স্যার,
সালাম কুশলাদির ধারে কাছে গেলামনা। চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছি। লেখার সময় কারো অভিব্যক্তি কেমন থাকে সেটা পাঠকের দেখার কোন সুযোগ নেই। অনুমান করতে হবে। ভাবছেন প্রচন্ড ক্ষুব্ধ কিংবা রাগে কিড়মিড় করা কোন হতভাগ্য যুবক লিখে যাচ্ছে একটানে। ব্যাপারটা সেরকম না।খুব ঠান্ডা মাথায় লিখছি। একটু আগে মোড়ের দোকান থেকে ভাত আর মুরগীর মাংস খেয়ে আসলাম। এক পিছ মুরগি, দুই পিছ আলু আর দুই প্লেট ভাত। ৪০ টাকা বিল। পানি ফাও! পয়সা লাগেনা। ঠেসে খেলাম। রাগ করবেননা স্যার। ঢেকুর তুলেছি একটা। অবশ্য সেটা দেখারসুযোগ নেই আপনার। এখন অনেক কিছুই ভাবতে পারেন। আরে বাবা! চাকরি ছাড়বে, এটার তো একটা নিয়ম আছে তাই না। দরখাস্ত করবে। সুপারভাইজারের কাছে যাবে। ফাইলবন্দী হয়ে পড়ে থাকবে কিছুদিন। ধুলো তো আর প্রতিদিন ঝাড়া হয়না। এক পিচ্চি একসাথে কত কিছু করবে। কারো চা, কারো পান আর কারো কারো জন্য তো...
থাক! কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছেনা। প্রসন্ন মনে লিখছি। দরখাস্ত দিয়ে এসেছি অফিসে। সবাই চলে গিয়েছিল আগেই। আমার দায়িত্ব ছিল অফিস বন্ধ করার। চলে আসার আধা ঘন্টা আগে কম্পিউটারে টাইপ করতে বসলাম। ২০-২৫ মিনিট ভেবে দুই কি তিন লাইন! “চাকরিটা করছিনা। ইস্তফা দিলাম”। ইংরেজিতে আমি বরাবরই কাঁচা। অথচ দু’বারই এ প্লাস ছিল। লেখাটা লিখে সুপার ভাইজারের টেবিলের কাছে গেলাম। পেপারওয়েট দিয়ে কাগজটা চাপা দিয়ে চলে আসলাম।
কালকে থেকে আর আসছিনা। এ মাসের বেতন লাগবেনা আমার। আগের দুইমাসের বেতন গুলো দিলেই চলবে।
ভাবছি... এই আশা করাটাও ঠিক হবে কিনা!
স্যার! আপনিতো মহা ব্যস্ত! এখনো পড়ছেন? আমি কিন্তু এমনি লিখছি। গল্প করার জন্য লেখা। আপনার পড়তে ইচ্ছে না হলে পড়বেননা। কিন্তু আমাকে কিছু বলতে আসবেননা। আমি স্বাধীন এখন।আপনার নিয়মে চলছিনা স্যার। এটা আমার লেখা। এখানে আমার নিয়মে চলবে।
আর! হ্যাঁ! প্রথম দিকে আপনার সেই চেহারাটা মনে পড়ছে। ভারি ফ্রেমের চশমার পিছনে বুদ্ধিদীপ্তদুটি চোখ। তেজী কণ্ঠস্বর! কেঁপে উঠেছিলাম। নিজেকে কেঁচোর মত মনে হয়েছিল। “ কাজ শিখতে হলে ভাল জায়গায় এসে পড়েছ!”
