somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কৃষ্ণচূড়া

০৭ ই জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৩:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১.
এইতো কয়েক বছর আগের কথা। ওর সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল কক্সবাজার থেকে ঢাকা যাওয়ার সময়। সেদিন মনে হয় সোমবার ছিল। ঘুরতে গিয়েছিলাম। তিনদিন ছিলাম কক্সবাজার। আর ঢাকা ফিরে আসার সময়ই তার সাথে দেখা। বাস স্ট্যান্ডে। ও আমার জীবনে আসার পর থেকে সবকিছু কেমন বদলে গেছে। আর এখনও সেই বদলানোর পালা শেষ হয়নি। আমি ঠিকই বদলে যাচ্ছি। প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছি।
এখনও।
প্রতিদিন।

২.
কক্সবাজার এক অনন্য সুন্দর জায়গা। তিনদিন ঘুরেও আমার মন ভরেনি। কি আর করা! ফিরে তো যেতেই হবে। প্রায় বিষন্ন মন নিয়েই বাস স্ট্যান্ডে গেলাম। আমার মন খারাপ বলে হয়তো আকাশেরও কিছুটা মন খারাপ হয়ে গেল। এক পশলা বৃষ্টি ঝরিয়ে আবার মন খারাপ করে বসে আছে। তবে কি হৃদয় ভাঙ্গার গল্প আকাশেরও আছে!
ঐরকম বৃষ্টি ঝরা দিনেই ওর সাথে আমার প্রথম দেখা।
তূর্ণা, আমার বউ।
সেদিনটা আমার জীবনের স্মৃতির পাতায় চিরকাল অমলিন হয়ে থাকবে। আমি বাসের টিকেট কেটে ওয়েটিং রুমে যাওয়ার পর প্রথমই ওর দিকে চোখ পড়ে। এ যেন নীল সাগরে টুকটুকে লাল রঙের একটা সূর্য। যার সৌন্দর্য এখনও আমায় বিমোহিত করে। ঐ সৌন্দর্য নতুন করে তার প্রেমে ফেলে আমাকে।
প্রতিদিন।

৩.
তূর্ণা সেদিন লাল রঙের একটা জামা পড়েছিল। আমার এখনও ঠিক মনে আছে। ওয়েটিংরুমে গিয়ে আমি যেন হঠাৎ-ই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ঐ লাল জামার রমণীর চেহারা যেন এক থোকা কৃষ্ণচূড়া। যাকে দেখেই আমাদর হৃদয়ের ভালোবাসা নামক সবুজ পাতার গাছটি দুলে ওঠে। ও সেদিন একটা চশমা পড়েছিল। কালো রঙের। দেখতেও বেশ বড়সড়। আমার হৃদয় ব্যাকুল হয়েছিল তার ঐ চোখ জোড়া দেখার জন্য। কিন্তু সে চশমা খুললো না। একবারের জন্যও না।
আমি ওয়েটিংরুমের চেয়ারে বসে আছি। বাস আসার জন্যই অপেক্ষা। শুধু আমি না, প্রায় সবাই হয়তো এই কারনেই বসা। আমি তূর্ণার ঠিক বিপরীত পাশেই বসা। ও রুমটার ডানপাশে জানালাটার পাশে আর আমি সোজাসুজি বামপাশে। তাকে দেখে হঠাৎ-ই হৃদয়ে এমন ঝড় শুরু হয়ে গেছে কেন! আগে তো কখনও এমনটা হয়নি। তবে কি আমিও প্রেমে পড়ে গেলাম! ভাবতেই শরীরটা কেমন শিহরে উঠছে।
হিহি।

৪.
প্রায় দশটা বেজে গেছে। কাউন্টারের একলোক বললো দশটায় নাকি গাড়ি আসবে। যদিও আমি উনাদের কথা বিশ্বাস খুব কমই করি। তবুও একরকম বিশ্বাস করার ভান করেই লোকটার সাথে কথা বলে আবার ওয়েটিংরুমে চেয়ারটায় এসে বসলাম। আজকাল তো আমাদের সম্পর্কগুলো ভান করা বিশ্বাসের উপরই দাড় করানো। তবে আমার আবার ভান করায় দোষ কোথায়!
রুমে টিভি চলছে। প্রায় সবারই নজর টিভির দিকে। তবে আমি একটু পর পর ঐ কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকাচ্ছি। কেউ দেখে ফেলে কিনা সেই ভয়ে চারদিকেও খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।

