somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ক্যাম্পাসের দিনগুলি: ছাত্ররাজনীতি, যেমন দেখেছি আমি

০৯ ই অক্টোবর, ২০১৯ বিকাল ৫:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্ব- ছাত্র রাজনীতি, যেমন দেখেছি আমি
তখন ঠিক কোন সেমিস্টার মনে নেই। বড় হলে অ্যালটমেন্ট দিয়েছে। শিবিরের সাথে সম্পৃক্তদের হলের গেট থেকে বের করে দেয়া হল। ছাত্রলীগের এক কথা, এ হলে ওরা সিট পাবে না। অন্য সবার সাথে আমিও ফর্ম জমা দিলাম। সিজিপিএ একটু কম ছিল, তবে হলে অনেক সিট থাকায় ধরেই নিয়েছিলাম তালিকায় নাম আসবে। কিন্তু বিধি বাম, নাম আসলো না। আমার মতো আরো অনেকের নামও সেদিন আসেনি। সবচেয়ে বেশী অবাক হলাম সিট বন্টন দেখে, সিভিলের ছাত্ররা অনেক বেশী সিট পেয়েছে(ওদের মধ্যে নেতার সংখ্যা বেশী)। অথচ এদের অনেকে ওয়েটিং লিস্ট থেকে ভর্তি হয়েছে, আমাদের চেয়ে গ্রেড পয়েন্টও কম। আসন বন্টনে এমন বৈষম্য আর রাজনৈতিক প্রভাব দেখে বেশ মুষড়ে পড়লাম।

এদিকে যারা সিট পায়নি তাদের অধিকাংশই লীগের ছেলেদের ধরে গোপনে গোপনে সিট ম্যানেজ করে নিল। বিষয়টা বুঝতে পেয়ে এক বন্ধুর সাথে এ নিয়ে কথা বললাম। ও এমনভাবে বললো যেন কয়েক ঘন্টা আগে বললেই সিট ম্যানেজ করে দিতে পারতো। হলের সহকারী প্রভোস্ট কিছুটা পরিচিত ছিল, একবার ভাবলাম স্যারকে গিয়ে রিকোয়েস্ট করবো; আরেকবার ভাবলাম ছাত্রলীগের নেতার কাছে যাব। পরে জিদ চাপলো, সিজিপিএ একটু কম বলে এর ওর পা ধরতে হবে! সালার ক্যাম্পাসেই থাকবো না, বাইরে থাকবো। আমার মা বাবা নিয়ম করে নৌকাতেই সিল মারে, কিন্তু ছাত্ররাজনীতি যা দেখেছি তাতে ওদের সাথে জড়ানোর রুচি হয় নি।
সিজিপিএর জন্য নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিলাম, আরেকটু পড়াশোনা করলে তো এ পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। বন্ধুরা সব চলে যাবে আর আমি একা থাকবো ভেবে মানসিকভাবে বেশ ভেঙে পড়েছিলাম।

সবাই নতুন হলে ওঠা শুরু করলো। এ হলের দোতলা পলিটিক্যাল ব্লক, লটারিতে যারা দোতলায় সিট পেল তাদের অধিকাংশকে যেতে হল নীচতলায় বা তিনতলায়। আর যারা পলিটিক্যালি উঠেছে তারা সিট পেল দোতলা(কর্মী) ও তিনতলার(সমর্থক) কিছু রুমে। যেভাবেই হোক আর যে তলায় হোক, রুম অন্তত পেয়েছে এই ভেবে হলের সবাই খুশি হল। এদিকে আমার ভেঙে পড়া দেখে এক রুমমেট তার নিজের সিটে আমাকে উঠতে বললো। কিছুটা সংকোচ বোধ করলেও ওর সিটেই উঠলাম। এই সময় এক মজার ঘটনা ঘটেছিল, আমি উঠেছিলাম রুবেলের সিটে, রুবেল উঠেছিল জামির সিটে আর জামি আমার সিটে। আমরা তিনজন তিন হলে উঠলাম, আপোষে।


