ছবির গল্প – প্রথম খন্ড
সে বহুদিন আগের কথা। আমার ২ বছরের বড় বোন টা দুম করে, প্রেম করে বিয়ে করে ফেললো। বিয়েটা অবশ্য পারিবারিক ভাবেই হলো। সেই ভগ্নিপতি কোনো এক সময়ে সিংগাপুরে গিয়েছিলেন। ফিরবার সময় একখানা এসএলআর ক্যামেরা কিনেছিলেন শখ করে, যা দিয়ে ছবি তোলা ছিলো তার সাধ্যের বাইরে। বিয়ের কিছুদিন পর না চাইতেই, তিনি কি ভেবে ক্যামেরাখানা আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘‘ক্যামেরাটা পড়ে রয়েছে, পারলে ছবি টবি তুলো।’’ আমি পড়লাম মহা ফাপড়ে! জটিল ক্যামেরা... এলুমিনিয়াম বডি... ফিল্ম কিনতে হলে তো কথাই নেই... এক ফিল্ম এ ৯০টাকা! তার উপর প্রতি রিল এ কিছু তো নষ্ট হবেই। তখন ভাই ডিজিটাল যুগ না! ১৯৯১ সালের কথা! তো সেই ক্যামেরা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হলো! সাদা কালো ফ্লিম কিনতাম তিন চার মাস পর পর একটা করে, টাকা জমাতে বাবার বাগানে গোলাপের চারা কলম দিয়ে ৩ থেকে ৫ টাকায় বিক্রি করতাম। এভাবে ৩৫ টাকা জমলে একটা ফিল্ম! এক বছর পার হয়ে গেল, দুবছর পার হলো... এস.এস.সি পাশ করেছি। হঠাৎ করে ক্যামেরাটা আমার ভগ্নিপতির ছোট ভাই এসে নিয়ে গেল। এক সপ্তাহ যায়, দু’সপ্তাহ যায়, আর ফেরত দেয় না। এভাবে, কয়েক মাস পার হয়ে গেলো। একদিন বোনকে বিষয়টি জানালাম। বোনের চোখটা ছল ছল করে উঠলো। বললো, “বড় হ, আমি যে সেলাই করে মেয়েদের জামা বানাই, তার টাকা জমিয়ে তোকে একটা কিনে দেবো।”
পরে জেনেছিলাম, আমার সেই বিয়াই কোনো কাজ ছাড়াই ক্যামেরাটি আমার কাছথেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, শুধুমাত্র সেটি উনার ভাই এর বলে। বিষয়টি জেনে আমার ভগ্নিপতি প্রচন্ড রেগে ক্যামেরাটি মাটিতে আছড়ে ভেঙে ফেলেছিলেন।
এখানে একটি কথা না বললেই নয়, আমার এই বোনকে বাবা আমার এক আত্মীয়ের সাথে জোর করে বিয়ে দিয়েছিলেন। পরে জানা গেলো আমার সেই ফুপাতো ভাই আসলে ঢাকায় কোনো লেখাপড়া করেন না, বাটপারি করে ঘুরে বেড়ায়। বাবাকে সে বলেছিলো যে, সে একটা স্কলারশিপ পেয়েছে জাপানে। এজন্য তার টাকার দরকার। আমার দাদু বিষয়টা বিবেচনা করে বাবাকে এই বুদ্ধি দিয়েছিলেন –
: এমনিতেই তো ওরে টেহা পয়সা দিতে হয়, তোমার মেয়ের সাথে বিয়ে রেজিষ্টী করে রাখো আর ওরে যেভাবে পারো টাকা দাও।
পরে আমরা সব জানতে পেরেছিলাম, যে আমার সেই ফুফাতো ভাই একজন প্রতারক। সেই রেজিষ্ট্রি বাতিল করা হয় (তালাক)। অভিমানে আমার সেই বোন আমার বাবার সঙ্গে কথা বলতো না। নিজের লেখা পড়ার খরচ নিজেই সেলাই করে, আর বাচ্চাদের প্রাইভেট পড়িয়ে আয় করতো। পরে আমার এখনকার এই ভগ্নিপতির সঙ্গে তার ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠে, এবং একজন উচ্ছনে যাওয়া মানুষ থেকে তাকে উৎসাহ দিয়ে বিশ্ব বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। নিজের আয় থেকে তাঁর স্বামীকে মাঝে মাঝেই লেখা পড়ার খরচ এর জন্য সাপোর্ট দিয়ে গিয়েছেন। আজ সেই ভগ্নিপতি, অনেক বড় সরকারী চাকুরীজীবি এবং তিনি আমার এই বোনটাকেও অনেক ভালোবাসেন।