মেয়েটা একবারের জন্যও তো চশমটা খুলতে পারতো। আমি ছোটকাল থেকেই মেয়েদের ব্যাপারে একটু ভীতু। স্কুল কলেজে তেমন কোন মেয়ে বন্ধুও ছিল না। যে কয়েকজনের সাথে কথা বলতাম শুধু পড়ালেখার প্রয়োজনে। তাই আমি যে সাহস করে ওর পাশে গিয়ে বসে দু-একখানা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবো; এই দুঃসাহস আমার কোনদিন ছিল না।
তাই একটাবারের জন্য চশমটা খুললে কি হতো! কিন্তু কৃষ্ণচূড়া তো গভীরভাবে জানালার দিকে তাকিয়ে। তবে কি তার কোন ভ্রমর আছে! এইকথা ভেবেই গাঁ কেমন শিহরে উঠলো। যে আমার কোনদিন কেউ ছিলই না তার জন্য হৃদয় এমন ব্যাকুল হয়ে গেল কেন!
একটু পরেই কাউন্টারের আরেকটা লোক রুমে এসে বলল, "ঢাকা যাওয়ার যাত্রীরা চলে আসেন, বাস চলে আসছে।"
সাথে সাথেই সবার মাঝে ব্যস্ততার কেমন ভাব চলে এসেছে। সবাই সবার ব্যাগপত্র গোছাতে ব্যস্ত। আমি নিজের ব্যাগটা হাতে নিলাম। শেষবারের মত কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকালাম। ওর তেমন নড়াচড়া নেই। হয়তো অন্য কোন বাসে যাবে। আমি ওয়েটিংরুম ছেড়ে বাসে এসে বসলাম। তবে ঐ কৃষ্ণচূড়ায় ভ্রমর হয়ে বসতে না পারার আক্ষেপ ছিল মনেমনে।

৫.
বাস ছাড়তে দুই কিংবা তিন মিনিট বাকি। হঠাৎ-ই দেখলাম লাল শাড়ির ঐ কৃষ্ণচূড়া এই বাসেই। কেউ একজন ওকে ধরে আমার পাশের সিটে বসিয়ে দিয়ে বাস থেকে নেমে গেল। সবকিছু কেমন স্বপ্নের মতো লাগছিল। নিজেকে নিজে কয়েকবার চিমটিও কাটলাম। সবকিছুই সত্যি। তবে কি কৃষ্ণচূড়া আজ ভ্রমরের কাছাকাছি! আমার আনন্দের যেন সবটুকু বাঁধ ভেঙ্গে গেল।
বাস অনেকটা পথ চলে আসছে। আমি আর ও পাশাপাশি বসে। আমার কল্পনার জগতে কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত গল্পেরা ওকি দিতে থাকে। তবে আমার ঐ ভীতু স্বভাব যে সবকিছুর ঘোরতর প্রতিপক্ষ তা আমি হাড়ে হাড়েই টের পাচ্ছিলাম। দুটো প্রাপ্তবয়স্ক মানব-মানবী একসাথে পাশাপাশি সিটে বসা। তবে তাঁরা একে অপরকে একটা 'হাই' ও বলেনি। কেমন অদ্ভুত ব্যাপার! এ যুগে সচরাচর এমনটা দেখা যায় না। এখনকার ছেলেমেয়ে তো ফুলের কুড়ি থেকে না পড়তেই প্রেমে পড়ে যায়। একটু এক্সপার্ট হলেই দু-তিনজন মেয়ে পটানো তাদের হাতের মোঁয়া। যদিও উল্টো ব্যাপারটা ঘটাতে হলে মেয়েদের তেমন এক্সপার্টও হওয়া লাগে না। আজকাল মেয়ে নামের একটা আইডি খুললেই অনেকটা কাজ হাসিল হয়ে যায়। সে ফেইক হোক বা না হোক তা পরখ করে দেখার মতো টাইম ছেলেদের নেই।
রূপকথার গল্পের মত কারো মুখে ভালোবাসার গল্প শুনে তার প্রতি দুর্বল হয়ে নিজেকে কল্পনায় জড়ানো বোকামো।
গল্প কেবল আবেগে সীমাবদ্ধ। গল্পগুলো শুধুমাত্র অন্ধকার রাতে আবেগের আক্রমণ থেকেই উৎপন্ন হয়।
প্রকৃত ভালোবাসা বুঝার মত সবাই হতে পারেনা। আর যে প্রকৃত ভালোবাসা বুঝেনা তার কাছ থেকে এটা আশা করাটাও ভুল। তবে হর-হামেশাই প্রেমে পড়ে যাওয়া এসব মানুষদের কে বোঝাবে বলেন!
আমরা সবসময় সুন্দরের পেছনে ছুটে চলি আর এই মোহ আমাদের এতটাই অন্ধ করে ফেলে যে, সুন্দরের পেছনের অসুন্দরগুলো দেখার কোন সময়-ই হয় না।
ভালোবাসতে মন লাগে, লাগে একজোড়া বিশ্বস্ত হাত, লাগে সুন্দর চিন্তাচেতনা, বিশ্বাস আর ভরসাকে সম্মান দেওয়ার মানসিকতা।
তাই এতক্ষণ পাশে বসেও আমি ওর দিকে তাকিয়ে একবার 'হ্যালো' বলার সাহসও যোগাতে পারলাম না। বাসে প্রায় দু-ঘন্টার মতো হইছে। আমি চুপচাপ বসে আছি। কৃষ্ণচূড়ার পাশেই।

