বাংলাদেশের বিশেষ এক বিভাগীয় শহরে ময়লাপোতা, গোবরচাকা, লবনচোরা, মাথাভাঙ্গা, সোনাডাঙ্গার মত চমৎকার সব নামের এলাকায় দারুণ সব সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাস।
আমার এক বন্ধুর আদিনিবাস এমনই এক সম্ভ্রান্ত এলাকায় যার নাম 'ময়লাপোতা'! নাম শুনেই বোঝা যায় কোন এক কালে বাকি শহরের যত সব ময়লা-আবর্জনা ওখানে এনে পোতা হোত। ওই এলাকার মানুষ স্থানের নামে আদি ঐতিহ্য বজায় রেখেছে - এটা অবশ্য একটা ভাল দিক।
আমার ওই বন্ধুর পরিবারটি বেশ সৌখিন। তাঁর বাবা খুব নামী-দামী মানুষ, নাম বললেই ব্লগের অর্ধেক মানুষ চিনে ফেলবে; তাই নাম পরিচয় উহ্য থাকুক। তাঁর বাবা আট ভাই-বোনের বড়। যেমন শিক্ষিত তেমন গুনী- এইসা তেজী ও একগুঁয়ে। তাঁর কথায় একরকম পুরো পরিবারের বাঘে-মহিষে একঘাটে জল খায়। ওদের তিনতলা বাড়ি- বাড়ির ছাদে সৌখিন বাগান করা হয়েছে, শুরুটা হয়েছিল সেই বছর বিশেক আগে। তখন সৌখিন বাগান নিয়ে বেশ বড় রকমের একটা উত্তেজনা ছিল। তবে এই ঘটনাটা ১২/১৩ বছর আগের।
চায়না থেকে চায়নিজ কমলা খেয়ে এসে তাঁর বড় ভাই এর গল্প শুনে আমার বন্ধু ঢাকার বৃক্ষ মেলা থেকে একটা চায়নিজ (ম্যান্ডারিন) কমলালেবুর চারা কিনে নিয়ে ময়লাপোতার ছাদে নিয়ে রোপন করল। এই খবর সেদিনই ময়লাপোতা থেকে ঝালকাঠি ওর নানার বাড়ি হয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট আর স্টুর্টগার্ডের অলিগলি হয়ে ভ্যাঙ্কুভার তক এই খবর ফেসবুক আর ম্যাসেঞ্জার মারফর পৌছে গেল! তাদের নানা-দাদা বাড়ির সবাই ছোট বড় খবর নিয়েও রমরমা উত্তেজনা নিয়ে থাকে সবসময়। মানুষ এত আবেগ উত্তেজনা সারাক্ষন ধরে রাখে কেমনে এইটা আমাদের মাথাতেই আসত না কখনো।
কমলা লেবুর গাছ বড় হচ্ছে আর তাঁর নিয়মিত আপডেট চলে যাচ্ছে সবখানে।
প্রথম যখন ফুলের কুড়ি থেকে ফল হল তখন তা দেখে দেশে গিয়ে আমার বন্ধু উত্তেজনায় প্রায় কেঁদেই ফেলল। শতাধিক এঙ্গেল থেকে ছবি আর ভিডিও করে সবাইকে শেয়ার করেও উত্তেজনা যেন প্রশমিত হচ্ছিল না।
এমনিতেই ওর মা বাবা আর ভাবি সকাল বিকাল ওই গাছের বিশেষ যত্ন আত্মি করে প্রতিদিন। ফল আসার পরে সেটা যেন বেড়ে গেল কয়েকগুন! ফল একটু একটু করে বড় হচ্ছে আর চারিদেকে সবার উত্তেজনা বাড়ছে। ঢাকার বাজারে তখনো চায়নার কমলা আসেনি-তাই আশে পাশের কেউ বেড়াতে আসলেই তাঁকে বিশেষভাবে ওই গাছ প্রদর্শন করানো হয়।
প্রতিটা দর্শনার্থীই দারুণ আপ্লুত হয়, অবাক বিস্ময়ে গাছ আর ফল দ্যাখে।
কমলালেবু বড় হয়ে একসময় হলদে রাঙ্গা হয়। প্রতিদিন ময়লাপোতার বাসা থেকে বন্ধুর ভাবি ছবি তুলে আপডেট দিচ্ছে। বন্ধু ঢাকায় বসে ভীষন এক্সাইটেড। সাতটা মাত্র কমলালেবু গাছে আছে- শতাধিক আত্মীয়স্বজনের মাঝে এইগুলো কেমনে ভাগ হবে এই নিয়ে দিনরাত ফোনে আর ম্যাসেঞ্জারে আলোচনা চলে। এছাড়া ওদের বন্ধুবান্ধবও কম নয়। নিজেদের কমলা খাওয়া ভাগ্যে হয় কি না আল্লা জানে- কোন দিকে কে গোস্যা করে বলা মুশকিল। অবস্থা এমন বেগতিক যে, ওর বড় ভাই পরামর্শ দিল; চায়না থেকে দুইমন কমলা এনে বিলিয়ে দিতে।
ওদিকে কমলালেবুর একেবারে কমলা রঙ ধরেছে-দু-চারদিনের মধ্যেই সেটা খাওয়া যাবে মনে হচ্ছে। আমার বন্ধুর উত্তেজনা এমন যেন মঙ্গলগ্রহে প্রথম কমলার ফলন হচ্ছে!