আমাদের রুম ছিল তৃতীয় তলায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই চোখে পড়ে দেয়ালে লেখা নানা সিরিজ আর ডিপার্টমেন্টের নাম, এছাড়া শিবির শব্দ লেখা। মনে মনে ভাবলাম, এক সময় হয়তো এরা দাপটে ছিল, আজ বিতাড়িত। কিছুদিন পর দেখি এসব লেখা মুছে দিয়ে নানা শব্দ লেখা, এর মধ্যে অন্যত্তম ছিল "মগের মুল্লুক"। লেখাটা পড়ে খুব মজা পেয়েছিলাম।
শব্দটির অবস্য যৌক্তিকতা ছিল। আমরা খেতাম ডাইনিং রুমে, কিন্তু ডাইনিং বয়কে প্রায় দেখতাম বক্সে করে ছাত্রলীগের রুমে খাবার দিয়ে আসছে। নেতাদের জন্য স্পেশাল রান্না হতো। ওরা ফ্রী নাকি টাকা দিয়ে খায় কখনো জিজ্ঞেস করিনি। তবে লীগের এক পাতি নেতাকে দেখতাম ডাইনিং রুমে এসে খায়, কিন্তু কখনো কুপন দেয় না। ওদের জন্য বাটি তুলে রাখা হতো। মিথ্যে বলবো না, আমি নিজেও কয়েকবার কুপন ছাড়া খেয়েছি। সেটা জোর করে নয় অনেকটা লুকিয়ে। আবার অনেকদিন এমনও হয়েছে কুপন কেটেছি অথচ খেতে পারিনি। টিউশনি শেষে এসে দেখতাম খাবার শেষ/গামলার তলায় ভাত পড়ে আছে। আবার বেশী রাত করে ফিরলে দেখতাম ডাইনিং রুমে তালা দেয়া। অনেক দিনই এমনটা ঘটেছে। তাই এসব নিয়ে আফসোসও নেই।

আমাদের মিল চলতো দুবেলা। আগে থেকে কুপন না কাটলে খাবার বেশী থাকা সাপেক্ষে নগদ টাকা দিয়ে খাওয়া যেত। একসময় এই হলের খাবারের খুব সুনাম ছিল, আমরা অন্য হল থেকে এখানে খেতে আসতাম। কিন্তু দিন দিন খাবার খারাপ হতে লাগলো। পরে কুপনের দাম বাড়ানো হল। কিছু দিন খাবার বেশ ভালো ছিল কিন্তু পরে যেই কার সেই। খেতে বসলে এ নিয়ে অনেকের সাথেই কথা হতো, কিন্তু এক যোগে কোন প্রতিবাদ করা হয় নি। পরে আমরা কয়েকজন মিলে বাইরে থেকে খাবার এনে খেতাম। টাকা বেশী লাগলেও খাবার ভালোই ছিল।


........ .....

অবাক হয়েছিলাম আরেকটা ঘটনায়। হলে ওঠার কয়েকদিন সপ্তাহ পর, আমাদের সহকারি প্রভোস্ট এক্স রুমমেটকে জানায় কয়েকটা সিট ফাঁকা আছে, তোমাদের কেউ চাইলে উঠতে পারো। অফিস রুমে সেই সিট দেখতে গিয়ে দেখতে পেলাম আমার এক স্থানীয় ক্লাসমেটের নাম। ওর সিজি আমার চেয়েও কম। ঘটনা হল: সে শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যানের ছেলে। সিট দেবার দিন প্রভোস্ট স্যারকে ফোন করে পরিচয় দিয়ে একটা সিট রাখতে বলে। ওই বন্ধু অবস্য কখনোই হলে ওঠে নি, আমাদেরই কেউ না কেউ ওর সিটে থেকেছে, ভাড়া দিয়েছে।

