তামান্না কিছুটা চিন্তিত। চুলোতে গ্যাস বলতে গেলে নেই। ভাত বসিয়ে দিয়েছে। বাকি সব গরম করা শেষ। বিশেষ একজনের আসার কথা আজকে। মেন্যু খুব সামান্য। ফ্রিজে মুরগি রান্না আর ডাল চচ্চড়ি ছিল। অল্প সময়ে আর কিছু করা হলনা। ডাল টক হয়ে গেছে কিনা এটা নিয়ে তামান্না কিছুটা ভয়ে ছিল! যাক হয়নি।
অবশ্য যে মানুষটার খেতে আসার কথা সে এতো কিছু বাছ বিচার করেনা। দেখা গেল সামান্য একটু ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলবে, "একটা কাঁচা সুপারি দিয়ে পান খাওয়াতে পার!" তামান্নাদের বাসায় পান থাকেনা। এখানে পান খাওয়ার মত লোক নেই। মানুষটা জানেও। কিন্তু তারপরও এরকম হুটহাট চলে আসে। কিছু না বলেই। তামান্না সাবধান হয়ে গেছে। পান আনিয়ে রেখে দিয়েছে ফ্রিজে। কিন্তু আর চায়নি সে। কি অদ্ভুত! নিজে থেকে সেঁধে দেয়া যায় নাকি? আজ কি মনে করে আগেই জানিয়ে দিয়েছে। তামান্নার খারাপ লাগছে একটু। কোনবারই ভাল কিছু দিতে পারেনা সে। খিচুড়ি রান্না করতে পারতো। কিন্তু গ্যাসের যে অবস্থা। এখন একেবারে ল্যাদল্যাদে হয়ে যাবে। সেবার এক আন্টির বাসায় গিয়েছিল। তারা সকালে একধরণের ল্যাদল্যাদে খিচুড়ি খায়। তামান্না অল্প খেয়ে বাথরুমে যেয়ে থু করে ফেলে দিয়েছে। আরেকটু হলে বমি করে দিত।
তামান্না অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারী করছে। গ্যাসের শিখা তিড়তিড় করে কাঁপছে। ভাত ফুটতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে? একটু চোখে কাজল দিয়ে নিতে পারত। কিন্তু যেতে সাহস পাচ্ছেনা। যদি পুড়ে যায়।
"কিরে! এমন করছিস কেন?"
মা এসে দাঁড়িয়েছে রান্নাঘরে।
“কিছুনা!” তামান্না অস্থিরতা চাপা দেবার চেষ্টা করে। ভ্রু জোড়া সমান করার চেষ্টা করছে।
কলিং বেল বেজে উঠলো। নিঃশ্বাস পড়ছে দ্রুত! তামান্না প্রাণপণে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে... কিন্তু.... সে এগিয়ে যায়না। ছুটে যেয়ে দরজা খুলে দেয়ার একটা ছেলেমানুষি ইচ্ছে প্রাণপণে দমন করে সে। অনেক বড় হয়েছে। তার এক ছোট চাচা বাইরে থাকে। অনেক বছর পরে এসে তামান্নাকে দেখে অবাক হয়ে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। মা কানে কানে বলায় তামান্না সালাম করে কি করবে বুঝতে না পেরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। চাচা তামান্নার মাথায় হাত বুলিয়ে ভেজা স্বরে বলতে লাগলেন, " তোকে কোলে নিয়ে কত আদর করেছিরে মা!" এখন এত্ত বড় হয়ে গেছিস। বলেই ছেলেমানুষের মত হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। তামান্না বড় হয়ে গেছে এটার জন্য হাউমাউ করে কাঁদার কিছু নেই কিন্তু তারপরও তামান্নারও চোখে পানি চলে আসে। দুঃখের সিনেমা বা প্রেমের উপন্যাস পড়ে কেঁদে বুক ভাসানো তামান্নার বহু পুরনো অভ্যাস! এরপরেও তামান্না আরেকদিন বুঝতে পেরেছিল সে বড় হয়ে গেছে। কিছুদিন আগে গ্রামে গেল। খালাতো বোনের সাথে পেয়ারা পেড়ে খাওয়ার জন্য সে গাছে উঠতে গেলেই খালা এসে চোখ পাকিয়ে শুধু বলেছিল, " তুই এখন বড় হয়ে গেছিস!"
বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে তামান্না! মা গেছে দরজা খুলতে! সে জানে রান্না ঘরে কেউ এসে এই মুহূর্তে উকি দিবেনা। অথচ তার কাছে মনে হচ্ছে দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ঐ মানুষটা হেঁটে সোজা এখানে চলে আসবে। মানুষটা কেমন চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। যেন খবরের কাগজ খুলে বসেছে। একবারে যেন ভেতরটা পর্যন্ত পড়তে পারে। তামান্নার আড়ষ্ট লাগে বড়। কিন্তু এই আড়ষ্টতার মধ্যে একটা ভাল লাগা আছে। তামান্না বুঝতে পারে সেটা। কিন্তু কাউকে বোঝাতে পারেনা। তার সবচাইতে ভাল ফ্রেন্ড সায়েমকেও না।
সাধারণত মেয়েদের সবচাইতে ভাল ফ্রেন্ড হয় মেয়ে। তামান্নার ক্ষেত্রে উলটো। সায়েম তার খুব ভাল ফ্রেন্ড। ক্লাসে তারা পাশাপাশি বসে। কিছুদিন আগে যমুনা ফিউচার পার্কে গিয়েছিল। বাইরের রাইডগুলো ভয়ঙ্কর। একটাতে চড়েই তামান্নার মাথা ঘুরে উঠে। সায়েমকে বারবার বলেছে বাসায় চলে যাবে। কিন্তু সায়েম জোর করে ভেতরে নিয়ে গেল। বেশীরভাগ দোকান এখনো খোলেনি। কিছু কিছু অর্ধেক মত খুলেছে। উপরের ফুড জোনে খাবার মত কিছু দোকান আছে। একটা বার্গার নিয়ে আধখাওয়া অবস্থায় উঠে গেছে সে। সায়েম পুরোই বিরক্তিকর একটা ছেলে।
ঢং ঢং করে ৩ টা বাজলো! টেবিলের একপাশে বসে আছে সে। প্লেটে ঢাকা দেয়া খাবার। ভাতের উপর প্লেট দিয়ে ঢাকা। চট করে একটা ডিম ভাজি করার বুদ্ধি মাথায় আসলো। একটা ডিম ভাজতে বেশীক্ষণ লাগবেনা। তামান্না দৌড়ে যেয়ে ফ্রিজ খোলে। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে হাত থেকে ডিম পড়ে যায়। কুসুমটা একপাশ দিয়ে বের হয়ে সাদা অংশ সাদা মোজাইকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে তামান্না কাপড় আনতে ছোটে। কেউ দেখে ফেলার আগেই মুছে ফেলতে হবে।
তামান্নাদের বাসা ৫ তলায়! উপরের এক ইউনিট করা হয়েছে অন্য ইউনিটে খালি। বিশাল ছাঁদ। বাচ্চারা এখানে কুমির কুমির খেলে। তামান্নাকে বলেছিল কয়েকবার। তামান্না হেসে বাচ্চাদের গাল টেনে দিয়ে এড়িয়ে গেছে। একাকী থাকতে ভাল লাগে তার। তাদের বিল্ডিঙের পেছনে নারিকেল গাছ আছে! অদ্ভুত হলেও সত্যি একটা লিকলিকে সুপারি গাছও আছে। তামান্না ওখানে যেয়ে বসে থাকে। ছাদের রেলিঙ ভর দিয়ে সে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে।
মা বকা দিয়েছে অনেকবার। এখন আর দেয়না। তিনি বুঝতে পেরেছেন বকা দিয়ে লাভ নেই। তামান্না না জানিয়ে আরেকটা কাজ করে। রাতের দিকে ছাদে যায় ঘুরতে। একা একা হাঁটে। বিড়বিড় করে কথাও বলে। কেউ শুনলে নির্ঘাত পাগল ভাববে। এতো রাতে শুনবেই বা কে? তামান্না আপনমনে গুনগুন করে গান গায়। আর ফিসফিস করে কথা বলে।
-কার সাথে কথা বলে?
ঐ মানুষটার সাথে কথা বলে! মনে মনে বলে! কত কি যে কথা!