৬.
এবার মনেমনে এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেই ফেললাম। যেভাবেই হোক ওর সাথে কথা বলতেই হবে। জীবনে প্রথম প্রেমে পড়লাম। যাকে ইংরেজিতে বলে "লাভ এট ফার্স্ট সাইট।" আর যাই হোক এই সুযোগ তো আর হাতছাড়া করা যায়। প্রবল সাহসে নিয়ে বলে ফেললাম-
-হ্যালো
ও মনে হয় শুনতে পায়নি। যদিও আমার ঐ দিনের 'হ্যালো' আদৌও আমার মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল কিনা সে ব্যাপারে এখনও আমার কিঞ্চিত সন্দেহ আছে। কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে আবার বললাম-
-হ্যালো। কেমন আছেন?
-জ্বী, কে আপনি?
এটা আবার কেমন প্রশ্ন! আমি কে? মনেমনে এটাই ভাবতে লাগলাম। সবকিছু কেমন ওলটপালট লাগছিল। আমি কে সেটা ভাবতে ভাবতে আরও কয়েক মিনিট চুপ করে রইলাম।
-আমি আনিসুল। নাম কি আপনার?
-সেটা জানা কি খুব প্রয়োজন?
-না। ঠিক তেমন না, না বলতে চাইলে থাক।
-আমি তূর্ণা।
-কক্সবাজার নিশ্চয়ই ঘুরে এসেছেন?
-না। আমার বোনের শশুড়বাড়ি এখানে।
-ওহহ। আমি ঘুরতে আসলাম। সমুদ্র আসলেই অনিন্দ্য সুন্দর। তবে এটা থেকে আরও বেশি সুন্দর কিছুর দেখা পেয়ে গেলাম।
-কি?
-থাক, সেটা না হয় গোপনই থাক।

৭.
এভাবেই শুরু হয়েছিল আমার জীবনের এক নতুন অধ্যায়। আমার আর তূর্ণার প্রেমের গল্প। ঐদিন বাসে বসেই দুজনের খুব ভালো পরিচয় হয়ে গেল৷ জীবনে প্রথম আমি কোন মেয়ের সাথে এত কথা বলেছিলাম। প্রেম হবেই না কেন! আমাদের সবকিছুতেই কেমন মিল আছে। বিধাতা হয়তো নিজের হাতে এই সম্পর্ক গড়ে দিয়েছেন। তূর্ণা আমার তিন ক্লাস জুনিয়র। ওর কলেজ তো আমার বাসার পাশেই ছিল। তবে এতদিন আমাদের দেখা হলো না কেন! তাহলে তো প্রেমকাহিনীটার বয়স এতদিনে অনেক হতো। কৃষ্ণচূড়ার জন্য এই প্রেমহীন ভ্রমরের এত অপেক্ষা করা লাগতো না।
পথ আর তেমন বাকী নেই। বাস যেন আনন্দ উৎসাহে বিমোহিত হয়ে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ছুটে চলছে। এরমধ্যে একটু পর পর তূর্ণা আর আমার কথা চলছেই। তবে একটা কথা ওকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে। খুব বেশিই ইচ্ছা করছে।

-আচ্ছা আপন সবসময় এই কালো চশমা পড়ে থাকেন কেন?