আবার ছবির কথায় ফিরে আসি। আমার বোনটি আজও আমায় ক্যামেরাটি কিনে দেয়নি! আমিও আর কোনো দিন বিষয়টি তাকে মনে করিয়ে দেইনি। কিন্তু তার সেই ছল ছলে চোখ আজও আমার মনে পড়ে যায় ক্যামেরা হাতে নিলেই। সরি, মূল ছবির গল্প এখন আর লিখতে পারবো না। আমার সেই কথা মনে পড়ে গিয়েছে এবং চোখে পানি এসে গিয়েছে। আবার পড়ে লিখবো।
ছবির গল্প – দ্বিতীয় ও শেষাংশ
এই ক্যামেরাটা নিয়ে কিছু স্মৃতির কথা বলে নেই আগে! বন্ধুরা সবাই মিলে মাঝে মধ্যেই পিকনিক করতাম, সঙ্গে নৌকা ভ্রমন। সবার চাদা থেকে ৩৫ টাকা আমাকে অগ্রীম দেওয়া হতো ক্যামেরার ফিল্ম কিনবার জন্য। সবাই মহা আনন্দ নিয়ে বিভিন্নভাবে ছবি ওঠা হতো। পিকনিক শেষে, ফিল্ম ডেভেলপ করতে আরো ১৫ টাকা খরচের পর দেখা যেতো সেগুলোর অধিকাংশই হয়েছে আবছা, নয়ত কালো!! ৫ থেকে ৬ টা ছবি হয়তো পাতে তুলবার মতন হতো! সকলের গালি, এমনকি মারও হজম করতে হতো! শাটার স্পিড, এ্যাপারেচার.... এইসব তো তখন বুঝতাম না। হাতে কলমে ছবি তুলে তুলে একটু একটু করে দুবছরে কিছুটা শেখা সম্ভব হয়েছিল বোধহয়! বন্ধুরা যতোই গালি-গালাজ করুক, পিঠে দুচার ঘা দিক... পরের পিকনিকে আবার সেই আমার উপরেই দায়িত্ব দেওয়া হতো বিভিন্ন সাবধানতা বার্তা সহ। সেই সঙ্গে মারের হুমকি। পরিনতি সেই একই...... এভাবে চলতে চলতেই সেই ইয়াশিকা ক্যামেরাটা হারালাম। কিভাবে সেটি হারাতে হয়েছিল তা প্রথমভাগেই বলেছি।
ফটোগ্রাফার হবার স্বপ্নটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে থাকে। জীবনের নানা চড়াই উতড়াই পার হয়ে বিশ্ব বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। ১৯৯৮ অথবা ১৯৯৯ সালের কথা, রাজশাহী থেকে একবার ঢাকায় এলাম গ্রীষ্মের ছুটিতে। তখন জাতীয় সংসদে ভবনের সামনে দুটো কি তিনটে দোকান বসত। প্রধান ফটকের ঠিক সামনেই এরা পুরোনো বই, জার্নাল, পত্রিকা এসব নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসত প্রতিদিন বিকেলে। সেখানে, একদিন পত্রিকা খুজতে খুজতে একখানা প্রত্রিকা বা ঐ জাতিয় কিছু পেলাম!!! ঐ জাতিয় বলছি কারণ সেটির অবশিষ্ট ছিলো ৪ টা পাতা!!! মোট ৮ পৃষ্ঠা! ভেতরে ছিলো এক অমূল্য সম্পদ!!! দু-টাকা দিয়ে সেই সম্পদ বগলদাবা করে ফিরলাম রাজশাহী। সেই আট পৃষ্ঠায় ছিলো ফটোগ্রাফি নিয়ে অনেক কিছু, সেই সঙ্গে একটি ছবি! ছবিটি দেখেই আমি সেই ছবির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। এই ছবিটিই কিন্তু এই গল্পের মূল চরিত্র!!!
বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে সেই ছবি ফটোকপির দোকানে নিয়ে বড় করে ফটো কপি করলাম। এনে লাগালাম হলের রুমে। সবাই ছবিটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। বলতো,
: এটা কে রে?
