুরু করে। সব সিটে বসা হলে সুপারভাইজার কয়েকটা টুলও যোগাড় করে এনে মাঝের আইলে দিয়ে দেয়। ছাতন ব্যাপারী দেখে আর অবাক হয়। কী চমৎকার! কী চমৎকার! কত আয়োজন ঢাকা যাওয়ার!। বাসের ছাদে মাছের ঝুড়ি তোলা হচ্ছে। তারই কিছু আইসটা পানি জানালা গলে ব্যাপারীর কাপড়ে লেগে যায়। কী খাইস্টা গন্ধ! ছাতন নাকে রুমাল চাপা দেয়। এরপর এক লোক ভিতরে দুটো রাজহাঁস নিয়ে উঠে পেছনের দিকের টুলে বসে পড়ে। ছাতন বিস্ময়ে এসব অবলোকন করছে।
একটু পরেই আরেক লোক দুটো বৃহদাকার পাঁঠা নিয়ে বাসের পেছন দিকে চলে যায়। লোকজন হৈ হৈ করে উঠে। ছাতনের অবশ্য ভালই লাগে, পশু পাখিরাও এভাবে তাদের সাথেই ঢাকা যাচ্ছে দেখে। কারণ তার নিজের এই ব্যবসা থাকায় পশুদের প্রতি আলাদা একটি দরদ রয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু মানুষ সুপার ভাইজারকে বকাবকি শুরু করেছে, বাসের ভিতরে পাঁঠা কেন? জবাব চাই? জবাব দিতে হবে?
সুপারভাইজার গব্বর সিং স্টাইলে অট্টহেসে, ‘৪০০ কিলোমিটার রাস্তা দুইশ টাকায় যাবেন। সাথে প্রাকৃতিক আতরের ব্যবস্থা তো থাকবেই। প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকা শিখুন মশাই। আপনারা সোনার বাংলাদেশে আছেন ভুলে যাবেন না’। সুপারভাইজারের কথাটা ছাতনের বেশ পছন্দ হয়, ‘সোনার বাংলাদেশ’। বাস ছেড়ে দিয়েছে।
এদিকে পাঁঠার বেসম্ভব গন্ধ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তেই আছে। ছাতন ভাবে, হা***দা পাঁঠা মিনিমাম ছয় মাস গোসল করে নি। তার নিজেরও অনেক পাঁঠা আছে। কিন্তু এরকম খাইস্টা গন্ধ নয়।
একলোক চিৎকার করে বলছে, পাঁঠার মা*রে বাপ। গন্ধে নেশা ধরে গেল যে বড়! গাঁজা খেলেও এত নেশা হত না। দেখা যাচ্ছে, তীব্র সুবাসে(?) কিছু লোক রানীক্ষেতে আক্রান্ত মুরগীর মতো ঝিমাচ্ছে।
এভাবেই পান্তা বেলা পার হয়ে ছাতনেরা গাবতলী পৌঁছে যায়।
২
গাবতলী বাস থেকে নেমে প্রথমে মিরপুরে চিড়িয়াখানা দেখতে যাবে তারা। ছাতন গবাদিপশুর দালালী করলেও কখনও সরাসরি বাঘ দেখে নি। ছাতনের একসময় সখ ছিল একটি বাঘ পোষার। অবশ্য এখন আর সে হাউশ নেই। তার কারণও আছে। একবার এলাকায় ধরা পড়া একটি বনগাবড়া(মেছোবাঘ) কিছুদিনের জন্য লালন-পালন করেছিল। কিন্তু একদিন, ছাতনের ভাষ্যমতে, হালার পো টসটসা দুটা বুড়ানি মুরগী সাবাড় করে পালিয়ে যায়। এরপর অবশ্য বাঘ পোষার চিন্তা মাথায় আসে নি। তবে দেখার খিদেটা আছে।