সেই থেকে শুরু! মুখ বুজে কাজ করে গেছি। কোন কিছুর পরোয়া করিনি। ছুটি ছাঁটা, বন্ধ! কিছুনা! সব জায়গায় দৌড়িয়েছি। যেখানে যখন যেতে বলেছেন। আপনার মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে আসা কিংবা বাজার থেকে ভাল মাছ দেখে নিয়ে আসার মধ্যে আমি কাজ শেখার চেষ্টা করতাম।
আমার এই মহা কর্মউদ্দীপনা সবাই পছন্দ করল। সবার ফুট ফরমাশ আমাকে মেটাতে হত। আমি শুধু শেখার চেষ্টা করতাম।
“চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি তোমরা শুনছ!”
এই স্ট্যাটাসটা দেবার পর থেকেই যারা লাইক কমেন্ট দিয়েছিল তারা আমাকে খুঁজছে। সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ অনেক আগে থেকেই। বলতে পারবেন স্যার! কেন বন্ধ করে দিয়েছি! জুনিয়র সেই মেয়েটাকে লাইব্রেরীতে পড়াতে পড়াতে মন দিয়ে ফেলেছিলাম। সেও তাড়া দেয়।
“ একটা কিছু কর”
বাসায় ছোট বোনটার খুব শখ হাই হিলের জুতো পড়বে। বোনটা আমার মোটেও খাঁটো না। কিন্তু তারপরেও কি মনে করে যে এই সব হাবিজাবি আবদার করে। ভাই আরেক পাগল। তালি দেয়া জিন্স প্যান্ট লাগবে। বসুন্দরায় অনেক দাম। নিউ মার্কেটের দিকে যাবার সময় পাইনা। কাজ শিখছি যে। বাবার জন্য একটা জায়নামাজ কেনার ইচ্ছে ছিল। গতবারের অসুখের জন্য হজ্জ্বে যেতে পারেনি। জমানো টাকাটা চিকিৎসায় খরচ হয়ে গেল বাবার।
মসজিদে যেয়ে বসে থাকে সারাক্ষণ। সস্তায় আতর একটা কিনেছে। আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল।আমার শার্টে মাখিয়ে দিয়ে চলে গেছে। এখনো গন্ধটা যায়নি। অবশ্য শার্টটা আমি পড়িওনি।পলিথিন পেঁচায়ে রেখে দিয়েছি। মাঝেমাঝে বের করে গন্ধ শুঁকি। কি আশ্চর্য্য! আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার বাবাকে বসে থাকতে দেখি। নামাজে বসে আছে বাবা। একটু পরেই সালাম ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাবে। তারপর কাছে এসে আমার গায়ে ফু দিবে।
স্যার!
ভাবছেন পাগল হয়ে গেছি। ভাবুন আপনি যা খুশি। অনেকদিন বাড়ি যাইনা। ভাবছি বাড়ি যাব দুয়েকদিনের মধ্যে। মসজিদে বাবার সাথে জামাতে নামাজ আদায় করে বাপ বেটা মসজিদ পুকুরপাড়ে বসবো। একসময় হয়তো বলেই ফেলবো, “ চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি।“ আমি জানি! বাবা কিছুই বলবেনা। চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকবে দূরের দিকে। তারপর বলবে, বাসাই চল্! তোর মা ছোট মাছের তরকারী রান্না করেছে মনে হয়। বিয়ের পর থেকে এই একটা জিনিষ যত বার খাই জিভে লেগে থাকে। বিয়ে করে একেবারে ঠকি নাই রে! কি বলিস্!
স্যার!
আমাদের সাথে সৃষ্টিকর্তার অনেক বড় একটা পার্থক্য বলি!
সৃষ্টিকর্তা! আমরা যা বলি উনি বুঝতে পারেন। যা বলিনা তাও। করুণাময় তার করুণাধারা আপনার উপর বর্ষণ করুক। ভাল থাকবেন।
ইতি,
সদ্যচাকরি ছেড়ে একজন শিক্ষিত বেকার।
(একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে।)
রাত ১১টা ৪৫ মিনিট।
১৭ই মে, ২০১৪
ফেসবুকঃ স্যার! চাকরীটা আমি ছেড়ে দিয়েছি!- http://goo.gl/nE1j8t