:: আমার উত্তর ছিলো, এর নাম ’সুবর্ণা’।
: সুবর্ণা মোস্তফা?
:: না, আমি নিজেই এর এই নাম দিয়েছি।
এই ছবি নিয়ে অনেক বিপাকেও পড়তে হয়েছে! বিশেষ রাজনৈতিক দলের পান্ডারা অনেকেই এসে হুমকি দিয়েছে –
: এসব কি? এটা সরিয়ে ফেলুন। না হলে ভালো হবে না।
কি আর করা! অবশেষে এর উপরে একখানা সাদা কাগজ পর্দার মতন করে লাগিয়ে দিলাম। সমস্যা, সমাধান।
এই ছবির প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে চলেছি! কোনো মেয়ের কথা মাথায় এলেই আগে আসে এই সুবর্ণার কথা। মুখে মুখে বিষয়টা নিজের ক্যাম্পসের অনেক ঘনিষ্ঠজনেরাই জেনে গেলেন! দেখা হলেই বলতেন-
কি রে তোর সুবর্ণার খবর কি? ..... কিন্তু ভালই!
যা খুশি বলুক কিন্তু সুবর্ণাকে নিয়ে কোনো খারাপ উক্তি সহ্য হতো না। এভাবেই কয়েক বছর পর এক বন্ধু কম্পিউটার কিনলো। হঠাৎ এসে বললো –
: তোর সুবর্ণার মূল ছবিটা দে।
:: কেন? ওটা দেওয়া যাবে না। ওটা দিয়ে তুই কি করবি? ওটা আমার সংগ্রহ, আমার সম্পদ। আমি হাতছাড়া করতে পারবো না। আমার সব নোটস লাগলে নিয়ে যা, কিন্তু ছবিটার কথা উচ্চারণ করবি না।
সেই বন্ধু বহু বুঝিয়ে শুনিয়ে প্রায় একমাস পর একখানা ফ্লপি ডিস্ক নিয়ে হাজির!
: দেখ, এখন যুগ বদলে যাচ্ছে। এরকম কোনো সম্পদ এখন আর এভাবে রাখে না কেও। ধর, তোর ট্রাংক টা হারিয়ে গেল। তখন কি করবি? এই ছবি স্ক্যানারে দিয়ে এই ডিস্কে সেভ করে দেব। এটা অবশ্য বেশিদিন লাষ্টিং করে না! তোর জন্য একটা সিডি কিনে আনবো। সেটাতে ঐ ছবি রাইট করে দেবো। কোনোদিন আর হারাবে না। তুই আমার উপর আস্থা রাখ, আমি এই ছবির কপি কাওকে দেবো না।
অবশেষে বিষয়টা বুঝতে পারলাম। বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ হলাম! তিনি একখানা ফ্লপি ডিস্কে পুরে সেই ছবি ফেরত দিয়ে গেলেন। সিডি কিনে এনে পরে সিডিতেও রাইট করে দেবেন। ফ্লপি নিয়ে যত্ন করে জামায় মুড়িয়ে ট্রাংকে রেখে নিশ্চিন্ত হলাম!
কিছুদিন পরে ক্যাম্পাসে প্রচন্ড গোন্ডগোল, প্রাণ হাতে নিয়ে পালাতে হলো। খালি হাতে, খালি পায়ে ট্রেনে চড়ে বাড়ী এলাম। সুবর্ণা থেকে গেলো হলের সেই রুমের দেয়ালে, ফ্লপি ডিস্কে। আবার ক্যাম্পাস খুললে তবেই হলে ঢুকতে পারবো। খবরের কাগজে দেখলাম, হলে নাকি কিছু লুট-পাট হয়েছে। বুকের মধ্যে খালি খালি লাগতে শুরু করলো। প্রতীক্ষার প্রহর ফুরোলো, একমাস পর হলে ফিরে দেখি কিছুই নেই! আমার কিছুই নেই! দেয়ালের ছবিটাও নেই! ট্রাংকও নেই। হলের গেটে এসে জানতে পারলাম, ভাঙ্গা ট্রাংটা পড়ে আছে স্টোর রুমে। স্টোর রুমে গিয়ে দেখি ট্রাংকের ডালা খোলা, সেটি যেন দাঁত বের করে হাসছে।
আমার, লেখা পড়া মাথায় উঠলো। ছুটলাম আমার সেই প্রযুক্তিবীদ বন্ধুটির কাছে! খুলে বললাম সব। তিনি মুচকি হেসে বললেন –
: এই টাই তো তোরে বুঝাতে পারছিলাম না! কম্পিউটারে রাখলে হারাবার ভয় নেই!!! দাড়া, একটা ফোল্ডার করে রেখেছিলাম, হিডেন করে। আছে নিশ্চই। তিনি খুজতে শুরু করলেন। আধা ঘন্টা ধরে খুঁজতে থাকলেন, এক ঘন্টা যায়, ছবি আর পাওয়া যায় না। আমার মুখ আধারে ঢেকে গেলো। আর বন্ধুর কপালে চিন্তার রেখা। অবশেষে বললেন –
: তুই হলে চলে যা। আমি আরো খুজবো ছবিটা। কি হলো বুঝতে পারছি না। কেউ মুছে দিছে মনে হয়। মন খারাপ করিস না, একটা ছবিই তো!