তূর্ণা কোন জবাব না দিয়েই চুপ করে আছে। তবে এই প্রশ্ন যে ও পুরোপুরি শুনতে পেয়েছে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
বাস প্রায় ঢাকার কাছাকাছি। এই অল্প সময়েই দুজনের খুব ভালো পরিচয় হয়ে গেল। আমি ওর ফোন নম্বরটা চেয়েছিলাম। তবে সে তা আমাকে দেওয়ার কোন ভাব দেখালো না। আমি চুপ করেই রইলাম। বাস প্রায় ঢাকা চলে আসছে। হয়তো আর আধা ঘন্টার মতো লাগবে পৌঁছাতে।
-আপনার প্রশ্নের উত্তর শুনবেন না?
-কোন প্রশ্ন?
-ঐ যে আমি কেন সবসময় কালো চশমা পড়ি।
-ওহ।
-বিধাতা খুব সুন্দর করে আমার পৃথিবীর আলো বাতাস দেখার অধিকারটুকু কেড়ে নিয়েছে। জন্মের সময়ই আমি চোখ দুটি হারাইছি। এমন ভাগ্য কয়জনের হতে পারে বলেন! তবে আমি অনেক খুশি। তিনি তো আমাকে পৃথিবীর বুকে পা রাখার অধিকারটুকু দিয়েছেন। আমার নিরন্তর পথ চলায় কল্পনাতে মানুষের ছায়াগুলো দেখেই তৃপ্ত থাকি। এটা কয়জন-ই বা পারে।

কথাগুলো বলার কেমন চুপ হয়ে গেল মেয়েটা। যেন কেমন একটা অভিশপ্ত ভাবনা ঘিরে রেখেছে জীবনের উঠানটার চারপাশ। আমি চুপ করেই বসে আছি। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছি না। যেন এক অভিশপ্ত ভাবনা আমাকেও গ্রাস করে ফেলছে। আমি তো এমন প্রেম চাইনি। তবে আমার সাথে কেন এমন হলো!

-কি আমার ফোন নম্বর নিবেন না! জানি 'হ্যাঁ' বলার কোন কারণই নেই আপনার কাছে। যে পৃথিবীর আলো বাতাস দেখে না তাকে কেউ আলো অনুভব করাতে পারে এটা আমার বিশ্বাসের বাইরে।

আমার মুখ থেকে কোন শব্দ বের হচ্ছিল না। তবে পাহাড় সমান ভাবনার নিয়ে চুপ করে বসে আছি।

৮.
আজকে বুঝতে পারছি, ঐদিন ওর ফোন নম্বর নিয়ে কতটা ভুল থেকে বেঁচে গেছি আমি। আমি কখনও চিন্তাই করতে পারিনি, যে আমি একজন অন্ধ মানুষের স্বামী হবো। এখন বুঝতে পারছি আমি কতটা ভাগ্যবান! তূর্ণা আমার জীবনে আসার পর আমার জীবনের পুরো রং-টাই পাল্টে গেছে। ধূসর আর সাদামাটা জীবনটাকে কেমন রাঙিয়ে দিল এই অল্প সময়ে। ওর সাথে পরিচয়ের প্রায় একবছর পর আমাদের বিয়ে হয়েছিল। এই একবছরে আমাদের ভালোবাসার খুনসুঁটে গল্পগুলো কখনও দাঁড়াতেই পারেনি।
তূর্ণা প্রায় সময় বাসাতেই থাকতো। আর আমাকে তো কাজের জন্য অফিসেই থাকতে হতো। তাঁর দেখাশুনার জন্য জারিনাকে রেখেছিলাম বাসায়। রান্নার কাজ থেকে শুরু করে সবসময় তূর্ণার পাশে থাকার জন্যে। আমার সপ্তাহে দুদিন ছুটি থাকে। তাকে নিয়ে প্রতি সপ্তাহে বের হতাম। আমার হাত ধরেই পৃথিবীকে অনুভব করতে শেখে সে। তূর্ণার ঘুরতে খুব ভালো লাগে। আর কক্সবাজার হলো সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। কারণ ঐ ওখানেই আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। তাইতো বিয়ের পর থেকে প্রতিবছর অন্তত একবার হলেও তাকে ওখানে নিয়ে যাই। আমার হাত ধরে সমুদ্রে গোসল করতে নেমে যে হাসি দেখি তার মুখে, ঐ হাসি-ই হয়তো আমাদের সম্পর্কটা এতদূর নিয়ে এসেছে। ওখানে গেলেই পুরনো সেই ধুলো জমানো স্মৃতিগুলো কেমন জেগে ওঠে। যেদিন সেই ভ্রমর প্রথম দেখা পেয়েছিল এই কৃষ্ণচূড়ার।