দ্বিপ্রহরের কিছু আগে দুজনে চিড়িয়াখানার গেটের সামনে হাজির হয়। সেখানে হাজির হওয়া মাত্র রকেট গতিতে কমপক্ষে বিশজন লোক তাদের টানাটানি শুরু করে। কেউ লুঙ্গি ধরে টানে, কেউবা পাঞ্জাবী। লুঙ্গি টেনে খোলার উপক্রম। ছাতন খালি বলে, কী তাজ্জব! কী তাজ্জব! তাদের উদ্দেশ্য সস্তায়(!) কিছু খেয়ে দেয়ে যেন চিড়িয়াখানায় প্রবেশ করে। রীতিমতো প্রায় কোলে করে হোটেলে নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। ছাতনের ব্যাপারটা মনে ধরে। বাড়ি থেকে বুড়ির কিছু বেঁধে দেওয়া শুকনো খাবার বাসের মধ্যে খেয়েছে। ক্ষুধাও বেশ লেগেছে। ওয়েটাররা তাদের বেশ আদর যত্ন করে খাওয়ায়। ছাতন ভাবে, ঢাকার মানুষগুলো কত্ত আন্তরিক ও ভালো। আর এলাকার হোটেলের বয়-বেয়ারাগুলো তো এক একটা হাড়ে হা**জাদা। শনিবারে খাবার অর্ডার দিলে রবিবারে টেবিলে দিয়ে যায়। আর এখানে কত তড়িৎগতি।
খাওয়া-দাওয়া শেষে বিলের কাগজ দিয়ে যায় বেয়ারা। একটু পরে দেখা যায় দুজন বেয়ারা ও ভাতিজা বাতাসু ছাতনকে আবার প্রায় কোলে করে হোটেলের বাইরে নিয়ে আসছে। আর ছাতন তড়পা-তড়পি করছে আর চিৎকার করে বলছে, ‘ওরে বাতাসু, এত যত্ন-আদর মুই ক্যান আগে বুজা পানু না। বান্দির পুতরা তো মোক শ্যাষ করে দিলো। চলেক, গাওত চলে যাই, বাতাসু’।
যাহোক, খাওয়ার শোক সামলে তারা চিড়িয়াখানায় প্রবেশ করে। বাঘ-টাঘ দেখে সেখান থেকে বের হয়ে মিরপুর-১০ আসে।
মিরপুর দশে ডাবল ডেকার বাসে বসে আছে। গন্তব্য মহাখালী। একসাথে চার-পাঁচজন ইষ্টিকুটুম সাইয়া সাইয়া হাত তালি দিতে দিতে কোমর দুলায়ে বাসে উঠে।
ছাতন ব্যাপারী ভাবে, কী সুন্দর! কী সুন্দর! মেয়েগুলো সেজেগুঁজে নাচতে নাচতে বাসে উঠছে। ব্যাপারী মুগ্ধ হয়। মুগ্ধ হয় আর ভাবে ঢাকা শহরে বুঝি সব সুন্দরীরাই এভাবে নাচতে নাচতে বাসে উঠে। কী ভালো! কী ভালো!
একটু পরে ছাতনের কাছে এসে একজন তার গাল টিপে দিতে দিতে বলে, বুড়ো সোনাজাদুর গালটা কী নরম! কী নরম!। একজন ফিসফিস করে বলে, তা জাদু সোনার ‘ও’টাও কি নরম নাকি শক্ত? ছাতন ভাবে, কী লজ্জা! কী লজ্জা! শরমে কিছু বলতে পারে না। ভাবে, ঢাকা শহরের মেয়েগুলো একটু বেশিই দুষ্টু। কী দুষ্টু! কী দুষ্টু! একজন ছাতনের কাছে টাকা চেয়ে বসে। ছাতন সানন্দে টাকা দিতে চাইলে দুষ্টুটি ওয়ালেটটি নিয়ে নেয়। সেখান থেকে বড়সড় দুটো নোট নিয়ে নিলে ছাতনের মনটা খারাপ হয়ে যায়। ভাবে, মেয়েগুলো কী খারাপ! কী খারাপ!