কি করে বোঝাই। এটি তো শুধু একটা ছবি নয়! এটি আমার একটি স্বপ্ন। আমি একদিন ফটোগ্রাফার হয়ে এমন একটি ছবি তুলবো। আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।!! আমি মন খারাপ করে, হলে ফিরে এলাম। সকলেই ছবিটার জন্য সমবেদনা জানাতে এলেন রুমে। অনেক ছোটভাই, ভক্তরাও ঘটনাটি জেনে আফসোস করতে থাকলেন।
- আরে গুরু, আপনার তো সামান্য একটা ছবির জন্য এমন মুষড়ে পড়লে চলবে না। গীটার, বাঁশী এসব আবার ধরেন।
- আহা! ছবিখানা জোস্ত ছিলো। আরে বাবা, মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে গেছিস, ভালো কথা! তাই বলে সামান্য একখানা ছবিও নিতে হবে!!
ছবি হারিয়েছে এটা তাও সহ্য হয়। মনের মধ্যে সে ছবি গেথে গেছে। কিন্তু সেই ছবিকে কেও সামান্য বলবে তা সহ্য হয় না।
প্রায় ৭ মাস পরে আমার সেই বন্ধু একদিন রাত দেড়টার সময় হলে এসে আমায় ঘুম থেকে ডেকে তুললেন!!! দু-কান বিস্তৃত হাসি দিয়ে বললেন –
: চল গায়ে কিছু চড়িয়ে নে। আমার সাথে চল, তোর সেই ছবি পাওয়া গেছে। সঙ্গে টাকা নিস... খিদা লাগছে। তালাইমাড়ি যাবো, বট পড়টা খাবো, তারপর আমার হলে চল।
পড়ি মরি করে ছুটলাম দুই বন্ধু। আমার কাছে সেই বন্ধু, সেই মুহুর্তে মানুষ নয়! দেবদূত! মাসের খরচের সব টাকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। প্রায় মাইল দেড়েক হেটে তালাইমাড়ি মোড়ে পৌছালাম। মনে হচ্ছিলো ১০০ মাইল হাঁটছি, পথ আর শেষ হয় না। বিশাল কড়াইতে গরুর ভুড়ি (বট) ভাজা চলছে। কড়াই এর উপরে ১০০ ওয়াটের একখানা বাল্ব ঝুলছে, আলোর চারিদিকে রাতের পোকা-মাকড় উড়ে এসে কড়াইতে পড়ছে, ভুড়ির সঙ্গে ভাজা হয়ে সেই বটের ঘ্রান ছড়িয়ে চলেছে! কিসে কি!!! তাড়া তাড়ি ফরমায়েশ দিয়ে দুজনে বসে পড়লাম।
: তা কেমন করে পাওয়া গেল ছবিটা? কিছুই তো বলছিস না! সারা পথ জিজ্ঞেস করে চলেছি। কিছুই বলছিস না, যা খেতে চাস খা ভা্ই, তাও আর চেপে রাখিস না!
:: সারা পথ অন্তত ১০০ বার এই ঘ্যান ঘ্যান করে চলেছিস! বলছি, আগে দু’চারখানা পড়টা পেটে দিয়ে নেই। তার পর ঠান্ডা মাথায় সব বলছি।
বট এসে গেলো, বন্ধুবর গুনে গুনে ৬ খানা পড়টা খেয়ে, আরো পড়টা চেয়ে পাঠিয়ে, শুরু করলেন!
