হাইস্কুল পর্যন্ত রাজনীতির কোন বালাই ছিল না। এএসসি পাশ করে যেই না কলেজে ভর্তি হলাম, শুরু হল ছাত্র রাজনীতির দৌরাত্ব। প্রায় প্রতিদিনই মিছিল হতো। অনার্সের ছেলেরা নেতৃত্ব দিত বাঁকিরা স্লোগান ধরতো, ক্লাস না থাকলে আমাদের ব্যাচেরও অনেকে মিছিলের পেছনে লাফাতো। মিছিলে অলিখিত একটা নিয়ম ছিল: মিছিল শুরু হলে সামনে থাকা যাবে না। তাই মিছিল দেখলে আমরা ক্লাসে ঢুকে যেতাম। একদিন মিছিল দেখে গণিতের স্যারের রুমে ঢুকে গিয়েছিলাম। স্যারেরা সেই সময় ক্লাসে থাকলে দরজা বন্ধ করতে বলতো, পড়ানো বন্ধ রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়েথাকতো। আর হোস্টেলের নিয়ম হল: হলে থাকলে মিছিলে যেতে হবে। ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে এক নেগেটিভ ধারণা নিয়ে কলেজ জীবনটাতাই মেসেই কেটেছে।
অ্যাডমিশনের পর সরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। আমার ধারণা ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটিতে রাজনীতি কম। কিন্তু ভর্তি হয়ে দেখলাম পরিস্থিতি ভিন্ন।
ভার্সিটিতে ক্লাস শুরু হয়েছে এক সপ্তাহও হয়নি। র্যাগ দিতে ইমিডিয়েট সিনিয়ররা হলে নিয়ে গেল। মানসিক নির্যাতন শেষে এক ভাই আরেক হলে নিয়ে গেল। দোতলায় ছাত্রলীগ ব্লকে এক ভাইয়ের রুমে যাই। সে ছাত্রলীগ নেতা, আমাদেরই জেলার। সেদিন বেশ অমায়িক দেখেছি ভাইকে। প্রথম দেখায় ভালোই লেগেছিল। আমাদের সাথে অনেক্ষণ গল্প করলো, ক্যাম্পাসের মাঠে গিয়ে বাঁকিতে বরই খাওয়ালো, সবার সাথে মিলে চলতে বললো, রাজনীতির দিকে না এসে যেন ঠিকঠাকমনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করি সেটাও বললো। পরে অবস্য এক ছাত্রকে খুনের ঘটনায় তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, তারপর জেল টেল হয়েছিল কি না জানা হয় নি। আমি এখনো ভাবি, অমন অমায়িক ছেলেটা খুনও করতে পারে/খুনের সাথে জড়িত থাকতে পারে!
তখন সবে ২য় বর্ষে উঠেছি। রোল অনুসারে হলে সিট দেয়া হল। আমার রোল একটু পেছনের দিকে থাকায় সিট পেলাম না। উপায় না দেখে স্থানীয় এক বন্ধুর সিটে উঠলাম। সেই হলে ছাত্ররাজনীতির প্রভাব তেমন ছিল না, তবে শাখা ছিল। চশমাপরা ফর্সা চেহারার চুপচাপ স্বভাবের একজনকে জানতাম, সে ছাত্রদল করে। অবস্য তাকে কখনোই প্রকাশ্য কিছু বলতে/করতে দেখিনি। মোটাগাটা চেহারার আরেকজনকে জানতাম সে ছাত্রলীগ করে। ওর রুমে সিগারেটের কড়া গন্ধ পাওয়া যেত। হলের একটা রুমে শিবিরের লাইব্রেরি ছিল। কিছুটা গোপনে। শিবিরের ছাত্রদের আমি দুটো ক্যাটাগরি পেয়েছি। একটাইপ লেখাপড়ায় বেশ ভালো, ধার্মিক, ভদ্র; আরেক টাইপ পড়ালেখায় পিছিয়ে, ধর্ম তেমন মানেনা, কিছুটা উগ্র।
....
সেকেন্ড ইয়ারে নিজের নামে সিট পেলাম। নিয়তির কি খেল, লটারিতে সিট পড়লো ছাত্রলীগ ব্লকে। প্রথা অনুযায়ী রুমে ওঠার আগে ছাত্রলীগের এক ক্লাসমেট আমাদের কয়েকজনকে ডেকে বললো, "দোস্ত তোদের সিট তোআমাদের ব্লকে পড়েছে। (আমাদের ব্লকে এটা ওটা হবে)তোরা ভালো ছেলে, ওখানে থাকতে সমস্যা হবে। নীচে এক রুম ফাঁকা আছে। তোরা ওখানে থাক।" ধমক নয়কথাগুলো রিকোয়েস্ট সুরেই ছিল। এক রুমমেট একটু প্রতিবাদ করলো, নিজের রুম ছেড়ে নীচের স্যাঁতস্যাঁতে রুমে কেন যাব বলে। পরে শুনলাম আমাদের রুমে উঠবে আমার সেকশনেরই কিছু ছেলে। কথানা বাড়িয়ে রাজি হয়ে গেলাম[রাজি না হয়ে উপায়ও ছিলনা, আর হল প্রভোস্টকে বললেও লাভ হতো না]। নীচতলার রুমটা একটু স্যাতস্যাতে, আলো বাতাসও কম, তবে মন্দ না। ভালো দিক হল গরমকালে বেশ ঠান্ডা থাকে, আবার এখান থেকে ডাইনিংরুমও কাছে। এছাড়া পেপার রুম, গেস্টরুম, টিভিরুম সবই নীচতলায়।
হলের দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিল। তবে মাঝেমধ্যে সন্ধ্যা রাতের দিকে হঠ্যাৎ ককটেলের আওয়াজ পাওয়া যেত। প্রথমদিকে চমকে যেতাম, ভেতরটা কেঁপেউঠতো, পরে গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। প্রায়ই ভাবতাম এটা নিয়ে প্রভোস্ট স্যারকে বলবো, পরে আর বলি নি।কি দরকার উটকো ঝামেলা করার? অন্য সবার যদি এতে আপত্তি না থাকে, আমি কেন কালার হতে যাব? আর হলে যে এসব হয়, প্রভোস্ট স্যার সেটা আমার চেয়েও ভালোজানে। একবার পুলিশ হলে সবার রুম চেক করেছিল, আমাদের সাথে কথা বলে দরজা থেকে চলে গিয়েছিল। এই হলের সবাই একই ব্যাচের ছিলাম। ছাত্রলীগের রুমগুলোর সামনে দা, বটি আর পিস্তলের ছবি(আঁকা) ছাড়া কারো সাথে ঝামেলা হতে দেখি নি, শুনিও নি। [হলে শিবির বা ছাত্রদলের কোন তৎপরতা চোখে পড়েনি]
ছাত্রলীগ দিয়ে একেবারে যে লাভ হয়নি তা নয়। বিশ্বকাপ উপলক্ষে কমন রুমে আমরা নতুন টিভি চাইলাম। প্রভোস্ট স্যার তো রাজি হয় না, পরে ছাত্রলীগের দাবী মুখে স্যার টিভি দিয়েছিল। টিভির দাম বাবদ সেজন্য অবস্য প্রতিমাসে হলভাড়ার সাথে অতিরিক্ত ২০টাকা দিতে হত। আবার নানা ছুতোয় ক্লাসটেস্ট বা পরীক্ষা পেছাতে হলে ছাত্রলীগ অন্যত্তম ভূমিকা পালন করতো।
চ ল বে.....
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০১৯ দুপুর ১:৩৮