৯.
রাফিনের বয়স প্রায় সাত হবে। আমার ছেলে রাফিন। যদিও তূর্ণা সারাদিন 'আমার ছেলে' 'আমার ছেলে' বলেই ওকে মাথায় তুলে রাখতো। ভালোবাসায় সিক্ত আমাদের জীবনে রাফিন আসার পর থেকে আনন্দ সবসময় বিপদসীমার উপর দিয়েই প্রবাহিত হতো।
তবে এই আনন্দ বিপদের বাইরেও একপ্রকার বিপদ এসেছিল। যা আমার জীবনের গল্পটা অনেকটা এলোমেলো করে দিয়েছিল।

রাফিনের বয়স মনেহয় তখন তিন কিংবা চার হবে। সবেমাত্র বসতে শিখেছে। ওর জন্মের পর আমাদের প্রথম কক্সবাজার ভ্রমণ। তূর্ণা একটু বেশিই খুশি ছিল। নতুন অতিথির সাথে প্রথম সমুদ্র দর্শন। যদিও ঐবার দুদিনের বেশি থাকা হয়নি। মঙ্গলবার সকালে আমাদের রওনা দেওয়ার কথা ছিল। তবে আমাকে অফিসের কি একটা খুব দরকারী কাজে সোমবার বিকেলেই রওনা দিতে হয়েছিল। মঙ্গলবার সকালের মধ্যে ঢাকা পৌঁছাতে হবে। আমরা যতবার কক্সবাজার গিয়েছি কখনও চারদিনের কম থাকিনি। তবে এবার সবচেয়ে কম থাকা হলো। রাফিনও তার মায়ের মতোই হইছে। সমুদ্র খুব পছন্দ করে। তাই ঢাকা চলে আসার সময় মা ছেলে দুজনেরই মন খারাপ ছিল।
আমরা বিকাল পাঁচটা কি সোয়া পাঁচটায় গাড়িতে উঠি। আমি ড্রাইভিংয়ে, সামনে মন খারাপ করে বসা ছেলেটা আর পিছনে তূর্ণা।
রাত প্রায় দুইটা। একটা রেস্ট হাউজে গাড়ি থামিয়ে একসাথে রাতের খাবার খেয়ে আবার রওনা দিলাম। সকালের মধ্যে যে পৌঁছাতেই হবে। রাফিনের রাত জাগা অভ্যাস ছিল। যদিও ঐদিন কিছুটা ক্লান্ত ছিল বলে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লো। আর পিছনে তূর্ণাও ঘুমে। মা ছেলে কেমন দিব্যি ঘুমাচ্ছে।
আমার সচরাচর এমন লং ড্রাইভিং করার অভ্যাস আছেই। রাফিনের জন্মের আগে প্রায় সময়ই ঘুরতে যাওয়া হতো। প্রায় সময় বলতে প্রতিমাসই বলা চলে।