:: তুই মাঝে মাঝে আমার রুমে গিয়ে পুরোনো হিন্দি গান শুনতি মনে আছে? তোর জন্য আলাদা একটা ফোল্ডার ছিলো। উইনএ্যাম্প প্লেয়ারে প্লেলিষ্ট এডিট করে গানের নাম, শিল্পীর নাম এগুলো মিডিয়া ইনফোতে এ্যাড করতি। তো কোনো এক সময়ে একটি গানের মিডিয়া ইনফোতে তুই সেই ফোল্ডার থেকে ছবিটা আইকন আকারে এ্যাড করেছিলি। ভুলে গিয়েছিস হয়ত। সেই মিডিয়া ইনফোতে ছবিটা এখনো রয়েছে।
আমি আশ্বস্ত হলাম!!!
: আরো বট দিতে বলবো? সেভেন-আপ খাবি? চা- সিগারেট? ধীরে সুস্থে খা.... সমস্যা নেই। যত সময় লাগে লাগুক। ফিরবার সময় রিক্সা নিয়ে নেবো।
সোহেলের হলে ফিরলাম। কম্পিউটার অন করা হলো! গানটা প্লে করা হলো, মিডিয়া ইনফোর উইন্ডোর মধ্যে ছোট্ট আকারে সেই ছবি। আমার সুবর্ণা।
: ছবি টা বড় কর, বড় কর! এতো ছোট করে রাখছিস ক্যান? বড় কর!
:: এর চেয়ে বড় হবে না। এইটাই এখন এর সবচেয়ে বড় সাইজ। মিডিয়া ইনফোতে ছবি এ্যাড হওয়ার সময় সাইজ ছোট হয়ে যায়।
: এইটা কি বলিস দোস্ত! কম্পিউটারে সব হয়, বড় ছবি যদি ছোট হয়, ছোট ছবিও বড় হয়। দেখ না একটু।
:: আরে বেটা, আমি তো বুঝেই বলছি। বড় করতে গেলে ফেটে যাবে। তোর সুবর্ণা তখন কুবর্ণা হয়ে যাবে।
: আচ্ছা তাহলে প্রিন্ট করে দে।
:: সেটা সকালে ছাড়া তো সম্ভব না। তাছাড়া এই ছবি এখন এই গান থেকে বের করি কিভাবে সেটাই ভাবছি। প্রিন্ট করতে হলে তো আগে এইটাকে আবার ছবির ফরম্যাট এ আনতে হবে।
আমার মন খারাপ হতে লাগলো। বন্ধু সোহেল মহা ব্যস্ত সমস্যার সমাধান করবার জন্য। এটা করে ওটা করে... কিছুতেই সেই ছবি আর বের হয় না, ছবি আকারে। গান বেজে চলে আর ছোট্ট মিডিয়া উইন্ডোতে ছবিটা দেখা যায়! অবশেষে ঘন্ট খানেক পর!
:: ইউরেকা!! গান বেজে চলুক, আমরা ডেস্কটপের একটা স্ক্রিন শট নিয়ে নেই! তাহলেই তো সমাধান হয়ে যায়।
অবশেষে সেই ছবি বের হলো। পরদিন প্রিন্ট করা হলো। কিন্তু এতো ছোট আকারে। কি আর করা। ওতেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়বার বাকীটা জীবন।
সম্মান শেষ বর্ষে এসে নিজেও একখানা কম্পিউটার কিনলাম। এটাও সম্ভব হলো সোহেলের কারণে। সোহেল আমাদের বাড়ী এসে বাবাকে বুঝিয়ে বললো, কম্পিউটার কিনবার দরকারের কথা। বাবা রাজী হলেন। সোহেলের এইচ ডি ডি থেকে সেই গান পরম যত্নে আমার এইচ ডি ডি তে স্থানান্তর করা হলো! ওই একই গান শুনি... একই ছবি দেখি!!! অবশেষে বিশেষ রাজনৈতিক দলের পান্ডাদের জ্বালাতনে এক মেসে উঠলাম, ছোট ভাই চন্দনের সঙ্গে। ইউনিভার্সিটির বাকী সময় এখানেই কাটাবো। এর মধ্যে আমার মেজ দুলাভাই রাশিয়া গেলেন, সেখান থেকে চিঠি মারফত জানালেন যে, আমার জন্য তিনি একখানা ক্যামেরা কিনেছেন জেনিথ ব্রান্ডের এস এল আর। খুশিতে আটখানা হয়ে উঠলাম। ৪ মাস পর তিনি রাশিয়া থেকে অবতরন করলেন বিমান বন্দরে, আমি ঢাকা এসেছি তাকে রিসিভ করতে (ক্যামেরার লোভে)!!! অবশেষে, সেই ক্যামেরা বিমান বন্দরের কাষ্টমস থেকে খোয়া গেলো। অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়। এই মুচির কপালে লুচি মিলিলো না!!!