-কি কথা!
সেটা তো বলা যাবেনা।
আজ তামান্নার মন খারাপ। চমৎকার বাতাস দিচ্ছে। বাসায় ভ্যাপসা গরম লাগছিল। ফেসবুকে ছিল অনেকক্ষণ! পরে ভাল লাগছিল না তাই বেরিয়ে আসলো। বাংলাদেশে নাকি থ্রি-জি চালু হয়েছে। ইন্টারনেট স্পীড ভাল হওয়ার কথা। তা না হয়ে বরং আরো খারাপ হয়েছে। মাঝেই মাঝেই তার মোবাইলে নেটওয়ার্ক থাকেনা। একের পর এক এসএমএস আছে। এই অফার সেই অফার।
তামান্না ইন্টারনেট ঘেঁটে নতুন একটা মেন্যু নামাবে ভাবছে। কাউকে বলতে সাহস পাচ্ছেনা। পাতলা ডাল কিভাবে রান্না করতে হয় সে জানেনা। মাছের ঝোল, ভুনা, ভাজি, মুরগির ঝোল, রোস্ট, বিফ ভুনা, ঝোল, ডাল চচ্চড়ি, ভুনা, সবজির কয়েক পদ এভারেজ রান্না গুলো পারে। কিন্তু রুটি বানাতে গেলেই কেন যেন গোল না হয়ে চারকোণা হয়ে যায়। সব কিছু নাকি গুগলে সার্চ দিলে পাওয়া যায়! কি লিখে সার্চ দিবে তাই ভাবছে? How to cook plain dal? এরকম কিছু?
তামান্না কথা বলা শুরু করে। নিজে নিজেই! শুরুটা এরকম। “কি! আজকে আসলেনা!” কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজে থেকেই বলে, খুব ভাব হয়সে?” আবারো সব চুপচাপ! তামান্নার চুল খোলা। বাতাসে উড়ছে। চাঁদের আলো সামনের বিল্ডিঙে থাই গ্লাসে প্রতিফলিত হচ্ছে। বইয়ে পড়েছে পুকুরের পানিতে চাঁদ দেখা যায়। তামান্না জানালার কাঁচে চাঁদের প্রতিফলন দেখে। এতো ছোট লাগছে চাঁদটাকে। একটা আলোকবিন্দুর মত। পেন্সিল ব্যাটারির টর্চের মত।
মোবাইল বাজছে। পরিচিত নাম্বার। তামান্নার অভিমান হয় বড়। সে কল ধরবেনা। না দেখার ভান করে ঘুমিয়ে পড়বে। দুপুরে আসবে বলে আসেনি কেন? সারাটাদিন অপেক্ষা করিয়ে রাখার মানে কি! তার অপেক্ষা করতে খারাপ লাগেনা বুঝি।
উপসংহারঃ রাস্তায় পড়ে থাকা একটা মোবাইল! একজন পথিক মোবাইলটা পেয়ে ডায়েল লিষ্টের প্রথম নাম্বারটিতে ট্রাই করে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পথিক লক্ষ্য করে নো আনসার! সে আবার ডায়েল করে। এবারো কেউ ফোন ওঠালোনা। পথিক ভাবে এতো রাতে নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছে। পরবর্তী নাম্বার খুঁজে পথিক। কেউ না কেউ তো ধরবে। একজন না একজন জেগে আছে? অন্তত জেগে না থাকুক। ঘুম ভাঙ্গাতে হবে। এই মোবাইলের মালিকের কাছের কোন না কোন মানুষকে তো জাগাতে হবে।
(সমাপ্ত)
উৎসর্গঃ তামান্না হাবিব। তিনি একদিন আমাকে ইনবক্সে বলেছিলেন, "
"আমার কাছে শুভ্র ভাইয়ার লেখা পড়ে মনে হয় যে, বাস্তবটাকে ভাইয়া কল্পনা করতে শেখায়
আর আপনার লেখা পড়ে মনে হয়, কল্পনাটাকে আপনি খুব সতর্কতার সাথে বাস্তবে নিয়ে আসতে পারেন!"
কোনটা বেশি ভাল কে জানে?
ফেসবুক লিংক: এই অবেলায়- http://goo.gl/HPZkO0