এমন দিনে ফজরের নামাজের পরে ওর মায়ের ফোন। ঘুম চোখে ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে আর্ত কন্ঠে মায়ের চিৎকার, কমলাতো সব চোরে নিয়ে গেছে!!!
এ যেন মৃত্যু সংবাদের থেকেও ভয়াবহ দুঃসংবাদ। সঙ্গে সঙ্গে এই ভয়াবহ দুঃসংবাদ ময়লা পোতা থেকে ঝালকাঠি হয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট আর স্টুর্টগার্ডের অলিগলি হয়ে ভ্যাঙ্কুভার তক ফেসবুক আর ম্যাসেঞ্জার মারফত পৌছে গেল! চারিদিকে শোকের ঢল।
বন্ধুর বাপের শুরু হোল ব্যাপক হুমকি ধামকি- তিনি ডিসি এসপিকে জড়ো করে ফেললেন। সবাই ফোনে স্যার স্যার বলে ভীষন দুঃখ প্রকাশ করে চারিদিকে খোঁজ দ্যা সার্চ শুরু করে দিল। ওসি তাঁর দল-বল নিয়ে এলাকা রেকি করেও গেল।
অনেক অনুসন্ধান করে পুরো ময়লাপোতায় সেই চায়নিজ কমলা লেবুর খোঁজ আর পাওয়া যায়নি সেদিন।
*** পরদিন ফজরের নামাজের পরে বন্ধুর মা ফের ছাদে উঠেছে অভ্যাস মত একটু মর্নিং ওয়াক আর ছাদ বাগানটা দেখার জন্য। আজ তাঁর মনটা বেজায় খারাপ। ছেলেটা এত সখ করে কমলা লেবুর গাছ লাগালো- কত সপ্ন ছিল, একটা কোয়া লেবুও খেতে পারল না। মন খারাপ করে বাগানে হাটতে হাটতে হঠাত তাঁর নজর গেল ছাদের কার্নিশে বলের মত কি যেন লাইন ধরে সাজিয়ে রাখা। কাছে যেতেই দেখেন, সেই চায়নিজ কমলা একটা খেয়ে ছয়খানা চোরে মায়া করে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। আহারে কি দরদী চোর- খুশীতে তাঁর চোখে জল এসে গেল। কমলাগুলো কুড়িয়ে আনতে গিয়ে দেখেন একটা কমলার নীচে ছোট্ট একটা চিরকুট।
সেই চিরকুটে লেখা ছিল,
"কোন শালার ছাওয়াল এই কমলার গাছ লাগাইছে ..."
আমার সেই বন্ধু মারফত জানা গেছে, ওই কমলা যে টক ছিল-দুনিয়াতে নাকি এমন টক লেবুর জন্ম হয় নাই।
আমার সেই বন্ধুর বড় ভাই, ওকে ফোন করে বলেছিল-
"এ-ই শোন তুই কিন্তু ভুল কইরেও কইস না যে, তুই এই কমলার চারা আনিছিস। আব্বা সকাল থেকি আমারে কয়েকবার জিজ্ঞেস করিছে। আমি কইছি, চায়নার বাঙ্গাদেশী এম্বাসেডর আমার বন্ধু পাঠাইছিল মনে হয়। সে কিন্তু বিরাট খ্যাপা। তুই আনিছিলি শুনলি তোরে বাড়িতে আসা বন্ধ করি দিবিনে।"
***
ছবিঃ ২০০৮ সালে চায়নার কুনমিং থেকে তোলা।