লেখাপড়া শেষ হলো। বাবা ক্যান্সারে মারা গেলেন। আমি অথৈ সাগরে পড়লাম। ঢাকায় এসে মোহাম্মদপুরে স্যার সৈয়দ রোডে এক অফিসে ছোট্ট একখানা চাকরী জুটলো। ২০০৫ সাল এপ্রিল মাস, ৩০০০ টাকা বেতন। শুরু হলো নুতুন জীবন। বড় বোনের বাসায় থাকি, খাই, আর মজার এই কম বেতনের চাকরী করি। “প্রতিকৃতি কমিউনিকেশানস”। আব্দুল্লা জাফর এটির মালিক। টেরিষ্ট্রিয়াল একুশে টিভিতে একসময় ”দেশজুড়ে” নামে একটা অনুষ্ঠান হতো। সেটি উনি করতেন। এই লোক নানাবিধ কাজ করে বেড়াতেন!! সেই সঙ্গে উনি ছিলেন বেশ বড় মাপের একজন ফটোগ্রাফার, একসময় সাংবাদিকতা করতেন। অফিসে উনার ক্যামেরাটি সবসময় থাকতো! কিন্তু কোনোদিন ছুয়ে দেখবার সাহস হয়নি।
বোনের বাসা কাফরুলে। কচুক্ষেত বাজারের পেছনে পুরাতন, ভাঙ্গাচোড়া, (এমনকি অনেক চোড়াই) বিভিন্ন জিনিস বিক্রি হতো। সেখানে সপ্তাহে একদিন যাওয়াটা ছিলো আমার নেশা! কারণ সেখানে অনেক ক্যামেরাও দেখতাম, কিন্তু জুতসই কিছু দেখা যায় না!! হঠাৎ একদিন, একটা ক্যামেরা চোখে পড়লো! সেই স্কুল জীবনে প্রথম পাওয়া সেই ক্যামেরা, একেবারে হুবুহু জিনিস!!! চেম্বার খুলে শার্টার মেরে দেখলোম ডায়াফ্রাম জ্যাম!! দাম করে ৩৫০ টাকায় ফয়সালা হলো। ক্যামেরা হাতে রাজ্য জয় করে ফিরলাম!!! বড় বোন বললেন,
: তোর এইসব ভাঙ্গাচোড়া জিনিস কেনার অভ্যাসটা এখনো গেলো না! এইটা দিয়া কি করবি। ছবিই তো উঠবে না!
আমার নির্লিপ্ত উত্তর,
:: ঠিক করে ফেলবো, চিন্তা কোরো না।
সেই ক্যামেরা ঠিক হলো, এবং যথারীতি ছবিও তোলা সম্ভব হলো। সেই ক্যামেরা নিয়ে বাইরে যেতে একটু লজ্জাও করতো, যারা ছবি টুবি তুলে বেড়াতো সবার হাতে তখনো এসএল আর ক্যামেরা, কিন্তু অনেক উন্নত!!! আমার টা রঙ চটা এসএল আর!! অফিস থেকে বাসায় ফিরে, ফোকাসিং প্র্যাকটিস করি।দু একটা ছবি তুলি। খারাপ হয় না। আবার ভালোও হয় না। আমার ভাগেনে তবুও উৎসাহ যুগিয়ে যায়। “মামা তুমি হাল ছেড়ো না! তোমার হবে! আজ না হোক দশ বছর পরে হলেও হবে। সাবজেক্ট না পেলে, আমি তো আছি। আমার ছবি তুলো।”
একদিন অফিসে বসে খবরের কাগজে ফটোগ্রাফী বিষয়ে একটা আর্টিকেল পড়ছিলাম। জাফর ভাই অফিসে ঢুকে দেখে ফেললেন!
: কি ফটো তোলার শখ টখ আছে নাকি?