১০.
আজকে হাইওয়েতে গাড়ি তেমন নেই। আমি বামহাতে রাখা ঘড়িটায় তাকালাম। তিনটা বাজতে নয় মিনিট সময় বাকী। হঠাৎ করেই একটা বাস আমাদের গাড়িতে পেছন থেকে ধাক্কা মারে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সবকিছু ঘটে গেল। আমার মাথাটা হুমড়ি খেয়ে স্টিয়ারিংটায় আঘাত করলো। রাফিনের কপালের দিকটা থেকে রক্ত বের হচ্ছিল। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম, প্রবল ইচ্ছা নিয়ে তাকে ধরতে চাইলেও উঠার শক্তিটুকুও ছিল না। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে ঐ দৃশ্যটা জীবনে কোনদিন দেখবো বলে আশা করিনি। তূর্ণার মাথা থেকে প্রচন্ডরকম রক্ত বের হচ্ছে। টকটকে লাল রক্ত।
কিছুক্ষনের মধ্যেই মানুষজন এসে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে গেল। তূর্ণার ডানহাতের মেহেদীর রঙটা আরও গাঢ় হয়ে গেছে। আমি শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলাম, মেহেদীর আলাপনাটা কেমন হয়ে গেছে! টকটকে লাল রঙের আবেগ দিয়ে রঙিন হয়ে গেছে চারপাশ।

১১.
হঠাৎ করেই রাফিনের ডাকে আমার ঘুম ভাঙে। আমার পুরো শরীর ঘামে ভেজা। বুঝলাম সবকিছুই স্বপ্ন ছিল। বিছানার পাশে ছোট টেবিলটায় রাখা পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে তূর্ণার বালিশটার দিকে তাকিয়ে কেমন শূন্যতা অনুভূত হলো।

বেডের পাশে দাড়ানো রাফিন বলে উঠলো,
"বাবা, আজকে তো আম্মুর মৃত্যবার্ষিকী। কবরস্থানে ফুল দিতে যাবে না?"

ছবি- গুগল
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৩:১৫
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দিশ হারা

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:২২

তোয়াত্তন আ`‌রে কেন লা‌গে?
গম লা‌গে না হম লা‌গে?
রাই‌ক্কো আ‌রে হোন ভা‌গে
ফেট ফু‌রে না রাগ জা‌গে?

তোয়া‌রে আত্তন গম লা‌গে
ছটফড়াই আর ডর জাগে
ছেত গরি হইলজা ফাড়ি
হইবানি হোন মর আগে।

হোন হতার হোন ইশারা
ন'বুঝি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। VF 3 Mini: মাত্র 60 মিনিটে 27 হাজার বুকিং!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২১ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:০৪



আমার ব্যাক্তিগত গাড়ি নেই কিন্তু কর্মসূত্রে বেঞ্জ , ক্যাডিলাক ইত্যাদি ব্যাবহার করার সুযোগ পেয়েছি । তাতেই আমার সুখ । আজ এই গাড়িটির ছবি দেখেই ভাল লাগলো তাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

খাদ্য পন্যের মান নিয়ন্ত্রন

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ২১ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১২

মশলা প্রস্তুতকারী কিছু ভারতীয় সংস্থার মশলায় ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান পাওয়া গিয়েছে।সম্প্রতি এমনই তথ্য প্রকাশ্যে এনেছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘সেন্টার ফর ফুড সেফটি’। সংস্থা জানিয়েছে, ভারতীয় বাজারে জনপ্রিয় বেশ কিছু সংস্থার মশলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ময়লাপোতার কমলালেবুর কেচ্ছা!! (রম্য)

লিখেছেন শেরজা তপন, ২১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৩


বাংলাদেশের বিশেষ এক বিভাগীয় শহরে ময়লাপোতা, গোবরচাকা, লবনচোরা, মাথাভাঙ্গা, সোনাডাঙ্গার মত চমৎকার সব নামের এলাকায় দারুণ সব সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাস।
আমার এক বন্ধুর আদিনিবাস এমনই এক সম্ভ্রান্ত এলাকায় যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাময়িক পোস্ট: বন্ধ হয়ে গেল সচলায়তন

লিখেছেন করুণাধারা, ২১ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


বন্ধ হয়ে গেল সচলায়তন! view this link

সামহোয়্যারইনব্লগ থেকে কয়েকজন ব্লগার আলাদা হয়ে শুরু করেছিলেন সচলায়তন বা সংক্ষেপে সচল ব্লগ। এটি বন্ধ হবার মূল কারণ উল্লেখ করা হয়েছে দুটি:

১)... ...বাকিটুকু পড়ুন

×