গরমের সময় বুঝতে পারলাম ছাত্রলীগ কেন দোতলায় থাকে। দুপুর থেকে রাত ৯-১০পর্যন্ত রুম একেবারে উত্তপ্ত হয়ে থাকে। কষ্ট হলেও অন্য সবাই দিব্যি মানিয়ে নিল। কিন্তু আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। না হচ্ছিল ঠিকমত ঘুম না পড়াশোনা, দিনে কয়েকবার গোসল করেও ঠিক থাকতে পারছিলাম না। ক্লাস না থাকলে দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত নীচতলার এক বন্ধুর রুমে অথবা লাইব্রেরীতে কাটাতাম। কিন্তু এভাবে আর কত? পরে ক্যাম্পাসের পাশে এক মেস নিলাম। আর যাই হোক ঘুমটা অন্তত ঠিকমত হতো। এদিকে মেসে ডিপার্টমেন্টের কেউ না থাকায় বেশ সমস্যায় পড়লাম। কয়েকমাস পর আবহাওয়া ঠান্ডা হল, মেস ছেড়ে হলে আসলাম। এই হল মেস করতে গিয়ে সেমিস্টারটা খারাপই হয়ে গেল।

ফোর্থ ইয়ারে কয়েকটা রুম ফাঁকা হল। ফরম উঠালাম। সিট বরাদ্দের আগেই দেখি যে যার মত রুম(খালি) দখল করছে। নোটিশবোর্ডে এবার রোল আর টাঙায় নি। আবার কয়টা সিট ফাঁকা আছে সেটাও বুঝতে পারছি না। সিট দেবার দিন স্যারেরা অনেক পরে হলে আসলো, কয়েকজনকে রুম দেবার পর জানালো, "আজ এখানেই শেষ, বাঁকিদের আগামিকাল দেয়া হবে।" সন্ধ্যা হতে দাঁড়িয়ে এমন কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে গেল। মনে মনে ঠিক করলাম, কাল যদি সিট না পাই, হয় স্যারের মাথা ফাটাবো নয়তো ছাত্রলীগের কারো।
না, শেষ পর্যন্ত কারো মাথাই ফাটাইনি। আমাদের সবারই সিট হয়েছিল। তবে ওই সিটে উঠিনি, মিজান উঠেছিল। হলে যে কয়টা বছর ছিলাম ভাড়া ঠিকই দিয়েছি, কিন্তু নিজের রুমে থাকা হয় নি।

শেষ হোস্টেলর লীগ ছাড়া কোন দল ছিল না, তাই তেমন ঝামেলা হয় নি। তখন ছাত্রলীগের দুটো গ্রুপ ছিল, অাধিপত্য বিস্তারের জন্য দু-একবার টুকটাক লেগেছিল। তবে মিছিল হতো প্রায়ই। যারা রাজনৈতিক সাপোর্টে উঠেছিল তাদের অনেকেই মিছিলে যেত, আবার অনেকে নানা ওযুহাতে যেত না, অনেকে আবার মিছিলের সময় হলে লুকিয়ে থাকতো বা হলে থেকে চলে যেত। মজা পেতাম ভেবে, আওয়ামিলীগের জায়গায় বিএনপি যদি ক্ষমতায় থাকতো এরা কি তাহলে সেই দলের পক্ষ নিয়ে হলে উঠতো? হয়তোবা।

রাজনীতির জন্য বিএসসি শেষ করতে কয়েক মাস বেশী লেগেছিল। ক্যাম্পাস ছেড়ে যখন আসি, নেতাদের(বেশীরভাগ) নামের পাশে তখন হালি হালি ব্যাকলগ। সার্টিফিকেট পেতে ওদের আরো কয়েক মাস/বছর লাগবে। একটা বিষয় লক্ষ করেছি, ছাত্রনেতাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই বড় পদ পায়, পরবর্তী সময়ে লাভবান হয়। বাঁকিরা হয় বলির পাঁঠা(ক্যাম্পাস লাইফটা হয়তো দাপোটে কাটায় কিন্তু পরে অবহেলিত থেকে যায়।) মাঝেমাঝে ভাবি, যে রাজনীতির জন্য কাছের বন্ধু দুরে সরে যায়, এডমিশনে পজিশনে থাকা ছেলেটা পাশ করতে হিমশিম খায়, ক্যাম্পাসে অশান্তি বাড়ে সেই রাজনীতির কোন দরকার আছে?
বন্ধ হোক ছাত্ররাজনীতি, মুক্তি পাক ছাত্রসমাজ।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০১৯ দুপুর ১:৫৩
১২টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×