:: না ভাইয়া, এমনি দেখছিলাম।
: আরে লজ্জার কি আছে! আমি এর আগেও দেখেছি, আমার সঙ্গে সেদিন রাতে সাঁওতাল পল্লীতে গিয়েছিলে। আমি ছবি তুলছিলাম, তুমি গভীর মনোজোগে আমার কাজ দেখছিলে। ক্যামেরা আছে?
:: জ্বী, আছে। এস.এল.আর।
: বাহ! কাল নিয়ে এসো অফিসে। দেখবো কেমন ক্যামেরা।
আমি ফেসে গেলাম! এই ক্যামেরা নিয়ে জাফর ভাইকে দেখাবো! কি করি কোনো উপায় পেলাম না। অবশেষে পরদিন সকালে দুরু দুরু বুকে জাফর ভাইয়ের সামনে হাজির হলাম। বাশঁ কাগজের খামের ভেতর ক্যামেরা!!!
: এটা কি!?
:: ক্যামেরা, আনতে বলেছিলেন।
: তাই বলে এসএলআর ক্যামেরা, এইরকম খামের মধ্যে? ব্যাগ নেই?
:: না। ব্যাগ কেনা হয়নি।
জাফর ভাই দুমড়ানো মোচড়ানো খামের ভিতর থেকে ক্যামেরা বের করলেন! অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে।
: এটা কোথায় পেলে? ভালো জিনিস। কত পড়েছে? কোথা থেকে কিনেছো?
:: কচুক্ষেতের ভাঙ্গাড়ী মার্কেট থেকে, সাড়ে তিনশ টাকা।
: কি! খুব জিতেছো। ক্যামেরাটা ভালো। তবে এইটাকে ঠিক এস.এল.বলা যায় না। এস এল আর এর মতনই তুমি ফোকাস এ্যাডজাস্ট করতে পারবে। এ্যাপারেচার ঠিক করতে পারবে, কিন্তু এস.এল.আর এর সব সুবিধা পাবে না। এটাতে লেন্স চেঞ্জ করতে পারবা না। তার পরও শিখবার জন্য যথেষ্ট ভালো জিনিস। এই জিনিস এখন খুব একটা দেখা যায় না এখন আর, অনেক পুরোনো জিনিস, ক্লাসিক। আমার ক্যামেরার ব্যাগটা নিয়ে এসো... কিছু দেখিয়ে দেই।
জাফর ভাই এর মতন মানুষ হয় না। তিনি আমাকে কোনোভাবেই আমার অজ্ঞতার কারণে আমাকে লজ্জায় পড়তে দেননি। এমনকি খুব সহজ ভাবে হাতে কলমে কিছু কিছু বিষয় দেখিয়ে দিয়েছেন। সেদিনই আমি জীবনে প্রকৃত এস.এল.আর ক্যামেরা দেখেছিলাম এবং হাতে নিয়েছিলাম। আমার সাড়ে তিনশ টাকার সেই ক্যামেরাও আমার কপালে বেশিদিন টিকলো না। আমার এক কলিগ কিশোরগঞ্জে অফিসের কাজে গিয়ে আমার ছবি তুলবার সময় হাত থেকে ফেলে দিলেন। একেবারে গেল....
ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সরদার! শুধু সুবর্ণা রয়েছে কম্পিউটারে, গানের মধ্যে বন্দী হয়ে। একবার এইচ.ডি.ডি ক্রাশ করে সূবর্ণাও হারিয়ে গেল আবার! ২০০৬ সাল। অন্য চাকুরী নিয়ে ঢাকা ছাড়লাম। সুবর্ণা নেই। কিন্তু মনের মধ্যে তার সেই ছবি গেথে গেছে....। সময় বয়ে চলে, ডি.এস.এল.আর এসে গেল। অনেকের হাতেই দেখি, দোকানের কাচের বাইরে থেকে দেখি। দাম শুনি। এভাবে কেটে গেল আরো ছয়টি বছর। ২০১১ সাল অবশেষে, একজনের কাছথেকে একটা ক্যানান ১০০০ডি কিনলাম, ভালো কন্ডিশান, ২২,০০০/- টাকায়। ছবি তুলি, সবাই বেশ উৎসাহ দেয়, প্রশংসাও করে। একা একা ফটো ওয়াকে বের হই। সেই ফটো ওয়াক শহরে নয়, গ্রামে, নদীর ধারে, গোধুলীর সময়। কিন্তু সুবর্ণার দেখা পাই না, তাকে ফ্রেমে আটকাতে পারি না, হৃদয়ের ফ্রেমে থেকে যায়। সুবর্ণার ছবি তোলা এযুগে কঠিন, অনুমতি নিয়ে তুলতে চাইলেও বিপদ, না নিয়ে তুলতে গেলেও বিপদ! তার উপর পারফেক্ট সুবর্ণা পাওয়া তো আরো দুসাধ্য। একটা লেন্স ও কিনে ফেললাম ২০১২ তে ৫৫-২৫০ ইএফএস। আমার যোগ্যতার চাইতেও বেড়ে জিনিস। দূর থেকে যদি কখনো সূবর্ণাকে দেকতে পাই!!!