ছাতনরা মহাখালী নেমে একটি নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ দড়াম শব্দে ভীষণ আওয়াজ। ছাতন ও ভাতিজা বাতাসু ফুটপাত থেকে ঝাঁপ দিয়ে রাস্তায় নেমে খিঁচে দৌড় লাগায়। সাথে চিল্লাচিল্লি। কেউ বলছে বোমা মারছে।
আসলে ঐ নির্মাণ চলাকালীন ভবনের উপর থেকে একটি ইট ভবনের চারপাশে দেওয়া টিনের ছাউনির উপর পড়েছে। নিচেই ছিল ছাতনরা। মাথার উপরে টিনে ইট পড়ায় বোমার মতো আওয়াজ হতেই ছাতনদের জান-প্রাণ যায় যায়। ছাতন ভাতিজাকে বলে, ‘এ কুন শহরত আসনু, বাতাসু’।
৩
ছাতনের মহাখালী হয়ে বনানীতে যাওয়ার কথা। সেখানে সে এরশাদ কাকার বাড়িটা দেখতে চায়। বলে রাখা ভালো, ছাতন হুমু এরশাদের একনিষ্ঠ ভক্ত। কারণ হিসেবে গোপন সূত্রে জানা যায়, ঐ বয়সেও ‘চাচা’ কীভাবে ভ্রমর হয়ে টপাক করে মধুর বোতল হাতড়া হাতড়ি করত সেটা ছাতনকে আকৃষ্ট করে। ছাতন ভাবে, ভাইজান একজন কামেল আদমী মাইরি? ছাতন এমন বীর্যবান পুরুষের ভক্ত হবে নাতো…? কিন্তু মহাখালীর এই ঝামেলা সাথে সময়ের অভাবে তারা বাস ধরে পুরান ঢাকার দিকে রওয়ানা হয়।
চাচা-ভাতিজা লালবাগ কেল্লা দেখে সদরঘাটের দিকে যায়। ইতোমধ্যে ছাতনের ঢাকার প্রতি কিছুটা ক্ষোভ জন্মে গেছে। বুড়িগঙ্গা নদীর কুচকুচে কালো পানির দিকে তাকিয়ে ছাতন চিৎকার করে বলে, বাতাসু, এই শহরত কী মানুষ বাস করে, নাকি ঘুন্দড়েরা থাকে? পাশের এক লোক ঘোঁত করে জানতে চায়, হুজুরে আলা, ঘুন্দড়ের অর্থ...? ছাতন আরো উচ্চৈঃস্বরে বলে, যে প্রাণী ঘোঁত ঘোঁত করে, তার নামই ঘুন্দড়। বাতাসু পরিবেশের গরম হওয়া দেখে, ছাতনকে টানতে টানতে বলে, ঢাকা শহরের সবাই ঘোঁত ঘোঁত করে না কাকা। যদিও এই ‘ঘোঁত’ শ্রেণির সংখ্যা নগণ্য, কিন্তু সত্যটা হলো এরাই ঢাকা চালায়। ছাতন গরুর দালালী করলেও সবই বোঝে। নিজেও কৃত্রিম ‘ঘোঁত’ শব্দ করে সামনে এগুতে থাকে।
বাতাসু সামনে, ছাতন পেছনে। একটু পরেই বাতাসু অস্পষ্টভাবে শুনতে পায় ‘আল্লা গো, মরে গেনু গা, বাতাসু, এই বাতাসু, ভাতিজা মোক বাঁচা’। বাতাসু পেছন ফিরে দেখে কাকা আশে পাশে নেই। অবাক হয়। পেছনে এসে দেখে ম্যানহোলের ভেতর থেকে ছাতন ওভাবে চেঁচামেচি করছে। ছাতনের ভাগ্য ভালো ম্যানহোলের ভেতরে শুকনো আবর্জনা পড়ে ছিল। লোকজনের সহায়তায় ছাতনকে উদ্ধার করা হয়। বেশ ব্যথা পেয়েছে ছাতন। আহসান মঞ্জিলের কাছে বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয় দুজনে। একটু সুস্থ বোধ করলে ছাতন বাতাসুকে বলে, আর এক মুহূর্ত নয় এই শহরত। সন্ধ্যারাতে তারা গাবতলীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় লোকাল বাসে করে।
তিনদিন পর ছাতন ও বাতাসু নিজেদেরকে আবিষ্কার করে দিনাজপুর সরকারী হাসপাতালে। ঢাকা সদরঘাট থেকে কীভাবে দিনাজপুর হাসপাতালে আসল সে রহস্যময় কাহিনি না হয় ‘সোনার বাংলাদেশ’ এর জনগণ পরেই শুনল!!!
***************************************************************
আখেনাটেন-এপ্রিল/২১
@ছবি: Pexels
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ২:২০