হঠাৎ, গত বছরের শেষের দিকে আমার ইউনিভার্সিটির রুমমেট ছোটভাই চন্দনের সঙ্গে দেখা। উচ্ছাসিত কন্ঠে বলে উঠলো।
: বস কেমন আছেন! আপনার সুবর্ণার খবর কি?
:: এতোদিনেও ভুলিসনি রে হতভাগা! নেই! সে হারিয়ে গেছে। ছবিটা আমার কাছে আর নেই।
: কি, কন বস!!! আপনার কাছে নাই। নো প্রবলেম আমার কাছে আছে। সেই গান তো আমিও আপনার কম্পিউটার থেকে কপি করে নিয়েছিলাম!!! সুবর্ণা আপনার জীবন থেকে কোনোদিনও সরে যাবে না ভাই। একটা ছবির প্রতি কোনো মানুষের এমন ভালোবাসা থাকতে পারে, সেটা আপনাকে না দেখলে জীবনে অজানা থেকে যেতো। আমি গানটা আপনাকে মেইল করে দিব। ডাউনলোড করে নিয়েন।
আমি আবার আকাশের চাঁদ পেলাম। চন্দনকে প্রতি দিনই ফোন দেই! ও বলে,
: বস, গানডা আছে কিন্তু কোন গানডা হেইডাই খুঁজে পাচ্ছি না। তবে মাস্ট আছে, আপনে হতাশ হইয়েন না।
অবশেষে সেই গান চন্দন ২০১৩ সালে আমাকে মেইল করেছে এবং সুবর্ণাকে আমি আবার আমার কাছে পেয়েছি।
শেষ কথা....
আমি আজও সুবর্ণার ছবি তুলতে পারিনি। কোনো সুবর্ণাকে পাওয়া যাবে কিনা জানি না। অবশেষে চিন্তা করেছিলাম নিজের মিসেস কে বলবো সেম সিকোএন্স এ পোজ দিতে, কিন্তু সত্য কথাটা হলো সেটা ঠিক সুবর্ণা হবে না। সুবর্ণা শুধু একটি ছবি না.... অনেক কিছু। আমার ক্যামেরাটার একটাই লক্ষ্য এমন একটি ছবি তোলা। আমার সুবর্ণার ছবি তুলবার এই স্বপ্ন হয়তো সফল হবে না কোনোদিন। তাই সুবর্ণাকে আর নিজের মধ্যে ধরে রাখতে চাই না। আপনাদের সকলের মাঝে এই চ্যালেঞ্জ টা ছড়িয়ে দিলাম। ছবিটাও এখানে দিয়ে দিলাম। কেও যদি এই ছবির কোনোরকম তথ্য জেনে থাকেন, আমাকে জানাবেন দয়া করে। এই ছবি কার তোলা, বা এর কোনো বড় ভারসন পাওয়া যাবে কিনা। কেউ জেনে থাকলে আমাকে জানাবেন। ফটোগ্রাফি শুধু আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে পোষ্ট প্রসেসিং নয়, উন্নত ইফেক্ট নয়, ফটোগ্রাফি একটা প্যাশান, ফটোগ্রাফি একটা ভালোবাসা..... এটাই ফটোগ্রাফি সম্পর্কে আমার ধারনা। আমি উচ্চ পর্যায়ের ফটোগ্রাফার নই, ভালো করে ছবি তুলতেও পারি না, একটা ছবিকে মনের চোখ দিয়ে দেখে মগজে গেঁথে রাখতে পারি। এটাই আমার কাছে আমার মতন করে ফটোগ্রাফী। প্রতিটি ছবির পেছনেই একটি করে গল্প থাকে, সে গল্পের নাম জীবনের গল্প, ছবির গল্প।
এই সেই সূবর্ণা -
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০১৩ দুপুর ২:১৪